তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমরা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক দিক থেকেই পিছিয়ে আছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো শিক্ষা। ফলস্বরূপ প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়ার হিড়িক যেন বেড়েই চলেছে। কেউ কেউ উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েই বিদেশে পাড়ি জমান, কেউ আবার স্নাতক শেষ করে। উচ্চশিক্ষার জন্য আমাদের দেশে অনেক পাবলিক, প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলেও বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষার যে মান সেটা কি শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণে যথার্থ। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই-বা কতটুকু সন্তুষ্ট? সেটা নিয়েই শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন মাহমুদ শাকিল।
মো. রেদওয়ান কবির অনিক
ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও শিক্ষক নিয়ে নিজের অজান্তেই শিক্ষার্থীদের মানসপটে যে প্রত্যাশার আবির্ভাব হয় সেখানে কুঠারাঘাত পড়ে তখনই যখন প্রাপ্তির সঙ্গে তার ঢের অমিল পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকরাই ক্ষমতার মোহে স্বীয় অন্ধত্ব ধারণ করে তাদের ক্লাস লেকচার, প্রয়োজনীয় স্টাডি ম্যাটেরিয়ালস, কনটেম্পোরারি বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে সিলেবাস আপডেট বা রিসার্চে আগ্রহ হারিয়ে তাদের বেশির ভাগ সময়ই ব্যয় করেন শিক্ষক রাজনীতির পেছনে। কেননা প্রোডাক্টিভ একাডেমিক চর্চার চেয়ে এই নির্ধারকটিই তাদের বেশি এগিয়ে রাখে পেশাগত জীবনে মোহনীয় ধাপটিতে পৌঁছাতে। একদিকে আবাসিক, একাডেমিক অবকাঠামোগত সংকট অন্যদিকে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে কিছু প্রভাবশালী শিক্ষকদের নতুন নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠার হিড়িক এই সমস্যায় বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। শিক্ষকদের এই অদূরদর্শী চিন্তাভাবনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক রেপুটেশন দিন দিন তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে।
মো.কামরুজ্জামান মিঠু
লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ল্যাব সুবিধা এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা এবং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল এবং সুযোগ নেই, যা শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এ ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, কর্মমুখী শিক্ষা ও কর্মজীবন নির্দেশিকার অভাব রয়েছে। এসব সমস্যার ফলে শিক্ষার্থীরা পেশাগত জীবনে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে। একটি কার্যকর ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য গবেষণা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এবং বাস্তবমুখী শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
আনিকা তানজিম
ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদালয়।
বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মানের ক্ষেত্রে সংশয় দেখা যাচ্ছে। র্যাংকিংয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে দেশে এবং বিশ্বে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখা যাচ্ছে না। এর পেছনে অন্যতম একটা কারণ গবেষণা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা। স্কুল-কলেজে যেই সার্বিক তত্ত্বাবধানে পড়াশোনার একটা পরিবেশ থাকে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বিমুখ হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনার দৃশ্যটি কম দেখতে পাওয়া যায়। তবে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক ও ইদানীং দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রমগুলো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সংগঠন গড়ে উঠছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন গড়ে উঠবে। শিক্ষকদের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে গবেষণামূলক কাজে আরও মনোনিবেশ করলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা যায়।
আব্দুল্লাহ আল নোমান
রসায়ন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানদণ্ড প্রশ্নে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই মনঃক্ষুণ্ন অনেকক্ষেত্রে হতাশ। প্রথমত, অনেক কোর্স বা টপিক পড়ানো হয় যার সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে সবাই অবগত নন, অনেকক্ষেত্রে তার প্রয়োগবিধি খুঁজে পাওয়া দুরূহ। আউটপুট ভিত্তিক এবং যথাযথ প্রয়োগ সম্পন্ন কোর্স বা টপিক নির্ধারণ এবং সুযোগ থাকলে ল্যাবে হাতে-কলমে শেখানো জরুরি।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের পড়ানোর দক্ষতা যাচাইপূর্বক নিয়োগ সম্পন্ন করা উচিত। একজন প্রথম বা সেকেন্ড হওয়া শিক্ষার্থী সব সময় ভালো শিক্ষক হতে পারবেন এমন কোনো যৌক্তিকতা নেই। যার ভুক্তভোগী পরবর্তী শিক্ষার্থী এবং এটা প্রায় সব ডিসিপ্লিনের একটি নিয়মিত ঘটনা। অনেকক্ষেত্রেই যেসব টপিকের উৎস হিসেবে বই বা নেটে ঠিকমতো রেফারেন্স নেই সেগুলোই অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রেজেন্টেশন হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, যার যৌক্তিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা সন্দিহান।
