![রওশন শিবিরে ভাঙনের সুর](uploads/2024/03/13/1710308225.Jatiyo_Party_Rowshon_Ershad.jpg)
সম্মেলনের তিন দিন যেতে না যেতেই রওশন এরশাদ শিবিরে শোনা যাচ্ছে ভাঙনের সুর। গত শনিবার (৯ মার্চ) রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির (জাপা) নতুন যে অংশের যাত্রা শুরু হয়েছে, শুরুতেই সেই দলে পদপদবি প্রশ্নে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন নেতাকর্মীরা। সম্মেলন শেষ হতে না হতেই রওশন শিবির থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন কো-চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম সেন্টু। পদত্যাগী নিয়ে রওশন শিবিরে যখন চরম অস্থিরতা বিদ্যমান, তখন জানা গেছে রওশন শিবিরের বেশ কজন নেতা মূল দলে ফিরে যাওয়ার জন্য চেষ্টা-তদ্বির করছেন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু অবৈধভাবে দলের ক্ষমতা দখল করে আছেন, এমন অভিযোগ এনে তাদের আগেই অব্যাহতি দিয়েছেন রওশন এরশাদ। তবে রওশনপন্থি অনেক নেতা বলেছেন, জি এম কাদের শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ চারজন নেতাকে দলে টেনে নিতে পারলেও রওশন এরশাদ মূল দলকে টলাতে পারেননি। পরে রওশনপন্থিরা বলেন, ‘মূল দলের দায়িত্বে থাকবেন রওশনপন্থিরা, কাদেরপন্থিরা থাকবেন সংসদে।’
রওশনপন্থিদের সম্মেলনের এক দিন পার হতেই জানা যায়, জি এম কাদেরের অংশ ছেড়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ নেতা শফিকুল ইসলাম সেন্টু আর রওশনের সঙ্গে থাকছেন না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি জাপায় আর সক্রিয় থাকতে পারছেন না বলে রওশন এরশাদকে জানান। পাশাপাশি নিজের শারীরিক কারণের কথাও উল্লেখ করেন। তবে সেই চিঠি গ্রহণ না করে সেন্টুকে কো-চেয়ারম্যানের পদে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন রওশন এরশাদ। রওশন অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘দলে ছোটখাটো মনোমালিন্য, মনের কষ্ট থাকবে। সেসব মিটমাট হয়ে গেছে। এটা নিয়ে ভাবছি না।’
তবে শফিকুল ইসলাম সেন্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি তো সঠিক কারণে সরে এসেছি। কাউন্সিলর হিসেবে এলাকায় আমার অনেক দায়িত্ব আছে। এ ছাড়া শারীরিক নানা কারণেও আমি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় থাকতে পারছি না আর। আমি জানি, ম্যাডাম আমরা রিজাইন লেটার গ্রহণ করেননি। এখন আমি ফিরে যাব কি না এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
তবে রওশনপন্থি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাহিদুর রহমান টেপাকে এক নম্বর কো-চেয়ারম্যান করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন শফিকুল ইসলাম সেন্টু। বয়সে প্রবীণ হলেও সাহিদুর রহমান জাপায় এসেছেন সেন্টুর অনেক পরে। এ ছাড়াও সম্মেলন উপলক্ষে অর্থের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েও রওশন শিবিরের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণেও সেন্টু ক্ষুব্ধ বলে জান যায়। এ নিয়ে সেন্টু বা কাজী মামুনুর রশীদ অবশ্য সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গত দুই বছর ধরে যারা রওশন ঘনিষ্ঠ নেতা বলে পরিচিত ছিলেন জাপায়, তাদের অন্যতম হলেন ইকবাল হোসেন রাজু। রওশনের সম্মেলনের আগে তাকে সক্রিয় দেখা গেলেও শেষ মুহূর্তে তিনি সরে যান। এ বিষয়ে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ম্যাডাম যেভাবে নিজেকে চেয়ারম্যান ও মামুনকে মহাসচিব ঘোষণা করেছেন, সেই প্রক্রিয়াই তো ভুল। এর আগে এই ভুল তিনি আরও দুই বার করেছেন। বারবার এমন ভুল করলে দল আর কী টিকে থাকে? আমরা চেয়েছিলাম, একটা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি। চেয়েছিলাম সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে। সেটা কী আর এখন হতে পারছে? আমরা তাই সরে এসেছি।’
রওশন এরশাদের সম্মেলনের ঠিক আগে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ না করলে মূল দল থেকে বিচ্যুত অনেক নেতাকে চেয়ারম্যান জি এম কাদের আবার মূল দলে ফিরিয়ে নেবেন। এই ঘোষণার পরে রওশন শিবিরের দ্বিতীয় সারির অনেক নেতা গোপনে জি এম কাদের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
