![দীর্ঘশ্বাস, দুর্ভোগ এবং ডলার](uploads/2024/06/10/Rajekuzzaman-Ratan-1717994437.jpg)
ঢাকা বিমানবন্দরে এত মানুষের ভিড়, আহাজারি আর হতাশা অনেক দিন দেখেনি দেশের মানুষ। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে, পাড়া-পড়শিদের দোয়া নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়া যাবেন বলে। বাবার পেনশনের টাকা, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে, জমি বন্ধক রেখে, মায়ের গহনা কিংবা গরু বিক্রি করে তাদের অনেকেই মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য টাকা জমা দিয়েছিলেন। কেউবা টাকা সংগ্রহ করেছিলেন ব্যাংক থেকে কিংবা লগ্নিকারকদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে। দেশে কিছু করতে পারছিলেন না, মালয়েশিয়ায় গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাবেন, ভবিষ্যৎ গড়বেন, এই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু যেতে না পেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাদের। একরাশ হতাশা নিয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফিরে গেছেন কয়েক হাজার মানুষ।
মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা ছিল, অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের সে দেশে প্রবেশের শেষ দিন ছিল ৩১ মে, শুক্রবার। শেষ দিনে যাওয়ার সর্বশেষ চেষ্টা করতে তাই শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন হাজারও মালয়েশিয়া যেতে প্রত্যাশী যুবক। কিন্তু তারা সবাই যেতে পারেননি।
ভিসা ও অনুমোদন জটিলতায় ৩১ হাজার ৩০৪ জন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি বলে নিশ্চিত করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দায়িত্বশীল সূত্র। নিয়ম অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হয়। প্রশ্ন হলো, মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিতে পারে কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কি? কারণ, এজেন্সিগুলোর মালিক এবং সিন্ডিকেটের কেন্দ্র বলে ক্ষমতাসীন দলের এমপি, সাবেক সামরিক-বেসামরিক বড় বড় কর্মকর্তার নাম এসেছে।
নিয়ম অনুযায়ী ৭০ হাজার টাকা প্রয়োজন হলেও মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক একজন কর্মী গড়ে খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। শেষ দিকে বিমানের টিকিটের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় খরচের পরিমাণ আরও বেড়েছে। টাকা বেশি লাগে লাগুক, তবু যেতে হবে- এই মানসিকতার কারণে খরচ করতে দ্বিধা করেননি তারা। যারা ছাড়পত্র নিতে পারেননি, শুধু বিমান ভাড়া ছাড়া বাকি টাকা এজেন্সিকে দিয়েছেন। অর্থাৎ ৩১ হাজার ৩০৪ জন যেতে না পারা কর্মী কয়েক লাখ টাকা করে দিয়েছেন। যাওয়া তো অনিশ্চিত, এখন টাকা ফেরত পাবেন কি না, পেলে কত ফেরত পাবেন সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।
মালয়েশিয়া যেতে টাকা জমা দিয়ে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। শ্রমবাজার চালু থাকার সময় অনেকেই বিদেশে যেতে প্রক্রিয়া শুরু করেন। এর মধ্যে কেউ কেউ হয়তো পাসপোর্ট করে এজেন্সির কাছে জমা দিয়েছেন। কেউবা পাসপোর্ট, মেডিকেল করেছেন। এরা সবাই এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে কিছু কিছু করে টাকা দিয়ে রেখেছেন। এসব টাকার কোনো মানি রসিদও থাকে না। বিদেশ গমনেচ্ছু এমন কর্মীর সঠিক সংখ্যা কত, তার কোনো হিসাব কারও কাছে নেই।
বায়রার যুগ্ম মহাসচিব বলেছেন, সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীর সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের পর মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার। গত দেড় বছর সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে মালয়েশিয়ায়, সাড়ে ৪ লাখের বেশি। শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রবাসে যাওয়া এবং প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু কেন এই সংকট দেখা দিল?
