ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

পৃথিবীর ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের মতো কেউ ত্যাগ স্বীকার করেনি: ইউসুফ রামাদান

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ১১:১৫ এএম
আপডেট: ১৫ মে ২০২৪, ১১:১৫ এএম
পৃথিবীর ইতিহাসে ফিলিস্তিনিদের মতো কেউ ত্যাগ স্বীকার করেনি: ইউসুফ রামাদান
বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান

বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। ৯ বছর ধরে এ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তার অবদান অতুলনীয়। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী চলমান আন্দোলনসহ তার ব্যক্তিজীবন ও ফিলিস্তিনসংক্রান্ত নানা প্রসঙ্গ নিয়ে খবরের কাগজের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিরাজ রহমানরিয়াজ উদ্দীন। সঙ্গে ছিলেন রায়হান রাশেদ

খবরের কাগজ: প্রথমেই জানতে চাই, ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি কী? 

ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রথমে ইসরায়েলের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলে তারা কিছু সংশোধনী দেয় এবং হামাস এ প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। হামাসের সম্মতির বিষয়টি নেতানিয়াহুকে খুবই অবাক করেছে। কারণ, তিনি এমনটা শুনতে চাচ্ছিলেন না। নেতিবাচক কিছু শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। তারা ভেবেছে, এ সংশোধনী হামাস প্রত্যাখ্যান করবে। 

নেতানিয়াহুর হয়ে যারা কাজ করে, তারা তাকে বলেছে- এ প্রস্তাব হামাস মেনে নেবে না। কিন্তু হামাস শেষ মুহূর্তে চমক দেখিয়েছে, মেনে নিয়েছে। নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের জন্য এটি অবাক করা খবর। কারণ তিনি যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান। এ যুদ্ধের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে তার ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ জড়িত। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে নেতানিয়াহুর ক্যারিয়ারও থমকে যাবে। 

বিশ্বের প্রায় সব সচেতন মানুষ বিশ্বাস করে, এ যুদ্ধটা ইসরায়েলের নয়; নেতানিয়াহুর এবং তার সরকারের যুদ্ধ। যদিও বর্তমান সময়ের সবকিছু নেতানিয়াহুর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 

মিসর, কাতার, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু প্রভাবশালী দেশসহ ফিলিস্তিনিরা চাচ্ছেন, এবার অন্তত এ যুদ্ধটি বন্ধ হোক। কিন্তু নেতানিয়াহুর একগুঁয়েমির কারণে বিষয়টি থমকে আছে। নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, ইসরায়েল একা লড়তে পারে। সুতরাং আমরা অপেক্ষা করছি সামনে কী ঘটে। 

খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থা কেমন?

ইউসুফ রামাদান: ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করার মতো নেই। এ পরিস্থিতির সঠিক ব্যাখ্যা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। গাজার মানুষ পুরোপুরি দুর্দশাগ্রস্ত, এমনকি পশ্চিম তীরের মানুষও মারা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে বহু নারী ও শিশু রয়েছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতিটা আসলে অনুমান করা সম্ভব নয়, লাখ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। গাজা ভূখণ্ডের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে এখন নিজ দেশেই শরণার্থী। এর ওপর খাবারের চরম সংকট বিরাজ করছে। গাজায় যে পরিমাণ খাবার প্রবেশ করছে, তাতে ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও মিটছে না। ২০ শতাংশ মানুষের অপ্রতুল খাবার বণ্টিত হচ্ছে পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ফলে তৈরি হচ্ছে তীব্র খাদ্যসংকট। 

এর মানে এই নয় যে, বহির্বিশ্ব আমাদের সহযোগিতা করছে না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ খাবার ও ওষুধসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করছে। কিন্তু ইসরায়েল সেসব সামগ্রী ফিলিস্তিনে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ইন্টারনেট নেই, যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, খাদ্য ও পানি নেই, ওষুধ নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদ, চার্চ ধ্বংস করা হয়েছে। হামলার কারণে অকার্যকর হয়ে গেছে সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক। কারও কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধও নেই। ছোট একটি উদাহরণ দিই, কোথাও কোনো অ্যানেস্থেসিয়ার ব্যবস্থা নেই। অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া সব ধরনের অপারেশন করা হচ্ছে। ১০ বছরের একটি বালকের পা কেটে ফেলা হয়েছে অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই। এবার আপনি চিন্তা করে দেখুন, সেখানকার মানুষ কেমন জীবন যাপন করছে!

খবরের কাগজ: যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী?

ইউসুফ রামাদান: দেখুন, রাজনীতিতে সবাই নিজ নিজ স্বার্থের কথা চিন্তা করে কাজ করে। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল যেকোনো উপায়ে, যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলকে সমর্থন করা। ‘ইসরায়েলেরও তাকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে’- এমন নীতির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। আমরা অনেকেই জানি, আমেরিকায় জায়োনিস্ট লবি (কট্টরপন্থি ইহুদিদের প্রভাব ও গ্রুপিং) খুবই শক্তিশালী এবং কার্যকর। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অন্য কোনো লবি আমেরিকায় নেই। এটা যেমন বর্তমানে আছে, তেমন অতীতেও ছিল। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের শুরু (১৯৪৮ সাল) থেকে, আমেরিকার জায়োনিস্ট লবি ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করছে। দেখুন, আমেরিকায় ৬০-৬৫টি দেশের ৩০-৪০ লাখ মুসলমান রয়েছে। তারা সবাই আলাদা দলে, কমিউনিটিতে বিভক্ত। আলাদা স্থান ও সমাজে বসবাস করে। তাদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্য নেই। আর এই অনৈক্য ভিন্ন লবিকে আমেরিকায় যেভাবে খুশি সেভাবে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দিচ্ছে। 

এ ছাড়া জায়োনিস্ট লবির আর্থিক সামর্থ্য অনেক বেশি এবং গণমাধ্যমেও তারা খুবই সক্রিয়। ফলে জায়োনিস্ট লবি আমেরিকায় খুবই শক্তিশালী। হোয়াইট হাউস, সিনেট, কংগ্রেসসহ আমেরিকার সর্বত্র এদের বিচরণ। আমি এটাকে ‘আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার’ বলে থাকি। এ লবি আমেরিকার সরকারের মাধ্যমে মানুষের স্বাধীনতাকে বাজেয়াপ্ত করার মতো প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপনি আমেরিকান হলে আমেরিকার সবকিছু নিয়ে সমালোচনা করতে পারবেন, দেশটির প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেস সদস্যদের নিয়েও কথা বলতে পারবেন, কিন্তু কোনোভাবেই ইসরায়েলের সমালোচনা করতে পারবেন না। এভাবে আপনার কাছ থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যেটা নিয়ে আমেরিকারও কিছু করার নেই। ইসরায়েলের সমালোচনা করলে তারা আপনাকে অ্যান্টিসিমেটিকের তকমা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করলে কিছুই হবে না।

বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফিলিস্তিনের চৌকস কিছু সাংবাদিক সবকিছু রেকর্ড করছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের অনেকেই জীবন হারিয়েছেন, অনেকে পরিবার হারিয়েছেন। তবু তারা কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে আমেরিকায় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে।

খবরের কাগজ: আপনার কথার সূত্র ধরে জানতে চাই, আমেরিকার ছাত্র আন্দোলনকে ফিলিস্তিন কীভাবে দেখে?  

