ঢাকা ১২ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
English
রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

চ্যালেঞ্জে বিদেশি বিনিয়োগ

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৫ এএম
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:১৩ পিএম
চ্যালেঞ্জে বিদেশি বিনিয়োগ
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসা উচিত মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ। বর্তমানে আসছে ১ শতাংশেরও নিচে। বিদেশি বিনিয়োগের এই রুগ্ণ দশা নতুন নয়। দুই দশক ধরে বাংলাদেশে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এফডিআই এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। 

বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে জিডিপির ভালো প্রবৃদ্ধির দেখা মিলেছে। অনেক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। বরং এফডিআই কমে গেছে।

চলতি বছরের এফডিআইয়ের তথ্য এখনো প্রকাশ পায়নি। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। এ ছাড়া বিগত বছরগুলোতে যে পরিমাণ এফডিআই এসেছে, তা অন্য দেশের তুলনায় খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১৪ শতাংশ কমেছে। 

অন্যদিকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে এর মধ্যে নতুন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। ২০২৩ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর নিট এফডিআই প্রবাহ ৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পুনঃবিনিয়োগ। বাকিটা নতুন বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে বলছে, ২০২৩ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার এবং ভিয়েতনামে ১৫ বিলিয়ন ডলার। মায়ানমারের মতো গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশেও ৯ বিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে। 

পার্শ্ববর্তী দেশের এই অগ্রগতি দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে বাংলাদেশে কেন বছরের পর বছর ধরে কম এফডিআই আসছে? এর নানাবিধ কারণ রয়েছে এবং এগুলো সবই পুরোনো। এফডিআই কম আসার পেছনের কারণগুলো বিভিন্ন সময়ে শনাক্ত করা হলেও সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যে কারণে ফলাফল আশানুরূপ নয়। 

বাংলাদেশে কেন এফডিআই কম আসছে তার কারণ ব্যাখা করেন দেশীয় উদ্যোক্তা এবং গবেষকরা। তারা যে কারণগুলো শনাক্ত করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন, বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ, জটিল করনীতি ও উচ্চ করহার, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, নীতি বাস্তবায়নে ধীরগতি, ঠিকমতো ওয়ান স্টপ সেবা চালু না করা, গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো খাতের দুর্বলতা, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়া, ব্যবসার খরচ বেশি হওয়া, বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। তাদের মতে, যতদিন বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত না করা হবে ততদিন এ দেশে প্রত্যাশিত বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। 

অর্থনীতিবিদরা বলেন, বিদেশিরা যদি মনে করেন, অন্য দেশে তাদের জন্য বিনিয়োগ করা সুবিধাজনক, তাহলে কেন তারা বাংলাদেশকে বেছে নেবেন? অবশ্য নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বাংলাদেশ সস্তা শ্রমের বড় একটি উৎস। মূলত সে কারণেই বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন। তাদের জন্য বিশেষ অঞ্চল তৈরি করতে পারলে দেশে ভালো এফডিআই আসবে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের এই ধারণা কতটা যুক্তিসংগত? কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সস্তা শ্রমই কি যথেষ্ট? 

অর্থনীতিবিদরা আরও বলেন, কেবল সস্তা শ্রমের প্রস্তাব দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন প্রযুক্তির যুগ। কাজেই নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার না করতে পারলে কেবল সস্তা শ্রম দিয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ নয়। তাই বাংলাদেশ যদি আরও বেশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়, তাহলে বন্দরের ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ না আসার অনেক কারণ আছে। এর অন্যতম ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন। করনীতির কিছু জায়গা আবার সাংঘর্ষিক। করহার বেশি। দুর্নীতি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি। ওয়ান স্টপ সার্ভিস যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবে হচ্ছে না। এগুলো বড় কারণ বলে আমি মনে করি।’ 

তিনি আরও বলেন, অনেক বিনিয়োগকারীকে সেবা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরি করতে হয়। বিদেশিরা চান এক জায়গা থেকে সব সেবা পেতে। কিন্তু তারা পান না। ফলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। 

বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার সে অনুযায়ী এফডিআইয়ের পরিমাণ কম কেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ এফডিআই আসা উচিত। সে অনুযায়ী বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন এফডিআই আসা উচিত। কিন্তু আমরা পাচ্ছি মাত্র ৩ বিলিয়ন বা তারও কম। বাংলাদেশে অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়া উচিত।’ কিন্তু এর জন্য যে ধরনের পলিসি সাপোর্ট দরকার সেটা নেই বলে মত দেন তিনি। 

শীর্ষ ব্যবসায়ী এই নেতার মতে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপিতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়া দরকার সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ভালো প্রকল্প বাদ দিয়ে খারাপ প্রকল্পগুলো পিপিপিতে রাখা হয়। এ জন্য পিপিপির উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। 

সূত্র জানায়, ভারত সরকার এফডিআই প্রবাহ বাড়াতে নীতি সংশোধন করেছে। ২০১৫ সালে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ চালু হওয়ার পর থেকে ভারতে এফডিআই প্রবাহ ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।