এবারই প্রথম নয়, গত ১৫ বছরে তিন দফায় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে। প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে চক্র বা সিন্ডিকেট গঠনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এই চক্রের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের প্রচুর অভিযোগ উঠেছে বারবার। ২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষে খোলা হয় বাজারটি। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি মিলে এক সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০২২ সালে আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। তখন আবারও গড়ে ওঠে সিন্ডিকেট। গত মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, দেশটি আপাতত আর শ্রমিক নেবে না। যারা অনুমোদন পেয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, তাদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে। ফলে এটা তো জানা ছিলই, তাহলে এই হাজার হাজার কর্মীর না যেতে পারার দায় কে নেবে?
এ কথা তো জানা আছে যে, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে শ্রমবাজার খোলার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছিল। তখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এজেন্সি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয় মালয়েশিয়াকে।
বাংলাদেশের এজেন্সি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড ছিল না। ফলে পুরো সুযোগটি নিয়েছে মালয়েশিয়ার কর্মী নিয়োগের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) সফটওয়্যার মাইগ্রামের মালিক প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট। এটির মালিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর। তিনি মালয়েশিয়ার নাগরিক, আমিন নূর নামে পরিচিত।
মালয়েশিয়া থেকে আমিন নূর কর্মী পাঠানোর পুরো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশে তার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন ওরফে স্বপন। তারা দুজন মিলে বাংলাদেশি এজেন্সিদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। প্রথমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর চক্রে ছিল ২৫টি এজেন্সি। এরপর ধাপে ধাপে মোট ১০০ বেসরকারি এজেন্সি অনুমোদন পায়, আর এর সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি এজেন্সি বোয়েসেল। ফলে কর্মী দুর্ভোগের জন্য কাদের দায় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র বারবার উঠে আসছে। পৃথিবীর প্রথম ১০টি কর্মী পাঠানোর দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নবম। সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম ও কম বেতনের কাজগুলোই করে বাংলাদেশি শ্রমিকরা আর বাংলাদেশের শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার খরচ পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ যে কী তা চোখে পড়ে না। কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান জোগানদাতা এই প্রবাসী শ্রমিকরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গত ২৯ মে ১৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। যদিও বাস্তব ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। এই তীব্র ডলারসংকট, টাকার দাম কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রিজার্ভসংকটের দুশ্চিন্তা, আর ঋণ নিতে গিয়ে আইএমএফের শর্ত- এসব শঙ্কা জাগানো তথ্যের মধ্যে নতুন আশার খবর হলো, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে। মে মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ২২৫ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা প্রায় চার বছরের (৪৬ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ, আর এযাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ২ হাজার ১৩৭ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে আসা ১ হাজার ৯৪১ কোটি ডলারের চেয়ে ১৯৬ কোটি ডলার বা ১০ শতাংশ বেশি। সেবার পুরো অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এক মাস বাকি থাকতেই আগের অর্থবছরের প্রায় সমান ডলার প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন। গত এপ্রিলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২০৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ১৬৯ কোটি ডলার। পরিবারের সদস্যরা একটু আনন্দ করবে, এ কথা ভেবে নিজের কষ্টে উপার্জিত টাকা ঈদের আগে পাঠিয়ে থাকেন প্রবাসীরা। সে কারণে প্রতিবছর ঈদের আগে প্রবাসী আয় বেড়ে যায়, এবারও তাই বেড়েছে। তবে এর চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স আনা সম্ভব যদি হুন্ডি বন্ধ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে সব রেমিট্যান্স আনা যায়।
পরিবারের দায়, নিজের কর্মসংস্থান আর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার পূরণের দায়িত্ব যারা পালন করেন, বিমানবন্দরে তাদের কান্নার ছবি দেখে আমাদের কি কোনো দায় অনুভূত হবে না? যারা এই দুর্দশার জন্য দায়ী তারা কি শাস্তির আওতায় আসবে না? নাকি দায়হীন দুর্দশা চলতেই থাকবে আর সরকার শুধু ডলার গুনবে?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]