ইউসুফ রামাদান: এই বিপ্লব, ছাত্রদের এই আন্দোলন আমেরিকার প্রশাসনকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, কার পক্ষে অবস্থান নেবে তারা। আমেরিকার জনসাধারণের স্বার্থ দেখবে নাকি ইসরায়েলের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নেবে। আর এ কারণে আমেরিকা এখন জোরালোভাবে যুদ্ধবিরতি চাচ্ছে। অথচ তারা ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের দাবিতে আলজেরিয়ার প্রস্তাবে ভেটো দেওয়াসহ তিনবার যুদ্ধবিরতিতে ভেটো দিয়েছে। ছয় মাসে তারা চারবার ভেটো দিয়েছিল। আর এটাই জায়োনিস্ট লবিস্টদের অভূতপূর্ব ক্ষমতা। এভাবেই নেতানিয়াহু সমর্থকরা জো বাইডেনকে প্রতিবন্ধকতায় ফেলে। 

পরিস্থিতি এখন কিছুটা পাল্টেছে। বাইডেন বুঝতে পারছেন, বারবার একই পথে যাওয়াটা তার দেশ, জনগণ ও প্রশাসনের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে। তিনি বিকল্প ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি ইসরায়েলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ না দেওয়ার কথাও বলছেন। এর মানে এই নয় যে, তিনি গাজার মানুষকে ভালোবাসেন কিংবা তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন; আসলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আমরা আশাবাদী। কারণ ইসরায়েল বর্তমানে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। হামাসের প্রস্তুাব মেনে নেওয়াটা ইসরায়েলকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এখন হয়তো তারা চরমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, নয়তো ভিন্ন কিছু চিন্তা করবে।   

খবরের কাগজ: বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ, বিশেষত আরব বিশ্বের ভূমিকায় কি আপনারা সন্তুষ্ট?

ইউসুফ রামাদান: আরব বিশ্বের ভূমিকা কিংবা সাধারণ মুসলিম দেশের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা সমস্যা আছে এবং সেটা যে কেবল ফিলিস্তিন ইস্যুতে সীমাবদ্ধ, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমস্যা আছে। অনেক ইস্যুতেই যথার্থভাবে তারা পাশে দাঁড়াচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলা যায়। ফিলিস্তিন ইস্যুর তুলনায় এটা অনেক অনেক সহজ ইস্যু। এখানে কি মুসলিম বিশ্ব কিংবা আরব বিশ্ব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে? তারা এখনো উদ্বাস্তু এবং বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা এটি বহন করছে এবং দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা (আরব বিশ্ব) অবশ্যই তাদের মতো করে ভূমিকা পালন করছে। তারা কি পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে? না, সেটা তারা করছে না। তারা কাজ করছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।

খবরের কাগজ: বাংলাদেশ-আমেরিকাসহ বিভন্ন দেশে আন্দোলন হচ্ছে, একে আপনি কীভাবে দেখছেন?

ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। ফিলিস্তিনি মানুষের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট। এমনটা এর আগে ঘটেনি। একেবারেই নতুন কিছু হচ্ছে। এটা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাপ্য। কারণ তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার মূল্যটা বেশ ভারি। যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ, দুর্দশা ও নির্যাতন ফিলিস্তিনের মানুষ সহ্য করছে, তারা এমন একটি সংহতি পাওয়ার প্রকৃত হকদার। 

গোটা বিশ্বের মানুষ এখন ফিলিস্তিনের পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করছে। তারা বুঝতে পেরেছে, ইসরায়েলের এ হামলা শুধু ফিলিস্তিনের বিপক্ষে নয়, এটা মানবতা ও ন্যায়ের বিপক্ষে এবং এ কারণে মানবতা কলঙ্কিত হচ্ছে। 

আমেরিকার মানুষ তাদের সরকারকে প্রশ্ন করছে, ‘কোথায় তোমার মানবতা, কোথায় তোমার নীতি-আদর্শ, কোথায় তোমার নৈতিকতা ও মোরালিটি? তোমরা আমাদের যেসব নীতি ও মানবতার কথা বলেছ, তা কি শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য? আমরা কি সেসব নীতির পক্ষে অবস্থান নেব?’ সুতরাং এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন এবং এমন কাজ চালু রাখতে আমরা তাদের আরও উৎসাহিত করি। 

বাংলাদেশের জনসাধারণকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ বাংলাদেশের জনগণ যে আন্দোলন-সংহতি বাস্তবায়ন করছে, তা খুব দারুণ। আশা করি, বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও একই কাজ করবে। ফিলিস্তিনি মানুষের সমর্থনে এগিয়ে আসবে এবং আশা করি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এ সংহতি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। 
 
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের সঙ্গে ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন?

ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশ ও ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সম্পর্ক অসাধারণ। এ সম্পর্ক খুবই গভীর ও আন্তরিক। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ, যাদের সরকার ও জনগণ যেকোনো ইস্যুতে ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে থাকে। গত ৯ বছর ধরে আমি বাংলাদেশে বসবাস করছি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ এবং যে মানের সাহায্য-সহযোগিতা ফিলিস্তিন গ্রহণ করেছে, আমি তা স্বচক্ষে দেখেছি এবং আমি এর প্রধান সাক্ষী। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি স্বীকৃতি পত্র পাঠিয়েছিল। যদিও সে সময়ে বাংলাদেশের জন্য এ স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তখন ফিলিস্তিনের সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের অকৃত্রিম বন্ধু।

বর্তমানে সবাই পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, ফিলিস্তিনের যুদ্ধের বিষয়টি কেবল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবন্ধ নেই; বরং এটা ভালো ও মন্দের মধ্যকার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ তাদের স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই ভালোর পক্ষে থাকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং আশা করি থাকবে। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ফিলিস্তিনে যেসব সহযোগিতা পাঠানো হচ্ছে, আদৌ কি তা সেখানে পৌঁছে?

ইউসুফ রামাদান: বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আমরা প্রথমবার বিপুল পরিমাণ ওষুধ এবং পরবর্তী সময়ে শুকনো খাবার সাহায্য হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং কায়রোয় থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তা গ্রহণ করে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের এ সাহায্য ফিলিস্তিনের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এগুলো হস্তান্তর করা, পৌঁছানো, বিতরণ, রান্না করা এবং খাওয়ার অনেক ভিডিও রয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা পেছনে রেখে সাহায্য গ্রহণ করার সময় শিশুরা বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে- এমন ভিডিও রয়েছে। 

এ ছাড়া বেসরকারিভাবেও বহু মানুষ এবং অনেক সংগঠনের কাছ থেকে আমরা বিপুল সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি। গত রমজানেও আমরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে ইফতারের সহযোগিতা গ্রহণ করেছি এবং যথাযথভাবে তা ফিলিস্তিনে পৌঁছিয়েছি। তবে সমস্যা হচ্ছে, যে পরিমাণ সাহায্য পাচ্ছি, সব পৌঁছাতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনে কোনো কিছু প্রবেশ করাতে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করছে। 

গাজায় ‘বাংলাদেশ অনাথ আশ্রম’ নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে বলে আশা করি। আরও একটি খুশির সংবাদ হলো, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিলিস্তিনিদের ফুল ফ্রি শিক্ষাবৃত্তি প্রদানে সম্মত হয়েছে, যেটা ফিলিস্তিনের জন্য অনেক বড় সুসংবাদ। অনেক বড় সহযোগিতা। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি সাড়া পেয়েছি আমরা। এ জন্য আমি বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ফিলিস্তিনের প্রত্যাশা কী? 

ইউসুফ রামাদান: এটা খুবই পরিষ্কার। তারা অতীতে যা করেছেন, বর্তমানে যা করছেন- এটাকে অব্যাহত রাখুন। হাল ছেড়ে দেবেন না। এ দেশের জনগণ যা করছে, তা অভূতপূর্ব। ফিলিস্তিন একে মূল্যায়ন করে। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের পাতায় এসব সাহায্য-সহযোগিতার কথা খচিত থাকবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা পড়বে এবং জানবে। ফিলিস্তিন মুক্ত হওয়ার পর, আশা করছি আমরা একদিন বাংলাদেশের এ ভালোবাসার মর্যাদাপূর্ণ প্রতিদান দেব।  

খবরের কাগজ: গাজায় ইসরায়েলের হামলার ক্ষতির প্রভাব কী?

ইউসুফ রামাদান: এ হামলার ক্ষতির প্রভাব অবর্ণনীয়। আমি আগেই বলেছি, গাজার প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। কীভাবে আমরা এগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব? এগুলো পুনর্নির্মাণ করতে বহু অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু ফিলিস্তিনের সে সামর্থ্য নেই। ফিলিস্তিনের আর্থিক সক্ষমতা এমনিতেই কম। এ হামলা ও যুদ্ধের ফলে তারা আরও পঙ্গু হয়ে গেছে। 

ফিলিস্তিনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, ধ্বংস হওয়া জনপদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ফিলিস্তিনের যেহেতু এ সামর্থ্য নেই, সুতরাং সারা বিশ্বের সহযোগিতা প্রয়োজন। 

এ যুদ্ধ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ জনপদ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কেউ সহযোগিতাও করবে না। কারণ আজকে নির্মাণ করলে কালকে যে আবার ইসরায়েল তা ধ্বংস করে দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই।    

খবরের কাগজ: গাজায় আপনার কি কোনো আত্মীয় রয়েছে? 

ইউসুফ রামাদান: সরাসরি রক্তের সম্পর্কের কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমার একজন জামাতা রয়েছে সেখানে। যুদ্ধের প্রথম তিন সপ্তাহে সে তার পরিবারের ৫৯ সদস্যকে হারিয়েছে। আর আমি গাজার অধিবাসীও নই। আমি ফিলিস্তিনের অন্য অংশের অধিবাসী। ফলে গাজায় আমার সরাসরি কোনো আত্মীয় নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, গাজায় যত ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং বর্তমানে যত মানুষ জীবিত রয়েছেন, সবাই আমার আত্মীয়। তাদের কেউ আমার মা, কেউ বাবা, কেউ আমার বোন, কেউ ভাই, কেউবা ছেলে কিংবা মেয়ে। তারা সবাই আমার পরিবারের সদস্য।

খবরের কাগজ: ইসরায়েল কেন ফিলিস্তিনে হামলা চালাচ্ছে? এখানে কি কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণ জড়িত? মূলত কি কারণে তারা হামলা চালাচ্ছে বা যুদ্ধ করছে? 

ইউসুফ রামাদান: তাদের যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। লুকানোর কিছু নেই। ৭৬ বছর ধরে যার জন্য তারা যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেটা হলো- ফিলিস্তিনের পুরো ভূখণ্ড তারা দখলে নিতে চায়। পুরো ভূমি দখল করার পর তারা ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ গঠন করতে চায়। অন্য সব কারণ গৌণ। এটাই মূল বা প্রধান কারণ। নেতানিয়াহুর মতো কিছু কট্টরপন্থি ইহুদি এ মিশন বাস্তবায়নে জড়িত। এই মিশনের অংশ হিসেবে এখন তারা যেকোনো মূল্যে গাজার জনসাধরণকে ভূমিছাড়া করতে চাচ্ছে। গাজাকে খালি করে এটা দখল করবে এবং তাদের ‘বৃহত্তম ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার একটি ধাপ সম্পন্ন করবে, এটাই তাদের উদ্দেশ্য। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের এ মিশন কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করতে দেবে না। তারা তাদের জন্মভূমি রক্ষায় আমরণ লড়াই করে যাবে। ফিলিস্তিনি মানুষের দেশপ্রেম ও সাহসিকতা বিশ্বের মানুষকে বিস্মিত করেছে। 

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি ফিলিস্তিনিদের মতো ত্যাগ স্বীকার করেনি। ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে, তারা স্বাধীনভাবে এখানে জন্মেছে এবং স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার তাদের আছে। কেউ তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার রাখে না। তারা সৃষ্টিকর্তার দাস। নেতানিয়াহু, বাইডেন কিংবা অন্য কারও দাসত্ব করার জন্য তাদের জন্ম হয়নি। 

খবরের কাগজ: অনেকে বলেন, ‘হামাস ও ফাতাহ গ্রুপে বিভক্ত থাকা এবং শক্তিশালী বিশ্বস্ত নেতা না থাকার কারণে ফিলিস্তিনের এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না’- এ মন্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখেন? 

