![আখের গোছাতে ব্যস্ত তাঁতী দলের নেতারা](uploads/2024/05/24/tati_dol-1716524508.jpg)
দলীয় পদ-পদবি এবং কমিটি বাণিজ্যের মাধ্যমে আখের গোছাতে ব্যস্ত তাঁতী দলের শীর্ষ নেতারা। বিস্তৃত করার পরিবর্তে তারা সংগঠনকে আরও সংকুচিত করেছেন। ৯০ দিনের আহ্বায়ক কমিটির ‘বয়স’ এখন ছয় বছর। দীর্ঘ এই সময়ে তাঁতী দলের শীর্ষ নেতারা নিজেদের বলয়কে আরও প্রসারিত করেছেন, পদ বাণিজ্য চালিয়েছেন প্রকাশ্যেই।
সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, শীর্ষ নেতারা তাঁতী দলকে নিজের ‘টাকা কামানোর’ দোকান হিসেবে ব্যবহার করছেন। অভিযোগকারীরা বলেছেন, দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ ও সদস্যসচিব মজিবুর রহমানকে টাকা দিলে পদ মেলে, না দিলে পদ নেই। পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। অর্থ গ্রহণকারীদের অনেককেই তিনি পদ দেননি, তবে কারও টাকা ফেরতও দেননি। উৎকোচের বিনিময়ে জেলা কমিটি অনুমোদন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অর্থের লোভে এক জেলায় দুই-তিনবার আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন করেছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, আজাদ ও মজিবুর ‘মাইম্যান’ দিয়ে জেলা ও মহানগরের পকেট কমিটি গঠন করেছেন। বিএনপি থেকে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান আয়োজনের খরচ দেওয়া হলে সেই টাকাও আত্মসাৎ করেছেন এই শীর্ষ নেতারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। সংগঠন পুনর্গঠন হলে নতুন নেতৃত্ব আসবে।’ তিনি বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা প্রতিহিংসার কারণে তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে বদনাম ছড়াচ্ছেন।’
তাঁতী দলের নিয়ন্ত্রণে আছেন গুটিকয়েক নেতা। তাদের মধ্যে আছেন আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শামছুন্নাহার বেগম, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল হান্নান খান এবং আব্দুল মতিন। তাদের সঙ্গে আছেন আরও সাত-আটজন। এদের অনিয়ম-দুর্নীতি, কমিটি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে বিভিন্ন সময়ে লিখিত আকারে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব লিখিত অভিযোগের কপি খবরের কাগজের হাতে রয়েছে।
চিঠি থেকে জানা যায়, পিরোজপুর জেলা তাঁতী দলের আহ্বায়ক মারা যাওয়ার পর দলের নেতাদের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা পরিবারের কাছে ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তান্তর না করে নিজের কাছে রেখেছেন আহ্বায়ক আজাদ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের ১ লাখ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। ১০ লাখ টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাজি মজিবুর রহমানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। এর আগে একই পদের জন্য টাইলস ব্যবসায়ী মতিন চৌধুরীর কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা, সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন সরদার ও যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার হেলাল উদ্দিনের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা করে নেন তাঁতী দলের আহ্বায়ক আজাদ। যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম মঞ্জুরের কাছে ৩ লাখ টাকা চান আজাদ। ২০১৭ সালে যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মনিরুজ্জামান মনির একটি সমিতি থেকে ৮ লাখ টাকা তুলে ধার দেন। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে মূল টাকা ফেরত দিলেও সমিতির সুদ দেননি আজাদ।
চিঠি থেকে আরও জানা যায়, ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ডামি কাউন্সিলের মাধ্যমে আহ্বায়ক মোস্তফা কামালের স্বাক্ষর ছাড়াই ঢাকা মহানগর উত্তরে কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ময়মনসিংহ জেলা কমিটির জন্য সাধারণ সম্পাদক শহীদ আনোয়ারুল ইসলাম উজ্জ্বলের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নেন আজাদ। গাজীপুর কমিটির সাবেক সহ-তথ্য গবেষণা সম্পাদক আসাদুল আলম সরকারের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন এই শীর্ষ নেতা।
অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাঁতী দল ছেড়ে গাজীপুর স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিয়েছেন আসাদুল আলম সরকার এবং ময়মনসিংহ মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক আনোয়ারুল ইসলাম উজ্জ্বল। তারা বলেন, তাঁতী দল ব্যবসায়ী সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, নীলফামারী, ফরিদপুর, রাজশাহী মহানগর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ অনেক জেলায় দু-তিনবার আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়কের তালিকা ওলটপালট করে জুনিয়রদের সামনে আনা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে পদ-পদবি ‘বিলিবণ্টন’ করা হয়েছে। ছাত্রদল নেতা হত্যা মামলার আসামি মোশারফ হোসেন কাজলকে রাজশাহী মহানগরের সভাপতি করা হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সংগঠন থেকে পদত্যাগ করেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ বাহার উদ্দিন বাহার, নীলফামারীর সদস্যসচিব এনামুল হকসহ বেশ কয়েকজন।
সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা কামাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিলেমিশে কাজ করার তাগিদ দিলেও তারা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না। টাকার বিনিময়ে কমিটি দিচ্ছেন, আবার পছন্দ না হলেই ভেঙে দিচ্ছেন। দুটি গ্রুপ সৃষ্টি করে সংগঠনকে সামনের দিকে এগোতে দিচ্ছেন না।’
যুগ্ম আহ্বায়ক জে এম আনিছুর রহমান বলেন, ‘প্রোগ্রামের কথা বলে তারা সারা দেশে চাঁদাবাজি করেন। প্রোগ্রাম সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা- সবই একা করেন। তার বিরুদ্ধে কথা বললেই বহিরাগত দিয়ে অনুষ্ঠানে হামলা চালানো হয়, পরে টার্গেট করে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাই দুর্নীতিমুক্ত তাঁতী দল গড়ে তুলতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জরুরি হস্তক্ষেপ দরকার।’
অভিযোগের বিষয়ে আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘অভিযোগ দিলেও তারা শক্ত কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। পদ-কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগও সর্ম্পূণ মিথ্যা। আমার টাকার প্রয়োজন নেই, নিজের টাকায় দল চালাই।’ তিনি বলেন, ‘কেউ তাঁতী দল করতে চায় না। সেখানে কেন পদ-পদবি কিনবে? প্রতিটি জেলায় সাংগঠনিক টিমের রিপোর্ট অনুযায়ী কমিটি দেওয়া হয়।’
সদস্যসচিব মজিবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়ার দরকার নেই, নিজের টাকায় দল করি। কমিটি না থাকলেও ভালোবেসে দল করে যাব।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তাঁতীবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম খান বলেন, ‘বিভিন্ন অভিযোগ আছে, তবে শক্ত প্রমাণ নেই। তাই ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু প্রতিহিংসা যেন না থাকে। যত দ্রুত সম্ভব কাউন্সিল করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে হবে।’
নেই গঠনতন্ত্র-কার্যালয়
১৯৮০ সালে তাঁতী দলের প্রতিষ্ঠা হলেও ৪৪ বছরে গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারেননি নেতারা। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে আসছে তাঁতী দল। রাজধানীসহ সারা দেশে কোনো কার্যালয় নেই। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে সংগঠনের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু সেখানে তাদের কোনো কক্ষও নেই।