রংপুর সদর উপজেলার কামারেরচর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা ৬নং চর। এই চরের বুক চিরে বয়ে চলছে যমুনা নদীর শাখা নদী দশানী ও ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়ার পর শুরু হয় ভাঙন। টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বাড়ায় এবারও বর্ষার শুরুতেই দেখা দিয়েছে ভাঙন।
ইতোমধ্যে ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি। হুমকিতে রয়েছে স্থানীয় একটি বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাঝে মধ্যে এই দুই নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় আতঙ্কে আছেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই বছরে দশানী নদীর ভাঙনে ৬নং চর গ্রামের অনেক পরিবারের ঘরবাড়ি, ফসলিজমি, কবরস্থান নদীতে বিলীন হয়েছে। একই অবস্থা ৭নং চরের মানুষের। এই দুই চরের মানুষ এখন আতঙ্কে রয়েছেন কবে কখন নিজেদের ঘরবাড়ি নদীতে চলে যায়। ইতোমধ্যে অনেকেরই জমিজমা নদীতে বিলীন হওয়ায় অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতি বছর এমন অবস্থা হলেও সংশ্লিষ্ট কেউই কার্যকরী পদক্ষেপ নেননি। গত বছর এই দুই চরের বিষয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে পানি উন্নয়ন বোর্ড নামমাত্র কিছু জিও ব্যাগ ফেলেই দায় এড়িয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। তৈরি হয়নি স্থায়ী কোনো বাঁধ। স্থানীয়রা একাধিকবার জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে হতাশ। তবে সংশ্লিষ্টরা বারবার আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকছেন।
সম্প্রতি নদীভাঙন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি বাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত তিন দিনের ব্যবধানে প্রায় ১৫০ মিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। একই সঙ্গে কমপক্ষে ২০-২৫টি ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। পাশাপাশি কয়েক একর সবজি ও ধানের বীজতলাসহ জমি নদীতে চলে গেছে। এখন নতুন করে ভাঙনের আতঙ্কে পড়েছে ৬নং চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও দুটি মাদরাসা, পোস্ট অফিস, গ্রামের রাস্তা ও কবরস্থান। ভাঙনের আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
একই অবস্থা ৭নং চর এলাকারও। ওই এলাকায় গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জিও ব্যাগ ফেলা অংশে আবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে হুমকির মুখে রয়েছে এলাকার একমাত্র বাজার। সেখানকার বেশির ভাগ নদীর তীরবর্তী মানুষের বাড়ি কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করলেও আতঙ্ক কাটেনি তাদের। তাই এলাকার মানুষেরা বলছেন, স্থানীয় কিছু বালু ব্যবসায়ী নদী থেকে বালু উত্তোলন ও অপরিকল্পিতভাবে নদী খননের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। তাই তাদের দাবি, পাইলিং করে স্থায়ীভাবে সমাধান করা হোক।
৬নং চরের বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন, ‘আমার তিন বিঘা জমি ছিল। শাকসবজি ও ফসল আবাদ করে ভালোই দিন পার করছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে নদী আমার সব কেড়ে নিয়েছে। এখন চাষ করব তো দূরের কথা, থাকাটাই অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দুবার ঘরবাড়ির জায়গা পাল্টেছি। কিন্তু আতঙ্ক যায়নি। আমার মতো অনেকেরই একই অবস্থা হয়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমগর চার ভাইয়ের ৬০ বিঘার মতো জমি আছিল। দুধেভাতে ছিল আমাদের সংসার। নদী আমাদের সব কেড়ে নিছে। এখন আমাদের ঘর খুলে রাখছি। কিন্তু ঘর তোলার জায়গা পাচ্ছি না। খুব কষ্টের মধ্যে আমাদের জীবন যাচ্ছে।’
আব্দুল জলিল মিয়া বলেন, ‘আমরা ছয় থেকে সাতবার বাড়ি বদল করেছি। এখন আবার ভাঙনের কবলে পড়েছি। এবার নতুন করে ঘর তোলার মতো আর নিজের জায়গা নেই। প্রতিবেশীর জায়গাতে বাড়ি করার চিন্তা করছি। যদি এবার নদী ঘর ভেঙে নিয়ে যায়, তাহলে এলাকা ছেড়ে ঢাকাতে চলে যাব।’
স্বামীহারা এক নারী বলেন, ‘তিন সন্তান নিয়ে পরের বাড়ি কাজ করে খাই। তিনবার বাড়ি পাল্টাইছি। এখন আবার আমার ননদের ছেলের বাড়িতে আছিলাম। এখানেও কপালে সইল না। এই বাড়িডাও নদী মধ্যে গেছে গা। সরকার আমাদের দেহে না কে।’
স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য সাইফুদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘এই নদীতে দুই বছর আগে আমার বাড়ি ভেঙে গেছে। অন্যের জমিতে বাড়ি করে আছি। এবারও আমার নতুন বাড়ির অর্ধেক ভেঙে গেছে। আমি ভূমিহীন হয়ে গেছি। এই নদীর ভাঙনরোধ না করতে পারলে শত শত মানুষ ভূমিহীন হয়ে যাবে। আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেন দ্রুত সময়ের মধ্যেই কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
কামারেরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বারবারই নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে একেকবার একেক জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত বছর ভাঙন শুরু হলে প্রশাসনের লোকজন এসে পরিদর্শন করেছেন। পরে দুই জায়গায় ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এ বছর আবার ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। আশা করছি, হয়তো দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেবেন তারা।’
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, ‘জেলার বেশ কয়েকটি নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেগুলোর স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা করার জন্য আমরা ডিপিপি পাঠিয়েছি। আমরা নদীগুলোর ভাঙন এলাকার প্রতিনিয়ত খোঁজখবর নিচ্ছি এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করছি।’ শেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ভূঁইয়া বলেন, ‘ভাঙনের বিষয়টি জেনেছি। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা হয়েছে। ভাঙনরোধে দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করছি।’