ইউসুফ রামাদান: ইয়াসির আরাফাত কি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত নেতা ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। তো তখন এ সমস্যার সমাধান হলো না কেন? ১৯৯০ সালে মাদ্রিদ থেকে তিনি এ সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু করেন এবং ২০০৪-এ এসে মারা যান। ১৪ বছর চেষ্টা করে তিনি কী পেয়েছেন? তখন তো হামাস ছিল না, ফাতাহও ছিল না। আমরা তখন একসঙ্গে ছিলাম। দেখুন, এটা ইসরায়েলের ছড়ানো একটি অজুহাত মাত্র। প্রোপাগান্ডা। তারা বলে বেড়ায়, ফিলিস্তিনিরা দেশ গড়তে পারবে না, কারণ তারা বিভক্ত। আমার দৃষ্টিতে, তারা (হামাস ও ফাতাহ) উভয়ই একই ভিশনে কাজ করছে। তারা উভয়ই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়। তবে দুই পক্ষের পন্থা ও চিন্তা আলাদা। কিন্তু ভিশন এক। স্বাধীন রাষ্ট্র চায় তারা। 

ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে বিভক্ত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং আমেরিকা তাকে এ কাজে মদদ দিচ্ছে। আশার কথা হলো, বর্তমান পৃথিবী বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয়েছে এবং পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে।

খবরের কাগজ: ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কী? আপনি কি কোনো আশার আলো দেখছেন?

ইউসুফ রামাদান: অবশ্যই, সব সময় আশা ছিল, আছে এবং থাকবে। আশা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আশাবাদী না হলে আমরা বাঁচতে পারব না। আমরা মুসলিম। আপনি জানেন, মুসলিম মানে কী? ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না।’ হতাশ হওয়া যাবে না। সব সময় আল্লাহর ওপর আশা-ভরসা রাখতে হবে। আপনি যদি এই আশা হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনি মানবতাকে হারিয়ে ফেলবেন। 

আমরা আশার ওপর বেঁচে থাকি, আশা নিয়েই অগ্রসর হই। আর এ কারণেই ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা বেঁচে আছে। নইলে আমরা অনেক আগেই অনেকের মতো হারিয়ে যেতাম। ফিলিস্তিনিরা ব্যতিক্রম। আল্লাহর ওপর আমাদের শক্ত বিশ্বাস আছে। আমাদের যা করার আছে, আমরা তা করছি- মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য স্বাভাবিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যা ভালো মনে করেন, তার ফয়সালা করবেন। প্রত্যেক ফিলিস্তিনি দৃঢ়ভাবে এমনটা বিশ্বাস করে।

খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ। 

ইউসুফ রামাদান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।  

সবার পরামর্শ নিয়ে সরকারের কাজ করা উচিত

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
সবার পরামর্শ নিয়ে সরকারের কাজ করা উচিত
নূর মোহাম্মদ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে দেশে যে অরাজকতা বিরাজ করছিল তা এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যে কঠিন সহিংসতা ঘটে গেছে তা খুবই ভয়ংকর। গত কয়েক দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে দুর্বিষহ সময় গেল তা চিন্তার বাইরে। মানুষের মধ্যে নানা রকম উৎকণ্ঠা, শঙ্কা ও ভয়ভীতি কাজ করেছে। দেশে কী হতে যাচ্ছে বা ভবিষ্যতে কী হতে পারে, এমন নানাবিধ শঙ্কা। সরকার এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কার নিয়ে যে দাবি তুলেছিল তা যৌক্তিক ছিল। মেধার ভিত্তিতে চাকরি হোক। গণপ্রজাতন্ত্রের চাকরিতে যে কোটা ছিল তা নিচের দিকে নামিয়ে আনা। এগুলো খুবই যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য দাবি ছিল। এই দাবি আদায়ে যে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল এবং জানমালের ক্ষতি হলো তা খুবই কষ্টদায়ক। সরকারি অনেক স্থাপনা নষ্ট হলো। 

সেতু ভবন, বিটিভি ভবন, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কোনো দেশপ্রেমিক এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে না। এর দায়ভারটা কে নেবে? সরকারের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিল বা যারা পরামর্শক ছিলেন, তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। এই সিদ্ধান্ত যদি আগেই দিতে পারত, তাহলে এমন সহিংসতা হতো না। তাহলে এতগুলো মানুষের প্রাণ হারাতে হতো না। 

নাশকতায় স্থাপনা ধ্বংস হতো না। আমি মনে করি, এখানে কিছুটা ভুলভ্রান্তি হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। এত দ্রুত সহিংসতা বেড়ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হবে তা আগে কেউ ভাবতে পারেনি। দেশের সবকিছুর পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে এলেও এই মানুষগুলোকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। প্রাণ হারানো মানুষগুলোর পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হলো, এর দায়ভার কে নেবে?

দেশের মানুষের মধ্যে ভয়ংকর এক অবস্থা বিরাজ করছে। আন্দোলন তো সব সময়ই হয়। এবারের ছাত্র আন্দোলনকে পুঁজি করে বিরোধী পক্ষ কিছু একটা করে সরকারকে দেখাতে ও বোঝাতে চেয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রেও বিরোধীরা এমন আচরণ করে থাকে। সরকারের দুর্বলতা সব সময় খুঁজতে থাকে বিরোধীরা বা তৃতীয় পক্ষ। কিন্তু এভাবে সরকারি স্থাপনা নষ্ট করা মোটেও কাম্য নয়। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দেশ হঠাৎ করে যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়, তাহলে স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবেই। আমার মনে হয়, সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তাতে অচিরেই দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করার চেষ্টা করছে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত বা দেশের মিলিটারি যা বলে সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপরি শান্ত হয়ে যাবে। এখন যে অবস্থা তাতে সারা দেশে ছোটখাটো দুর্ঘটনা হতে পারে। বড় কোনো সংঘাত তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা নেই। 

অন্যভাবে বলা যায়, যদি বেহালায় একটা টান দেওয়া হয়, তাহলে প্রথমে বড় একটা শব্দ করবে। তার পর ধীরে ধীরে সেই শব্দ বিলীন হতে একটু সময় লাগে। তেমনি দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে একটু সময় নেবে। তার পরও সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে বলে মনে করি।

দেশের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায়ও একটু ঘাটতি ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাদের এমন দুর্বলতা থাকে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গুলি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার ক্ষেত্রেও গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। গোয়েন্দাদের নজরদারি সব সময় সঠিক হয় না। তাদেরও কিছু ব্যর্থতা বা সচেতনতার অভাব থাকে।

যেহেতু কোটা সংস্কারের বিষয়টি সরকার আগে থেকেই জানত, সে ক্ষেত্রে ছাত্রদের এই আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত ছিল। সরকারের যে ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল সেটা নিতে পারেনি। 

