‘শত যুগের ঘন আঁধার গাঁয়ে আজও আছে, সেই আঁধারে মানুষগুলো লড়ায় করে বাঁচে।’ কবি শামসুর রাহমানের ‘প্রিয় স্বাধীনতা’ কবিতার এই পঙক্তি যেন মনে করিয়ে দেয় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার চুনা নদীর চরের কথা। গত ১১ জুন সাতক্ষীরাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই চরে বসবাস করা ভূমিহীন পরিবারগুলোর ভাগ্যে সরকারি ঘর জোটেনি। বর্তমানে ভাঙাগড়ার জীবনে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা বসবাস করছেন। বনে বাঘ, জলে কুমির, আর ডাঙায় লোনা জলের ক্ষত নিয়ে সংগ্রামের জীবন যেন তাদের।
চুনা নদীর চরটি শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায় সম্বল হারানো ২০-২৫টি জেলে পরিবারের ঠাঁই হয়েছে এখানে। বছরের পর বছর এই চরকে আগলে বসবাস করলেও সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা।
এই চরেরই একজন ৩৫ বছর বয়সী রমেশ চন্দ্র মণ্ডল। দুর্যোগে সহায় সম্পদ হারিয়ে আশ্রয় নেন চরের এক কোণে। সেখানে মাটির ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ রমেশ ভারী কাজ করতে পারেন না। স্ত্রীর ওপর নির্ভর তার জীবন। রমেশ জানান, অসুস্থতার কারণে দিনে পাঁচ-ছয়বার জ্ঞান হারান তিনি। স্ত্রীর আয়ের টাকায় চলে সংসার। চিকিৎসার খরচও মেটান ওই অর্থ থেকে। সরকারি কোনো সহায়তা পান না বলে জানান তিনি।
রমেশের মতো প্রায় একই অবস্থা ষাটোর্ধ্ব ফকির বিশ্বাসের। বয়সের ভারে কাবু হলেও পেটের দায়ে তাকে কাজ করতে হয়। একবেলা কাজ করলে আরেকবেলা কাটে অসুস্থতায়। ফকির বিশ্বাস জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায় সম্বল হারিয়ে এই চরে আশ্রয় নেন তিনি। তখন থেকে কেটে গেছে দুই যুগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার জীবনমানের কোনো উন্নতি হয়নি। বরং প্রতিবছর ছোট-বড় দুর্যোগের কারণে ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
ওই এলাকার সুপদ মণ্ডল নামে এক বৃদ্ধ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তেলা মাথায় সবাই তেল দেয়। আ-তেলা মাথায় কেউ তেল দিতে চায় না। চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে বললে তারা গুরুত্ব দেন না। জনগণের সেবক হয়েও তারা যদি জনগণের কষ্ট না বোঝেন তা হলে আমরাও বা কী করতে পারি?’
ওই চরের বাসিন্দা স্বর্ণ রানি বিশ্বাস। পেশায় গৃহবধূ। জানান, স্বামী-সন্তান নিয়ে সব সময় তাকে চিন্তায় থাকতে হয়। নদীতে কুমির, বনে বাঘের আতঙ্ক। তার ওপর ডাঙায় লোনা জলের ক্ষত। লবণাক্ত চরে কোনো সবজির চাষ করা যায় না। তার ওপর চরটি নদীর পাশে হওয়ায় জোয়ারের পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যায়।
স্বর্ণ রানি আরও বলেন, যখন বসতবাড়ি নদীর পানিতে তলিয়ে থাকে তখন স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ওই সময় চর এলাকার সবার দিন খুবই কষ্টে কাটে। শিশু সন্তানদের সব সময় নজরে রাখতে হয়। তার ভাষ্য, জোয়ারের পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে থাকলে যে পানিতে গোসল, সেই পানিতে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হয়। একই সঙ্গে ওই পানি দিয়ে গৃহস্থালির কাজও করা লাগে। এতে তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এ নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই একই এলাকার পলো দাসীর। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে তার বসতবাড়ি নদীর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। পলো দাসী জানান, ‘ঘূর্ণিঝড় রিমাল বলে কথা না! যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জোয়ারের পানিতে তারসহ এই চরের অন্যদের বসতবাড়ি তলিয়ে যায়। তখন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এমনও অনেক সময় গেছে, দিনের পর দিন চুলোতে আগুন দিতে পারিনি। ওই সময় শুকনা খাবার খেয়ে থাকা লাগত। যখন খাবার ফুরিয়ে যেত তখন পানি খেয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়।’
চর এলাকার মানুষের ভাষ্য, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের জীবন আজ বিপর্যস্ত। ঋণের জালে আটকা পড়ে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ বেড়েছে ব্যয়। বর্তমানে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট আর অভাবে কাটছে তাদের জীবন। জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঁধ ভাঙন, জলোচ্ছ্বাসসহ ঘূর্ণিঝড়। প্রতিবছর এসব দুর্যোগে শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে প্রতিনিয়ত সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তারা।
স্থানীয় বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজি নজরুল ইসলাম জানান, সরকারি ঘরের বিষয়টি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ছিল না। পুরো বিষয়টি দেখভাল করেছে উপজেলা প্রশাসন। এ জন্য চর এলাকার ভূমিহীন পরিবারগুলো কেন ঘর পেল না সে ব্যাপারে তিনি কোনো কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় এখানে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বেশি। সরকারিভাবে যে সহায়তা আসে সেটাও চাহিদার তুলনায় কম। এ জন্য সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও থেকে সহায়তা নিয়ে উপকূলের মানুষের মাঝে বণ্টন করা হয়।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ন কবির জানান, সাতক্ষীরাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হলেও গৃহনির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের তথ্য পেলে যাচাই-বাছাই শেষে তাদের সরকারি ঘর করে দেওয়ার কথাও জানান তিনি।