জানা গেছে, রওশন শিবিরের এক নম্বর কো চেয়ারম্যান সাহিদুর রহমান টেপা এখন মূল দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত মহাসচিব। এ ছাড়া ফখরুল আহসান শাহজাদা যুগ্ম মহাসচিব; মাহমুদা রহমান মুন্নী সাংগঠনিক সম্পাদক; শাহনাজ পারভীন যুগ্ম মহিলাবিষয়ক সম্পাদক; শাহিন আরা সুলতানা রিমা ও মনিরুজ্জামান টিটু কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে মূল দলে রয়েছেন। রওশনপন্থি নেতা আলমগীর হোসেন ও নিগার সুলতানা রানী ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব ইফতেখার আহসান হাসান সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে রয়েছেন। জি এম কাদের এখনো তাদের স্বপদে বহাল রেখেছেন। এরাও মূল দল থেকে অব্যাহতি নেননি।
রওশন শিবিরের নেতাদের মধ্যে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের আরও অনেক নেতা এখন মূল দলে ফিরতে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে জানান জাপার দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম। তিনি বলেন ‘অনেকেই ফোন দিচ্ছেন, জাপার মূল দলে ফিরে আসার জন্য। তারা কোনো ব্র্যাকেটবন্দি দলে থাকতে চান না।’
এ বিষয়ে কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘জি এম কাদের মানুষের অপরাধ উনি কী ক্ষমা করবেন? উনি জাতীয় পার্টিতে যে অপরাধ করেছেন, আগে নেতাকর্মীদের কাছে ক্ষমা পেয়ে নিক। ওনাকে দলে নেবে কি-না নেতাকর্মীরা, সেটি আগে দেখুক। তারপর না উনি অন্যদের দলে নেবেন।’
রওশনের সম্মেলনের আগে কাদেরপন্থি একজন কো-চেয়ারম্যানও রওশন শিবিরে ভিড়তে চেয়েছিলেন। তিনি নিজে দলের মহাসচিবের ভূমিকায় থেকে রওশনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহকে নিয়ে দল গোছাতে চেয়েছিলেন। সেই দলে রওশনপুত্র রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদকে নির্বাহী চেয়ারম্যানের পদে আসীন করার কথা হয়েছিল। তবে সেই উদ্যোগ ভেস্তে দিয়েছেন কাজী মামুনুর রশীদ। তবে সেই কো-চেয়ারম্যান এখনো যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা গেছে।
গত ৯ মার্চ রওশন এরশাদ অনুসারীরা আলাদা সম্মেলন করে নতুন দল গঠন করলেও এখন তারা দাবি করছেন, জাপায় কোনো ভাঙন হয়নি। তারাই মূল দলের নেতা। দলীয় প্রতীক লাঙ্গলের মালিকানা নিজেদের করে নিতে পরে আইনি লড়াইয়ে নামার কথাও জানিয়েছেন তারা। শনিবার সম্মেলন মঞ্চে রওশন এরশাদ বলেন, ‘১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর লাঙ্গল প্রতীক ধরে রাখতে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেই সময় এরশাদ ও আমাকে লাঙ্গল প্রতীক দিয়েছিলেন। এখনও লাঙ্গল জাতীয় পার্টির আছে, আগামীতেও থাকবে।’
আলাদা দল গঠনের প্রক্রিয়ায় গত মাসে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থি নেতারা দলীয় চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয়। তবে বিষয়টি দলের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী হওয়ায় নির্বাচন কমিশন তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে। তখন নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়, শুধুমাত্র দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন করা হলে দলীয় প্রতীক তাদেরকে দিতে পারবে নির্বাচন কমিশন। তা না হলে এই সিদ্ধান্ত দিতে হবে আদালতকে। দলীয় প্রতীক বরাদ্দ কিংবা যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে গঠনতন্ত্রে প্রেসিডিয়াম সদস্য যে কজনের স্বাক্ষর লাগবে, তা যদি রওশনপন্থিরা জমা দেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন তার আইন অনুযায়ী বিবেচনা করবে।
নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের পরে এখন জাপার আগের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নতুন এক গঠনতন্ত্র রচনা করছেন রওশনপন্থিরা। সেই গঠনতন্ত্র তারা নির্বাচন কমিশনে শিগগির জমা দেবেন বলে জানান রওশনপন্থি অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশিদ।