ঢাকা ৫ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

ওষুধ কেনার চাপে মধ্যবিত্ত

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১২ পিএম
আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৩ পিএম
ওষুধ কেনার চাপে মধ্যবিত্ত
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

রাজধানীর টিকাটুলী এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম (ছদ্মনাম)। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। বছর পাঁচেক আগে দেখা দেয় কিডনির সমস্যাও। ২০২৪ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া কোমরে ব্যথা যেন তার জীবনে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেয়! কারণ আগের তিন রোগের ওষুধ কিনে খাওয়াই তার জন্য কষ্টকর ছিল। এর মধ্যেই কিডনি ও কোমর ব্যথার ওষুধ যোগ হওয়ায় তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। 

আব্দুর রহিম জানান, প্রতিদিন দুই বেলা করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও গ্যাসের ওষুধ এবং এক বেলা কিডনির সমস্যার ওষুধ খেতে হচ্ছে তাকে। দুই মাস আগে থেকে কোমরে সমস্যা শুরু হওয়ায় নতুন করে ওষুধ খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে এখন প্রতি মাসে সাড়ে ৭ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এ ছাড়া আমার স্ত্রীও ডায়াবেটিস-উচ্চ রক্তচাপের রোগী। তারও নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার খরচ কমপক্ষে আরও ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা।’

‘অথচ ছোটখাটো ব্যবসা করে চলা মাসিক আয় ৫০-৬০ হাজার টাকার বেশি নয়। আয়ের চার ভাগের এক ভাগই ওষুধ কিনতে চলে গেলে বাসা ভাড়া, সংসার ও ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ কীভাবে মিটবে’ প্রশ্ন তুলে যোগ করেন রহিম।

ওষুধ কিনতে গিয়ে এমন হিমশিম অবস্থা শুধু রহিমের একার নয়; ধানমন্ডির রিয়াজউদ্দিন, আদাবরের এনামুল হকসহ আরও অনেক মধ্যবিত্তেরই প্রায় একই কাহিনি। মাসের ওষুধ কিনতেই তাদের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায়। ভেজাল খাদ্য আর দূষণের কারণে শুধু শহরে নয়; গ্রামাঞ্চলেও এখন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে কমন বিষয়। এ কারণে শহরের সঙ্গে গ্রামেও এখন হু হু করে বাড়ছে ফার্মেসির সংখ্যা।

ঔষধ প্রশাসনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত ওষুধের ফার্মেসি ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৯টি। ২০২০-২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও একই সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। ২০২১-২২ সালে ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৫২৮টি। ২০২২-২৩ সালে ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৯১টি। 

আর্থসামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী শ্রেণির বাসিন্দাদের অর্থনীতির পরিভাষায় মধ্যবিত্ত বলা হয়। বিশ্বব্যাংক এবং অর্গানাইজ়েশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) রিপোর্ট অনুযায়ী, মাসে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আয় করা মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পড়বেন। অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ’ বলেছে, দিনে ১০ থেকে ৫০ ডলার আয় করলে তাকে মধ্যবিত্ত বলতে হবে।

ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১১তম। বর্তমানে ওই তালিকার ২৮তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশগুলোকে বাদ দিলে আগামী দশকে অন্য জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে মধ্যবিত্ত বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষ তিনে থাকবে বাংলাদেশ। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতাভুক্ত। শ্রেণিটির বিকাশের মাধ্যমে দেশের সেবা খাতের চাহিদা ও ভোক্তার সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে সম্প্রসারিত হবে অর্থনীতির ক্ষেত্র।

মোহাম্মদপুর, আদাবর, সাতমসজিদ রোড ও শ্যামলী এলাকার অন্তত ১০টি ফার্মেসির বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চারটি কমন রোগের ওষুধ কেনার জন্য তাদের নিয়মিত কাস্টমার রয়েছে; যাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত। আদাবরের ওষুধ বিক্রেতা মাহবুবের মতে, চারটি রোগের ওষুধের চাহিদা নিয়মিত পূরণ করা এখন প্রায়ই কঠিন হয়ে ওঠে। অনেকে অগ্রিম বলে গেলেও কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিদের সেগুলো সরবরাহ করতে সময় লাগে। তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা নিজেরাই বলাবলি করেন যে বাজার খরচের তুলনায় ওষুধ কেনার খরচ বেশি লাগে।’

প্রতিটি পরিবারেই নিত্যপণ্যের মতো প্রতি মাসে কমবেশি এখন ওষুধ কিনতে হয়। মাসে ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৭-৮ হাজার, এমনকি ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অনেক পরিবারে শুধু ওষুধ কিনতেই খরচ হয়। কেননা রোগব্যাধি এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) এক হিসাবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ রোগী চিহ্নিত করা হয়েছে। মধ্যবিত্তের অনেককে বাজার খরচ কমিয়ে এখন ওষুধে খরচ করতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব বলছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ের অংশ প্রতিবছরই কমছে। বিপরীতে ব্যক্তির পকেটের খরচ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করছে ব্যক্তি নিজেই।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য খাতে সরকার ব্যয় করেছে যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে। আবার ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। তবে এই ধারা শুধু তিন বছরের নয়, দুই দশকের বেশি সময়ের। গত ১০ বছরে ওষুধের দামও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। 

জুরাইন এলাকার মর্জিনা বেগমের ছেলে আতিক জানান, তার মা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ না খেলে কোনো খাবারই খেতে পারেন না। পেট ফুলে থাকে। সে জন্য ডাক্তার দুটি ওষুধ দিয়েছেন, যা খেয়ে দীর্ঘদিন তিনি ভালো ছিলেন। এরপর ওষুধের খরচ কমাতে প্রতিদিনের জায়গায় এক দিন পরপর খাওয়া শুরু করেন। পরে একসময় খাওয়া বন্ধ করে দেন। আবার সমস্যা দেখা দিলে সেই ওষুধ আবার খাওয়া শুরু করেন।

আবার যারা একসময় সরকারি হাসপাতালে যেতেন না। তারা এখন খরচ কিছুটা কমানোর জন্য সরকারি হাসপাতালে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসক দেখানোর চেষ্টা করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘যদিও সরকারি হাসপাতালে অনেক ভিড় থাকে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেখাতে গেলে যে টাকা ভিজিট দিতে হবে, সেই টাকায় কিছু ওষুধ কেনা যায়। সেই চিন্তা করে এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাই।’ 

বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি চারজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (২৩.৫%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। ডব্লিউএইচওর ২০২৩ সালে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেছে, যার ৫৪ শতাংশের (৫১% পুরুষ, ৫৮% নারী) জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপ। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি), ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কিডনির কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২০২৩ সালে প্রকাশিত ডায়াবেটিস চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকায় দেওয়া তথ্যমতে, দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ।

ওষুধের চাহিদা থাকায় প্রতিবছরই দেশে অন্তত ১৫ হাজার করে ফার্মেসি বাড়ছে 
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, টিকাটুলী এলাকার বেশ কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে জানা গেছে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কিডনিজনিত রোগের ওষুধের নিয়মিত ক্রেতা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। জুরাইন এলাকার এক ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, প্রতি প্রেসক্রিপশনেই গ্যাস্ট্রিকের কোনো না কোনো ওষুধ থাকে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, অনেকের আগে থেকেই গ্যাসের সমস্যা থাকে, সে জন্য চিকিৎসক গ্যাসের ওষুধ লিখে থাকেন। এ ছাড়া রোগী মূলত যে রোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান, সেই রোগের ওষুধ খেলে রোগীর গ্যাস হতে পারে, সে জন্য গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ লিখে থাকেন। এ ছাড়া অধিকাংশ মানুষ গ্যাসের একটু সমস্যা বুঝলে নিজের মতো করে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ কিনে খান।

তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইএমএস হেলথের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে বিক্রির শীর্ষে থাকা ১০টি ওষুধের মধ্যে পাঁচটি গ্যাসের ওষুধ। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ওষুধ হচ্ছে সার্জেল, ৯১৮ কোটি টাকা; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ম্যাক্সপ্রো, ৪৮৬ কোটি টাকা; তৃতীয় সর্বোচ্চ প্যান্টোনিক্স, ৩৭৬ কোটি টাকা; চতুর্থ সর্বোচ্চ নাপা, ৩৩৮ কোটি টাকা। সেফ-থ্রি, মোনাস, এক্সিয়াম, সেক্লো ও বিজোরানের বার্ষিক বিক্রি ২০০ কোটি টাকার বেশি। দেশে বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি ৩১ জেনেরিক ওষুধ ও ৫০ কোটি টাকার ওপরে ৭৯ জেনেরিক ওষুধ বিক্রি হয়েছে ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ ওষুধ ব্যবহার করি, পৃথিবীর অন্য দেশে এত ওষুধ ব্যবহার করে না। আমাদের দেশে রোগব্যাধি বেশি। সবারই গ্যাস্ট্রিক আছে। এর বাইরে ওষুধ ইজি অ্যাকসেস হওয়ায় নিজেরা প্রেসক্রিপশন ছাড়া কিনি। প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোর জন্য যদি খরচ বেশি হয়, তাহলে তা এড়ানোর সুযোগ নেই। ওষুধের দাম বাড়বে। এক জায়গায় স্থির থাকবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘দাম কমাতে হলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। কিন্তু তা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। তাহলে কী করতে হবে? ভারতের মতো ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি নামের একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। যারা সব ওষুধের দাম নির্ধারণ ও মনিটর করবে। প্রতি দুই বছর পর এই অথরিটি ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করবে, এতে হবে কী? দাম নিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়বে। বর্তমানে আমাদের যে সংস্থা আছে, ঔষধ প্রশাসন, তাদেই সেই শক্তি-সামর্থ্য নেই।’

গত ৬ জানুয়ারি সরকার মালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী মতবিনিময় সভা করেন। এ সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যান হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। এটা সরকারের কমিটমেন্ট। এটা গ্লোবাল কমিটমেন্ট। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার প্রধান উপাদান হচ্ছে মেডিসিন কাভারেজ। ৬৭ থেকে ৭০ শতাংশ আউট অব পকেট ব্যয় হচ্ছে ওষুধ ব্যয়। এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড ভালোভাবে প্রোডাক্ট তৈরি ও অব্যাহতভাবে ওষুধ সরবরাহ করতে পারলে বাংলাদেশের পুরো মার্কেটের ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তিত হয়ে যাবে।’

১০ মাসেও শেষ হয়নি তদন্ত, ভবন নির্মাণে চরম অনিয়ম

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২১ এএম
আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২২ এএম
১০ মাসেও শেষ হয়নি তদন্ত, ভবন নির্মাণে চরম অনিয়ম
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের করুণ মৃত্যুর ঘটনায় এখনো শেষ হয়নি তদন্ত। এতগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও টনক নড়েনি ঘটনার জন্য দায়ী থাকা সংশ্লিষ্টদের। ভয়ানক এ ট্র্যাজেডির পর জড়িতরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ প্রিয়জন হারানো স্বজনেরা।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেইলি রোডের ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। তবে প্রাথমিকভাবে এ অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার জন্য ভবনের কাঠামোগত ত্রুটিকে দায়ী করেছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ভবন নির্মাণে অগ্নিনিরাপত্তার প্রশ্নে প্রচলিত নিয়মনীতির ৯৫ শতাংশই ব্যত্যয় ঘটানো হয়। 

এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ) মো. আনিচুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘৪৬ জন মানুষের জীবন গেছে, এটি একটি বড় ঘটনা। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনায় আগে কোনো মামলা হয়নি। এ ধরনের মামলা আমাদের জন্য নতুন। যেমন- পুরান ঢাকার নিমতলীর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তাই আমরা চাচ্ছি না কোনো ভুলত্রুটি নিয়ে সামনে এগোই। তদন্তে তাড়াহুড়ো করছি না, আবার যাতে কোনো গাফিলতি না হয় যেদিকেও সতর্ক রয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা হওয়ায় বেশ কয়েকটি সংস্থা এ বিষয়ে তদন্ত করছে। সবার রিপোর্ট এখনো আমরা হাতে পাইনি। তবে আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ হবে। আমরা একটি বস্তুনিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও নির্ভুল তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারব।’

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিনিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়ে নানা তথ্য উঠে এসেছে। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য রাজউক ভবনের নকশা অনুমোদন করলেও এতে রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমতি ছিল না। কিন্তু ভবনের বেজমেন্ট (গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান) ছাড়া সব কয়টি ফ্লোরে ছিল রেস্তোরাঁ। এ কারণে ভবনে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সে অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়নি। পুরো ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে, সিঁড়িতে একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছিল। ভবনে সিঁড়িও ছিল মাত্র একটি। এমনকি বিভিন্ন রেস্তোরাঁর ক্যাশ কাউন্টারের পাশেও রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। ভবনের নিচতলার ‘চুমুক’ নামের চা-কফির দোকানের ইলেকট্রিক চুলায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শর্টসার্কিট) থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডারের লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি না থাকায় মানুষ চেষ্টা করেও বের হতে পারেননি।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান ও সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সেবা সংস্থাগুলোর গাফিলতি রয়েছে। ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাগুলো অনুমোদিত নকশা যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি। ভবন ব্যবহারের সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণসংক্রান্ত নির্দেশনাও মানেননি সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বহুতল ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার জন্য ফায়ার সার্ভিসের সনদও ছিল না। এই ভবনে অগ্নিনিরাপত্তামূলক ৯৫ শতাংশ নিয়ম মানা হয়নি। 

তিনি বলেন, ‘চুমুক’ নামের চা-কফির দোকানের পুরোনো কেতলি বিস্ফোরণ হয়ে প্রথমে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। রেস্তোরাঁগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ফলে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ভবনের ছাদ বন্ধ থাকায় প্রাণহানি হয়েছে বেশি। তিনি আরও বলেন, দেশে তিন লাখেরও বেশি রেস্তোরাঁ ব্যবসা রয়েছে। এই খাতকে নিরাপদ রাখতে অবশ্যই নিয়ম মানতে হবে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে দুর্ঘটনা বাড়বে। নিয়ম মানলে দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে।

সম্প্রতি বেইলি রোডের সেই ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটি অনেকটা কঙ্কালসার অবস্থায় রয়েছে। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, আগুনের লেলিহান শিখায় প্রতিটি দোকানের আসবাবপত্র পুড়ে কয়লা অবস্থায় পড়ে আছে। পুড়ে যাওয়া কাচ ও আসবাবের টুকরো পুড়ে কয়লা হয়ে পড়ে ছিল মেঝেতে। এখনো পুলিশি ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে ভবনটিকে। শুরু হয়নি ভবনটির সংস্কারকাজ। তবে বেইলি রোডে কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায় আগের মতোই। খোলা ছিল বেশির ভাগ শপিংমল ও শোরুম। এমনকি পিঠাঘর ও নানা রেস্তোরাঁয় রান্না ও খাবারের পসরা ছিল জমকালো। ফুটপাতেও বসেছিল ফুচকা, চটপটি, মুড়ি মাখানোর দোকান। 

সরেজমিন সেখানে গেলে কথা হয় পুড়ে যাওয়া ভবনের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার মোশাররফের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাঝেমধ্যে তদন্তের কাজে ভবন দেখতে পুলিশ আসে। তারা জানিয়েছে, তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। শুনেছি শিগগিরই ভবনের সংস্কারকাজ শুরু হবে।’ তিনি বলেন, অনেক দিন হয়ে গেল, এটার কোনো সুরাহা হয়নি। 

অন্যদিকে নিহতের স্বজনরা এবং প্রাণে বেঁচে ফেরা অনেকেই দাবি করছেন এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং একধরনের হত্যাকাণ্ড। ঘটনার ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের স্পষ্ট কারণ ও দায়ী কারা সেসব জানতে পারেননি নিহতদের স্বজনরা। ঘটনার জন্য দোষীদের বিরুদ্ধেও তেমন কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও তদন্তসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে বিষয়টিকে সাধারণ দুর্ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা। তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ করে তদন্ত প্রতিবেদন নিজেদের সুবিধামতো করার পাঁয়তারা করে যাচ্ছে বলেও একাধিক ভুক্তভোগী পরিবার অভিযোগ করে।

এ প্রসঙ্গে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত বৃষ্টি খাতুনের (অভিশ্রুতি শাস্ত্রী) বাবা শাবলুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বৃষ্টি আমার প্রথম সন্তান। রাতে ঘুমাতে পারি না, সারাক্ষণ সন্তানের মুখটা চোখে ভাসে। সন্তান হারানোর ব্যথা কজন বোঝে। চোখের জলে বুক ভেসে যায়। কেউ খবর নেয় না। প্রায় এক বছর হয়ে গেল, আগুন লাগার কারণ জানা গেল না। এটি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এটি হত্যাকাণ্ডও হতে পারে। ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তদন্ত পিছিয়ে যাচ্ছে।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে শাবলুল আলম বলেন, ‘আমার মেয়ের লাশ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি ছাড়ানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল আমার মেয়ের নাম অভিশ্রুতি, সে হিন্দু। আমি নাকি তার বাবা না। টাকা পাওয়ার জন্য বাবা সেজেছি। যাহোক, এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’ 

বেইলি রোডে এই বহুতল ভবনে সন্তানসহ আটকে পড়েছিলেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘১০ মাস শেষ হয়েছে, এখনো তদন্ত প্রতিবেদন হয়নি। এত বড় ঘটনা, এত মানুষের জীবন গেলেও এখন মনে হচ্ছে এটি সামান্য ছিল। এটাকে আমি গাফিলতিই বলব।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি সমস্যা হচ্ছে কোনো কিছু ঘটলে ঘটনার পর পরই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। পরে আমরা তা ভুলে যাই। আমার সন্তানরা এখনো ওই ভবনের সামনে দিয়ে গেলে তাদের গা শিউরে ওঠে, আতঙ্কিত হয়।’ তিনি বলেন, নিয়ম না মেনে যারা ভবন করেছে, অগ্নিনিরাপত্তার সার্টিফিকেট নেয়নি, রেস্তোরাঁ চালিয়েছে, জরুরি নির্গমন পথ বন্ধ করে করে যারা সিঁড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার রেখেছে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। এ ছাড়া সরকারি যেসব সংস্থার এসব দেখভালের দায়িত্ব ছিল তারাও তা করেননি, এদেরও বিচার হওয়া উচিত।’ 

প্রসঙ্গত, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে রমনা থানায় মামলা করা হয়। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি ২৭ মার্চ প্রতিবেদন জমা দেয়। তা ছাড়া প্রতিবেদন দিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি এবং তিতাসের কমিটিও।

শরীরে গুলি নিয়ে কষ্টে না.গঞ্জের মাইনুদ্দিন

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:০১ এএম
আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:০১ এএম
শরীরে গুলি নিয়ে কষ্টে না.গঞ্জের মাইনুদ্দিন
মো. মাইনুদ্দিন

চিকিৎসকরা দুই দফায় তার শরীরে অস্ত্রোপচার করেছেন। ২০টি গুলি বের করা হয়েছে। এখনো তার শরীরে ২৫০টির বেশি গুলিবিদ্ধ রয়েছে। মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত গুলির আঘাত। দিন কোনো রকমে পার করেন। কিন্তু রাত ভীষণ কষ্টে কাটে মো. মাইনুদ্দিনের (৪৫)। চোখে ও মাথায় ছররা গুলি নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরান তিনি। 

নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সানারপাড় এলাকার বাসিন্দা মাইনুদ্দিন। বাবা রুহুল আমিন (৮০)। মা ফিরোজা বেগম (৭০)। দুই বোন বিবাহিত। কয়েক বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে তার। এরপর থেকে মা-বাবাকে নিয়েই তার সংসার। 

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য মাইনুদ্দিনের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। নয়তো হারাতে পারেন দৃষ্টিশক্তি।

মাইনুদ্দিন এখন আছেন নিদারুণ অর্থকষ্টে। অসুস্থ হওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু সেই উদ্যোগ নেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য তার পরিবারের নেই। 

মাইনুদ্দিন বলেন, ‘আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। তবুও সেদিন ঘরে থাকতে পারিনি। গত ৫ আগস্ট সকালে বাবা-মার চোখের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হই। সঙ্গে ছিল বন্ধু হিজবুল্লাহ। মৌচাকের কাছাকাছি এসে একটা মিছিলের সঙ্গে মিশে যাই। সেখানে প্রায় হাজারখানেক মানুষ। একবারের জন্যও মনে হয়নি আমি তাদের চিনি না। মনে হয়েছে, ভাই ভাই আমরা, প্রত্যেকটি মানুষকে চিনি। 

মাইনুদ্দিনের ভাষ্য, শনিরআখড়ার ঢালে যাওয়ার পর যা দেখি তাতে শরীরের রক্ত গরম হয়ে যায়। একের পর এক রক্তাক্ত লাশ নিয়ে মানুষ হাসপাতালে যাচ্ছেন। যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজার কাছে যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের মিছিল আটকে দেয়। এর মধ্যে একজন পুলিশ হ্যান্ডমাইকে আমাদের ডাকেন। বুঝলাম কথা বলার জন্য ডাকছে। ভয়ে কেউ যাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। ভাবলাম কি বলবে শুনি, না গেলে যদি গুলি শুরু করে, তাহলে সবাই মারা যাব। মিছিলের ভাইদের কথা ভেবে পুলিশের দিকে হাঁটা শুরু করি। আমাকে দেখে সাদা টিশার্ট পরা একটা স্কুলপড়ুয়া ছেলে আমাকে বলে, ভাইয়া আমিও আপনার সঙ্গে যাব। বললাম, গেলে তো গুলি খেতে পার! ছেলেটা বলল, ‘গুলি খাওয়ার জন্যই তো এসেছি।’ সে আমার পেছন পেছন আসে। ৮-১০ ফুটের দূরত্বে যখন পৌঁছে যাই, তখন পুলিশদের মধ্যে একজন বলেন, গুলি কর। সত্যিই পুলিশ গুলি করে। গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে আমি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাই। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে দেখি পুরো শরীরের রক্তে শার্ট ভিজে গেছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।

পুলিশদের তখন বলেছিলাম, ‘তোদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম। ধোঁকা দিয়ে গুলি করেছিস, তোদের পতন নিশ্চিত।’ এটা বলে পিছনে ফিরে যেতেই আরেকটা ধাক্কা খেলাম। দেখি, ১০০ গজ দূরে সাদা টিশার্ট পরা ছেলেটা মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ওরে শটগানের গুলি করা হয়েছিল। আমি ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার রক্তবমি শুরু হয়। আমি আর সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। পরে কয়েকজন আমাকে ধরে ভ্যানে উঠিয়ে ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরিস্থিতি গুরুতর হলে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। 

আহত মাইনুদ্দিন বলেন, ‘হাসপাতালে থাকা অবস্থায় একজন ডাক্তার বললেন, ‘আপনার রক্ত দেওয়া স্বার্থক, ফ্যাসিবাদ ভাগছে। মুহূর্তেই সব ব্যথা ভুলে যাই, অদ্ভুত এক স্বস্তি কাজ করে।’ এর মধ্যে বাবা আমার গুলি লেগেছে শুনে হার্ট অ্যাটাক করেন। তিনি এখন সুস্থ আছেন।

গুলশানের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন মাইনুদ্দিন। ৫ আগস্টের পর হারিয়েছেন তার চাকরি। বিষয়টি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাকরির দায়িত্বের জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শুরু থেকে আন্দোলনে যেতে পারিনি। কিন্তু ৪ আগস্ট আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলাম না। অফিস থেকে দুপুরের খাবারের আগে ছুটি চাইলাম। প্রথমে তারা ছুটি দিতে চায়নি। পরে অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছি বলে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে ছুটি দেয়। আমি শাহবাগ অবস্থান থেকে আন্দোলনে যুক্ত হই। আমার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। সাধারণ জনতার সঙ্গে মিলে আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু আহত হওয়ার পর থেকে আর চাকরি করার অবস্থায় ছিলাম না। চাকরি নেই। এখন বাসায় বেকার আছি। পুরোপুরি সুস্থ হলে যদি কোনো চাকরি হয় আরকি, সেই আশায় আছি। জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পাওয়ার কথা জানান তিনি। 

মাইনুদ্দিনের মা ফিরোজা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার পোলায় মৃত্যুকে জয় করে আমাগো কাছে ফিরেছে। চিকিৎসার অভাবে ছেলে এখন রাইতে ছটফট করে ব্যথায়। বুড়া বয়সে ওরে এখন আমাগো খেয়াল রাখতে হয়। আমার পোলাডার চাকরি গেছে গা, ওর শরীরের এই অবস্থা! আমাগো কি হইব আল্লাহ জানেন!’

ব্যাটারিচালিত রিকশার আইনি সমাধানে ধীরগতি!

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:২০ এএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৭ পিএম
ব্যাটারিচালিত রিকশার আইনি সমাধানে ধীরগতি!
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

‘দইয়ের হাঁড়িতে দই থাক, ঘিয়ের হাঁড়িতে ঘি’। ঢাকা মহানগরের সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা (ব্যাটারিচালিত রিকশা) চলবে কি না প্রশ্নের যেন এই সমাধান। অর্থাৎ ব্যাটারিচালিত রিকশা যেভাবে চলে আসছে চলুক, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও রিকশার (প্যাডেলচালিত) মালিক বা চালকদের মুখোমুখি করে দেওয়ার দরকার নেই। কারণ এসব নিয়ে যেকোনো পক্ষের আন্দোলন আবার সরকারকেই মোকাবিলা করতে হয়।

প্যাডেলচালিত রিকশার আইনি অনুমোদন থাকলেও ব্যাটারিচালিত রিকশার তা নেই। তবে মেট্রোরেলের শহরে দ্রুতগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার চাহিদাও আছে, আবার আছে ঝুঁকিও। যদিও আইনিগতভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে পারবে কি না, সেই সমাধান এখনই আসছে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার পর এককথায় বলা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশার আইনি সমাধান চলছে ধীরগতিতে!

ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ বা চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের ওই নির্দেশের ওপর এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে এ-সংক্রান্ত রুল হাইকোর্টে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের আদেশটি স্থগিত চেয়ে সরকারপক্ষের করা এক আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর চেম্বার আদালত ওই আদেশ দেন। ঢাকা মহানগরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপে নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন রিকশা মালিক জোটের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. মোমিন আলী রিটটি করেন। আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এইচ এম সানজিদ সিদ্দিকী। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী তাহসিনা তাসনিম।

জানতে চাইলে আইনজীবী এইচ এম সানজিদ সিদ্দিকী দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘রুল শুনানির জন্য হাইকোর্টের একই বেঞ্চে আবেদন করেছি। আশা করছি, চূড়ান্ত শুনানির জন্য আদালত আগামী সপ্তাহে দিন ধার্য করবেন।’

গত ২৫ নভেম্বর এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। এরপর দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে মো. মোমিন আলী বলেন, ‘আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থা ছিল এক মাসের জন্য। ওই সময় পেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে আমরা ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আবেদন নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে গিয়েছিলাম। পুলিশ প্রশাসন, ট্রাফিক পুলিশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ও সিটি করপোরেশনসহ আমাদের মামলার ১২ বিবাদীর সবার কাছে গিয়েছি। কিন্তু আসলে কেউই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে আগে যে চাঁদাবাজি ছিল, এখনো তা আছে, তাই চাঁদাবাজরাও চায় না যে এটা বন্ধ হোক। তারা বরং ব্যাটারিচালিত রিকশার পক্ষে আন্দোলনে নামে। প্রশাসনও আন্দোলনের করণে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সিইওর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলছেন, আমরা তো আছি আসলে অস্থায়ীভাবে (নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই)। এসব ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে মিছিল-মিটিং হয়। সেসব সামাল দেওয়া যায় না। ডিএমপির ট্রাফিকের প্রধানের কাছে গেলাম। তিনিও বলছেন, আদালত থেকে আইনি বিষয় আগে শেষ হোক। পরে দেখি কী করা যায়।’

ব্যাটারিচালিত রিকশা প্যাডেল রিকশার চেয়ে দ্রুতগতিতে চলে, ভাড়া তুলনামূলক কম। অনেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা এড়িয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ওঠেন। এটা পরিবেশবান্ধব- এসব ইতিবাচক দিকের কথাও অনেকে বলেন। এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে মো. মোমিন আলী বলেন, ‘প্রতিক্রিয়া-মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকবেই।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কি সিটি করপোরেশনের একার কাজ? যা করার সবাই মিলে করতে হবে।’

সিটি করপোরেশন ‘সবাই’কে আহ্বান জানিয়েছে কি না বা অংশীজনের কেউ সিটি করপোরেশনকে আহ্বান জানিয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এখন রুটিন দায়িত্ব পালন করছি। কয়েক দিন হয় মাত্র এই দায়িত্বে এসেছি। এটা আমার অতিরিক্ত দায়িত্ব। এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না ঠিক বলতে পারছি না।’

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার বলেন, ‘এটি চলুক তা আমরাও চাই না। তবে আমরা খুব ধীরে পদক্ষেপ নিচ্ছি। বড় অ্যাকশন নিলে তারা আবার আন্দোলন করেন। আমরা যেখানে এই রিকশার ব্যাটারি উৎপাদন বা মজুত হয়, সেখানে অভিযান চালাব। সব পদক্ষেপই কিন্তু বুঝেশুনে নেব। তবে এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’

ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাপারে ইতিবাচক কথাবার্তাও আছে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘ঝুঁকি এবং ইতিবাচক দিক ভেবে এটি চলবে কি চলবে না সে সিদ্ধান্ত নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে আসবে। আমরা কেবল বিদ্যমান আইনে যা আছে তা কার্যকর করব। পরবর্তী সময়ে আইন পরিবর্তন হলে তখন সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের বিদ্যমান আইনেই চলতে হবে।’

সারা দেশের প্রধান সড়ক এবং ফ্লাইওভারগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। গত ২১ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. বাহাউদ্দিন আল ইমরান জনস্বার্থে এ নোটিশ পাঠান। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে এই নোটিশ পাঠানো হয়।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের ফলে সড়কের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু-হতাহতের মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। এ বিষয়ে সরকার-সংশ্লিষ্টদের একটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে নোটিশের কোনো জবাব বা কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। আমরা আর কিছুদিন অপেক্ষা করব। এরপরও সরকার থেকে কোনো সদুত্তর না পেলে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হব।’

নৈতিকতা এখন মূল্যহীন

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২৯ এএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২৪ পিএম
নৈতিকতা এখন মূল্যহীন
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফিকস

দেশে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা বা গুরুত্ব এখন নেই বললেই চলে। উপরন্তু যারা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেন তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। যে গুটিকয়েক মানুষের সৎভাবে চলার আগ্রহ রয়েছে, নৈতিকতাহীন লোকের আধিক্যের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাও ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। বলা হচ্ছে, সমাজে সবচেয়ে বেশি আয় করা ছেলেকে মা-ও বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু ওই মা কখনো আয়ের উৎস জানতে চান না। পাশাপাশি শিক্ষিত ও মূল্যবোধসম্পন্ন ছেলেটি অনেক সময়ই সমাজে ‘অযোগ্য’ হিসেবে বিবেচিত হন। একই উদাহরণ স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা বেশি আয় করা স্বামী ও বাবাকেই পছন্দ করেন।

এসব কারণে সমাজে এমন ধারণা বা ‘পারসেপশন’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায়ের লোকজনও নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। রাজনীতিক থেকে শুরু করে আমলা, পুলিশ, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিচারপতি, এমনকি নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যেও এখন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা নেই। মধ্যবিত্তের কেউ কেউ আলোচনা করলেও এই বোধকে সমুন্নত রাখা তাদের পক্ষে হয়ে ওঠে না। সব মিলিয়ে সমাজে এমন একটি অবস্থা দাঁড়িয়েছে, মানুষের ভরসা করার আর কোনো জায়গা থাকছে না। পাশাপাশি অনুসরণযোগ্য সৎ, সজ্জন ও নৈতিকতাসম্পন্ন বিশিষ্ট নাগরিকের সংখ্যাও এখন খুব কম। বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে ‘সততা’র কারণে অনেকে নির্ভরযোগ্য হলেও রাজনীতিতে জড়িয়ে তারা আবার সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন। 

গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জনমনে একধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল- ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসায় নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণ ঘটবে। মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবেন। অন্তত সৎ থাকার তাগিদ তৈরি হবে জনমনে। কিন্তু এ প্রশ্নে কোনো উন্নতি বা দিকনির্দেনা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বরং ক্ষমতার নানামুখী টানাপোড়েন বা দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়েছে। ব্যাপক প্রত্যাশার মধ্যেই বর্তমানে নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। উন্নয়ন, সংস্কার, নৈতিকতা ও সততার চর্চায় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কি সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে?

গ্রিক শব্দ Ethos থেকে এসেছে নৈতিকতার ইংরেজি শব্দ ‘Ethics’; যা দিয়ে চরিত্র, রীতিনীতি, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয় বোঝায়। অন্যভাবে বললে, নৈতিকতা দিয়ে নীতিসম্পর্কিত বোধ বা অনুভূতিকে বোঝানো হয়। যার মাধ্যমে মানুষের আচরণ বা চরিত্র প্রকাশিত হয়। ওয়েবস্টার অভিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, নৈতিকতা হলো এমন বিষয়, যা জবাবদিহির সঙ্গে ভালো ও মন্দের মাত্রা নির্ণয় করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘নৈতিকতার অবক্ষয়ের পেছনে অনেকগুলো সেক্টর কাজ করে। একটা সেক্টরকে এটার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমার কী দায়িত্ব ছিল, আমি কী করছি। এটা যদি আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি তাহলে কী উত্তর দেব? আমি কেমন? আমি যেটা করছি সেটা করার অধিকার আছে কি না। এ বিষয় নিয়ে নিজেকে ভাবতে হবে। উদাহরণস্বরূপ আমি শিক্ষক হিসেবে আমার কাজটা ঠিকমতো করছি কি না। আমরা তো নীতি-নৈতিকতার অনেক কিছুই জানি। কিন্তু জানার পরও তো শিক্ষকদের অনেকেই নৈতিকতাবিরোধী কাজ করছেন। আমি কি সমাজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছি। আমরা অন্যের সমালোচনা করি, কিন্তু নিজেরটা দেখি না।’

তিনি বলেন, নৈতিকতা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। এটাকে আইন দিয়ে কোনো কিছু করা যাবে না। এটা উপলব্ধির বিষয়। নিজ থেকে অর্জন করতে হবে।

বিতর্কের শীর্ষে রাজনীতিবিদরা

দেশের নীতিনির্ধারক হিসেবে বিবেচিত হন রাজনীতিবিদরা। মহান সংসদে নির্বাচিতদের মতামতের ভিত্তিতেই পাস হয় গুরুত্বপূর্ণ সব আইন। কিন্তু এই রাজনীতিবিদরাই যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তাদের অধিকাংশেরই সম্পদ বেড়ে যায়। কেউ কেউ বনে যান টাকার কুমির। ফলে তাদের নৈতিকতা, সততা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। ক্ষমতার মেয়াদ শেষে তাদের অনেকেই আবার দুর্নীতির অভিযোগে আটক হন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত একাধিক জরিপেও বিষয়টি উঠে আসে। সংস্থাটির ২০১৫ সালে করা ‘জাতীয় যুব-সততা জরিপ’-এ অংশগ্রহণকারী ৮৬ শতাংশ মনে করেন রাজনীতিতে সততার অভাব রয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানের করা গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠান হলো রাজনৈতিক দল (৯৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর মত)।

অন্যদিকে নির্বাচনি হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রার্থীদের প্রথমবার জমা দেওয়া সম্পদের পরিমাণ পরবর্তী নির্বাচনের হলফনামায় শতগুণ বেড়েছে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সাবেক ২০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সম্পদ নজিরবিহীনভাবে বেড়ে যায়। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সম্পদ বাড়ে ২ হাজার ১৩১ শতাংশের বেশি। 

বিগত সরকারের রাজনীতিবিদদের বড় ধরনের আর্থিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা এখন সামনে আসছে। নামে-বেনামে দেশের টাকা পাচার করেছেন তারা। নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পদ ছাড়তে হয় এক প্রতিমন্ত্রীকে। এ ছাড়া দলে নিজের অবস্থান সুসংহত রাখতে গ্রুপিংয়ের রাজনীতি করার চিত্র অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাও কম মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

নিজেদের সুপিরিয়র মনে করেন আমলারা

রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আমলারা। ফলে নিজেদের সুপিরিয়র বা সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মনে করা, আমিত্ব-ভাব প্রবলভাবে পেয়ে বসেছে তাদের। সম্প্রতি আন্তক্যাডার বিরোধেও বিষয়টি সামনে এসেছে। সবাই বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদান করলেও প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ সুযোগ-সুবিধা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। বিষয়টি নিয়ে অন্যদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অন্যদিকে এসব আমলার দুর্নীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ার হার অনেকটা বেড়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শীর্ষ পর্যায়ের অনেক আমলাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগে এ সংখ্যা অনেক কম ছিল।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠছেন অধিকাংশ আমলা। প্রশাসনে সৎ কর্মকর্তাদের উৎসাহ দিতে চালু করা হয় শুদ্ধাচার পুরস্কার। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এই শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের আরও ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের ছেলের ছাগলকাণ্ডে অনেকের দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের করা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনেও বিষয়টি দেখা যায়। তাদের মতে, চোরতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছেন আমলারা। 

দুর্নীতির পাশাপাশি দলবাজিতেও আমলারা ছিলেন শীর্ষে। পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকার পরিবর্তে বিভিন্ন দলের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর ছিলেন। ফলে সরকার পরিবর্তনের পর ওএসডি, পদত্যাগে বাধ্যকরণ, বদলির হিড়িক পড়ে যায়। আর এভাবেই আমলাতন্ত্রের নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয়টি আজ জনমনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। 

পেশাদারত্ব ভুলে তেলবাজিতে সাংবাদিকরা

ষাট, সত্তর, আশি; এমনকি নব্বইয়ের দশকে বলা হতো যে সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। কিন্তু সময়ের আবর্তে মহান সেই পেশার নৈতিকতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ সাংবাদিকদের মধ্যে একটি শ্রেণি পেশাদারত্ব ভুলে এখন তেলবাজি ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে অনেক সম্পাদককে প্রশ্নের বাইরে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রশংসা করতে দেখা গেছে; যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সমালোচিত হয়। অনেকে এসব প্রশংসাকে ‘তেলবাজি’ বলে অভিহিত করেন। এ ছাড়া অর্থের বিনিময়ে নিউজ করা, নিউজ বন্ধ করা, নানা ধরনের আর্থিক অনিয়মে জড়িত থাকার তথ্য সামনে আসায় পেশাদার সাংবাদিকরাও এখন বিব্রত ও লজ্জিত বোধ করেন। এ ছাড়া অনেকের নামে-বেনামে সম্পদশালী হওয়ার তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকদের পর্যন্ত আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অন্যান্য পেশার মতোই সাংবাদিকতা পেশাও আজ কলুষিত হয়েছে। তাদের সততা ও নৈতিকতা নিয়েও সমাজে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

চিকিৎসকদের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মবিরতি
দেশে বিভিন্ন সময় চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ঘোষণা দিতে দেখা যায়। পর্যবেক্ষকদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে দাবি যৌক্তিক থাকলেও মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে যুক্ত এ মহান পেশাজীবীদের কর্মবিরতি নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরেও চিকিৎসকরা কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। এ সময় অনেক রোগীকে ভয়ংকর রকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আবার অনেক সময় ভুল চিকিৎসার অভিযোগে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন, যা চিকিৎসকদের জন্য আতঙ্কের। অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেশি মুনাফার জন্য রোগীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়। অনেক মানবিক চিকিৎসক আছেন যারা গরিব রোগীদের ক্ষেত্রে কম ফি নিয়ে থাকেন বা বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেন। আবার অনেক চিকিৎসক রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করেন। এসব ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে চিকিৎসকদের আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকেই।

বিচারকরাও বিতর্কের মুখে
মহান পেশার মধ্যে বিচারকদের থাকার কথা মর্যাদার শীর্ষে। কারণ তাদের রায়ের ওপর সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। কেউ কেউ মহান সৃষ্টিকর্তার পরেই বিচারকদের অবস্থান নির্ণয় করে থাকেন। কিন্তু সেই বিচারকদের নিয়ে সমাজে এখন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একটি দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার ঘটনা নিয়ে সমাজে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিচারকরাও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারছেন না। তাদের মধ্যেও নৈতিকতার অভাব দেখা গেছে। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সরকার পতনের পর পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরা পড়েন। স্থানীয় জনগণ তাকে অপদস্ত করেন। অথচ তার থাকার কথা ছিল মর্যাদার আসনে। এ ছাড়া দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রায় দেওয়ায় এবং আর্থিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় অনেককে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। 

পুলিশ সদস্যরাও দুর্নীতিতে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে জনগণের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল পুলিশের। কিন্তু নানা ধরনের অনিয়মের কারণে তাদের অনেকে এখন জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এ কারণে ছাত্র-জনতাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। পুলিশের শীর্ষ থেকে নিম্নপর্যায়ের লোকজনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদও দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। তার অবৈধ দখলদারি থেকে বাদ যায়নি সরকারি জমিও। এ ছাড়া ক্ষমতার পটপরিবর্তনে অনেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ সদস্যকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। এসবের পেছনে নৈতিকতার অধঃপতনকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

নীতিহীন ব্যবসায়ীরাই গড়ে তুলছেন সিন্ডিকেট
ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে সবাই জিম্মি। প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। যখন যে পণ্যের মৌসুম, সেই পণ্যের দাম পরিকল্পিতভাবে বাড়ানো হচ্ছে। কিছুদিন আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় বোতলজাত সয়াবিন তেল। কিন্তু দাম বাড়ানোর ঘণ্টাখানেক পর অধিকাংশ দোকানে দেখা যায় শত শত তেলের বোতল। একইভাবে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। ডিম নিয়ে কারসাজিও সিন্ডিকেটের। সরকারের একার পক্ষে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া কঠিন বলে মনে করছেন অনেকে। যদি ব্যবসায়ীরা নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বজায় রাখেন, তাহলে এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে দেশের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে সমাজে একধরনের ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে বাধা তৈরি করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, যা নৈতিকতা ও মূল্যবোধ তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, সেগুলোও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের অগ্রগতির জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম দরকার। এসবের অবক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষত সরাতে না পারলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নসহ কোনো কিছুই টেকসই হবে না।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-

>সমস্যা ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত
>বুদ্ধিজীবীরাও বিচার করেননি
>সমাজব্যবস্থার কারণে মূল্যবোধের ক্ষয়

চাকরির নামে কোটি টাকা আত্মাসাৎ করলেন চসিক কর্মকর্তা

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:২০ এএম
আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪০ এএম
চাকরির নামে কোটি টাকা আত্মাসাৎ করলেন চসিক কর্মকর্তা
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন সংস্থাটির এক উচ্চমান সহকারী। তার নাম কাঞ্চন কুমার চৌধুরী। দুই মাস ধরে তিনি কর্মস্থলেও আসছেন না। এদিকে চাকরি না পেয়ে এবং অর্থ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। কাঞ্চন ও তার স্ত্রীর মোবাইল ফোন বন্ধ। কেউ কেউ বলেছেন, কাঞ্চন চৌধুরী সাধুর বেশ ধরে ভারতে বাড়ি করেছেন। তিনি সেখানেও চলে যেতে পারেন।

চসিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর কাঞ্চন কুমার চৌধুরী কিছুদিন অফিস করলেও ধীরে ধীরে তিনি অনিয়মিত হয়ে পড়েন। নভেম্বর মাসে এসে তিনি চসিক কর্তৃপক্ষের কাছে অবসরে যাওয়ার আবেদন করেন। যদিও তার চাকরির মেয়াদ আরও চার বছর আছে। এই খবর জানাজানি হওয়ার পর পাওনাদাররা তাকে খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে কেউ কেউ তার বাসায় যান। চাকরি কিংবা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দেন। ভুক্তভোগীদের কয়েকজন বাসায় যাওয়া শুরু করলে তিনি নগরীর ঘাটফরহাদবেগ এলাকার বাসা ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে খবরের কাগজ বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে। কাঞ্চন চৌধুরী মূলত অফিস সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী, কর আদায়কারী, চসিক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়া, মেকানিকের সহকারীসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছেন, কাঞ্চন চৌধুরী তার শ্বশুরবাড়ি কক্সবাজারে অবস্থান করতে পারেন। কেউ কেউ ভারতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন।

চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা সেবক কলোনির বাসিন্দা ভুক্তভোগী উত্তম ভৌমিক খবরের কাগজকে জানান, তার স্ত্রী, শ্যালিকাসহ পরিবারের চারজনের চাকরি দেওয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। একইভাবে পাথরঘাটা ব্রিকফিল্ড এলাকার বাসিন্দা মো. সোহেল নিজের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের আটজনের চাকরির জন্য দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। কাঞ্চন টাকা নেওয়ার পর বার বার সময় নিয়েছেন। কিন্তু টাকাও ফেরত দেননি, চাকরিও দেননি। কাঞ্চন চৌধুরী এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন। শোনা গেছে, কাঞ্চন এখন কর্পোরেশনের চাকরি ছাড়ারও আবেদন করেছেন।

একসময় সেবক হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাজ করতেন প্রতিবন্ধী মো. মজিবর। সেই কারণে বিভিন্ন সময়ে তাকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে যেতে হতো। আসা-যাওয়ার সুবাদে সংস্থাটির উচ্চমান সহকারী কাঞ্চন কুমার চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় সূত্রে মজিবুরের ভাইপো মো. ইমনকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেওয়ার জন্য দুই দফায় ৫ লাখ টাকা নিয়েছেন কাঞ্চন। এর মধ্যে দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকার ডকুমেন্ট হিসেবে ১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দিয়েছে। তিনি জমি বিক্রি করে টাকাটা দিয়েছেন। এখন জমিও গেছে, ভাইপোর চাকরিও হয়নি।

আরেক ভুক্তভোগী লিটন দাশ খবরের কাগজকে জানান, তিনি ৯ জনের চাকরির জন্য ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনিসহ বেশ কয়েকজন পাওনাদার টাকা ফেরত চাইতে কাঞ্চন চৌধুরীর বাসায় গেলে দুই মাস আগে তিনি সবাইকে নিয়ে স্থানীয় সাধু তারাচরণ সেবাশ্রম মন্দিরে ভুক্তভোগীদের ডাকেন। সেই বৈঠকে অন্তত ৩০ জন ভুক্তভোগী উপস্থিত ছিলেন। পরের সপ্তাহে সবাইকে টাকার ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরের সপ্তাহে বাসায় তালা ঝুলিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর বোয়ালখালির তার গ্রামের বাড়ি এবং কাট্টলী এলাকায় তার আত্মীয়ের বাড়িসহ সম্ভাব্য এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে তার হদিস মিলেনি। একজন উচ্চমান সহকারীকে এত টাকা কেন তুলে দিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাঞ্চন চৌধুরী তখন সাধুর মতো চলাফেরা করতেন। বাইরে কিছু খেতেন না। ধর্মপালন করতেন। এ কারণে তারা সবাই তাকে বিশ্বাস করেছেন। তিনি যে সাধুর বেশে চুরি করবেন, তা তারা কল্পনাও করতে পারেননি।

ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সানিকে মেকানিক্যাল বিভাগে মেকানিকের সহকারী হিসেবে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। তার বিনিময়ে কাঞ্চন চৌধুরী নিয়েছেন দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। ডকুমেন্ট হিসেবে ১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। টাকা নেওয়ার পর থেকে মোবাইল বন্ধ। তার সঙ্গে আরো একজন ভুক্তভোগীর সচিবের পিএস পদে চাকরির জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকার মৌখিক চুক্তি হয়। তবে তিনি দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। তাদের দুইজনের কারো চাকরি হয়নি। তারা টাকাও ফেরত পাননি।

এদিকে চসিকের সবিচ মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সিটি কর্পোরেশনে সচিবালয় বিভাগের সাধারণ শাখার উচ্চমান সহকারী কাঞ্চন কুমার চৌধুরী বিভিন্নজনের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিয়েছেন। টাকা নেওয়ার দীর্ঘদিন পার হলেও চাকরি এবং টাকা ফেরত না দেওয়ার বিষয়ে পাওয়া অভিযোগগুলো তদন্ত করে দাখিলের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত ৬ জানুয়ারি গঠিত কমিটির আহ্বায়ক হলেন চসিকের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট মনীষা মহাজন, সদস্য শিক্ষা কর্মকর্তা মোছাম্মদ রাশেদ আক্তার এবং সদস্য সচিব আজিজ আহমদ। কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম খবরের কাগজে বলেন, ‘কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তারা পেয়েছেন। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। যারা অভিযোগ করেছেন, তারা যদি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তার কাছে টাকা পাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে কাঞ্চন কুমার চৌধুরীর অবসরের পর এককালীন পাওনা থেকে কেটে তাদের টাকা  পরিশোধ করা হবে। এছাড়া কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করারও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’