ঝিনাইদহের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় নেতা কাজী কামাল আহমেদ ওরফে বাবু গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ খুনের জট খোলা শুরু হয়েছে। আনার হত্যার ঘটনায় মামলার পর জেলা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম স্থানীয় নেতাদের নজরদারিতে রেখেছিল। কার কার সঙ্গে এমপি আনারের বিরোধ ছিল তাদের বিস্তারিত বায়োডাটাও সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তদন্ত সম্পন্ন করেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ ছিল পুলিশের। পরে এ খুনের সঙ্গে জড়িত তানভীর ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদে স্থানীয় একাধিক ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের জড়িত হওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে। পরে তানভীর আদালতে জবানবন্দিতে ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে বাবুর নাম বলার পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই মধ্যে বাবুকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। তবে তার দেওয়া কিছু তথ্যে পুলিশের পিলে চমকেছে।
এ খুনের সঙ্গে আরও দুজন নেতা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন বলে জানিয়েছেন বাবু। তার মধ্যে একজন জেলা যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। ওই নেতার বাড়ি কালীগঞ্জ এলাকায়। আরেকজন কালীগঞ্জ পৌরসভার ছাত্রলীগের নেতা। ওই ছাত্রলীগের নেতা আনারের সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে ২ বছর আগে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাকে নিজ দল থেকে এমপি আনার বাদ দেন। তার বিরুদ্ধে থানায় প্রতারণার অভিযোগ দিয়েছিলেন। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যস্থতায় সালিশি বৈঠকে বিরোধ মিটে গেলেও ভেতরে ভেতরে তার এই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত করে রেখেছিলেন কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে। মামলার তদন্তকারী এক কর্মকর্তা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ১৩ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। তার আগে ২২ মে আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশ এ মামলায় গ্রেপ্তার করেন শিলাস্তি, আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়া ওরফে ফয়সাল সাজিকে। পরে আদালত শিলাস্তিসহ মোট তিনজনকে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। প্রথম দফায় রিমান্ডে কিছু তথ্যের ঘাটতি থাকার কারণে ডিবি পুলিশ গত ৩১ মে পুনরায় আদালতে আসামিদের হাজির করে আবার রিমান্ডের আবেদন করে। শিমুল ভূঁইয়া তার জবানবন্দিতে কাজী কামাল আহমেদের কথা বলেন। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। তাকে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারি বিভাগের ডিসি আব্দুল আহাদ গতকাল সন্ধ্যায় খবরের কাগজকে জানান, ‘আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে।’
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, আনার হত্যাকাণ্ডে কাজী কামাল আহমেদ ওরফে বাবুর সংশ্লিষ্টতা আসার পর পুলিশ মাঠপর্যায়ে আরও কাজ করা শুরু করেছে। বাবু দুই নেতার নাম বলেছেন। তবে ওই দুই নেতা কোন প্রক্রিয়ায় এ খুনের সঙ্গে জড়িত তা জানতে পারেনি পুলিশ। আনারের সঙ্গে স্থানীয় একাধিক রাজনৈতিক নেতার বিরোধ থাকার কারণে গ্রুপভিত্তিক কিছু নেতাও এ খুনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তবে বাবু পুলিশকে জানিয়েছেন যে, এ হত্যাকাণ্ডে ওই দুই নেতা প্ররোচনা ও খুনিদের অর্থ প্রদান করে থাকতে পারেন।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাবু পুলিশকে জানিয়েছেন আনার ও শাহীনের দ্বন্দ ছিল প্রকাশ্যে। তাদের এই দ্বন্দ্বের কথা সবাই জানত। স্থানীয় নেতারা এই বিরোধকে মেটানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিলেও তা কোনো কাজে আসেনি। একাধিক সালিশি বৈঠকেও এই বিরোধ মেটেনি। এই বিরোধের জেরে আনারকে খুন হতে হয়েছে।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আনার বিএনপির রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগে আসার কারণে স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগের নেতাও তাকে নির্বাচনি মাঠ থেকে সরাতে তৎপর ছিলেন। কিন্তু এরপরও আনার ৩ বার এমপি নির্বাচিত হন। আর হত্যাকারীদের নানাভাবে প্ররোচনা প্রদানে এই আনারের বিদ্রোহী গ্রুপ সক্রিয় ছিল বলে জানা গেছে।