![শুদ্ধাচার, শিক্ষক এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়](uploads/2024/06/11/Shah-Nister-Jahan-1718083735.jpg)
আমাদের দেশে কদিন আগে দুটি ঘটনা খুব আলোড়ন তুলেছিল। সেটি এখনো খুব মুছে যায়নি। ঘটনাটি দুর্নীতি নিয়ে। আমাদের পুলিশের খুব বড় কর্মকর্তা জনাব বেনজীর আহমেদ, মিলিটারির সবচেয়ে উঁচু কর্মকর্তা জনাব আব্দুল আজীজ সাহেব হলেন এই আলোড়নের মূল। চাকরিতে থাকাকালে বেনজীর সাহেবের মতো ‘সৎ’ পুলিশ আমরা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শিক্ষক, সাংবাদিক আর নানা কিসিমের বুদ্ধিজীবী তার পায়ে হদ্দে দিয়েছেন। রাজনীতিবিদদের কথা বাদ। তারা পুলিশ বাহিনীকে মোটামুটি সাত আসমান দখলের ইজারা দিয়েছেন, আর সাংবাদিকদের দেহ ব্যবসায়ীর পর্যায়ে নামতে সাহায্য করেছেন।
যেখানে নিজেরা নেমেছেন বহু আগে। আবার বেনজীর সাহেব শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন। আব্দুল আজীজ সাহেবকে দেওয়া গেল না, সম্ভবত নীতিমালার বাধায়। না-হলে, কোনো সমস্যা ছিল না। আবার, যেখানে নীতি নেই, সেখানে নীতির প্রশ্ন থাকেই বা কেন, তাকেও দিয়ে দিলেই হতো। বা এখনো দিয়ে দিলেই হয়। ল্যাঠা চুকে যায়। তারা সৎ এবং কর্মনিষ্ঠ ছিলেন এতে আমাদের আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কারণ, দুজনেই ডক্টরেট পাওয়া লোক। কদিন আগে এই নিয়ে আফসোস করতে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে।
নিশ্চয় অর্বাচীন শিক্ষক, না হলে এসব বিষয়ে আফসোস করে! তার আফসোস এদের ডেকে এনে পিএইচডি দেওয়া হলো। হয়তো স্বার্থ উদ্ধারে। কীভাবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, সেটি এক মজার গল্প। শিক্ষার বাঘা বাঘা পণ্ডিতও এসব দেখে-শুনে টুঁ শব্দটিও করছেন না, কিংবা সাহস পাচ্ছেন না। আবার কেউ জান বাঁচাতে বেকুব হয়ে আছেন, তা নিয়ে মহাকাব্য লেখা সম্ভব।
বলছিলাম আমাদের বড় কর্মকর্তাদের সততা নিয়ে। তারা ‘সৎ’ ছিলেন এবং সেজন্য পুরস্কার পেয়েছেন। মানে, ওই শুদ্ধাচার পুরস্কার (নাহ, আব্দুল আজীজ পাননি)। নিশ্চয় তাদের সততার যে অঙ্গীকার তা এক দিনে তৈরি হয়নি। তাদের ওপর সরকার এবং তার বাহিনীর নির্ভরতা ছিল প্রবাদসম। আমরা তাদের সততা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ফলে আমাদের সান্ত্বনা দিতে এখন তাদের দুষ্টতা একটু বেরিয়ে পড়েছে। মানে, বস্তা গলিয়ে একটু বেরিয়েছে। ঠিকঠাক জেরা করলে বহু কিছু বের হবে। তবে জেরা করবেন কে?
সে এক অনন্ত অঙ্কের টাকার প্রশ্ন। অনন্ত অঙ্ক কেন? নাহ, এখন আর বিলিয়ন, মিলিয়নের হিসাব নিয়ে লাভ নেই, ওসব ওদের দুই আঙুলে এক তুরির ব্যাপার। এর আগে আমরা থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়তে দেখেছিলাম। সেকালে শুদ্ধাচার পুরস্কার ছিল না। বেচারা নাবালক! ড্রাইভারের কারণে ধরা পড়ে গিয়েছিল। এখন, নিশ্চয় ‘শুদ্ধাচারীদের’ অসততাও এক দিনের ফল নয়। আমরা তাদের শুদ্ধতার জন্য পুরস্কার দিতে পারলাম মোটামুটি দ্রুত। সেটি করতে গিয়ে তাদের অসততার খবরই রাখলাম না। বরং নানাভাবে তাদের এই কাজে ইন্ধন দেওয়া হলো।
আসলে অসততার বিনিময় হলো ওই শুদ্ধাচার। নাকি তার সম্পদ ও অর্থ সম্পর্কে দুদক বা সরকারের কেউ জানতেন না? সেটি কী করে সম্ভব? যিনি এক দিনে চারটি ফ্ল্যাট কেনেন, সেটি মাত্রই জানতে পারল সবাই। আর বাংলার বিভিন্ন পরগনায় তাদের জমিদারির খবর, সব জানছি এখন।
সততার বদৌলতে তারা যে পুরস্কার আমাদের দেশ থেকে পেলেন তার বিনিময় তারা আমাদের দিয়েছেন নানাভাবে। না হলে এত সম্পদ পাচার কী করে সম্ভব? আমরা শুধু বুঝতে পেরেছি, আলোচনা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে এবং অন্যান্য জায়গায়। শুধু কেউ শব্দ করিনি। কিন্তু এখন আমাদের কাছে সেগুলো সংবাদের কারণে প্রকাশিত হচ্ছে।
আমাদের সাংবাদিকরা আবার এত ব্যস্ত যে, সবাই এসব গল্প তাদের, মানে ওই শুদ্ধাচারীদের চাকরিরত অবস্থায় প্রকাশ করতে পারেননি। পারেননি, কারণ এরা তখন সাংবাদিকদের কাছে বিশেষ নমস্য! পারেননি, কারণ বহু সাংবাদিকের রয়েছে নানা ব্যবসা। তাই কেউ এক বিন্দু লিখতে পারেননি এই শুদ্ধাচারী মানুষদের ‘শুদ্ধ জীবন-যাপন’ সম্পর্কে। খুব ভালো। এখন, এই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে (বেনজীর এবং আজীজ) আমরা বেশ শুনছি। জনাব বেনজীরকে নিয়ে আমাদের দুদক বেশ তাগড়া। বেশ হম্বিতম্বি। তারাও খুব চুপ ছিল কিছুদিন আগে।
এসব বিষয়ে, বিশেষত রাজনৈতিক বা অন্য কারণে কেউ একটু পিছিয়ে পড়লে দুদুক খুব শক্তি পায় মেরুদণ্ডে। সেটি না হলে, তারা আবার আধ্যাত্মিক লাইনে চলে যায়, দুনিয়ার কর্মকাণ্ডে তাদের মন বসে না। যেমন, এখন তারা নড়েচড়ে বসছেন। যেন এদের সম্পর্কে সমাজের মানুষ আগে কিচ্ছু জানত না। এবং তারাও কিচ্ছু জানতেন না। ফলে, তাদের শুদ্ধাচারী বানানো গেল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশে এরকম অফিসারের অভাব হবে না আশা করি। হাত বাড়ালেই কিংবা ঝাড়ু দিলেই আঠার মতো লেগে আসবে। শত শত। আরও তাজ্জব কাণ্ড হলো, এসব অফিসার এবং আমলা আমাদের বিশ্ববিদ্যাগুলোতে পর্যন্ত আসেন শুদ্ধাচার শেখাতে।
অথচ তিনি তার অফিসের মানুষদের শুদ্ধ হওয়ার কাজটি করালেন না এবং করতে পারলেনও না। কারণ, সেখানে রয়েছে তারই সততা নিয়ে বিশাল প্রশ্ন। আবার, ওই আমলারাই চাইছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন তাদের হাতে আসে। তাদের অভিযোগও খুব উত্তম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পড়াতেই তো পারেন না, প্রশাসন চালানো তাদের পক্ষে কী করে সম্ভব? ফলে, আপাতত রেজিস্ট্রার বা ট্রেজারারের পদটি তাদের দেওয়া হোক। কী আনন্দ, কী আনন্দ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নানা খবরদারি এখন কিন্তু বেশ লক্ষণীয়।
আসলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমলাদের মাথাব্যাথার এই কারণ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মুরগি শিক্ষক। এরা শিক্ষকতার মূল কাজটি বুঝতে পেরেছেন কি না, আমি নিশ্চিত না। কোনো একটি সুযোগ পেলেই হলো, ওসব অফিসারের পায়ে মাথা রাখতে এদের কোনো সমস্যা নেই। এরা যতটা না শিক্ষকতার কাজে সময় দেন তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন তোষামোদে। কীভাবে ভিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, সেটিও এদের বড় আরাধনার বিষয়। এবং এদের তোষামোদে বহু ভিসি মুরগি ভিসিতে রূপান্তরিত হন। কিছু বিভাগে সাধারণত এরকম কিছু মুরগিপ্রধানও থাকেন। তিনি নিজ মেধায় কাজ করেন না।
বিশেষত একাডেমিক কাজ। সেটি হয়তো করার যোগ্যতা তার নেই। ফলে, ব্যস্ত হন নয়-ছয়ে। তবে তা একা করেন না। অন্যের বয়ানে নিজের স্বপ্ন দেখেন। ফলে একটি বিভাগ হয়ে ওঠে তাদের যৌথ প্রযোজনার জায়গা। তারা দিবারাত্রি সাপ-লুডু খেলেন। নানা ফন্দিফিকির করেন। শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার বিশাল আনন্দের স্বপ্ন দেখেন। তার মতো করে যে শিক্ষার্থী কথা বলেন তাকে কাছে টেনে নেন। তার অপছন্দের শিক্ষকটি সম্পর্কে ওই শিক্ষার্থী কী বলেন, সেটি মন দিয়ে শোনেন। কিন্তু শিক্ষার্থীকে আসল পথটি দেখাতে সব সময় ব্যর্থ হন। চুপচাপ কাজ করে যাওয়া শিক্ষকদের কোণঠাসা করার এক নিরন্তর আরাধনায় এরা সদা লিপ্ত। এই মুরগিরা কবে শুদ্ধাচার পুরস্কার পান, সেটি দেখা এখনো বাকি আছে।
আমি বলছিলাম শুদ্ধাচারী অফিসারদের কথা। তাদের কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরগি ভিসিরা এবং তাদের দল ডক্টরেট দিয়েছেন। এটি যতটা না শুদ্ধাচারীদের ইচ্ছা, তার চেয়েও বেশি ওই শিক্ষকদের আকুল প্রার্থনা। এই সময় গাভি বৃত্তান্তের লেখক বেঁচে থাকলে কী শিরনামে কী লিখতেন, সেটি এক কঠিন প্রশ্ন। কারণ, শিক্ষকরা এখন শো-ডাউনে কেবল ভিসির টেবিলের ময়লা পরিষ্কার করেন না, পুলিশদের বাসার টয়লেটও সাফ করেন।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা