অবশেষে ঘোষণা করা হয়েছে বিএনপির ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, বরিশাল মহানগরের আংশিক কমিটি। চার মহানগরে মূলত দুই সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন সপ্তাহের বেশি সময় পর এ ঘোষণা এলেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি কমিটিতে। কেবল বাদ পড়েছেন চার শীর্ষ নেতা। যারা তিনজনই বয়স ও পদবিতে সিনিয়র ছিলেন। বলা চলে তুলনামূলক তারুণ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ কেউ আছেন আগের অবস্থানে। কারও কারও পদোন্নতি হয়েছে।
গত ১৩ জুন আকস্মিকভাবে কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর থেকেই দলের মধ্যে আলোচনা ছিল কয়েকজন সিনিয়রকে বাদ দিতে চান নীতিনির্ধারকরা। এ জন্যই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। নতুন কমিটিতে বিলুপ্ত কমিটির একাধিক নেতাকে পুনর্বহাল করায় সেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন দলের অনেকে। বলা হচ্ছে, ভাঙা কমিটিই জোড়া দেওয়া হলো নতুন ঘোষণার মাধ্যমে। তবে নতুন কমিটিতে দায়িত্ব পাওয়া নেতারা বলছেন, এবার দলের আস্থার প্রতিদান দিতে চান তারা।
বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটিতে নতুন আহ্বায়ক হয়েছেন রফিকুল আলম মজনু। আগের কমিটিতে তিনি সদস্যসচিব ছিলেন। অর্থাৎ তার এক ধাপ পদোন্নতি হয়েছে। জানা গেছে, তার ভূমিকায় সন্তুষ্ট বিএনপির হাইকমান্ড।
খবরের কাগজকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় রফিকুল ইসলাম মজনু বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাকে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা মহানগরের দায়িত্ব দিয়েছেন, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও সে দায়িত্ব পালন করব। আগামী দিনে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলন আরও জোরদার করব।’
তবে বাদ পড়েছেন আগের কমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম। সমালোচকদের অনেকেই বলছেন তার প্রতি যে প্রত্যাশা ছিল, সেটি তিনি পূরণ করতে পারেননি। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর নেতা-কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এই সিনিয়র নেতা। কমিটির বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে কল দেওয়া হলেও পাওয়া যায়নি তাকে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণে দুই সদস্যের আংশিক কমিটিতে সদস্যসচিব করা হয়েছে সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিনকে। বিগত আন্দোলনের সময় কয়েক মাস কারাবন্দি ছিলেন তিনি। দলীয় সূত্রমতে, দক্ষিণে দুই শীর্ষ নেতৃত্বকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মহানগরের শীর্ষ নেতা মির্জা আব্বাসের পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তরে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরবকে। তিনি প্রায় ১৬ মাস কারাভোগের পর সম্প্রতি মুক্ত হয়েছেন। তার নামে সাড়ে ৪০০ মামলা আছে বলে জানা গেছে। আর সদস্যসচিব হিসেবে আছেন আগের কমিটির সদস্যসচিব বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও ফুটবলার আমিনুল হক। তার পদোন্নতি বা পদাবনতি কিছুই হয়নি। বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ বর্তমানে চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। এই কমিটিতে নেই আগের কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারও।
সাইফুল আলম নীরব বলেন, ‘যে আস্থা-বিশ্বাস রেখে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা রক্ষায় সবকিছু করব। বিজয় না হওয়ার আগে রাজপথ ছাড়ব না। আর যত দ্রুত সম্ভব সবার মতামত নিয়ে সবার সমন্বয়ে থানা এবং ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হবে।’
এদিকে ঢাকা মহানগরের নতুন কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। নয়াপল্টন পার্টি অফিসে আসা কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেন, তরুণদের নেতৃত্বে ভালো কমিটি হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, প্রবীণ-নবীন সমন্বয় না হওয়ায় মহানগর রাজনীতিতে বিভেদ বাড়বে। মহানগরে যারা ৫০ বছর ধরে রাজনীতি করেন তারা কার কাছে যাবেন? জুনিয়রদের সঙ্গে তাদের রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে। একসময় তারা ঠিকানাবিহীন হয়ে হয়তো রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাবেন।
অন্যদিকে কমিটি ঘোষণার পর বিকেলে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের নিয়ে হাজির হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহবায়ক রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের আহবায়ক সাইফুল আলম নীরব এবং সদস্যসচিব আমিনুল হক। তবে দক্ষিণের সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ বিদেশ থেকে সন্ধ্যায় দেশে ফেরেন। রবিবার বিকেল ৪টার দিকে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে নয়াপল্টন-নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত শোডাউন করেন নেতা-কর্মীরা। এ সময় খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন।
চট্টগ্রাম মহানগরে দুই সদস্যের আংশিক কমিটিতে বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে এরশাদুল্লাহকে। আর সাবেক ছাত্রদল নেতা নাজিমুর রহমানকে সদস্যসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন সদস্যসচিব নাজিমুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে কাজ করব। বিএনপি একটি বৃহত্তর পরিবার। সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তৃণমূলকে সংগঠিত করা হবে। দল যে আস্থা রেখেছে তার সর্বোচ্চ প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করব।’ চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিতে রাখা হয়নি সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনকে।
দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার মতে, মহানগরে অন্তর্ভুক্ত না হলেও আবদুস সালাম, আমান উল্লাহ আমান ও ডা. ফরহাদ হালিম বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে এখনো বহাল আছেন। এর পাশাপাশি দলের অন্য কোনো দায়িত্বে হয়তো তাদের দেখা যাবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনকে নিয়ে নীতিনির্ধারকদের অন্য পরিকল্পনা থাকতে পারে। বিশেষ করে পেশাজীবী হলেও ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার ও ডা.শাহাদাত হোসেন দলের বিভিন্ন কার্যক্রমে বেশ সক্রিয়। ফলে তারা দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন এমন জায়গায় তাদের দেওয়া হবে।
অন্যদিকে সাবেক আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুককে আবারও আহ্বায়ক, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো. জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়াকে সদস্যসচিব ও সাবেক ছাত্রদল নেত্রী আফরোজা খানম নাসরিনকে ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক করে বরিশাল মহানগর বিএনপির তিন সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাদ পড়েছেন বিলুপ্ত কমিটির সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির।
মনিরুজ্জামান খান ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। অতীতের ভুল-ত্রুটি দূরে রেখে সামনে এগোতে চাই। যারা দায়িত্বে আসতে পারেননি কিন্তু পরীক্ষিত তাদের সঙ্গে একযোগে দায়িত্ব পালন করব। দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যেহেতু ভরসা রেখেছেন, তার প্রতিদান দিতে চাই।’
বরিশাল মহানগরে নতুন দায়িত্ব পাওয়া ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন বলেন, ‘সবার কাছে দোয়া চাই। আর বলব, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাঠের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। দেশনেত্রীকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই কাজ করব। দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশনায় ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ।’
ঘোষণার অপেক্ষায় যুবদলের কমিটি
এদিকে বিলুপ্ত জাতীয়তাবাদী যুবদলের নতুন আহ্বায়ক কমিটিও চমক রেখেই প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে এ কমিটি ঘোষণা হতে পারে।
ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব এবং যুবদলের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম নয়ন ও ছাত্রদলের সাবেক সেক্রেটারি আকরামুল হাসানকে নিয়ে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদিও যুবদলের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিনও পদ পেতে তাদের লবিং-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।