শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গণহারে পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হিসাবে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। বেশ কয়েকটিতে এখনো একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। সরকার পতনের পর ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ছেড়েছেন, যা মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশের বেশি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগে ‘নিরপেক্ষ শিক্ষক’ খুঁজে বের করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জেঁকে বসেছিল দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি। দলসমর্থিত শিক্ষকদের প্রশাসনের শীর্ষ পদে বসানোর সংস্কৃতি এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন সেই সরকার-সমর্থিত কর্তাব্যক্তিই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পদে আসীন হন। বহুদিন ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই সংস্কৃতির চর্চা করে আসছে। এটি কখনো উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় ভালো ফলাফল বয়ে আনেনি। বরং এই সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয়েছে ছাত্রদের মধ্যেও। দলবাজ শিক্ষকরা ছাত্ররাজনীতিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উদ্বেগজনকহারে উসকে দিয়েছে। তারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীকে নানা কাজে ব্যবহার করছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, সেখান থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে জাতির মেরুদণ্ড নামক শিক্ষা তার মূলশক্তি হারাবে।
ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। এতদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আওয়ামী লীগের আধিপত্য ছিল। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। যে যেমন পেরেছে পদত্যাগ করেছে। আবার কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। বর্তমানে তাদের জায়গায় শূন্যস্থান পূরণ করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বিএনপি সমর্থকরা। এই অবস্থায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাহলে সংস্কার করার কথা বলে লাভ হলো কী? তারা এসে আওয়ামী লীগের মতো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগে যে দলীয়করণ ও পক্ষপাতের বোঝা মাথায় নিয়ে চলছিল, সেটাই ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রশাসনকে শতভাগ নিরপেক্ষ রাখতে হবে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়করণের কারণে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। উপাচার্যসহ শীর্ষস্থানীয় পদে দলীয় মদদপুষ্ট কর্মকর্তা নিয়োগ পাওয়ায় তারা দলের মতামতকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। এই সুযোগে ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনও ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি হলগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক সময় তাদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা এসব ছাত্র সংগঠনের দ্বারা তিক্ত অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হয়েছেন। এসব পরিস্থিতি মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে গ্রহণযোগ্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান সংকটের বিষয়টি নিয়ে সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনিক দিক দিয়ে সবার কাছে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এর পর যত দ্রুত সম্ভব অন্তত প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ দলীয়ভিত্তিক প্রশাসন চান না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সরকারি সূত্র মতে, উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে এক ধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সরকারের কেউ কেউ বলছেন, প্রথাগতভাবে দলীয় শিক্ষকদের উপাচার্য না করে তুলনামূলক অধিক যোগ্য ও সুনাম আছে এমন ব্যক্তিদের উপাচার্য করা দরকার। বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের চাওয়া- উপাচার্য নিয়োগ তাদের মধ্য থেকে করা হোক।
উচ্চশিক্ষায় নানামুখী সংস্কার কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামে শিক্ষকদের একটি মোর্চা ‘বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনার আয়োজন করে। সেখানে বলা হয়েছে, সব স্তরে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে উদার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মতো চলতে দিতে হবে। প্রশাসনের পদে থাকা শিক্ষকদের সমিতির নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে না রাখার প্রস্তাবও করা হয়।
উপাচার্য হলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। সুতরাং, এই অভিভাবক নিয়োগ প্রক্রিয়াটা হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দলীয় উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিন্ন পদ্ধতি ও বিধিবিধান প্রতিপালন করতে হবে। অধিকতর যোগ্য, মেধাবী ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে।