দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসা উচিত মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ। বর্তমানে আসছে ১ শতাংশেরও নিচে। বিদেশি বিনিয়োগের এই রুগ্ণ দশা নতুন নয়। দুই দশক ধরে বাংলাদেশে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এফডিআই এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে জিডিপির ভালো প্রবৃদ্ধির দেখা মিলেছে। অনেক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। বরং এফডিআই কমে গেছে।
চলতি বছরের এফডিআইয়ের তথ্য এখনো প্রকাশ পায়নি। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এ ছাড়া বিগত বছরগুলোতে যে পরিমাণ এফডিআই এসেছে, তা অন্য দেশের তুলনায় খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১৪ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে এর মধ্যে নতুন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। ২০২৩ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পুনঃবিনিয়োগ। বাকিটা নতুন বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে বলছে, ২০২৩ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনামে ১৫ বিলিয়ন ডলার। মায়ানমারের মতো গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশেও ৯ বিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে।
পার্শ্ববর্তী দেশের এই অগ্রগতি দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে বাংলাদেশে কেন বছরের পর বছর ধরে কম এফডিআই আসছে? এর নানাবিধ কারণ রয়েছে এবং এগুলো সবই পুরোনো। এফডিআই কম আসার পেছনের কারণগুলো বিভিন্ন সময়ে শনাক্ত করা হলেও সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যে কারণে ফলাফল আশানুরূপ নয়।
বাংলাদেশে কেন এফডিআই কম আসছে তার কারণ ব্যাখা করেন দেশীয় উদ্যোক্তা এবং গবেষকরা। তারা যে কারণগুলো শনাক্ত করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন, বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ, জটিল করনীতি ও উচ্চ করহার, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, নীতি বাস্তবায়নে ধীরগতি, ঠিকমতো ওয়ান স্টপ সেবা চালু না করা, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়া, ব্যবসার খরচ বেশি হওয়া, বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। তাদের মতে, যতদিন বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত না করা হবে ততদিন এ দেশে প্রত্যাশিত বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বিদেশিরা যদি মনে করেন, অন্য দেশে তাদের জন্য বিনিয়োগ করা সুবিধাজনক, তাহলে কেন তারা বাংলাদেশকে বেছে নেবেন? অবশ্য নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের বড় একটি উৎস। মূলত সে কারণেই বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন। তাদের জন্য বিশেষ অঞ্চল তৈরি করতে পারলে দেশে ভালো এফডিআই আসবে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের এই ধারণা কতটা যুক্তিসংগত? কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সস্তা শ্রমই কি যথেষ্ট?
অর্থনীতিবিদরা আরও বলেন, কেবল সস্তা শ্রমের প্রস্তাব দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রযুক্তির যুগ। কাজেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার না করতে পারলে কেবল সস্তা শ্রম দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ নয়। তাই বাংলাদেশ যদি আরও বেশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়, তাহলে বন্দরের ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ না আসার অনেক কারণ আছে। এর অন্যতম ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন। করনীতির কিছু জায়গা আবার সাংঘর্ষিক। করহার বেশি। দুর্নীতি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি। ওয়ান স্টপ সার্ভিস যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে হচ্ছে না। এগুলো বড় কারণ বলে আমি মনে করি।’
তিনি আরও বলেন, অনেক বিনিয়োগকারীকে সেবা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরি করতে হয়। বিদেশিরা চান এক জায়গা থেকে সব সেবা পেতে। কিন্তু তারা পান না। ফলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার সে অনুযায়ী এফডিআইয়ের পরিমাণ কম কেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ এফডিআই আসা উচিত। সে অনুযায়ী বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন এফডিআই আসা উচিত। কিন্তু আমরা পাচ্ছি মাত্র ৩ বিলিয়ন বা তারও কম। বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়া উচিত।’ কিন্তু এর জন্য যে ধরনের পলিসি সাপোর্ট দরকার সেটা নেই বলে মত দেন তিনি।
শীর্ষ ব্যবসায়ী এই নেতার মতে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপিতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়া দরকার সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ভালো প্রকল্প বাদ দিয়ে খারাপ প্রকল্পগুলো পিপিপিতে রাখা হয়। এ জন্য পিপিপির উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।
সূত্র জানায়, ভারত সরকার এফডিআই প্রবাহ বাড়াতে নীতি সংশোধন করেছে। ২০১৫ সালে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ চালু হওয়ার পর থেকে ভারতে এফডিআই প্রবাহ ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
গত সাত বছরে ভারতে এফডিআই প্রবাহ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারতে এফডিআই ছিল মাত্র ৪ হাজার ৫১৫ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি বেড়ে ৮ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশটিতে এফডিআইয়ের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টা চিত্র দেখা যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এফডিআই কমছে। এখন পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের বেশি এফডিআই আসেনি। ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরের মধ্যে (২০১৫ সালে ঘোষিত) সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দাবি করেছে, ইতোমধ্যে ১০টি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তিন-চারটি দৃশ্যমান হয়েছে। বাকিগুলো কাগজেই রয়ে গেছে।
গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট বা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ব্যবসার খরচ (কস্ট অব ডুইং বিজনেস) অনেক বেশি। নীতিনির্ধারকরা পলিসির যে প্রতিশ্রুতি দেন তা প্রতিপালন হয় না। যেমন: বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চিত হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া খুবই জটিল। এখানে বড় ধরনের সংস্কার না করলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। নিরবছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি আছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কথা বলে গেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’
বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দুর্নীতি- এ কথা উল্লেখ করে এই গবেষক ও অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘এ কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যদি বিনিয়োগসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় তাহলে এটি নিষ্পত্তি করার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে কোনো বিরোধ হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভয় পান। সর্বোপরি আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। রিজার্ভ কমে গেলে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে ভয় পান। তারা মনে করেন, এমন পরিস্থিতি থাকলে বিনিয়োগ করলে তা থেকে রিটার্ন আসবে না।’