ঢাকা ১৩ ভাদ্র ১৪৩১, বুধবার, ২৮ আগস্ট ২০২৪

প্রধানমন্ত্রীর ‘পালক পুত্র’ পরিচয়ে এমপি হতে চেয়েছিলেন পিয়ন মান্নান

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
প্রধানমন্ত্রীর ‘পালক পুত্র’ পরিচয়ে এমপি হতে চেয়েছিলেন পিয়ন মান্নান
আবদুল মান্নান

অভাবের তাড়নায় আশির দশকের শেষ দিকে বাড়ি ছেড়েছিলেন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার গাজীমুড়া গ্রামের মৃত সৈয়দ আহম্মদের ছেলে আবদুল মান্নান। দীর্ঘদিন তার কোনো খোঁজ জানতে পারেননি এলাকাবাসী। এরপর একসময় মানুষ জানতে পারে মান্নান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে তার বাসায় কাজ পেয়েছেন। থাকেন ঢাকাতেই। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খোলস পাল্টাতে থাকেন মান্নান। এলাকায় প্রচার করতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পালক পুত্র’ তিনি। প্রধানমন্ত্রীকে ডাকেন ‘মা’। এরপর থেকেই বদলাতে থাকে চিত্র। ধীরে ধীরে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন তিনি। ছয় শতক জমির ওপর গড়ে তোলেন বিলাসবহুল তিনতলা ভবন। কিনতে শুরু করেন জমিজমা। 

গড়ে তোলেন নিজস্ব বলয় ও কিছু কর্মী বাহিনী। ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যাওয়া মান্নানকে দেখে বিস্ময়ের ঘোর লাগে এলাকাবাসীর। প্রচার হতে থাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হতে চান মান্নান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নের আবেদন ফরমও সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। এমপি হওয়ার বাসনায় এলাকায় নিজস্ব বাহিনী দিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন তিনি। 

পার্শ্ববর্তী মানুষের জমি দখল, লাকসাম পৌর সদরের টিঅ্যান্ডটি কলোনি দখল করে দোকান তুলে ভাড়া দেওয়া ও পজিশন বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ফলে মতবিরোধ তৈরি হতে থাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। তবে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে এলাকায় আর আসেননি আবদুল মান্নান। 

এলাকায় না এলেও সম্প্রতি এলাকাবাসীর কাছে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন মান্নান। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দেওয়া নোয়াখালীর জাহাঙ্গীর আলম ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার খবর মান্নানকে আলোচনায় নিয়ে আসে। কারণ মান্নানও এলাকায় নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিতেন। 

এ ছাড়া নানা অনিয়মের অভিযোগে জাহাঙ্গীরের পাশাপাশি একই নোটিশে মান্নানকেও চাকরিচ্যুত করা হয় বলে জানা গেছে। 

মঙ্গলবার দুপুরে লাকসামের গাজীমুড়া এলাকায় গিয়ে দেখা মেলে ছয় শতক জমির ওপর নির্মিত আবদুল মান্নানের বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়িটির তদারকিসহ পরিবার নিয়ে থাকছেন মান্নানের ভাগনে রাশেদুল ইসলাম। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি অভিযোগ করেন, এখানে মান্নানের বাবার মাত্র দুই শতক জমি ছিল। 

এ জমি থেকে নিজের ভাইবোনদের বঞ্চিত করে পাশের জমির মালিকদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জমি লিখে নিয়ে বাড়িটি করেছেন মান্নান। কিন্তু পরে তাদের আর চাকরি দেননি। অনেকে জমিও ফেরত পাননি। এ ছাড়া লাকসামের মার্কেট, কক্সবাজারে চিংড়ির ঘের, চট্টগ্রামের গার্মেন্ট ব্যবসা ছাড়াও শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জে মান্নানের প্রচুর সম্পদ রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন এলাকাবাসী।

দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা ওই এলাকার বাসিন্দা মো. শাহজাহান বলেন, ‘মান্নান সাহেব গত ২০১৭ সালে আমার ছেলেকে চাকরি দেবেন বলে ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত চাকরিও দেননি, টাকাও ফেরত দেননি। টাকা ফেরত চাইলে উল্টাপাল্টা কথা বলে ধমক দেন। এখন তো আর এলাকায়ও আসেন না।’ 

মো. শাহ আলম বলেন, ‘২০১১ সালে আবদুল মান্নান রেলওয়েতে চাকরি দেবেন বলে আমার কাছ থেকে দুই শতক জমি লিখে নেন। কিন্তু তিনি চাকরি ও জমি কোনোটাই দেননি।’  

আবদুল মান্নানের বোন রাশিদা আক্তার বলেন, ‘আমাদের বাবার তেমন কোনো সম্পত্তি ছিল না। ভাইয়ের কাছে অনুরোধ করেছি, আমাদের তো কিছু নাই, যদি দয়া হয় আমাদের কিছু দিতে। আমি মানুষের বাড়িতে ভাড়া থাকি, ভাই ইচ্ছে করলেই দিতে পারেন, কিন্তু দেন না।’ 

আবদুল মান্নানের ভাগনে রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মামা উনি ঢাকাতে আছেন, ব্যবসা করেন। তিনি এলাকায় এসে নির্বাচন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সবই মিথ্যা। কারও কাছে কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ দিতে পারলে যেকোনো শাস্তি মেনে নেব।’ 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, ‘অনেকেই অনেক কথা বলছেন, আমার নাকি দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পত্তি। কিন্তু আমি যদি কোনো অপকর্ম করে থাকি, তাহলে আমাকে ধরুক। আমি কার সঙ্গে কী করছি, কার জায়গা দখল করছি- পারলে প্রমাণ করুক। 

এখন আমার প্রধান অপরাধ হচ্ছে, আমি সংসদ নির্বাচন করতে চেয়েছি। এ কারণেই আমি রাজনৈতিক রোষানলে পড়েছি। যারা মূলত আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিভিন্ন সময়ে আমার এবং স্বজনদের ওপর হামলা করেছেন, তাদের কাছ থেকেই আমার বিরুদ্ধে বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। আমি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই।’ 

চাকরিচ্যুত হওয়ার বিষয়ে মান্নান বলেন, ‘আমি কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চাকরি করিনি। আমি সরকারি কোনো কর্মচারী না, ‘ভলিন্টিক সার্ভিস’ হিসেবে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী ছিলাম। আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে কি না, তাও জানি না। 

তবে সংসদ নির্বাচনের আগে যেহেতু আমি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইব, এ জন্য আমার যে আইডি কার্ড ছিল, সে আইডি কার্ড আমি স্যারেন্ডার করি। যেহেতু এক ব্যক্তি দুই জায়গায় থাকতে পারে না, তাই আমি স্যারেন্ডার করে চলে আসি। তবে আমি কখনোই আমার পরিচয়ের অপব্যবহার করিনি।’

যেভাবে শেখ হাসিনার কর্মচারী মান্নান

এলাকাবাসী ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে কাজের সন্ধানে লাকসাম থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় পাড়ি জমান মান্নান। সে সময় এক দিন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে হামলায় আহত হন তিনি। তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা হাসপাতালে নেতা-কর্মীদের দেখতে গিয়ে মান্নানকে দেখতে পান। হাসপাতালে মান্নানের সঙ্গে কেউ নেই দেখে তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে পরে শেখ হাসিনা তাকে বাসায় নিয়ে যান। সেই থেকেই শেখ হাসিনার বাসার কর্মচারী হিসেবে কাজ করতে থাকেন মান্নান।

মান্নানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে জানিয়ে লাকসাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও লাকসাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউনুস ভূঁইয়া বলেন, ‘হঠাৎ এক দিন জানতে পারি সে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে অপকর্মের অভিযোগ এসেছে। 

কীভাবে সে এত টাকার মালিক হলো, সেই জানে। গত সংসদ নির্বাচনে সে এমপি হতে চায়, নেত্রীকে মা ডাকে, নেত্রী তাকে নমিনেশন দেবেন। এ রকম নানান কথা শুনেছি। তবে মনোনয়ন পায়নি। শেখ হাসিনা এ রকম মানুষকে মনোনয়ন দেবেন না, তা আমরা বুঝতে পারতাম।’

প্রধানমন্ত্রীর বাসার কর্মচারী হওয়ার সুবাদে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদও বাগিয়ে ছিলেন আবদুল মান্নান। এক বছর আগে কেন্দ্রীয় এক নেতার সুপারিশে তাকে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য করা হয়।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুপম মজুমদার বলেন, ‘সর্বশেষ কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আংশিক কমিটি ঘোষণার পর এক বছর আগে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আবদুল মান্নানকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছিল।’ 

ওরিয়নের ওবায়দুল ঘুষ দিতেই আলাদা কোম্পানি

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৫০ এএম
আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১০:২৬ এএম
ঘুষ দিতেই আলাদা কোম্পানি
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

১৯৯৬ সাল থেকে সব সরকারের আমলেই ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয়ে টিকে আছেন ওরিয়নের ওবায়দুল করিম। করেছেন অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা ও জালিয়াতি। এসবের মধ্যেও ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মামলা থেকে বাঁচতে পারেননি তিনি। ঘুষ লেনদেন, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তিন মামলার বিচার শেষে হয়েছে ৪৮ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু তাকে সাজা ভোগ করতে হয়নি। সর্বত্র ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কারাদণ্ড ঘোষিত রায়ের নথিও গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের নিজের প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়েছেন। সাজা থেকে রক্ষা পেতে প্রভাবশালীদের ঘুষ দেওয়া ছাড়াও নানাভাবে পক্ষে রাখার চেষ্টা করেছেন। শুধু ঘুষ দেওয়ার জন্য ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। যে প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু ঘুষ দেওয়া হয়। এমন কিছু বিষয় খবরের কাগজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

এর মধ্যে গত বছর ৫ মে  হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চের দেওয়া রায়ে ওবায়দুল করিম ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।

