![পশু পরিবহনে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০ স্পটে চাঁদাবাজি, উত্তরাঞ্চলে বন্ধ](uploads/2024/06/11/Cattle-1718072242.jpg)
আগে উত্তরাঞ্চলে ঈদ সামনে রেখে সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পেলেও এ বছর সড়ক পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। চাঁদা বন্ধে হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, র্যাব ও আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থা মাঠে নামায় চাঁদাবাজির ঘটনা একেবারেই কমে গেছে। পুলিশের পাশাপাশি পরিবহন-মালিকরা বলছেন, কঠোর প্রশাসনিক নজরদারির কারণে উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় চাঁদাবাজি এবার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মতিন সরকার জানান, ‘সংগঠনটির ১ হাজার ১০০ সদস্যের কেউ চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ করছেন না। সাধারণত চাঁদাবাজির বেশি অভিযোগ আসে ঈদের আগে। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম। বগুড়ায় অনেক স্থানেই আগে চাঁদা আদায় করা হতো বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার নামে। কিন্তু এখন শুধু বগুড়ায়ই নয়, আমার জানামতে উত্তরাঞ্চলের কোনো জেলাতেই এখন রাস্তায় অবৈধ কোনো চাঁদা তোলা হচ্ছে না।’ তিনি আরও জানান, বগুড়ায় ট্রাক মালিক সমিতির ১ হাজার ১০০ সদস্য থাকলে সমিতির সদস্য হয়নি এমন আরও অন্তত এক হাজার ট্রাক রয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশ বগুড়া রিজিয়নের এসপি মো. হাবিবুর রহমান জানান, ‘রাস্তায় কর্তব্যরত পুলিশের কর্মকাণ্ড এখন সব সময়ই মনিটরিং করা হচ্ছে। এটা শুধু বগুড়ার ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য এলাকাতেও একইভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের কাজকর্ম। চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে আমি নিজেও লুঙ্গি পরে ট্রাকে অনেক এলাকায় গেছি। কিন্তু চাঁদাবাজির কোনো ঘটনা দেখিনি।’
হাইওয়ে পুলিশের কুন্দারহাট ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. আব্বাস আলী জানান, গত ৫ জুন চাঁদাবাজি করার সময় বগুড়া শহরের বনানী এলাকায় টাকাসহ হাতেনাতে আটক করা হয় সুজন নামে এক ব্যক্তিকে। এ ঘটনায় মামলা করার পর অনেক স্থানেই চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে পুরোপুরি। তিনি বলেন, আগে বগুড়া পৌর এলাকার ভবের বাজার, মাটিরডালী ও চারমাথায় সারা দিন-রাতই চাঁদা তোলা হতো বিভিন্ন নামে। কিন্তু এখন একেবারেই বন্ধ।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২০ স্পটে চাঁদাবাজি, মাশুল গোনে ভোক্তা
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোরবানির পশু ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সময় বেপারি ও ট্রাকচালকদের অন্তত ২০ স্পটে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। পাশাপাশি পশুর হাটেও গরুপ্রতি চাঁদা দিয়ে ট্রাক ছাড়তে হচ্ছে বলে পশু ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন। পথেঘাটে চাঁদা দেওয়ার ফলে ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ছে তার মূল্য। কোথাও পরিবহন শ্রমিক, কোথাও ক্ষমতাসীন দল, আবার কোথাও পুলিশের নামে তোলা হচ্ছে এসব চাঁদার টাকা।
চলতি বছর খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় কোরবানি উপযোগী পশুর সংখ্যা ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৫। এ অঞ্চলে চাহিদা রয়েছে ১০ লাখ ৫ হাজার ৭৭০টির। সে হিসাব অনুযায়ী এবারে কোরবানির পশুর সংখ্যা চাহিদার চেয়ে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৫টি বেশি। এসব পশু রাজধানী ও চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হবে বলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