দেশে আন্দোলন বড় রূপ ধারণ করলে স্বাভাবিকভাবেই তা পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রতিহত করা কঠিন হয়। এবারের আন্দোলনে এত বেশি নাশকতা হয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিল না। একটু আগে যদি এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হতো, তাহলে আন্দোলন সারা দেশে এত ছড়াতে পারত না। ছাত্র আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা বলেছিলেন, আন্দোলন আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে সময় সরকার শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আবার ফিরে আসবে। সেই সময় ছাত্রছাত্রীরা তাদের অন্যান্য দাবির জন্য আন্দোলন করতে পারে। তখন সরকারকে একটু চিন্তাভাবনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আগেই পরিকল্পনা করা ঠিক 
হবে না। ছাত্রদের আন্দোলনের ব্যাপারে ছাত্রলীগের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী সময়ে যাতে না বাড়ে, সে জন্য রাজনৈতিক দলসহ সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- ছাত্ররা পুনরায় দাবিদাওয়া তুললে সরকার আগে শুনবে। তারপর ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করবে। ছাত্ররা ১০টা দাবি তুললে সরকার হয়তো ৫টা রাখল, এভাবেই সমাধানে যেতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুরই সমাধান সম্ভব। আলোচনা না করলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবেই। ছাত্রদের সঙ্গে যথাসময়ে আলোচনা করলে সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নিতে পারত না। এসব বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদের ওপর পুলিশের গুলি করাটা খুবই অমানবিক কাজ হয়েছে। কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না। গুলি তখনই করে, যখন জানমালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। পুলিশ যাকে গুলি করেছে তার দিক থেকে বড় কোনো শঙ্কা বা ভীতিকর অবস্থা ছিল না। 

সবকিছু মিলিয়ে আবু সাঈদের যে অবস্থা দেখা গেল, সে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা লাঠি। সে খালি হাতে ঢিল ফেরাচ্ছে। পুলিশ তাকে গুলি করার কোনো অর্থই খুঁজে পাই না। সেই পুলিশ কনস্টেবল একদম অপেশাদারির পরিচয় দিয়েছে। একজন প্রশিক্ষণহীন মানুষের মতো কাজ করেছে। সেই কনস্টেবল একজন অবিবেচক ও অমানবিক কাজ করেছে।

দুষ্কৃতকারীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ ও সরকারি স্থাপনায় যেভাবে আগুন দিয়েছে তা ধারণার বাইরে। দুষ্কৃতকারীদের ধারণা ছিল, এভাবে ধ্বংসাত্মক কাজ করে সরকারকে অচল করে দেওয়া যায় কি না। এ জন্যই সরকারি স্থাপনাগুলোতে আঘাত করেছে।

উচ্চ আদালত কোটা সংস্কারের যে রায় দিয়েছেন, তা যথেষ্ট সম্মানজনক। ছাত্রদের কোটা সংস্কার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তবে সরকার ইচ্ছা করলে পরবর্তীকালে নারী কোটাসহ অন্যান্য কিছু সংযোজন-বিয়োজন করতে পারে। দেশে ইন্টারনেট না থাকায় যে অচলাবস্থা হয়েছে তা মানুষের জন্য বড় দুর্ভোগ। 

আমার মনে হয়, এখনই ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া উচিত। ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া জরুরি। কিন্তু সরকারের অবস্থান থেকেও বুঝতে হবে যে, এখনই যদি ইন্টারনেট খুলে দেওয়া হয়, তাহলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না। সরকার যখন চিন্তাভাবনা করে দেখবে যে, দেশ পুরোপুরি নিরাপদে আছে, তখনই খুলে দেওয়া সম্ভব। তবে সরকার খুব দ্রুতই খুলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় আছে।

এই মুহূর্তে সরকারের উচিত সবার পরামর্শ নিয়ে কাজ করা। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। ছাত্রদের যদি আরও কোনো যুক্তিসংগত দাবিদাওয়া থাকে; তাহলে আলোচনার মাধ্যমে কিছু দাবি মেনে নিয়েই সরকারের সামনে এগোনো উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এখনো কিছুটা শঙ্কা আছে। আশা করি, বৃহত্তর জনস্বার্থে সরকার অচিরেই শান্তি ফিরিয়ে আনবে।

লেখক: সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল,
বাংলাদেশ পুলিশ

কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বই হতে পারে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বড় শক্তি

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৬ এএম
কমলা হ্যারিসের নেতৃত্বই হতে পারে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বড় শক্তি
সাইমন জেনকিন্স

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদের দৌড়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী এখন কমলা হ্যারিস। তাকে দেখে কিছুটা দুর্বল মনে হলেও তিনি সফল হতে চান। আমেরিকার সাবেক দুই প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়। মার্কিন গণতন্ত্রে নেতাদের ব্যর্থতার সমালোচনা করা ইউরোপীয়দের দীর্ঘদিনের খেলা। 

কমলা হ্যারিস ৫৯ বছর বয়সী ক্যালিফোর্নিয়ার একজন আইনজীবী। তিনি একজন অভিবাসী শিক্ষাবিদদের মেয়ে। তার বাবা-মা দুজন দুই দেশের, একজন জ্যামাইকান এবং অন্যজন ভারতীয়। তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। তিনি তার রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল এবং শেষ পর্যন্ত একজন সিনেটর হয়েছিলেন। তিনি প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান, যিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন।

যদিও মনে হচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রচারাভিযানে কমলা হ্যারিসের জাতি এবং লিঙ্গের ওপর আক্রমণ করবেন। বারাক ওবামাও দুটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। যদিও ওবামার জাতি এবং লিঙ্গ নিয়ে সীমাহীন ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এতেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এ ধরনের প্রচারণা ভোটারদের খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। নারীর জন্য হোয়াইট হাউসে নিশ্চয়ই প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কৃতিত্বের কিছুটা ঘাটতি থাকলেও এগিয়ে যাচ্ছেন। মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্ত সংকট দিয়ে প্রথমেই তাকে বেঁধে দেন বাইডেন। তার সমালোচকরা এমনটাই দাবি করেন। অদ্রবণীয় ছিল। গর্ভপাত এবং অপরাধ নিয়ে বিভাজনে দেশীয় নীতিও বিভক্ত। প্রথমত, হ্যারিস একজন স্পষ্টবাদী প্রচারক। দ্বিতীয়ত, তিনি রক্ষণশীল বই লেখক হিসেবেও পরিচিত। 

হ্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ভেঙে পড়া ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে ট্রাম্পকে থামাতে সক্ষম না হলেও কমপক্ষে এমন এক কংগ্রেসকে নির্বাচিত করা হয়, যা তার বন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম। এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন নেতৃত্বের দক্ষতা প্রয়োজন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্চি ব্রাউন তার চ্যালেঞ্জিং কাজ ‘দ্য মিথ অব দ্য স্ট্রং লিডার’-এ এই থিসিসটি ভেঙে দিয়েছিলেন যে, যারা সহকর্মীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে তারা সবচেয়ে বেশি সফল হন। 

তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সহকর্মীদের ওপর নেতৃত্ব দেওয়াকে প্রায়শই দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটাকে বড় শক্তি হিসেবে দেখা হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইজেনহাওয়ার ও রিগান এবং ব্রিটেনের অ্যাটলি ও উইলসনের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

ব্রিটেনে একজন নেতার ক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদীয় দলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে কাজ করার ক্ষমতা থেকেই উদ্ভূত হয়। তেমনি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশংসা করে এবং তাদের ইচ্ছার কাছে নত করে খুব কম নেতাই জয়ী হয়েছেন। বারাক ওবামাকে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যেমনভাবে দেখা গেছে। 

কমলা হ্যারিসের শক্তি নিশ্চয়ই অন্য জায়গায়। ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি এগিয়ে এসেছেন। কারণ অনেকেই জো বাইডেনের বিদায়কে বিভিন্নভাবে আঘাত করতে শুরু করেছিলেন। এখন তাকে ঘিরেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে চায়। তার নিজের কোনো নির্বাচনি এলাকা নেই। তার অংশীদার, সমর্থক, সহযোগী, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং প্রতিভাপূর্ণ একটি দল প্রয়োজন। তাদের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্টেটগুলোতে সমর্থন জোরদার করতে হবে। কমলা হ্যারিসের শক্তি প্রচার করতে হবে এবং তার দুর্বলতাগুলো হ্রাস করতে হবে।

অতীতের অনেক প্রেসিডেন্টের উচ্চপদে আসীন হওয়ার অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তবে এতে ভেঙে পড়ার দরকার নেই। অ্যাটর্নি এবং সিনেট কমিটিতে কমলা হ্যারিসের অনুসন্ধানী ক্ষমতা তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। আপনি ইতোমধ্যে শিখেছেন- এমন বিশ্বাসের চেয়ে শেখার প্রস্তুতি প্রায়শই আরও বেশি কার্যকর। 

কমলা হ্যারিস যত পরামর্শ শুনবেন, তার তত জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তার চেয়েও বড় কথা, ট্রাম্পের আরেকটি প্রেসিডেন্সি এড়াতে মরিয়া আমেরিকানদের এখন আর কোনো বিকল্প নেই। কমলা হ্যারিসকে জয়ী করতে তাকে অবশ্যই সাহায্য করতে হবে।  

লেখক: গার্ডিয়ানের কলামিস্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, নজর দিতে হবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দিকে

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫০ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৫০ এএম
বিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, নজর দিতে হবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দিকে
শাহদীন মালিক

ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা দেখেছি। প্রথম দিকে আন্দোলন কোনো রকম সহিংসতা ছাড়াই সুশৃঙ্খলভাবে হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য শৃঙ্খলবদ্ধভাবে এই আন্দোলন করেছেন। অবরোধের মধ্যে কিছু কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ হয়েছে এ কথা অনস্বীকার্য। তবে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা সংঘটিত হতে দেখা যায়নি। 

তারপর সহসা আমরা দেখলাম চারদিকে সহিংসতা শুরু হয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর করা হলো। গাড়িঘোড়া পোড়ানো হলো। নরসিংদীর জেলখানা ভেঙে ৮০০-এর মতো কয়েদি পালিয়ে গেল। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক কিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের সঙ্গে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে- কারা এ ধরনের সহিংস আন্দোলনের পথে গেল!

সরকারের জবাব একটাই। এ কাজ করেছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে অবস্থিত ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ৬০ জন রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই কাজ সংঘটিত করেছে বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রফ্রন্ট ইত্যাদি গোষ্ঠী। 

সরকার মনে করে, বড় বড় দেশ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা এসব কে করছে, কেন করছে, এসবকিছুই তারা জানেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা অনেক কিছুই জানেন। সারা বিশ্ব এ সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে। এই সহিংসতা কে করেছে? এই সহিংসতা করেছে একটি অশুভ শক্তি, যারা কখনো দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গল চায় না। তারাই দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়েছে। এরাই সেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সহিংসতায় বিএনপি-জামায়াতের যে সম্পৃক্ততা নেই, সেটা কেউই জোর গলায় দাবি করছে না। এ ধরনের সহিংসতার পেছনে অবশ্যই জঙ্গিবাদী দলের সম্পৃক্ততা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়। একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কিছু সহিংস লোক থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, এভাবে পূর্বপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোর ওপর সংঘবদ্ধভাবে হামলা করা, এটা রাষ্ট্র আক্রমণের শামিল। এ ধরনের আক্রমণ দল-মতনির্বিশেষে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীই করতে পারে।

এ ধরনের কার্যক্রম করে তারা পরিবেশ অস্থিতিশীল করে থাকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকেন্দ্রিক যে সহিংসতা হয়েছিল, স্থানীয় সরকারের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, পাঠাগার পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম হয়েছিল। সেটাও জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে। সরকার শুধু বিএনপি-জামায়াতে ভূত দেখছে। এটা সম্পূর্ণ অমূলক। 

জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপানোয় সরকারের অতি উৎসাহের কারণে এই সন্ত্রাস গোপনে গোপনে ব্যাপক আকারে সংঘটিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে নজরদারির প্রয়োজন ছিল, সেই নজরদারি অনেকটাই শিথিল। হোলি আর্টিজেনের কথা যদি আমরা মনে করি, যে ছেলেরা এই হোলি আর্টিজেনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা জামায়াত-বিএনপির ছিল না। 

তারা ছিল উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রশিক্ষিত সদস্য। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় বিএনপির বর্ষীয়ান নেতাকে রিমান্ডে নেওয়া হলো। কিন্তু ছাত্রী মেরে ফেলা কোনো জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের কথা আমরা শুনিনি। বিএনপি-জামায়াতের নিশ্চয়ই কিছু সংশ্লিষ্টতা আছে। এ ধরনের সহিংসতা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করে, এমন সব স্থাপনায় ভাঙচুর করা, ইন্টারনেট অকেজো করে দেওয়া, আমি বিশ্বাস করতে চাই না, ভালোমন্দ যেটাই হোক, বিএনপির মতো পুরোনো রাজনৈতিক দল এটা করতে পারে না। 

এসব কাজ করে থাকে চরমপন্থী জঙ্গিরা। আমরা দেখছি সরকার বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করছে। ফলে চরমপন্থী জঙ্গিরা যে ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে, সেদিকে সরকারের যতটুকু তৎপর হওয়ার কথা ছিল, সেই তৎপরতা দেখছি না। এতে আশঙ্কা করা হয়, সরকার এক পক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে আরও অন্যান্য যে ভিশন শত্রু দেশে সয়লাব হয়ে গেছে, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়েছে। 