২৭৩ পৃষ্ঠার ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়, ওরিয়নের ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড অনৈতিকভাবে কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে। এর মধ্যে ওবায়দুল করিম তার সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১১০০০১২৮১৪ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে ৮১৯১৩৫৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে ইকবাল মাহমুদ টুকুকে ৫০ লাখ টাকা দেন। এ ছাড়া ২০০৬ সালের ৬ জুন ওবায়দুল করিমের ঘুষ বিতরণের প্রতিষ্ঠান ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের মাধ্যমে ভারতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের ০২৩৩০২২৬১৩ ও ০৫১৩০৯৫৯২০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ১ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ টাকা দিয়েছে। এসব টাকার ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৬ টাকায় একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দেওয়া হয়েছে, ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনে দেওয়া হয়। বাকি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৩ টাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ওবায়দুল করিম দাবি করেছেন সেই টাকা ওই সময়ে ভারতে অবস্থানরত তার ভাইকে বাড়িভাড়া বাবদ দেওয়া হয়েছে। 

এদিকে ২০০৫ সালে ৬ ডিসেম্বর ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট থেকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার পে-অর্ডার নম্বর ০৩৯২৯৫৯ মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই পে-অর্ডারে রিসিভার হিসেবে ওবায়দুল করিমের জামাই মেহেদী হাসানের নাম থাকলেও পরে তার নাম কেটে দিয়ে সেখানে রুমানা মাহমুদ লেখা হয় এবং পার্টিকুলার রিসিভার হিসেবে ওই টাকা রুমানা মাহমুদ উঠিয়ে নেন। এর আগে একই বছর ২৮ মার্চ রুমানা মাহমুদকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়।  এভাবে বিভিন্ন সময়ে ওবায়দুল করিম অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে রায়ের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। পুরো রায়টি লেখেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায়ে সমর্থন জানান বিচারপতি খিজির হায়াত। 

এদিকে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজ পেতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে গাড়ি ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৫ জুন ধানমন্ডি থানায় মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় ওবায়দুল করিমসহ ৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে ওবায়দুল করিম এ মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করলে শুনানি শেষে অব্যাহতি পান। 

অপরদিকে ঘুষ লেনদেন, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা ও ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ওবায়দুল করিম ২০০৯ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোট সরকার গঠন করলে সব অপকর্মের দায় থেকে বাঁচতে ওবং ওই সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিসহ ক্ষমতাধর নেতাদের বাগে আনতে তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করে নেন। এর মধ্যে ওরিয়নের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেন সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে। ডাচ্‌-বাংলা পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি  আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের পরিচালক পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমানকে। এমন অনেক মন্ত্রী-এমপিকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়ে গত ১৬ বছরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। এখনো সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন:

> বারবার পার পেয়ে ‘বেপরোয়া’ ওরিয়নের ওবায়দুল করিম
> পরিবারের পঞ্চপাণ্ডব খেয়েছে ব্যাংক

> ৪৮ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে বহাল তবিয়তে ওরিয়নের ওবায়দুল
> আত্মস্বীকৃত অপরাধী ওবায়দুল

> ওরিয়নের ওবায়দুলের অপকর্ম: মামলা ঠুকে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে বাঁচার চেষ্টা
> ওরিয়নের ওবায়দুল করিমের অপকর্ম: বেলহাসা কোম্পানি হাইজ্যাক

কারা মারল? ‘শেষ মাইরেই’ কাহিল সাবেক বিচারপতি মানিক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১০:২২ এএম
আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১০:২২ এএম
কারা মারল? ‘শেষ মাইরেই’ কাহিল সাবেক বিচারপতি মানিক
তিন দফা পিটুনি খেয়েছেন সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

ভারত পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার আগে ও পরে তিন দফা পিটুনি খেয়েছেন সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ধরা পড়ার আগে তার টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় প্রথম দফা মারধরের শিকার হন।

এরপর আদালতে হাজির করার সময় উন্মুত্ত জনতার হাতে আরেক দফা, সর্বশেষ তাকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে গেলে সেখানেও মারধরের শিকার হন তিনি।

সেখানে তাকে ‘শেষ মাইর’ বলে বেধড়ক মারধর করা হয়। এতে তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হতে দেখা যায়।

এ অবস্থায় তাকে জরুরি ভিত্তিতে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। দুই দফা অস্ত্রোপচারের পর পর্যবেক্ষণে শারীরিক অবস্থার উন্নতি দেখে স্থানান্তর করা হয়েছে হাসপাতালের কেবিনে। 

সোমবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, তিনি ভালো আছেন।

বিচারপতি মানিককে ‘শেষ মাইর’ কারা মারল-এ প্রশ্ন এখন জোরালোভাবে উঠেছে। এ নিয়ে খবরের কাগজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারাগারের মারধরেই তার স্পর্শকাতর অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বিজিবি ও পুলিশ বলছে, তারা গণপিটুনির মুখ থেকে মানিককে রক্ষা করেছে। কারারক্ষীদের হেফাজতে সর্বশেষ আক্রোশে পড়েন। তারা ‘শেষ মাইর’ বলে মারধর করেছে। সেখানেই সাবেক বিচারপতির শরীরের স্পর্শকাতর অংশে আঘাত পেয়েছেন। তবে কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের হেফাজতে আসার আগেই তিনি মারধরে কাহিল ছিলেন। স্পর্শকাতর অংশে আগেই আঘাত পেয়েছেন।  

ধরা পড়ার আগে
গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় সাবেক বিচারপতি মানিক প্রথম জনতার হাতে আটক হন। এ নিয়ে একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

তাতে দেখা গেছে, একটি জঙ্গলে কলাপাতার ওপর শুয়ে আছেন তিনি। সেখানে দুজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এরপর আরও চারটি ভিডিও ছড়িয়েছে ১৯ বিজিবির অধীন দনা ফাঁড়ি ক্যাম্পে আটক অবস্থার।

সেসব ভিডিওতে দেখা গেছে, এ সময় তিনি নিজেই বলছেন, দুই ছেলেছোকরা তার টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে। মারধর করেছে। তিনি শার্ট খুলে পেটের অংশও দেখাচ্ছিলেন।

দনা ফাঁড়ির নায়েক সুবেদার আবিদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘তার টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় এক দফা পিটুনির মুখে পড়েন মানিক। শরীরের বিভিন্ন স্থানে পিটুনির চিহ্ন দেখাচ্ছিলেন। এরপর অবশ্য তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা জানান। শরীরের সুগার লেভেল কমে যাওয়ায় ও হাইপার টেনশনের উপশমে তাকে পানি ও শরবত খাওয়ানো হয়।’

কানাইঘাট থানার ওসি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার খবরের কাগজকে বলেন, বিজিবির হেফাজত থেকে তাকে পুলিশে হস্তান্তর করলে কানাইঘাট থানার পুলিশের একটি দল ভোর ৪টার দিকে সিলেট আদালতের উদ্দেশে রওনা করে।

কিল-ঘুষি, ডিম-জুতা
মানিককে আদালতে হাজির করা হয় শনিবার দিন শেষে। সকাল থেকে উৎসুক মানুষ সিলেটের আদালতপাড়ায় হাজির হতে দেখা গেছে। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে গাড়ি থেকে নামানোর পর জনতার তোপের মুখে পড়েন।

এ সময় তারা ‘এ মানিক... কালো মানিক...মারবে...’ বলে শোরগোল করতে থাকে। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে তাকে আদালতে নেওয়ার সময় শতাধিক মানুষ তার উদ্দেশে ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করেন।

এ সময় কয়েকজন তাকে কিল-ঘুষি মারেন। পরে কঠোর নিরাপত্তায় তাকে আদালতে তোলার পর বিচারক আলমগীর হোসেন তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এ সময় সাবেক বিচারপতি মানিকের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। 

আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করার সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী দুজন পুলিশ ও তিনজন আইনজীবী খবরের কাগজকে জানান, জনরোষের মূলে ছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কটাক্ষ করে টকশোতে সাবেক বিচারপতি মানিকের কথাবার্তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব কথা ভাইরাল হয়েছে। এ কারণে দফায় দফায় জনরোষের মুখে পড়েন তিনি। হেলমেট পরা সাবেক বিচারপতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় শারীরিকের চেয়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বেশি দেখাচ্ছিল। ওই সময় তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হলে তিনি নিজেই বলতেন। কিন্তু সেখানে তিনি কাঠগড়ায় হাত রেখে বেশ দৃঢ়ভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। 

সিলেটের কোর্ট ইন্সপেক্টর মো. জামশেদ আলম ব্রিফিংয়ে বলেন, তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আদালত আসামির চালান মোতাবেক ঢাকাসহ অন্য থানায় হত্যাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার এজহারভুক্ত আসামি হওয়ায় তাকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখার আদেশ দেন। তার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। তাকে আদালত সাবেক বিচারপতি হিসেবে যেটুকু আইনানুগভাবে প্রাপ্য সেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য জেলকোডের বিধান অনুযায়ী আদেশ দিয়েছেন।

খবরের কাগজের অনুসন্ধানে সূত্র জানায়, এই আদেশের পরপরই সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় সাবেক বিচারপতি মানিককে। সংবাদকর্মীরা তখন আদালত পুলিশের ব্রিফিংয়ের জন্য অবস্থান করেন। তখন আরেক দফা পিটুনির মুখে পড়েন। তবে এই পিটুনি কারারক্ষীদের হেফাজতে না কারাগারে পাঠানোর গাড়িতে হয়েছে, এ নিয়ে মুখ খুলছেন না কারা কর্তৃপক্ষ। 

‘শেষ মাইর’
আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হলেও মানিক সাবেক বিচারপতি বিবেচনায় আয়েশে থাকবেন, এ রকম একটি ধারণা ছিল কারা-পুলিশ ও কারারক্ষীদের। এ থেকে এক ধরনের আক্রোশ তৈরি হয়। সূত্র জানায়, ‘শেষ মাইর’ দিতে কারাগারের অভ্যর্থনাকক্ষকে বেছে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটের সময় হাজির করার প্রায় ১৫ মিনিট বেধড়কভাবে মারধর করা হয়।

এ সময় বুটের লাথিতে তার শরীরের স্পর্শকাতর অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে দ্রুত সেখান থেকে সরাতে প্রথমে কারা হাসপাতাল এবং এরপর সরাসরি সিলেট এম এ জি ওসমানী হাসপাতালের কারাগার নির্দিষ্ট আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।

কারাগারের অভ্যর্থনা কক্ষ সূত্র জানায়, সর্বশেষ মারধরের সময় কোটা আন্দোলনের বিরোধিতা ও কথায় কথায় রাজাকারের বাচ্চা বলার ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়।

এ সময় ‘সাঈদীকে ফাঁসির রায় দিয়েছে...’ শোরগোলে এমন কথাও শোনা গেছে। এ অবস্থায় কারা কর্তৃপক্ষের লোকজন ও কারা হাসপাতালের লোকজন সেখানে হাজির হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তখন সাবেক বিচারপতি মানিককে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতির সময় ক্ষুব্ধ কারারক্ষীরা কারা হাসপাতালের স্মারকপত্রে ‘ইনজিউরড আউটসাইড’ লেখতে বাধ্য করান। 

কারা হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর-সংক্রান্ত হাসপাতালের স্মারকপত্রটি খবরের কাগজের হাতে এসেছে।

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সহকারী সার্জন (কারা হাসপাতাল) ডা. মো. ইনামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত স্মারকপত্রে (নম্বর ৩৭০৩) বলা হয়েছে, ‘কয়েদি নম্বর ৫২৩১/২৪-এর আবুল হোসেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (৭৪)-কে ইনজুরি আউটসাইড অবস্থায় সতর্কতার সঙ্গে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করতে সুপারিশ করা হলো।’

‘শেষ মাইর’ সম্পর্কে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার সাখাওয়াত হোসেন গতকাল বিকেলে খবরের কাগজকে বলেন, ‘কারা হেফাজতে তার ওপর কোনো আক্রমণ হয়নি।’ আদালতে হাজির বা কাঠগড়ায় থাকাকালে তো এ অবস্থায় তাকে দেখা যায়নি? কারা হেফাজতে কে মারল? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে উনাকে ৫টা ২০ মিনিটে আনা হয়। ৬টা ১০ মিনিটে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর বাইরে কিছু জানি না।’

কারা হেফাজতে বা কারারক্ষীদের দ্বারা কিছু ঘটলে পরে দেখা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সিলেটের কারা উপ-মহাপরিদর্শক মো. ছগির মিয়া।

সোমবার তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিনি (সাবেক বিচারপতি) ওসমানী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আছেন। তাকে মারধর করেছে কে, এ ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। তার সঙ্গেও কোনো কথা হয়নি। তার সঙ্গে এখনো আমার দেখাও হয়নি।’

‘ভালো আছেন’
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া শুক্রবার রাতে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘কারাগার থেকে আমাদের জানানো হয়, বিচারপতি মানিক সাহেব আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। আমরা সে অনুযায়ী প্রিপেয়ার্ড ছিলাম। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর তাকে ওটিতে নিয়ে দেখা গেল তার স্ক্রোটাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আঘাত পেয়েছেন। আমরা সেটি রিপেয়ার করেছি। অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে। তিনি এখন পর্যবেক্ষণে আছেন।’

চিকিৎসার জন্য ৮ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে জানিয়ে পরিচালক গতকাল খবরের কাগজকে বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের পর পর্যবেক্ষণ শেষে তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা দেখভাল করছেন। আগের চেয়ে তিনি ভালো আছেন।’

বারবার পার পেয়ে ‘বেপরোয়া’ ওরিয়নের ওবায়দুল করিম

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১৬ এএম
আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১০:৩৬ এএম
বারবার পার পেয়ে ‘বেপরোয়া’ ওরিয়নের ওবায়দুল করিম
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

একাধিক ব্যাংক থেকে ওরিয়ন গ্রুপের নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লেও তা পরিশোধে আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই এর কর্ণধার ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের বারবার তাগাদা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধার আওতায় নিয়মিত করা হয়নি। বিশেষ ছাড়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হলেও বিষয়টি গায়েই মাখেননি সব সময় সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এ ব্যবসায়ী। ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের অর্থ লোপাট নিয়ে ২০০৭-০৮ সালের মামলাগুলোর কয়েকটিতে তার সাজা হলেও নানা কৌশলে প্রভাব খাটিয়ে সেই সাজা থেকে বরাবরই পার পেয়ে গেছেন তিনি। এই ‘পার পেয়ে যাওয়া’ তাকে আরও বেপরোয়া করে তোলে। আর এ কারণে বিভিন্ন ব্যাংকে সাধারণ গ্রাহকের গচ্ছিত আমানতের টাকা ঋণ নিয়েও তা পরিশোধে ‘দায়হীন’ মনোভাব নিয়েই তিনি সময় পার করে আসছেন। 

