কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন মনসুর আলী। ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত মনসুর পেশায় দিনমজুর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর্থিক সংকটের কারণে বেসরকারি কোনো হাসপাতালে যেতে পারেন না। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মনসুরের চিকিৎসা আর এখানে হবে না। যেতে হবে ঢাকায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করার মতো টাকা নেই তার। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ডাক্তার বলছেন, যে চিকিৎসা দরকার সেটা এখানে নেই। আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। আমি গরিব মানুষ, ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করার মতো টাকা পাব কোথায়?’
হাসপাতাল চত্বরে কথা হয় আব্দুর রহিমের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনিও পেশায় দিনমজুর। বাড়ি নীলফামারীতে। জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘নীলফামারীতে চিকিৎসা করতে গিয়ে আমার স্ত্রীর ক্যানসার ধরা পড়ে। পরে রংপুরে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডাক্তার বলছেন, থেরাপি লাগবে। মেডিকেলে এসে শুনি মেশিন নেই। পরে এক ম্যাডামের সঙ্গে কথা বললাম, উনি বগুড়া অথবা ঢাকায় যেতে বললেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি দিনমজুর। শুনলাম অনেক টাকা খরচ হবে। কিন্তু এত টাকা আমি পাব কোথায়। মানুষের কাছে হাত পেতে পেতে টাকা তুলে চিকিৎসা করছি। আর কত মানুষ টাকা দেবে? আল্লায় জানে কতদিন বাঁচাবে।’
চিকিৎসা করাতে এসে এমন হাহাকার শুধু মনসুর আলী বা আব্দুর রহিমের নয়, তাদের মতো হাজারও মানুষের। মূলত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার রেডিওথেরাপির মেশিন ঘরটি তালাবদ্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ৯ বছর ধরে মেশিনটি বিকল রয়েছে। তাই এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বগুড়া, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রেফার করা হচ্ছে। আর বেসরকারি হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ব্যয়বহুল হওয়ায় আর্থিক দিক থেকে অসচ্ছল রোগীরা বেকায়দায় পড়েছেন।
কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছর ধরে বিকল থাকা মেশিনটি এখনো কেন সচল করা হয়নি, এমন প্রশ্নের উত্তর কর্তৃপক্ষ দিতে পারছে না। তারা জানিয়েছে, বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার চিঠি পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। যদিও অধিকারকর্মীর ভাষ্য অনুযায়ী, সিন্ডিকেটের কারণে এসব মেশিন মেরামত বা নতুন করে স্থাপন করা হয় না।
হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০০০ সালে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন করা হয়। চালু হয় ২০০১ সালে।
হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টরা জানান, এ মেশিনটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু চালুর পর তা একবারও করা হয়নি। ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সচল ছিল। এরপর বন্ধ হয়ে যায়। এসব মেশিন একবার নষ্ট হলে আর ঠিক করা যায় না। তখন থেকে ক্যানসারে আক্রান্তদের রেডিওথেরাপি বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলো যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে প্রতিবছরই চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়েও একাধিকবার চিঠি দেওয়ার পরও কার্যত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চিঠির ফিরতি কোনো জবাবও পাচ্ছে না রংপুর মেডিকেল কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মূল হাসপাতালের বাইরে পশ্চিম পাশে একতলা একটি ভবনে রেডিওথেরাপি মেশিনটি স্থাপন করা হয়। সেই ভবনটি বর্তমানে তালাবন্ধ। ভেতরের অংশ ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
হাসপাতালটির ক্যানসার বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যানসারে আক্রান্ত পাঁচ হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে রংপুর বিভাগ ছাড়াও অন্য বিভাগ থেকেও প্রতিদিন শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। তাদের বেশির ভাগই স্তন ও জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত। এ ছাড়া ফুসফুস ও ক্লোন ক্যানসার আক্রান্ত রোগীও আছেন।
জনস্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বেলাল আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এসব ভারী যন্ত্রপাতি মেরামত না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সবার গাফলতি রয়েছে। এ ছাড়া বড় সিন্ডিকেটের কারণে এসব মেশিন মেরামত বা নতুন করে স্থাপন করা হয় না। কারণ তখন প্রাইভেট ব্যবসা নষ্ট হবে।’
রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের প্রধান ডা. জাহান আফরোজা খানম লাকি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতিদিনই অনেক রোগী আসছেন। তাদের ৮০-৯০ শতাংশ রোগীর রেডিওথেরাপি প্রয়োজন। কিন্তু এখানে মেশিন বন্ধ বা নষ্ট থাকায় সেই থেরাপি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রেফার্ড করা হচ্ছে সরকারি অন্য হাসপাতালে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে যেসব রোগী আসেন তাদের বেশির ভাগই গরিব। তাদের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে রেডিওথেরাপির নেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। সরকারি হাসপাতালে রোগীর অবস্থাভেদে রেডিওথেরাপির জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। আর বেসরকারি হাসপাতালে এই খরচ ১২ থেকে ১৪ গুণ বেশি। আমার মনে হয় না, যারা এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তারা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন।’
বিকল হওয়া মেশিন কখনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তখন আমি ছিলাম না, তাই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। তবে এটুকু শুনেছি, মাঝেমধ্যে রেজাল্ট খারাপ হতো।’
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. ইউনুস আলী বলেন, ‘আমি আসার বহু আগে থেকেই এই মেশিন নষ্ট, শুধু একটা মেশিনই নয়, আরও অনেক মেশিনের একই অবস্থা। যেগুলো মেরামত করলে ঠিক হবে, সেগুলো মেরামতের জন্য চিঠি দিয়েছি। আর যেটা একদম বিকল, সেটা পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছি। দেখা যাক কী সিদ্ধান্ত আসে।’