এটাই সবচেয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কার ব্যাপার যে, এতে নিশ্চয়ই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের বিরাট ব্যর্থতা আছে। এত জায়গায়, এতভাবে আক্রমণ হলো এভাবে সংঘবদ্ধ আক্রমণ, অথচ তারা কিছুই জানত না। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে সরকারের যে একচোখা মনোভাব দেখাল, এতে আমাদের রাষ্ট্রই সশস্ত্র হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ল। 

আমরা চাই দেশব্যাপী অস্থিতিশীল পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হোক। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এখন অবধি সঠিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার কোনো সুযোগ দেখছি না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকার যদি সমঝোতার পথে আসতে চায়, তাহলে শুরুতেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা দরকার। 

পুলিশের গুলিতে নিহত রংপুরের আবু সাইদের মৃত্যু এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের তদন্তের মাধ্যমে বিচার করা উচিত। দেশে অন্যায়-অবিচার হলে সব মহলই বিচারের জন্য তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানায়। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে সঠিক বিচার তারা পায় না। আমার মতে, বিচার বিভাগকে অচিরেই ঢেলে সাজানো খুবই জরুরি। 

দেশব্যাপী সহিংসতায় অর্থনীতি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশে সেনাবাহিনী নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে, হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারকে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সব সমস্যা সমাধানের পথে যেতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যাপীঠে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। দেশ ও দেশের স্বার্থকে সবার আগে আমলে নিয়ে দল-মতনির্বিশেষে সব পক্ষকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তৎপর হতে হবে।

লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক

প্রগতিশীল সমাজ গঠনে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৫ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪৫ এএম
প্রগতিশীল সমাজ গঠনে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে
হীরেন পণ্ডিত

দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যুবক। বিভিন্ন আর্থসামাজিক বৈচিত্র্যসহ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হলে তরুণদের কথা ভাবতে হবে। তরুণরা বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, যুবকদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। সরকারের যুবনীতিতে এ সীমা ১৮ থেকে ৩৫ বছর। বয়সসীমা যদি ২৯ বছর ধরে যুবক হিসেবে ধরা হয়, তাহলে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এর নিচে।

তারুণ্য হলো মানুষের জীবনে সাহস, সংগ্রাম ও সৃজনশীলতার সময়। পুরোনো ভেঙে সংস্কার করে নতুন কিছু করা যেন তারুণ্যের ধর্ম। সমাজের এই সংস্কারকাজে তরুণসমাজকে সাহস ও সততার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণরা সমাজের সর্বস্তরে পরিবর্তনের বিপ্লব শুরু করবে এবং এ ক্ষেত্রে তরুণসমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই সবচেয়ে কার্যকর। সমাজে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি দেখলে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিবাদ যদি তরুণসমাজের কাছ থেকে আসে তাহলে তা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

আমাদের দেশের তরুণদের অর্জন অনেক। খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তরুণরা এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উদ্দীপনা এবং সম্ভাবনাকে ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণসমাজ। তবে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের শক্তি দেশ ও জাতির জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা যেমন স্পষ্ট নয়, তেমনি তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আজকের তরুণসমাজই ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক। 

তারা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সমাজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করবে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সব কল্যাণমূলক কাজে যুবসমাজের অংশগ্রহণ আবশ্যক। তরুণসমাজ ঘুমিয়ে থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সমাজের আকাশ থেকে কখনো কালো মেঘের ছায়া সরবে না। সমাজ পরিবর্তন করতে হলে তরুণসমাজকে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি দেশ ও সমাজের কথাও ভাবতে হয়। সব সমাজকল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে আসতে হবে। 

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ সব সংস্কার আন্দোলনে তরুণদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ছিল। আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। তাই একটি আদর্শ সমাজ গঠনে তরুণসমাজকে কিছু চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। সামাজিক রাষ্ট্র নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী সাহসিকতার সঙ্গে সব বাধা অতিক্রম করে স্বপ্নের পথে হাঁটতে হবে। সঠিক প্রস্তুতি নিতে হবে এবং তরুণসমাজের সঠিক প্রস্তুতি শুধু নিজেকে নয়, সমাজকে, রাষ্ট্রকে নিয়ে যাবে অনন্য সাফল্যের পথে। 

তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উনয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে জন্য বর্তমান সরকার মজুরির মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তরুণদের জন্য উপযুক্ত চাকরি নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিচ্ছে- উপার্জন এবং আত্মকর্মসংস্থান।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শ্রমবাজারে দক্ষ ও শিক্ষাগতভাবে যোগ্য শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে পারছে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষায় বিশেষ দক্ষতার অভাবে চাকরির বাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না পড়াশোনা শেষ করা তরুণ-তরুণীরা। কলেজের স্নাতকদের মধ্যে মাত্র ১৯ শতাংশ ফুলটাইম বা পার্টটাইম নিযুক্ত, যেখানে প্রায় অর্ধেক বেকার। অধিকন্তু নারী স্নাতকদের স্নাতক হওয়ার দুই বছর পরও বেকার এবং পড়াশোনার বাইরে থাকার আশঙ্কা অনেক বেশি: ৩৭ শতাংশ পুরুষ স্নাতকের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বেকার থাকে।

তরুণদের বেকারত্বকে অর্থনীতির জন্য একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের নীতিমালায় অনুপস্থিত। জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয়নি বলে মনে করেন অনেকে। নীতিমালায় তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। অবশ্য অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান বেশি হওয়ায় কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হতে হবে বেসরকারি খাতকে। 

এ জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন কাঠামো, তদারকি ও মান নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে করতে হবে। উচ্চশিক্ষার কারিকুলাম তৈরি করতে হলে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কারিকুলাম হালনাগাদ করতে হবে। আইনপ্রণেতা, নিয়োগকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সরকারকে কিছু প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নিতে হবে। 

এ জন্য আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য কর্মশক্তির বিভিন্ন বিভাগের জন্য চাকরি তৈরি করে। চাকরির সংখ্যা, তাদের ধরন এবং কোন সেক্টরে চাকরি তৈরি করা হবে তার একটি চিত্র থাকতে হবে।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষতা উনয়ন প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবু চাকরির বাজারে দক্ষতার বিশাল ঘাটতি রয়েছে। বেসরকারি খাতের অনেক কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি-সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের যুবকদের মধ্যে, কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব দেখায়, যা তাদের আরও পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। একটি প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য যুবসমাজকে মূলধারায় যুক্ত করার জন্য আমাদের উপরিউক্ত বিষয়টিতে মনোনিবেশ করা উচিত। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো

হাওয়ায় ভেসে থাকা থেকে মাটিতে নেমে আসার অনুভূতি

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪২ এএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪২ এএম
হাওয়ায় ভেসে থাকা থেকে মাটিতে নেমে আসার অনুভূতি
অমিয় দত্ত ভৌমিক