গত সাত বছরে ভারতে এফডিআই প্রবাহ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারতে এফডিআই ছিল মাত্র ৪ হাজার ৫১৫ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি বেড়ে ৮ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশটিতে এফডিআইয়ের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টা চিত্র দেখা যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এফডিআই কমছে। এখন পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের বেশি এফডিআই আসেনি। ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আসে। 

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরের মধ্যে (২০১৫ সালে ঘোষিত) সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দাবি করেছে, ইতোমধ্যে ১০টি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তিন-চারটি দৃশ্যমান হয়েছে। বাকিগুলো কাগজেই রয়ে গেছে। 

গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট বা র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ব্যবসার খরচ (কস্ট অব ডুইং বিজনেস) অনেক বেশি। নীতিনির্ধারকরা পলিসির যে প্রতিশ্রুতি দেন তা প্রতিপালন হয় না। যেমন: বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চিত হয়নি।’ 

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া খুবই জটিল। এখানে বড় ধরনের সংস্কার না করলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। নিরবছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি আছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কথা বলে গেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’

বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দুর্নীতি- এ কথা উল্লেখ করে এই গবেষক ও অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘এ কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যদি বিনিয়োগসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় তাহলে এটি নিষ্পত্তি করার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে কোনো বিরোধ হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভয় পান। সর্বোপরি আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। রিজার্ভ কমে গেলে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে ভয় পান। তারা মনে করেন, এমন পরিস্থিতি থাকলে বিনিয়োগ করলে তা থেকে রিটার্ন আসবে না।’

নোয়াখালী তথ্য কমপ্লেক্সের ১৫ কোটি টাকার কাজে অনিয়ম

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৩ এএম
নোয়াখালী তথ্য কমপ্লেক্সের ১৫ কোটি টাকার কাজে অনিয়ম
মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না-লুৎফুল লাহিল মাজিদ

নোয়াখালী জেলা আধুনিক তথ্য কমপ্লেক্স ভবনের কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কার্য সম্পাদনের জাল সনদে ২০২৩ সালে প্রায় ১৫ কোটি টাকার এই কাজ বাগিয়ে নেয় আওয়ামী লীগের একটি সিন্ডিকেট। এখন তারাই প্রভাবশালীদের হাত করে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে যেনতেনভাবে দায়সারাভাবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার আধুনিক এ কমপ্লেক্স (টেন্ডার আইডি-৮৬৬০৬৪) নির্মাণে ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করে গণপূর্ত বিভাগ। পরে ঠিকাদারদের দাখিল করা কার্য সম্পাদনের কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ওই বছরের ২ অক্টোবর যৌথ মালিকানাধীন মোস্তফা কনসোর্টিয়ামকে ১০ শতাংশ কমমূল্যে ১৩ কোটি ৩৮ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ টাকায় ভবনটি নির্মাণের কার্যাদেশ প্রদান করেন কর্মকর্তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড সন্স, মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশন মিলে গঠন করে মোস্তফা কনসোর্টিয়াম। এই কনসোর্টিয়াম কাজটি পায়। কিন্তু কাজ পাওয়ার শর্ত হিসেবে শেষোক্ত দুই প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা ১২টি কার্য সম্পাদন সনদের (ওয়ার্ক কমপ্লিশন সার্টিফিকেট) সব কটি ইতোমধ্যে ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। এ ঘটনায় নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে বাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কর্মরত) সা’দ মোহাম্মদ আন্দালিব ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. এমদাদুল হক মিয়ার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।  

জানা গেছে, তথ্য ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ এবং মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশনের মালিক লুৎফুল লাহিল মাজিদ রাসেল নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বেগমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ কিরণের ঘনিষ্ঠ। গোলাম মর্তুজা মুন্না গত ১৮ সেপ্টেম্বর সুধারাম মডেল থানায় দায়ের হওয়া বিস্ফোরক মামলার (নম্বর-২৭) এজাহারভুক্ত আসামি।

এদিকে জেলার আধুনিক এই কমপ্লেক্সের টেন্ডার পেতে কনসোর্টিয়ামের দুই ঠিকাদারের ছলচাতুরীর প্রমাণ মিলেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজ চার অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ২১ কোটি ২৪ লাখ ৭৬ হাজার ২৫১ টাকার কাজ করেছে বলে কার্য সম্পাদনের সাতটি ভুয়া সনদ জমা দেয়। 

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফুল লাহিল মাজিদ রাসেলের মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশন তিন অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫৪ কোটি ৯৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৭১ দশমিক ৭৭ টাকার কার্য সম্পাদনের পাঁচটি জাল সনদ জমা দেয়। 

খবরের কাগজের হাতে আসা এসব কার্য সম্পাদন সনদে দেখা যায়, আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের দাখিল করা বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সনদের প্যাড ও লেখায় অসংখ্য ভুল। এ ছাড়া সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশনের দাখিল করা ২০২০ সালের ৫ জুলাইয়ের সনদে কর্মকর্তার স্বাক্ষর ওই বছরের ১৬ জানুয়ারি লেখা এবং ২০২০ সালের ৬ জুলাইয়ের সনদে আগের মাস জুনের ২৮ তারিখে স্বাক্ষর করা। 

অন্যদিকে দাখিল করা এসব কার্য সম্পাদন সনদ ভুয়া এবং সঠিক নয় বলে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (পূর্ত) মো. নজরুল ইসলাম, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের (সাবেক আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. উজিরে আজম খান, বেগমগঞ্জ উপজেলার সাবেক প্রকৌশলী মো. হাফিজুল হক ও চৌমুহনী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক।

নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. উজিরে আজম খান খবরের কাগজকে বলেন, ঠিকাদারের দাখিল করা কার্য সম্পাদন সনদগুলোর বিষয়ে মেডিকেল কলেজের রেকর্ডপত্র যাচাই করে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

চৌমুহনী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক খবরের কাগজকে বলেন, কার্য সম্পাদন সনদগুলো যাচাই করে সঠিক পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, এই কাজটি সম্পন্ন করার সর্বশেষ সময়সীমা ছিল গত বছরের ২ ডিসেম্বর। সরেজমিনে নির্মাণাধীন তথ্য ভবনে গিয়ে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়া হলেও কাজের তেমন অগ্রগতি হয়নি। মেয়াদ শেষের পর গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভবনের প্রথম তলার ছাদ ঢালাই দেওয়া হয়েছে। তাও এতে গণপূর্তের কাজের নিয়ম ভেঙে স্টিলের সেন্টারিংয়ের পরিবর্তে বাঁশের সেন্টারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণকাজে নিম্নমানের এনজিএস সিমেন্ট, এসএস রডসহ নিম্নমানের ইট, পাথর, বালু, কণা ব্যবহার করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্ত বিভাগের একাধিক ঠিকাদার বলেন, নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. এমদাদুল হক অনিয়ম করে অদক্ষ ঠিকাদারকে এ কাজ পেতে সহযোগিতা করেছেন। এখন তার তত্ত্বাবধানে চলা এই কাজে ব্যাপক অনিয়ম হলেও তিনি দেখেও না দেখার ভান করছেন। 

যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোস্তফা কনসোর্টিয়ামের মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড সন্সের মালিক মো. শহীদুল ইসলাম কিরণ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি এ কাজের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি নির্মাণেও নাই, অর্থনৈতিক লেনদেনেও নাই। মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না কাজটি পাওয়ার স্বার্থে আমার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করেছেন। কাগজে-কলমে আমার অনুমোদন নিয়ে তিনিই এখন সবকিছু দেখাশোনা ও লেনদেন করছেন।’

মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘বন্যার কারণে কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। তা ছাড়া স্টিলের পরিবর্তে বাঁশের সেন্টারিং ব্যবহার করা হয়েছে, বিষয়টি সত্য। আমরা গণপূর্ত বিভাগের কাছে বাঁশের সেন্টারিংয়ের বিল দাবি করব।’ নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

অন্যদিকে জাল সনদের বিষয়ে জানতে নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে বাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কর্মরত) সা’দ মোহাম্মদ আন্দালিব, মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না ও মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশনের মালিক লুৎফুল লাহিল মাজিদ রাসেলকে বারবার ফোন দিলেও তারা কেউ ধরেননি।

নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. এমদাদুল হক মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঠিকাদারের কাজ পেতে সহযোগিতা করার বিষয়টি সঠিক নয়। আধুনিক ভবন নির্মাণে স্টিলের পরিবর্তে বাঁশের সেন্টারিং গণপূর্ত বিভাগ কখনোই অনুমোদন করে না। এ বিষয়ে ঠিকাদারদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে। তারপরও তারা কথা শোনেননি। এ ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

গণপূর্ত বিভাগের নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুল হাছান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি আসার আগেই এ কাজের কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) দেওয়া হয়েছে। এখন কার্য সম্পাদনের জাল সনদ, বাঁশের সেন্টারিং ও নিম্নমানের কাজের বিষয়গুলো প্রমাণিত হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঢাকার গণপরিবহন সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ওজর আপত্তি বাসমালিকদের

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:৪৫ এএম
আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:০৬ এএম
সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ওজর আপত্তি বাসমালিকদের
কোনো রুটে কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে যেতে নারাজ বাসমালিকরা। ছবি: খবরের কাগজ

গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাজধানীর সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর গণপরিবহনকে শৃঙ্খলায় আনতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প তথা ঢাকা নগর পরিবহনকে সক্রিয় করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। 

রাজধানী ঢাকা ও শহরতলি ঘিরে ৩৮৮টি বাস রুটকে ৪২টি রুটে নামিয়ে আনা, তারপর সেই ৪২টি রুটে আলাদা আলাদা বাস কোম্পানি গঠন করে সড়কে বাসের রেষারেষি বন্ধ করা ছিল এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এতে বাদ সেধেছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। 

ঢাকার বাসমালিকদের এই সংগঠনটি বলছে, কোনো রুটে কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে যেতে তারা নারাজ। ঢাকায় বাস চালাতে তারা বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটিকে মানতে নারাজ। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষকে (ডিটিসিএ) রীতিমতো অগ্রাহ্য করে তারা এই সংস্থার প্রায় সব উদ্যোগ ভেস্তে দিতে চলেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত হতে বাসমালিকদের মধ্যে যারা আবেদন জানিয়েছিলেন, তাদের পরিবহনের অনেক বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। আগামী মে মাসের মধ্যে ফিটনেসবিহীন বাসগুলো রাজধানীর সড়ক থেকে উঠিয়ে নিতে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা মানতে একদম নারাজ তারা।
 
এগিয়ে গিয়েও থমকে গেল বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প 
ঢাকা নগর পরিবহন নামে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প শুরু হয় ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। তখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) থেকে ৩০টি এবং বেসরকারি অপারেটর ট্রান্স সিলভা থেকে ২০টি বাস চালু করা হয়েছিল। ৫০টি বাসের রুট ছিল কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, শাহবাগ, মতিঝিল হয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে ট্রান্স সিলভা পরিবহন তাদের বাসগুলো তুলে নেয়। বিআরটিসিও লোকসানের মুখে প্রথমে বাস কমিয়ে দেয়। পরে একেবারে বন্ধ করে দেয়। 

সরেজমিন দেখা গেছে, বিআরটিসির কোনো বাস ঢাকা নগর পরিবহন রুটে চলাচল করছে না। 

এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ১১ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক ও বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভার আয়োজন করেন। তিনি জানিয়েছিলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের আওতাধীন রুটগুলোতে বাস চলতে হলে ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় আসতে হবে।

বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম খবরের কাগজকে জানান, সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা মহানগরের ২৪, ২৫, ২৭ ও ২৮ নম্বর রুটসহ ৪২টি রুটে বাস পরিচালনায় আগ্রহীদের থেকে আবেদনপত্র গ্রহণ করতে শুরু করে ডিটিসিএ। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৪২টি রুটে দুই শতাধিক পরিবহন কোম্পানির মালিক আবেদন জানান। তারা এসব রুটে প্রায় তিন হাজার বাস পরিচালনা করতে চান। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা নগর পরিবহনের সবুজ গুচ্ছে (গ্রিন ক্লাস্টার) আবারও বাস চালু করতে তোড়জোড় শুরু করেছেন তারা। 

এই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে গেলেও সংকট শুরু হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি থেকে। ওই দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সভাপতিত্বে ডিএমপি কার্যালয়ে ঢাকা মেট্রো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির (আরটিসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘আমরা ঢাকা নগর পরিবহনে কোনো বাস দিতে পারব না। ঢাকা নগর পরিবহন চালাতে হলে ডিটিসিএ নিজ উদ্যোগে দুই হাজার বাস এনে চালাক। কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে বাস চালাতে আমরা বাধ্য নই। ঢাকা সড়ক পরিবহনে বাস চালাতে আমাকে বাধ্য করতে পারে না কেউ।’

সাইফুল আলম আরও বলেন, ‘আমি এই সড়কে বাস নামিয়ে কী লাভটা পাব? আমাকে কোনো ফ্যাসিলিটি না সাবসিডি দেওয়া হয়েছে? ডিটিসিএর মতো সংস্থা পরিবহন খাতের জন্য কী করেছে? তারা একের পর এক কনসালট্যান্সির নাম করে সরকারের টাকা খাচ্ছে।’ 

এ বিষয়টি পরে খবরের কাগজকে নিশ্চিত করেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। এ সমিতির দপ্তর সম্পাদক কাজী জুবায়ের মাসুদ বলেন, ‘আমরা বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় থাকতে চাচ্ছি না। আমরা পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মহোদয়ের সহযোগিতায় সড়কে বাস চালাব।’

ঢাকা নগর পরিবহনের প্রকল্পটি যেন ভেস্তে না যায়, সে জন্য জোর প্রচেষ্টা করছে ডিটিসিএ। সংস্থাটির পরিচালক নীলিমা আখতার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাসমালিকরা এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে গেছেন। আমরা তাদের নিয়ে আরও দু-তিনটি সভা করব। এরপরে কিছু ভালো খবর পাবেন।’

রুট পারমিট, ফিটনেস নেই, তবু বাসমালিকরা সেসব গাড়িই আনতে চান এই প্রকল্পে 
বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প তথা ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত হতে গেলে আধুনিক, মানসম্পন্ন বাস দিতে হবে বাসমালিকদের। কিন্তু এই বাসমালিকদের বড় অপকর্ম ধরা পড়ে ডিএমপির একটি পরিসংখ্যানে। 

সেই পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি) অনুমোদিত ঢাকার ১১০টি সচল রুটে এখন বাস চলছে ৪ হাজার ৫৪৬টি। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন বাসের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩টি। এসব রুটে অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা ৭ হাজার ৪৩। 
ডিএমপি, বিআরটিএর নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো কোনো পরিবহনের ৯০-৯৫টি বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (২০ বছরের বেশি) ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে। যেমন: এ-২২২ রুটে গাজীপুর পরিবহনের ব্যানারে বাসের সংখ্যা ২০৫। তবে বৈধ রুট পারমিটধারী বাসের সংখ্যা ১১০। এ পরিবহনে ২০ বছরের বেশি বয়সের বাস রয়েছে ৯৫টি। 

এ-২২০ রুটে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন লিমিটেডের বাসের সংখ্যা ১১৮। এর মধ্যে বৈধ রুট পারমিটধারী বাসের সংখ্যা ১০০। মেয়াদোত্তীর্ণ বাসের সংখ্যা ১৮। অথচ এ পরিবহনের মালিক নতুন করে ২৬টি বাসের রুট পারমিটের জন্য আবেদন করেছেন। 

বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, নিজেদের রুট পারমিটবিহীন বাসের পাশাপাশি বিভিন্ন রুটে চলমান রুট পারমিটবিহীন বাসগুলোকেও নিজস্ব ব্যানারে পরিচালনার তোড়জোড় শুরু করেছে এসব পরিবহন কোম্পানি। যেমন- দুলদুল পরিবহনের ২৯টি বাসের সবগুলোর রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি বাস তারা অন্য কোম্পানির ব্যানারে পরিচালনা করছে। এসব বাস নিজেদের ব্যানারে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি অন্য রুটের ১৩টি বাসসহ মোট ৩৮টি বাস নিয়ে পুনরায় দুলদুল সার্ভিস চালু করতে তোড়জোড় করছেন মালিক। অনাবিল পরিবহনের ৫১টি বাসের মধ্যে ৪২টির রুট পারমিট নেই। তারাও নানা রুট থেকে বাস এনে এখন ৮৩টি বাস পরিচালনা করতে চাণ। এমন মালিকদের সংখ্যা ৫১ জন।

ঢাকা নগর পরিবহন প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেন, ‘এই প্রকল্পে কোনোভাবেই যখন এসব বাসমালিককে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে, তখন তারা আমাদের প্রকল্প নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি করেছেন। সমন্বিত বাস পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আসবেন না বলে এখন আরটিসি সভায় গিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে চাইছেন।’

সমাধান তবে কোথায় 
ঢাকা মহানগরীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে হলে সরকারি পরিবহনব্যবস্থা চালু করতে হবে বলে মনে করেন পরিবহন খাত বিশেষজ্ঞরা। 

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আরটিসির রুট আর ঢাকা নগর পরিবহনের রুট বিদ্যমান থাকায় এখন সংকট তৈরি হয়েছে। এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় না হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা থেকেই যাবে। একই সড়কে তো দুই ধরনের ব্যবস্থাপনা চলতে পারে না।’ 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বেসরকারি বাসমালিকদের ওপর ভরসা করে সড়ক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো যাবে না। তাদের লক্কড়ঝক্কড় বাস দিয়ে কোনো গণপরিবহনব্যবস্থা চলতে পারে না। সরকারকে এখন অন্তত চার হাজার নতুন বাস আনতে হবে। 

তিনি বলেন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত সেসব বাস সড়কে নামলে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমবে। এতে সড়কে যানজট কমবে, বাসের ট্রিপের সংখ্যা বাড়বে, আয়ও হবে বেশি। এই ব্যবস্থাটি এই সরকারকে শুরু করে দিয়ে যেতে হবে। তার পরের সরকারকে এই ব্যবস্থা চলমান রাখতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে রাজধানীতে বেসরকারি মালিকদের গাড়ি চলে না। আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা শুরু করতে না পারলে কোনো উন্নতি দেখি না। 

সিফাত/

সংকটেও ঢাকায় ‘বিলাসী সার্কিট হাউস’

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৫ এএম
সংকটেও ঢাকায় ‘বিলাসী সার্কিট হাউস’
প্রতীকি ছবি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের অনেক অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা প্রকল্প বাতিল করেছে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে হিমশিম খেলেও দেশের অর্থনৈতিক সংকটের এই দুঃসময়ে ‘ঢাকায় বিলাসী সার্কিট হাউস’ প্রকল্প বাতিল করা হয়নি।

শেখ হাসিনার অনুমোদন করা সেই প্রকল্প ‘ঢাকা জেলায় বিদ্যমান সার্কিট হাউস ভবনের স্থলে নতুন অত্যাধুনিক সার্কিট হাউস ভবন নির্মাণ’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গোসল করার জন্য পাঁচ তারকা হোটেলের মতো সুইমিংপুল তৈরি করা হবে। তাতে খরচ করা হবে ৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। শুধু তা-ই নয়, গার্ডরুম তৈরি করতেও খরচ করা হবে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এভাবে আসবাবপত্র কেনা থেকে শুরু করে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে ৩৩৪ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

এ ব্যাপারে সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তা মোকাবিলা করতে এই সরকার আগের সরকারের অনেক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী প্রকল্প বাতিল করেছে। তাই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছাড়া এ ধরনের বিলাসী প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি।’ 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করা হবে। তার এই নির্দেশনার পর ভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্পের তালিকা তৈরি শুরু করে। তার পরই ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ‘ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প, ঢাকার নবাবগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নসহ অসংখ্য প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।

কিন্তু দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক পর্যায়ে চলে গেলেও ঢাকায় সার্কিট হাউস নির্মাণের মতো বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। গত বছরের ৯ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা প্রকল্পটির অনুমোদন দেন। সম্পূর্ণ সরকারি খরচে ১৩ তলা ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য কাজে খরচ ধরা হয়েছিল ৩৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২৪-এর জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। 

সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) শুরুতেই অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অনেক শিল্প-কারখানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে যায়। ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প কার্যকর করতে যাচ্ছে। এই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশীষ কুমার সাহা গত ৫ জানুয়ারি প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছেন। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজধানীর বেইলি রোডের পুরোনো সার্কিট হাউসের জায়গায় নির্মাণ করা হবে নতুন সার্কিট হাউস ভবন। এতে থাকবে আধুনিক নানা সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ তারকা মানের হোটেলে যা যা থাকে, তার সবটাই পাওয়া যাবে এখানে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আনা সরকারি কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সাময়িক রাত্রিযাপনের জন্য ভবনটি ব্যবহৃত হবে। নতুন সার্কিট হাউসে দুটি বেজমেন্টসহ একটি ১৩ তলা এবং আরেকটি ৮ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে খরচ ধরা হয়েছে ২৩৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। 

সার্কিট হাউস ভবনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক সব পণ্য। এতে খরচ করা হবে ১৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া সুইমিংপুলও নির্মাণ করা হবে। এতে খরচ হবে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা খরচে জিমনেসিয়ামও করা হবে। অতিথিদের পাহারা দেওয়ার জন্য একটি গার্ডরুম নির্মাণে খরচ করা হবে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে প্রকল্প পরিচালকের দুটি গাড়ির জন্য খরচ করা হবে ৬০ লাখ টাকা। এ ছাড়া এসি, লিফট, বাউন্ডারি ওয়াল, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, স্যুয়ারেজ সিস্টেম, জেনারেটর এবং বিদ্যুৎবাবদ বাকি টাকা খরচ হবে। স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও (এসটিপি) নির্মাণ করা হবে। তাতে খরচ করা হবে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এভাবে সব কাজ করতে ৩৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা খরচ করা হবে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ঢাকায় আসতে হয়। তাদের সাময়িক রাত্রিযাপনের জন্য ঢাকা জেলা সার্কিট হাউসটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বিদ্যমান সার্কিট হাউসটি অনেক পুরোনো। চাহিদা অনুযায়ী স্থান-সংকুলান সম্ভব হয় না। আবার পুরোনো সার্কিট হাউসটিতে তেমন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এ ছাড়া রাষ্ট্রের ভিভিআইপি অতিথিদের রাত্রিযাপনের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত রেস্টহাউস নেই। তাই কর্মকর্তাদের ঢাকায় সাময়িক আবাসন সুবিধা বাড়ানোর জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন নতুন সার্কিট হাউস নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে তারা নিরাপদে থাকতে পারেন। এতে সরকারেরও রাজস্ব আয় বাড়বে।

সিফাত/

লুটপাটে শতকোটি টাকার মালিক খালেক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩০ এএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩১ এএম
লুটপাটে শতকোটি টাকার মালিক খালেক
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক

২০০৮ থেকে ২০২৪। ১৬ বছর। এই সময়ে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ৮৩২ গুণ। ২০০৮ সালের সিটি নির্বাচনের সময় তার কাছে নগদ টাকা ছিল মাত্র ৫৭ হাজার ৫৫০ টাকা। ২০২৩ সালে তার কাছে নগদ টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪ কোটি ৭৯ লাখ। চারটি ব্যাংকে তার জমা ছিল আরও ১ কোটি ১৮ হাজার টাকা।

জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকা অবস্থায় নিয়ম ভেঙে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়ান তিনি। খুলনার বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে থেকে অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কয়েক বছরের মধ্যেই ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাটে কৃষি-অকৃষি জমি, মৎস্যঘের, রাজউকের পূর্বাচল, কেডিএ ময়ূরী আবাসিক ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মুজগুন্নি আবাসিকে প্লটসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে তালুকদার আব্দুল খালেক ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে ওঠেন।

অভিযোগ রয়েছে, খুলনা সিটি করপোরেশনে মেয়র হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি থাকায় সবকিছু একক নিয়ন্ত্রণে ছিল তালুকদার আব্দুল খালেকের। অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার আর লুটপাটের মাধ্যমে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। 

সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২১ জানুয়ারি দুদকের খুলনার উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে অনুসন্ধান টিম গঠন করে সংস্থাটি। এর মধ্যে তালুকদার খালেক ও তার স্ত্রী হাবিবুন নাহারের আয়কর রিটার্ন, কর নির্ধারণী আদেশসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র, তার ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে পরিচিত ঠিকাদারদের তথ্য, মেয়র হয়ে রামপাল-মোংলায় যাতায়াতের জন্য কেসিসির গাড়ি ব্যবহার, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থ আত্মসাতের বিষয়েও অনুসন্ধান করছেন দুদক কর্মকর্তারা।

জানা যায়, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েও প্রায়ই তিনি ব্যক্তিগত কাজে খুলনা থেকে মোংলা ও রামপাল যেতেন। তিনি খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার ছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ২০১৮ ও ২০২৩ সালে দুটি নির্বাচনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈঠক করে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খালেক তালুকদার তার পক্ষে প্রচার চালাতে বাধ্য করেন। প্রচারকাজে ব্যয় মেটাতে প্রচুর টাকা তোলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে।

সিটি করপোরেশনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, তাজুল এন্টারপ্রাইজ ও আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে খালেক তালুকদারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকাদারি কাজের যাবতীয় তথ্য ও পরিশোধিত বিলের পরিমাণ জানতে চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ কাজ পেয়েছেন খালেকের আস্থাভাজন ঠিকাদাররা।

২০০৮ সালের নির্বাচনে তার কাছে নগদ ৫৭ হাজার ৫৫০ টাকা থাকার তথ্য দেন। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে আয় ২ লাখ ১০ হাজার, ব্যাংকের সুদ থেকে আয় ২ লাখ ১৮ হাজার, বাড়ি ভাড়া থেকে আয় ১ লাখ ৯১ হাজার, সঞ্চয়পত্র থেকে আয় ৬ লাখ ৮২ হাজার, ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ১৮ লাখ টাকার পোস্টাল এফডিআর। তার দুটি গাড়ি, ২৩ বিঘা কৃষিজমি, তিন কাঠা অনাবাদি জমি আছে। জমিসহ নগরীর কাস্টমঘাটের একটি বাড়ির অর্ধেকের মালিক তিনি, যার দাম ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। 

৫ আগস্টের পর থেকে তালুকদার খালেক আত্মগোপনে রয়েছেন। দুর্বৃত্তরা তার বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছে। বর্তমানে তিনি কোথায় তা কেউ জানে না। কাস্টমঘাটের বাড়ি দখল, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হলফনামা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে খালেকের নগদ টাকা ছিল ৪ কোটি ৭৯ লাখ। চারটি ব্যাংকে জমা ছিল ১ কোটি ১৮ হাজার টাকা। তবে এই টাকা তিনি কীভাবে আয় করেছেন পলাতক থাকায় তার কাছ থেকে জানা যায়নি। 

সচেতন নাগরিকদের সংগঠন খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, বিগত সরকারের সময় যে বা যারা কালোটাকার মালিক হয়েছে, দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে। সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী হাবিবুন নাহারসহ তাদের সহযোগীদের দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে দুদক যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে নাগরিক সংগঠন স্বাগত জানায়। একইভাবে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি তালুকদার খালেক কীভাবে ঠিকাদারি সিন্ডিকেটে জড়িত হলেন এবং তার সহযোগী আরও যারা এভাবে আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, প্রত্যেকের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।

দুদকের খুলনার উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ খবরের কাগজকে জানান, সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। তার ও সহযোগীদের আর্থিক সংশ্লিষ্টতার তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি দেওয়া হয়েছে।

রাজশাহীতে বিদ্যালয় ঘেঁষে ইটভাটা, শ্বাসকষ্টে ভুগছে শিক্ষার্থীরা

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২০ এএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২২ এএম
রাজশাহীতে বিদ্যালয় ঘেঁষে ইটভাটা, শ্বাসকষ্টে ভুগছে শিক্ষার্থীরা
গোদাগাড়ী কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁষেই ইটভাটার কালো ধোঁয়া উড়ে আসছে। ছবি : খবরের কাগজ

রাজশাহীর গোদাগাড়ী কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একতলা ভবনটি ছিমছাম, পরিপাটি। শুধু তাই নয়, এর সীমানাপ্রাচীর থেকে শ্রেণিকক্ষ- সব স্থানেই নান্দনিকতার ছাপ রাখা হয়েছে। শিশুদের বিনোদনের মাধ্যমে পড়ালেখা শেখার সব আয়োজন রয়েছে। ক্লাসরুমের দেয়ালে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন চিত্র। লাল ইটের প্রাচীরঘেরা বিদ্যালয়ের ভেতরে সুবজ খেলার মাঠ। রয়েছে দোলনাসহ খেলাধুলার নানা উপকরণ। চত্বরে লাগানো হয়েছে নানা ধরনের ফল-ফুলের গাছ। অথচ শিশুপার্কের মতো সুন্দর এই বিদ্যালয়টির পেছনের সীমানা ঘেঁষেই দাউ দাউ করে জ্বলছে ইটভাটার আগুন। আর সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে সড়কে চলছে ইট ও মাটির ট্রাক। এ ছাড়া ইট ও মাটি রাখা হচ্ছে বিদ্যালয়টির দেয়াল ঘেঁষেই। এতে ভাটায় ইট পোড়ানোর কালো ধোঁয়া আর উড়ে আসা ধুলাবালি বিদ্যালয় ভবনে ঢুকে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। পাশাপাশি জীবনের প্রথম পাঠের স্থানে এসে দিন দিন শ্বাসকষ্টসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে কোমলমতি শিশুরা।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) ২০১৯ অনুযায়ী, বিশেষ কোনো স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেলপথ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। অথচ সেই আইন না মেনে কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পেছনে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে পশ্চিম পাশে মেসার্স এম এস ব্রিকস্ নামে একটি ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে ইট। আবার প্রায় সমান দূরত্বে উত্তর পাশেও রয়েছে মুন হাওয়া ব্রিকস নামে অপর একটি ভাটা। সব মিলিয়ে এ বিদ্যালয়কে মাঝখানে রেখে দুটি ভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে ইট। 

প্রাথমিক বিদ্যালয়টির শিক্ষকরা জানান, ইটভাটার দূষণ থেকে পরিবেশ রক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক বিবেচনা করে ভাটার বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে। তবে সেখান থেকে এখনো কোনো প্রতিকার মেলেনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, ২০০০ সালে স্থাপিত গোদাগাড়ীর কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাটায় দিনে-রাতে সমানতালে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ভাটার কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালি থেকে বাঁচতে বিদ্যালয়ের চারটি শ্রেণিকক্ষেই জানালা বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন শিক্ষকরা। আবার ক্লাস শেষ হলেই শিশুরা বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলায় মেতে উঠছে। ফলে দিন দিন শিক্ষার্থীরা শ্বাসকষ্টসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে অসুস্থ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইট পোড়ানোর চুল্লির ধোঁয়া, ইট কাটার মাঠের (ফরাস) ধুলা এবং মালামাল আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত ট্রলি গাড়ির শব্দে ভারী হয়ে ওঠে স্কুল কম্পাউন্ডের পরিবেশ। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী হুমাইরা আফরিন বলেন, ‘ভাটার কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালির কারণে আমাদের বিদ্যালয়ের জানালাগুলো সব সময় বন্ধ রাখা হয়। এতে আলো-বাতাস না পেয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আবার, জানালা খুললে চোখ মেলে চলাফেরা করা যায় না। কালো ধোঁয়া এসে শ্রেণিকক্ষে গন্ধ ছড়ায়। বেঞ্চে কালি হয়ে যায়। আমরা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছি।’ 

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ বলেন, ‘স্কুলের পাশে ভাটা থাকায় বাতাসে ধুলাবালি ও কালো ধোঁয়া আমাদের নাক-মুখে ঢুকে যাচ্ছে। এতে অনেকের হাঁচি-কাশিসহ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।’ 

স্কুলের শিক্ষিকা কামরুন নেসা বলেন, ‘স্কুলটি প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় এখানকার প্রায় সব শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। তারা এখানে পড়ালেখা করতে এসে ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আবার অর্থের অভাবে তাদের চিকিৎসা নিতেও কষ্ট হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে দ্রুত সমাধান হওয়া জরুরি।’ 

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ইমাম হোসেন বলেন, ‘ভাটাগুলো একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে। অন্যদিকে স্কুলের কোমলমতি শিশুদের জন্য অত্যন্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। শুধু তাই নয়, স্কুল এক-দুই দিন বন্ধ থাকার পর খুললেই চেয়ার-টেবিলসহ সব আসবাবপত্র ধুলাবালি ও কালির আস্তরণে পরিত্যক্ত ভবনের মতো হয়ে যায়। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বারবার আবেদন জানিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি।’ 

এ বিষয়ে মুন হাওয়া ব্রিকস নামে ভাটার মালিক মো. আফজাল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে মেসার্স এমএস ব্রিকসের মালিক ওবাইদুল্লাহ দাবি করে বলেন, ‘ভাটা স্থাপনের পর স্কুলটি নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন)-২০১৯ এর ব্যত্যয় ঘটেনি।’ তবে ভাটা কত সালে নির্মাণ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোনটি কেটে দেন। পরে আবারও কল করা হলে তিনি আর ফোন ধরেননি। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবুল হায়াতকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল ধরেননি। এতে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

তবে রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ওই দুটি ভাটা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ভাটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই দুটির বিষয়েও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’