গরু ব্যবসায়ীরা জানান, আসন্ন কোরবানির ঈদ ঘিরে বর্তমানে রাজধানীমুখী পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাঁদাবাজিও। গরুর ট্রাক রাজধানীতে নিতে পথে পথে চাঁদাবাজির শিকার হতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকজন বড় পশুর বেপারি বলেন, যশোরের বৃহৎ পশুর হাট সাতমাইলসহ বিভিন্ন হাট থেকে ঢাকার গাবতলী পর্যন্ত কোরবানির পশু পৌঁছতে অন্তত ১৫টি স্পটে কমবেশি চাঁদা দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে যশোরের বাগআঁচড়া, নাভারণ, ঝিকরগাছা, চাঁচড়া, খাজুরা, মাগুরা, মধুখালী, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোয়ালন্দঘাট, মানিকগঞ্জ, সাভারসহ কয়েকটি স্পটে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বেপারিরা। স্থানীয় বেপারিরা বড় পাইকার বেপারিদের কাছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে পশু পাঠান।
স্থানীয় পশু বেপারি সালাউদ্দিন হাসান বলেন, ‘যশোর থেকে ঢাকায় পশু নিয়ে যেতে অন্তত ১৫টি স্থানে ট্রাকপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হারে চাঁদা দিতে হয়। টাকা দিতে রাজি না হলে ভয়ভীতি দেখানো হয়। বাধ্য হয়ে চাঁদা দিচ্ছি।’ আরেক বেপারি মেহেদি আলী বলেন, ‘আমরা ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গরু পাঠাচ্ছি। পথে পথে চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে স্বস্তিতে থাকতে পারতাম। ভোক্তারাও একটু কম দামে পশু কিনতে পারতেন।’
কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের বেপারি আসাদুল মণ্ডল বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাটে গরু নিয়ে যেতে তিন পয়েন্টে পুলিশকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। এমনকি লাঞ্ছিতও হতে হচ্ছে। আরেক বেপারি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মতিয়ার রহমান বলেন, ‘ঢাকায় গরু নিয়ে যেতে পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। বিশেষ করে হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবাজিতে বেপারিরা অতিষ্ঠ। লালন শাহ সেতু এলাকায় পুলিশ, বনপাড়া ও যমুনা সেতুসংলগ্ন এলাকায় হাইওয়ে পুলিশকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।’
গরুবাহী ট্রাকের চালক আল আমিন জানান, ঝিনাইদহে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৩৫০ টাকা, ফরিদপুরে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ১৫০ টাকা এবং ট্রাক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের নামে ৫০ টাকা করে আদায় করা হয়। পাশাপাশি ফরিদপুর মোড়ে ৫০০, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ৩০০, মাগুরায় ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
নড়াইল অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার তুলারামপুর, হাওয়াইখালী, লক্ষ্মীপাশার মোল্লারমাঠসহ কয়েকটি স্পটে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। আর সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে অন্তত তিনটি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। সাতক্ষীরা থেকে নিয়মিত গরু কেনেন ফেনীর গরু ব্যবসায়ী আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বা অন্য কোনো জেলায় গরু নিয়ে যেতে পথে পথে গুনতে হয় চাঁদা। এভাবে বড় গরুপ্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা চলে যায়। তাহলে আমরা গরু বিক্রি করে লাভ করব কীভাবে?’
এ ব্যাপারে যশোর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, ‘যশোর অঞ্চলে চাঁদাবাজি রুখতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে হাইওয়ে পুলিশকে। কোনোভাবেই যেন পশুবাহী ট্রাককে হয়রানি না করা হয়। শ্রমিক সংগঠনের নামেও যেন চাঁদাবাজি না হয়, সে ব্যাপারে পুলিশের বিশেষ নজরদারি রয়েছে।’
সূত্র জানায়, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় খামারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৫টি কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে ষাঁড় ৪ লাখ ৯ হাজার ৯৬৫টি, বলদ ৫৮ হাজার ২৮৯টি, গাভি ৬৮ হাজার ৭৯০টি, মহিষ ৫ হাজার ৬৫৪টি, ছাগল ৭ লাখ ৬০ হাজার ৪৯৫টি, ভেড়া ৪৯ হাজার ৫২৫টি ও পশু অন্যান্য ৮৪৭টি।
খুলনা বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমরা খামারিদের আগেই পরামর্শ দিয়েছি স্টেরয়েড হরমোন ও কেমিক্যাল গবাদিপশুকে না খাওয়ানোর জন্য। পাশাপাশি গবাদিপশুকে পোলট্রি ফিড বা ব্রয়লার ফিড না খাওয়াতে। গরুকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের মধ্যে রাখার কথা বলেছি। খামারে হিট ওয়েভ বা গরম বাতাস কমাতে চারপাশে ও চালের ওপর পানি দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।’