আজ থেকে পাঁচ শ বা হাজার বছর পর ইন্টারনেট আবিষ্কারের আগের সময়টাকে বলা হবে আদিম যুগ। আর আমরা যেটাকে আদিম যুগ বলছি সেটাকে ‘আদিম দাদার যুগ’ বলা হতে পারে। সে হিসেবে আমরা যারা ইন্টারনেট যুগের আগে জন্মেছি তারা আদিম যুগের মানুষ হিসেবে বিবেচিত হব। আর যারা এই আদিম যুগের শেষ ধাপ আর ইন্টারনেট যুগে প্রবেশের সময়টা দেখেছি, তারা কোন হিসেবে বিবেচিত হব, তার সঠিক নাম আমি এখনো দিতে পারছি না।

আজ আমার এই লেখাটি যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। আমরা যারা আদিম যুগ থেকে ধীরে ধীরে ইন্টারনেট তথা আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছি, তাদের কাছে বিষয়টি বেশ মজার। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বা তারপর যারা জন্মেছে তারা আদিম যুগের মধ্যে পড়ছে না। তবে তার বাবা-মা, দাদা-দাদিরা আদিম যুগের।

আধুনিক যুগে প্রবেশের পর থেকে আমরা কমবেশি সবাই আদিমতা ভুলে এই যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখে গেছি। আমাদের হাতে আদিমকালে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিকস জিনিসের পরিবর্তে চলে এসেছে অত্যাধুনিক সব ডিভাইস। এগুলোই এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। এক দশক আগেও কিছু কিছু অফিস-আদালতে ‘সেমি আদিম’ যুগের ইলকট্রনিকস জিনিসের ব্যবহার ছিল। 

বিশেষ করে দেশে-বিদেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে টেলিফোনের ল্যান্ডলাইন, ফ্যাক্স ইত্যাদি। ধীরে ধীরে এগুলোও আর ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক অফিসে যন্ত্রটি থাকলেও তা সচল আছে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ আছে।

আধুনিক যুগে প্রবেশের পর আমরা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তা হলো ইন্টারনেট। এর ব্যবহার এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সব জায়গাতেই এটি সমানভাবে সমাদৃত। আমাদের কাছে এটি এখন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হয়েছে। অনেককে তো বলতে শোনা যায়, এটি নাকি অনেক ক্ষেত্রে ‘টনিক’ হিসেবে কাজ করে। 

সন্তান লালন-পালন করতে ইন্টারনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেও অনেকে অভিমত দেন। আবার এর বদৌলতে ঘরে বসেই দলবদ্ধ আড্ডাও চলে। যাক ওসব কথা। আসি সাম্প্রতিক বিষয়ে।

মাঝেমধ্যে এই ইন্টারনেট ডাউন হয়ে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কিছু বিষয়ের সঙ্গে আমাদের কমবেশি পরিচয় আছে। এটা স্বল্প সময়ের জন্য হতো। তবে বিকল্প ব্যবস্থাও থাকত। কোম্পানি বদল করে বা একসঙ্গে একাধিক সংযোগ ব্যবহার করে সবাই কাজ চালিয়ে নিতে পেরেছেন। 

কিন্তু গেল কয়েক দিন দেশজুড়ে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংস আন্দোলনের ফলে বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এটাও সপ্তাহখানেক হয়ে গেল। এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন বিরাট ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি জনজীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার! যারা শতভাগ ডিজিটাল জীবনযাপন করেন, তাদের তো ‘ঘোর কলি’ চলছে। তাদের খাওয়া, ঘুম, চলাফেরা সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

অন্যদিকে ইন্টারনেটের বদৌলতে সংবাদমাধ্যমেও এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। আগে যেভাবে সংবাদ সংগ্রহ বা প্রকাশ করা হতো, তা থেকে সরে আধুনিক যত পদ্ধতি আছে সবই ব্যবহৃত হচ্ছে এই দুনিয়ায়। ফলে সংবাদ সংগ্রহে সংবাদমাধ্যমগুলোকে বেগ পেতে হচ্ছে। 

আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বড় একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ভিত্তি করে মূল ধারাকে ছাড়িয়ে ফেসবুক বা ইউটিউবকে সংবাদ পাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম মনে করে থাকে। ফলে এসব নেশাতুরদের চলছে ‘ঘোর কলি’।

অন্যদিকে যারা, আধা আদিম আর আধা আধুনিক তারা একটা অন্য রকম অনুভূতি পাচ্ছেন। অনেক দিন পর এমন একটা সময়ের অপেক্ষা হয়তো তারা করেননি। কিন্তু যেকোনোভাবেই হোক, এমন একটা সময় তারা উপভোগ করছেন। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের মতো সেই দিনগুলো অল্প সময়ের জন্য হলেও ফিরে পেয়েছেন। আর চলমান ইন্টারনেটবিহীন পারিবারিক আড্ডায় সন্তানদের সঙ্গে আদিম হতে যাওয়া যুগের কিছু প্রচলিত সামাজিক ও পারিবারিক চিত্র কেমন ছিল তা হয়তো বোঝাতে পারছেন।

আমরা যান্ত্রিক জীবনে শুধু ছুটছি আর ছুটছি। যতটুকু সময় ঘরে কাটানোর সুযোগ হয় তারও অধিকাংশ কেটে যায় মোবাইল ফোন ঘিরে। এতে এক সময়ের পারিবারিক রীতিগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। এই কয়েক দিন ভাসমান দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অনুভূতি নতুন প্রজন্মের কাছে একেবারেই অনভিপ্রেত। তবে তাদের আগের প্রজন্মের থেকে শোনা কথাগুলো সপ্তাহখানেক আগ পর্যন্ত অনেকটা গল্পের মতো লাগলেও তা যে সত্যিই এমন ছিল, এটা নিশ্চয়ই বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়।

যে শিশুটি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল সেটে গেম খেলত, সে এখন টেলিভিশন দেখছে। অনেকেই লুডু খেলছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় পরিবারের সবাই বসে টেলিভিশনে সিনেমা বা নাটক দেখছে। খাবার টেবিলে বসে দাদা-দাদি, মা-বাবার সঙ্গে আড্ডা হচ্ছে। পরে পড়বে বলে ফেলে রাখা বইগুলোও হয়তো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। 

মোট কথা, এক ছাদের নিচে থেকেও যে পরিবারের সঙ্গে অনেকটা দূরত্ব ছিল তা অল্প সময়ের জন্য হলেও সবার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে। 

এই ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা আমাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে পেছনে নিয়ে গেলেও পরিবার বা সমাজের যে আলাদা একটা প্রাণ আছে, তা এই প্রজন্মের সামনে হাজির করতে পেরেছে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, খবরের কাগজ