![ফেনী সীমান্তে চিনি চোরাচালান প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায়](uploads/2024/06/11/Sugar-feni-1718085306.jpg)
ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে প্রতিদিন দেশের অভ্যন্তরে ঢুকছে কোটি কোটি টাকার ভারতীয় চিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে প্রতিদিন দেশে ঢুকছে এসব চিনির চালান। অভিযোগ রয়েছে, এ চক্রে জড়িত স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ, যাদের ছত্রচ্ছায়ায় চিনি চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে ফেনী সীমান্ত।
গত শনিবার (৮ জুন) ছাগলনাইয়া পৌরসভা ও মহামায়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিজিবির সহায়তায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চিনি আসে ফেনীর সীমান্ত দিয়ে। এসব ভারতীয় চিনির চালান বাংলাদেশে আনার জন্য সীমানাপ্রাচীরের ৫-১০ গজ তারকাঁটার বেড়া কেটে ফেলা হয়েছে। এসব কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত অবাধে দেশের অভ্যন্তরে চিনি আনছে চোরাকারবারিরা। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় চোরাকারবারিদের বিশাল সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলেও জানা যায়। এসব চোরাচালানে যারা জড়িত, তারা বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। উপজেলাসহ ফেনীর বাজারগুলোতে বেশির ভাগ দোকানে ভারতীয় চিনি বিক্রি হচ্ছে দেদার। কোনো সুফল পাচ্ছেন না ক্রেতারা। পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের চিনিশিল্পের ওপর।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাত ২টার দিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ৯৯ নম্বর পিলার পূর্ব ছাগলনাইয়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কেটে চিনি চোরাচালানের অভিযোগে ২৩ বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করে নিয়ে গেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ফেনীর ৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বলেন, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফের মাঝে পতাকা বৈঠকে বিএসএফ জানায়, চোরাকারবারের অভিযোগে ২৩ বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করা হয়েছে।
গত ৭ জুন ছাগলনাইয়া বাজারের উত্তর পাশে জমাদার পাম্পের বিপরীতে একটি গুদামে ট্রান্সপোর্ট অভিযান চালান বিজিবি, পুলিশ ও ভূমি কর্মকর্তারা। এই যৌথ অভিযানে ২৫৩ বস্তায় ১২ হাজার ৬৫০ কেজি চিনি জব্দ করা হয় বলে জানিয়েছেন ছাগলনাইয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান ইমাম। দোষীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনীর বড়বাজার ও ইসলামপুর রোডের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বিভিন্ন দোকানে ভারতীয় চিনি বিক্রি করার কারণে দেশীয় চিনির কদর কমেছে। বর্তমানে বাজারে ভারতীয় চিনির চাহিদা বেশি এবং দেশীয় চিনির চাহিদা কম। ব্যবসায়ীরা বলেন, ভারতের সীমান্ত থেকে চোরাই চিনি প্রতি বস্তা পাইকারি দরে ৫ হাজার ৫০০ টাকা করে কেনা হয় এবং খুচরা দোকানির কাছে ৫ হাজার ৬০০ থেকে ৫ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রতি কেজি ১২২ থেকে ১২৩ টাকা বিক্রি করেন। দেশি চিনি প্রতি বস্তা পাইকারি দরে ৬ হাজার টাকা করে কেনা হয় এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ৬ হাজার ৬০০ টাকা বা ৮০০ টাকা বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ দেশি চিনি বিক্রয়ে লাভ কম এবং ভারতীয় চিনি বিক্রিতে লাভ বেশি। এ জন্য ভারতীয় চিনি বিক্রিতে আগ্রহ বেশি ব্যবসায়ীদের।
পরশুরাম সীমান্তে অনুসন্ধানে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক একরামুল হক চৌধুরী পিয়াস ও ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আবদুল আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে উপজেলার বিভিন্ন স্থান দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চিনির চালান প্রবেশ করছে দেশে।
জানা গেছে, বিলোনিয়া স্থলবন্দর সীমান্ত, তালুকপাড়া, বাঁশপদুয়া, নরনীয়া, নিজকালিকাপুর, মেলাঘর, মহেষ পুষ্করিণী সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ বস্তা চিনি নামে। এ সময় বিজিবি পাহারা দিয়ে বস্তাপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা নেয় বলে অভিযোগ চোরাকারবারি ও স্থানীয়দের। চিনি চোরাচালানে ২৫০-৩০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। শ্রমিকদের প্রতি বস্তা হিসেবে ৩০০ টাকা করে দেওয়া হয় বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চোরাকারবারি।
এ বিষয়ে পরশুরাম উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল আহাদ চৌধুরী জানান, চোরাচালান চক্রের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যারা তার নাম বলেছে, নিঃসন্দেহে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে বলে জানান তিনি।
ছাগলনাইয়া উপজেলার ভারতীয় সীমান্তে মহামায়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড জয়নগর ও সত্যনগর, পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড যশপুর, ৭ নম্বর ওয়ার্ড পূর্ব ছাগলনাইয়া, ৮ নম্বর ওয়ার্ড মটুয়া, রাধানগর ইউনিয়নের মোকামিয়া ও ফুলগাজী উপজেলার মুন্সীরহাট ইউনিয়নের বদরপুর সীমান্ত, আমজাদহাট ইউনিয়নের তারাকুচা ও ফেনা পুষ্করিণী সীমান্তে প্রতিদিন বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ঢুকছে হাজার হাজার টন চিনি।
চোরাচালানে বিজিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রসঙ্গে ফেনীর ৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ মো. বদরুদ্দোজা বলেন, এটি মানুষের ভ্রান্ত ধারণা। যেখানে বিজিবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সীমান্তে চোরাচালান রোধ ও পাহারা দেওয়ার জন্য, সেখানে চোরাচালানে বিজিবির সম্পৃক্ততা বা সহযোগিতা থাকবে, এটি নিঃসন্দেহে স্থানীয়দের অপপ্রচার। বিজিবি প্রতিনিয়ত ফেনীর ১০২ কিলোমিটার সীমান্তে চোরাচালান রোধে কাজ করছে। প্রতিনিয়ত ভারতীয় চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য আটক করছে। গত এক মাসের পরিসংখ্যান দেখলে বুঝতে পারবেন। চোরাচালান চক্রের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে বিজিবির।