উপর্যুক্ত কর্তৃপক্ষের তথ্য থেকে জানা যায়, রেজিস্ট্রিভুক্ত ওরিয়ন গ্রুপের ৩৩ কোম্পানির মধ্যে ২৪টির নামে ব্যাংকঋণ পাওয়া গেছে ১১ হাজার ৪৭০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১২টি কোম্পানির নামেই নেওয়া আছে ৭ হাজার ৩৩৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ। এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়া এ ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৩৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অবশিষ্ট ৪ হাজার ১৩১ কোটি টাকা নিয়মিত ঋণ রয়েছে আরও ১২টি কোম্পানির নামে। এই ঋণও নিয়মিত করা হয়েছে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া ‘বিশেষ সুবিধা’র আওতায়। বিতর্কিত ওই বিশেষ সুবিধা হলো মোট অনিয়মিত ঋণের ২ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ পরিশোধ করা সাপেক্ষে অনিয়মিত বা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নেওয়া।

সর্বশেষ ৩১ জুলাই ২০২৪ তারিখের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ঋণ ও খেলাপির পরিমাণ রয়েছে ‘ওরিয়ন অয়েল অ্যান্ড শিপিং’-এর নামে। এই কোম্পানির মোট ঋণ ২ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে খেলাপি ৫৩২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট-২ ঢাকা লিমিটেডের নামে। এই কোম্পানির নামে ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৪৫২ কোটি টাকাই খেলাপি। তৃতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের নামে। এই কোম্পানির নামে ৪৯১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১১০ কোটি টাকাই খেলাপি। বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের মধ্যে আরও রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড। এই কোম্পানির মোট ৩৫৯ কোটি টাকা ঋণের ৯০ কোটিই খেলাপি। এ ছাড়া পটুয়াখালীর বাউফলে ওরিয়ন গ্রুপের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ‘এনারগন রিনিউয়েবলস’ নামে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে ৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। 

হালনাগাদ তথ্যে আরও জানা গেছে, ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেডের ৬২৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ২৬ কোটি টাকা। ওরিয়ন নিট টেক্সটাইল লিমিটেডের নামে ২৩০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে এবং এর মধ্যে ১৪ কোটি টাকা খেলাপি। ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের নামে ঋণ রয়েছে ৩৪০ কোটি টাকা এবং এই ঋণের ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা খেলাপি। ওরিয়নের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান কার্গো মেরিটাইম লিমিটেডের মোট ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণের পুরোটাই খেলাপি হয়ে পড়ে রয়েছে। স্টার অ্যাসোসিয়েটস নামে অপর একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির ২০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা খেলাপি। এ ছাড়া ওরিয়নের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের মোট ১০২ কোটি টাকা ঋণের ৫৫ লাখ টাকা এবং ওরিয়ন ফুটওয়্যার লিমিটেডের নামে ১৭ কোটি টাকা ঋণের ৫১ লাখ টাকা খেলাপি রয়েছে।

বর্তমানে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল করিম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তার ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম। এই গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ওবায়দুল করিমের স্ত্রী আরজুদা করিম, দুই কন্যা জেরিন করিম ও নুদরাত করিম।

২০০৭ সালের মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন এই পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগ তদন্ত করে আসছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রভাব খাটিয়ে সেই তদন্ত কার্যক্রম ফ্রিজ করে রাখেন তারা। তদন্তে দুদক এই পরিবারের বিরুদ্ধে পাচার করা অর্থে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ব্যবসা গড়ে তোলার অভিযোগের সত্যতা পায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। 

গতকাল রবিবার এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে মন্তব্যের জন্য ওরিয়ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান ওবায়দুল করিমের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি কলটি ধরেননি।

আরও পড়ুন:

> পরিবারের পঞ্চপাণ্ডব খেয়েছে ব্যাংক
> ৪৮ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে বহাল তবিয়তে ওরিয়নের ওবায়দুল
> আত্মস্বীকৃত অপরাধী ওবায়দুল

> ওরিয়নের ওবায়দুলের অপকর্ম: মামলা ঠুকে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে বাঁচার চেষ্টা
> ওরিয়নের ওবায়দুল করিমের অপকর্ম: বেলহাসা কোম্পানি হাইজ্যাক

জিরানোর ফুরসত নেই স্বেচ্ছাসেবীদের

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১:১৮ এএম
আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১১:১৯ এএম
জিরানোর ফুরসত নেই স্বেচ্ছাসেবীদের
কাজের ফাঁকে খাচ্ছেন বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহকারীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রে। ছবি: খবরের কাগজ

ঘড়িতে সময় তখন বিকেল সাড়ে ৫টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে একে একে আসছে ত্রাণবোঝাই গাড়ি। এক সেকেন্ডও যেন জিরানোর সময় নেই স্বেচ্ছাসেবীদের। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললেও অনেকেরই সুযোগ হয়নি দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়ার। 

কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের একটি কক্ষ। শেষ বিকেলে সেখানে একটু বিরতি নিয়ে অনেকেই খেয়ে নিচ্ছেন দুপুরের খাবার । কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর মতো ৮ থেকে ৯ বছর বয়সী মামুনও খেতে বসেছে। সকাল ৯টা থেকে কাজ করছে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র মামুন। কখনো পানি, শুকনো খাবার, কখনো বা ওষুধের কার্টন টেনেছে বলে জানায়। বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে কথা বলে ওর কথার সত্যতা মেলে।

রবিবার (২৫ আগস্ট) শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের ওই কক্ষে খাবার খেতে খেতেই খবরের কাগজের সঙ্গে কথা হয় মামুনের। তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালে, রাজধানীর অদূরে কালীগঞ্জ এলাকায় বাবা-মা ও বোন নিয়ে থাকে। এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকরা কাপড়সহ অন্যান্য ত্রাণ সংগ্রহ করতে গেলে, তাদের সঙ্গে ঢাবি ক্যাম্পাসে চলে আসে সে। 

মামুন খবরের কাগজকে বলে, ‘এখানে কাজ করতে এসেছি। আমাগো ওই জায়গায় জামা-কাপুড় আনতে গেছিল। তাদের সঙ্গে আমরা আসছি। আমিসহ অনেক পোলাপান আইছে। পোলাপানেরা অন্য সাইডে আছে। এখানে যে আসছি, এইডা আমার আম্মু ও আপু জানে।’

এখানে এসে কী কী করলা? এমন প্রশ্নের জবাবে  সে বলে, ‘আজকে এখানে এসে মাল নামাইছি, খাজুর নামাইছি, মেডিসিন নামাইছি, তারপর বস্তা উঠাইছি।’ বাড়ি ফেরা প্রসঙ্গে বললো, ‘সন্ধ্যাকালে বাড়ি ফিরব। আমাগো এলাকার অনেক ব্যাটারা আসছে, পোলাপান আসছে। তা ছাড়া আমি আমাদের বাড়ি চিনি।’

সকাল থেকে মামুন যে কাজ করেছে, তার সত্যতা মেলে ত্রাণ কাজে আসা রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের সমাজকর্ম বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর নোমান হোসেনের কথায়। নোমান বলেন, ‘ছোট মানুষ হিসেবে এমন কর্মকাণ্ড সত্যিই আমাদের অনেক অনুপ্রেরণা ও শক্তি জোগাচ্ছে। সেই সকাল থেকেই তাকে এখানে দেখতেছি। বিশেষ করে পানির বোতল, গাড়িতে যেই মালামালগুলো আসছে, তাৎক্ষণিকভাবে সে একাই মালগুলো কারও সাহায্য ছাড়াই টেনে আনছে।’

দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার্তদের সহযোগিতা করার জন্য টিএসসিতে আসা ত্রাণ রাখার মতো জায়গা হচ্ছে না। সে কারণে ত্রাণ সংগ্রহের ভেন্যু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র করা হয়েছে। রবিবার থেকে শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে ত্রাণসামগ্রী এবং ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্রে (টিএসসি) নগদ অর্থ এবং ওষুধ সংগ্রহের কর্মসূচি চলে।

অভিন্ন নদীর পানি বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত বাড়ছে

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০১:১৮ পিএম
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত বাড়ছে
ফারাক্কা বাঁধ

ফারাক্কা বাঁধকে বাংলাদেশের মরণফাঁদ বলা হলেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যে। এ কারণে রাজ্য দুটি ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশ কয়েকটি চিঠিও দিয়েছে।

একই কথা বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমের তিস্তা এবং ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের ক্ষেত্রেও। ভারতীয় অ্যাক্টিভিস্টদের দাবি, এভাবে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদী সরে যাচ্ছে এবং বিপুল এলাকায় দেখা দিচ্ছে খরা ও বন্যা।

ভারতের বিখ্যাত অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকার সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, ‘ভারতেও ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে। দেশটির জন্যও ফারাক্কা এখন যত না উপযোগী, তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে।’

ফারাক্কা ও তিস্তা নদীর বাঁধ নিয়ে নয়াদিল্লির কাছে প্রতিবাদ পশ্চিমবঙ্গের
গঙ্গা ও তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত বাঁধ যে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি, সেটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লিখে জানিয়েছেন দিল্লিকে। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লেখেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। 

চিঠিতে ফারাক্কা প্রসঙ্গে মমতা লিখেছেন, প্রথমত গঙ্গা ক্রমেই আরও পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। ফলে সুন্দরবনে পানি কম যাচ্ছে। এই বাঁধের ফলে উজান ও ভাটিতে প্রবল ভাঙন শুরু হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর। ধ্বংস হয়েছে প্রচুর সম্পত্তি, যার মধ্যে রয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো স্থাপনা-অবকাঠামো। এই ভাঙন রোধে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গকে যে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাও দেয়নি।

তিস্তা প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, সিকিমে একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার পানি কমে গেছে। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ভাগ করা হলে উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি রয়েছে। 

