রাজধানীর টিকাটুলী এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম (ছদ্মনাম)। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। বছর পাঁচেক আগে দেখা দেয় কিডনির সমস্যাও। ২০২৪ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া কোমরে ব্যথা যেন তার জীবনে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেয়! কারণ আগের তিন রোগের ওষুধ কিনে খাওয়াই তার জন্য কষ্টকর ছিল। এর মধ্যেই কিডনি ও কোমর ব্যথার ওষুধ যোগ হওয়ায় তিনি চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন।
আব্দুর রহিম জানান, প্রতিদিন দুই বেলা করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও গ্যাসের ওষুধ এবং এক বেলা কিডনির সমস্যার ওষুধ খেতে হচ্ছে তাকে। দুই মাস আগে থেকে কোমরে সমস্যা শুরু হওয়ায় নতুন করে ওষুধ খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে এখন প্রতি মাসে সাড়ে ৭ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এ ছাড়া আমার স্ত্রীও ডায়াবেটিস-উচ্চ রক্তচাপের রোগী। তারও নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার খরচ কমপক্ষে আরও ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা।’
‘অথচ ছোটখাটো ব্যবসা করে চলা মাসিক আয় ৫০-৬০ হাজার টাকার বেশি নয়। আয়ের চার ভাগের এক ভাগই ওষুধ কিনতে চলে গেলে বাসা ভাড়া, সংসার ও ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ কীভাবে মিটবে’ প্রশ্ন তুলে যোগ করেন রহিম।
ওষুধ কিনতে গিয়ে এমন হিমশিম অবস্থা শুধু রহিমের একার নয়; ধানমন্ডির রিয়াজউদ্দিন, আদাবরের এনামুল হকসহ আরও অনেক মধ্যবিত্তেরই প্রায় একই কাহিনি। মাসের ওষুধ কিনতেই তাদের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায়। ভেজাল খাদ্য আর দূষণের কারণে শুধু শহরে নয়; গ্রামাঞ্চলেও এখন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে কমন বিষয়। এ কারণে শহরের সঙ্গে গ্রামেও এখন হু হু করে বাড়ছে ফার্মেসির সংখ্যা।
ঔষধ প্রশাসনের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত ওষুধের ফার্মেসি ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৮৯টি। ২০২০-২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও একই সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। ২০২১-২২ সালে ছিল ২ লাখ ২ হাজার ৫২৮টি। ২০২২-২৩ সালে ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৯১টি।
আর্থসামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী শ্রেণির বাসিন্দাদের অর্থনীতির পরিভাষায় মধ্যবিত্ত বলা হয়। বিশ্বব্যাংক এবং অর্গানাইজ়েশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) রিপোর্ট অনুযায়ী, মাসে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আয় করা মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পড়বেন। অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ’ বলেছে, দিনে ১০ থেকে ৫০ ডলার আয় করলে তাকে মধ্যবিত্ত বলতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১১তম। বর্তমানে ওই তালিকার ২৮তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশগুলোকে বাদ দিলে আগামী দশকে অন্য জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে মধ্যবিত্ত বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষ তিনে থাকবে বাংলাদেশ। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতাভুক্ত। শ্রেণিটির বিকাশের মাধ্যমে দেশের সেবা খাতের চাহিদা ও ভোক্তার সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে সম্প্রসারিত হবে অর্থনীতির ক্ষেত্র।
মোহাম্মদপুর, আদাবর, সাতমসজিদ রোড ও শ্যামলী এলাকার অন্তত ১০টি ফার্মেসির বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চারটি কমন রোগের ওষুধ কেনার জন্য তাদের নিয়মিত কাস্টমার রয়েছে; যাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত। আদাবরের ওষুধ বিক্রেতা মাহবুবের মতে, চারটি রোগের ওষুধের চাহিদা নিয়মিত পূরণ করা এখন প্রায়ই কঠিন হয়ে ওঠে। অনেকে অগ্রিম বলে গেলেও কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিদের সেগুলো সরবরাহ করতে সময় লাগে। তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা নিজেরাই বলাবলি করেন যে বাজার খরচের তুলনায় ওষুধ কেনার খরচ বেশি লাগে।’
প্রতিটি পরিবারেই নিত্যপণ্যের মতো প্রতি মাসে কমবেশি এখন ওষুধ কিনতে হয়। মাসে ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৭-৮ হাজার, এমনকি ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অনেক পরিবারে শুধু ওষুধ কিনতেই খরচ হয়। কেননা রোগব্যাধি এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) এক হিসাবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ রোগী চিহ্নিত করা হয়েছে। মধ্যবিত্তের অনেককে বাজার খরচ কমিয়ে এখন ওষুধে খরচ করতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব বলছে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ের অংশ প্রতিবছরই কমছে। বিপরীতে ব্যক্তির পকেটের খরচ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের তিন-চতুর্থাংশ বহন করছে ব্যক্তি নিজেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য খাতে সরকার ব্যয় করেছে যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের অংশ ক্রমান্বয়ে কমছে। আবার ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাড়ছে। তবে এই ধারা শুধু তিন বছরের নয়, দুই দশকের বেশি সময়ের। গত ১০ বছরে ওষুধের দামও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
জুরাইন এলাকার মর্জিনা বেগমের ছেলে আতিক জানান, তার মা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ না খেলে কোনো খাবারই খেতে পারেন না। পেট ফুলে থাকে। সে জন্য ডাক্তার দুটি ওষুধ দিয়েছেন, যা খেয়ে দীর্ঘদিন তিনি ভালো ছিলেন। এরপর ওষুধের খরচ কমাতে প্রতিদিনের জায়গায় এক দিন পরপর খাওয়া শুরু করেন। পরে একসময় খাওয়া বন্ধ করে দেন। আবার সমস্যা দেখা দিলে সেই ওষুধ আবার খাওয়া শুরু করেন।
আবার যারা একসময় সরকারি হাসপাতালে যেতেন না। তারা এখন খরচ কিছুটা কমানোর জন্য সরকারি হাসপাতালে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসক দেখানোর চেষ্টা করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘যদিও সরকারি হাসপাতালে অনেক ভিড় থাকে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেখাতে গেলে যে টাকা ভিজিট দিতে হবে, সেই টাকায় কিছু ওষুধ কেনা যায়। সেই চিন্তা করে এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাই।’
বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি চারজনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (২৩.৫%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। ডব্লিউএইচওর ২০২৩ সালে উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ২ লাখ ৭৩ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেছে, যার ৫৪ শতাংশের (৫১% পুরুষ, ৫৮% নারী) জন্য দায়ী উচ্চ রক্তচাপ। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি), ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কিডনির কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২০২৩ সালে প্রকাশিত ডায়াবেটিস চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকায় দেওয়া তথ্যমতে, দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ।
ওষুধের চাহিদা থাকায় প্রতিবছরই দেশে অন্তত ১৫ হাজার করে ফার্মেসি বাড়ছে
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, টিকাটুলী এলাকার বেশ কয়েকটি ফার্মেসি ঘুরে জানা গেছে, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কিডনিজনিত রোগের ওষুধের নিয়মিত ক্রেতা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ। জুরাইন এলাকার এক ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, প্রতি প্রেসক্রিপশনেই গ্যাস্ট্রিকের কোনো না কোনো ওষুধ থাকে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, অনেকের আগে থেকেই গ্যাসের সমস্যা থাকে, সে জন্য চিকিৎসক গ্যাসের ওষুধ লিখে থাকেন। এ ছাড়া রোগী মূলত যে রোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান, সেই রোগের ওষুধ খেলে রোগীর গ্যাস হতে পারে, সে জন্য গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ লিখে থাকেন। এ ছাড়া অধিকাংশ মানুষ গ্যাসের একটু সমস্যা বুঝলে নিজের মতো করে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ কিনে খান।
তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইএমএস হেলথের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে বিক্রির শীর্ষে থাকা ১০টি ওষুধের মধ্যে পাঁচটি গ্যাসের ওষুধ। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ওষুধ হচ্ছে সার্জেল, ৯১৮ কোটি টাকা; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ম্যাক্সপ্রো, ৪৮৬ কোটি টাকা; তৃতীয় সর্বোচ্চ প্যান্টোনিক্স, ৩৭৬ কোটি টাকা; চতুর্থ সর্বোচ্চ নাপা, ৩৩৮ কোটি টাকা। সেফ-থ্রি, মোনাস, এক্সিয়াম, সেক্লো ও বিজোরানের বার্ষিক বিক্রি ২০০ কোটি টাকার বেশি। দেশে বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি ৩১ জেনেরিক ওষুধ ও ৫০ কোটি টাকার ওপরে ৭৯ জেনেরিক ওষুধ বিক্রি হয়েছে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমরা যে পরিমাণ ওষুধ ব্যবহার করি, পৃথিবীর অন্য দেশে এত ওষুধ ব্যবহার করে না। আমাদের দেশে রোগব্যাধি বেশি। সবারই গ্যাস্ট্রিক আছে। এর বাইরে ওষুধ ইজি অ্যাকসেস হওয়ায় নিজেরা প্রেসক্রিপশন ছাড়া কিনি। প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোর জন্য যদি খরচ বেশি হয়, তাহলে তা এড়ানোর সুযোগ নেই। ওষুধের দাম বাড়বে। এক জায়গায় স্থির থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘দাম কমাতে হলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। কিন্তু তা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। তাহলে কী করতে হবে? ভারতের মতো ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি নামের একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। যারা সব ওষুধের দাম নির্ধারণ ও মনিটর করবে। প্রতি দুই বছর পর এই অথরিটি ওষুধের দাম পুনর্নির্ধারণ করবে, এতে হবে কী? দাম নিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়বে। বর্তমানে আমাদের যে সংস্থা আছে, ঔষধ প্রশাসন, তাদেই সেই শক্তি-সামর্থ্য নেই।’
গত ৬ জানুয়ারি সরকার মালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী মতবিনিময় সভা করেন। এ সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যান হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। এটা সরকারের কমিটমেন্ট। এটা গ্লোবাল কমিটমেন্ট। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার প্রধান উপাদান হচ্ছে মেডিসিন কাভারেজ। ৬৭ থেকে ৭০ শতাংশ আউট অব পকেট ব্যয় হচ্ছে ওষুধ ব্যয়। এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড ভালোভাবে প্রোডাক্ট তৈরি ও অব্যাহতভাবে ওষুধ সরবরাহ করতে পারলে বাংলাদেশের পুরো মার্কেটের ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তিত হয়ে যাবে।’