সামিয়া রহমান অনি
ইংরেজি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শেষ নেই। শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষতা উন্নয়নের পরিবর্তে ভর্তি প্রতিযোগিতা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, যা প্রকৃত শিক্ষার চেয়ে সার্টিফিকেট অর্জনের দিকেই মনোযোগ বাড়াচ্ছে। শিক্ষকদের ঘাটতি থাকায় শিক্ষার্থীরা মানসম্মত পাঠদান ও পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই শিক্ষা নিশ্চিত করতে গবেষণা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার অভাব প্রকট। আধুনিক চাকরির বাজারের সঙ্গে কোর্স কারিকুলাম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিকল্পিত শিক্ষানীতি, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির উদ্যোগ প্রয়োজন। শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যর্থ হবে। এজন্য শিক্ষায় উদ্ভাবনী পদ্ধতির সংযোজন অপরিহার্য।
জান্নাতুল ফেরদৌস মৌ
কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষণা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছে, যা ইতিবাচক দিক। তবে শিক্ষার্থীদের রয়েছে লাইব্রেরি, ল্যাবে সময় দেওয়ার প্রতি অনীহা। কিছু অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে আগ্রহ থাকলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কিছু গৎবাঁধা পড়াশোনা করে কোনো রকমে একটা ডিগ্রি নিতে চায়। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুণগত মানের গবেষণার সুযোগের অভাব, গবেষণা থেকে অন্য সরকারি চাকরিগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, শিক্ষকদের সহযোগিতার অভাব, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দেওয়া। ফলে বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব তালিকায়ও অনেক পিছিয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান উন্নত করতে গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে, প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং শিক্ষা আধুনিকায়ন জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষকদের সহযোগিতা ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উন্নয়ন শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে জরুরি।
জেম ইয়াছিন অরিন
আইন বিভাগ, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পুথিগত জ্ঞান অর্জনের জায়গা নয়, বরং সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং বাস্তবজীবনের দক্ষতা গড়ে তোলার একটি কেন্দ্র হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তুষ্টি দেখায়। এর প্রধান কারণগুলো হলো সৃজনশীলতার অভাব, যুগোপযোগী শিক্ষাক্রমের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত গবেষণা সুবিধা এবং দুর্বল পরিকাঠামো। অনেক সময় প্রশাসনিক জটিলতা ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব শিক্ষার্থীদের শেখার পরিবেশ ব্যাহত করে। এ ছাড়া ক্যারিয়ার উপযোগী প্রশিক্ষণের অভাবও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষার মানোন্নয়নে শুধু প্রশাসনের নয়, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ও বিশ্বব্যাপী চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার পদ্ধতিকে আধুনিক করা প্রয়োজন। সৃজনশীল ও ব্যবহারিক শিক্ষায় জোর দিয়ে শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে অনলাইন রিসোর্স ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসার শিক্ষার মান আরও উন্নত করতে পারে।
হুমায়রা তিথি
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে, শিক্ষকের পক্ষে সবার প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার না হওয়া, আধুনিক ল্যাব ও ডিজিটাল ক্লাসরুমের অভাব শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব এবং যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে শিক্ষার্থীরা পুথিগত জ্ঞান থেকে বাস্তবসম্মত জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদেরও নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। আবাসিক হলগুলোর নিরাপত্তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং মানসম্মত খাবারের অভাব শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাঠদান বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি, যা শিক্ষার পরিবেশকে আরও খারাপ করে তোলে। এ ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য ও ক্যারিয়ার গাইডেন্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও মানসিক স্থিতিশীলতার অভাবে ভুগছে। যদিও কিছু জায়গায় উন্নতির প্রচেষ্টা চলছে, তবে শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নত করতে আরও পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
হাসান