বিহারের আপত্তি
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও প্রায় ১৫ বছর ধরে ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করে আসছেন। বিশেষত ২০১৬ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার বিহারে বড় বন্যার কারণ হিসেবে ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেন তিনি। নীতিশ কুমারও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন। 

গঙ্গা থেকে বেরোনো বিহারের কোসি নদী নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করা গোপাল কৃষ্ণ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলা থেকে উত্তর, পূর্ব ও মধ্য বিহারের অন্তত সাতটি জেলা ফারাক্কার এই বাঁধ ও অন্য বাঁধের কারণে বিপর্যস্ত। প্রতিবছরই হয় বন্যা হচ্ছে অথবা আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে।’

সিকিম, আসাম ও ত্রিপুরায় বিরূপ প্রভাব
তিস্তা নদীর ওপর একাধিক বাঁধ নির্মাণের কারণে সিকিমে পাহাড়ধস, বন্যা ও খরা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের এই রাজ্যটিতে পাহাড়ধসে ভেঙে পড়েছে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের (এনএইচপিসি) একটি বাঁধ। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, পাহাড়ের বিশাল অংশ ধসে পড়ছে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর। তাতে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়ে বাঁধের বড় একটি অংশ। গত কয়েক দিনে একাধিকবার ছোটখাটো ভূমিধসের কারণে আগেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর আগে গত বছর মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ভেঙে গিয়েছিল চুংথাংয়ে তৈরি আরেকটি বাঁধ। এখনো সেই বাঁধ পুরোপুরি ঠিক করা যায়নি। 

ভারতের পরিবেশবিদ অরূপ গুহ জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলকে বলেন, এমন যে হবে, সে আশঙ্কা ছিলই। পাহাড়ে এবং ডুয়ার্সে তিস্তার ওপর একের পর এক প্রকল্প তৈরি হয়েছে। নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে অবৈজ্ঞানিকভাবে। পরিবেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।

সম্প্রতি একাধিক বিদেশি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকারও বলছেন, বাংলাদেশের মতো ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরাতেও বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। 

বাঁধ নির্মাণবিষয়ক এক গবেষণায় সম্প্রতি বলা হয়, অবকাঠামো হিসেবে বাঁধ কেবল নদীপ্রবাহেরই সর্বনাশ করছে না, ভূমিকম্পপ্রবণ আসাম-বাংলা ভাটি অঞ্চলকে চিরস্থায়ী এক বিপদের মুখেও রেখে দিয়েছে। এ ছাড়া এ রকম অবকাঠামোর নীরব প্রতিক্রিয়া হিসেবে নদী অববাহিকার নানা স্থানে নিরন্তর ভাঙন চলছে।

বাংলাদেশের প্রতিবাদ
১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা নামক জায়গায় বাঁধ নির্মাণ শুরু করে ভারত। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নানা আলোচনার আড়ালে ফারাক্কা বাঁধ চালু করে ভারত। কিন্তু ভারতের প্রতিশ্রুত পানি বাংলাদেশ কখনোই পায়নি।

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘেও সোচ্চার ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেন। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কখনোই পানি পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। 

বাংলাদেশের প্রতিবাদের মুখে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের বরাক নদীর ওপর ২০০৯ সালে এটি নির্মিত হয়। এই বাঁধ টিপাইমুখ নামের গ্রামে বরাক ও তুইভাই নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। অভিন্ন নদীর উজানে এই বাঁধ ভাটির বাংলাদেশের পরিবেশ আর অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এমন আশঙ্কা সত্ত্বেও ভারত কর্ণপাত করেনি। 

সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। উজানের পানি ত্রিপুরার বিভিন্ন জনপদ ভাসিয়ে হু হু করে ঢুকছে বাংলাদেশে। ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজান থেকে বানের পানি ঢুকতে থাকায় ফেনী জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। 

বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়টি ত্রিপুরার গোমতী জেলা প্রশাসক তরিৎ কান্তি চাকমা সরকারি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে নিশ্চিত করেছেন। এক্সে তিনি লিখেছেন, গোমতী নদীতে পানির স্তর বেড়ে যাওয়ার ফলে ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জলস্তরও বিপৎসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। বাঁধ বাঁচাতে গেট খুলে পানি ছেড়ে দিতে হয়েছে।’ 

যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সম্প্রতি দাবি করেছে যে বাংলাদেশের বন্যা ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে হয়নি। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক নদী আইনের নীতি অনুযায়ী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষতি করা যাবে না। উজানের দেশ যারা তাদের ভাটির দেশকে জানানোর কথা- যখন এ রকম অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়, পানি ছাড়ার দরকার হয়। একটু জানিয়ে দিলে প্রস্তুতি রাখা যায়। মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়া যায়। সেটি এবার প্রতিপালিত হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন সময় এসেছে এই ব্যাপারে বাঁধগুলোর ব্যাপারে সোচ্চার হওয়ার। অভিন্ন নদীতে ভারত যেসব বাঁধ দিয়েছে সেগুলো নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করা এখন সময়ের দাবি। কেননা অভিন্ন নদীতে কোনো একটি দেশের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই।