![ভারতের নির্বাচনি ফল দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না](uploads/2024/06/11/Towhid-Hossan-1718083897.jpg)
সম্প্রতি ভারতের লোকসভা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আগে বিজেপি একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল যে, তারা ৪০০ আসন প্রত্যাশা করছে। ভারতীয় মিডিয়াও এর সঙ্গে অনেকটা সুর মিলিয়ে বলতে চেয়েছিল যে, বিজেপি নিশ্চয়ই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। বিজেপির আসন পাওয়ার বিষয়ে এরকমই একটা ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা অবধারিতভাবেই হয়নি। বিজেপি জোট পেয়েছে ২৯৩টি আসন। সরকার গঠনের জন্য বিজেপি এককভাবে ২৭২ আসনও পায়নি। তারা পেয়েছে ২৪০টি আসন।
এ ক্ষেত্রে কিছু চমক নিশ্চয় ছিল বলা যায়। কংগ্রেস গত ১০ বছর ধরে খুবই খারাপ অবস্থায় ছিল। বিরোধীদল হওয়ার জন্য ন্যূনতম যেটুকু প্রয়োজন সেটাও তাদের ছিল না। প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দল বলে ১০ বছর ধরে ভারতীয় লোকসভায় কিছু ছিল না। সেদিক বিবেচনায় কংগ্রেস পুনরায় ফিরে এসেছে বলা যায়। কংগ্রেস জোট থেকে ২৩২টি আসনের মতো পেয়েছে। বিজেপির যেমন তার জোটের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে কিন্তু মূল অংশটি বিজেপির পাওয়ার ছিল। কংগ্রেস অর্ধেকও পায়নি। যদিও আগের নির্বাচনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ আসন তারা পেয়েছে।
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে গতকাল ৯ জুন সন্ধ্যায় টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনে কংগ্রেস জোট ২৩২টি আসন পেলেও এককভাবে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা মাত্র ৯৯টি।
অনেকেই এমনকি নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছিলেন ছিলেন, ৪০০ না হলেও ৩৫০ আসন পাচ্ছেন মোদি। কিন্তু তাদের ধারণা ও উত্তেজনা সবই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ‘বিজেপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এটা আমার কাছেও অতিপ্রত্যাশা বলে মনে হয়েছিল এবং এক প্রশ্নোত্তরে আমি সেটা বলেছিলাম।
বিজেপি যেহেতু একক সংখ্যাগড়িষ্ঠতা পায়নি অথবা বলা যায়, জোটসঙ্গীদের সমর্থন নিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করছে। ইতোমধ্যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, বিজেপির আসনসংখ্যা ২৪০-এ নেমে আসা এবং কংগ্রেসের ৫২ থেকে ৯৯ আসনে উত্তরণ, সেই সঙ্গে ১০ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে এককভাবে ভারত শাসনের পর সরকার গঠনে মোদির জোটসঙ্গীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়াকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরাজয় এবং উদারনৈতিকতার একপ্রকার বিজয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে দুটি দিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রথমত, মোদি টানা তিনবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। অন্যদিকে লোকসভায় গত ১০ বছরব্যাপী বিজেপির এককভাবে আধিপত্যের অবসান হলো। অন্যদিকে ভারতীয় লোকসভায় একটি বাস্তব বিরোধী দল থাকছে, যাদের কণ্ঠস্বরও এখন থেকে শোনা যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস দলের ভরাডুবি হলেও সেই অবস্থা থেকে তারা আবার মূলধারায় ফিরতে পেরেছে।
গত দুটি লোকসভায় কোনো স্বীকৃত বিরোধী দল ছিল না। প্রয়োজনীয় ৫৫টি আসন লাভেও ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। ৯৯টি আসন নিয়ে কংগ্রেস এবার স্বীকৃত বিরোধী দল হিসেবে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে। ভারতের গণতন্ত্রের ক্রান্তিলগ্নে দুটি বিষয়ই আশাব্যঞ্চক খবর। কিন্তু আরেকটু যদি গভীরে প্রবেশ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, আঞ্চলিকভাবে হয়তো কিছু কিছু মেরুকরণ ঘটেছে, কিন্তু সর্বভারতীয় পর্যায়ে ২০১৯-এর তুলনায় বিজেপির ভোট কমেছে।
সাধারণ মানুষের ক্ষমতাসীনদের ওপর অসন্তোষ, সে কারণেই হোক এমনকি আরেকটু বেশিও তফাৎ হতে পারত। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ভোটারদের মাঝে বিজেপির সার্বিক প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। লোকসভায় আসন লাভে যদিও ব্যাপক হ্রাস-বৃদ্ধি হয়েছে, জনসমর্থনে পরিবর্তন সে তুলনায় তেমন স্পষ্ট নয়। দুই দলই আগামী পাঁচ বছর পর ২০২৯-এর নির্বাচনের জন্য তাদের কার্যকৌশল নির্ধারণ করবে বলেই মনে হয়।
ভারতের এই নির্বাচনি ফল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে হয়। কারণ, দুই দেশের কোথাও নীতিগত পরিবর্তন হয়নি এবং উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে পুনঃ পুনঃ সন্তোষ ব্যক্ত করে আসছেন। বাংলাদেশের চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু ঘটবে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। যেহেতু বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়গুলোর সমাধান না করেই ভারত তার স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে, কাজেই বিষয়গুলো খুব দ্রুত সমাধান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলা যায়।
তাছাড়া নিয়মমতো পূর্বপ্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম ছাড়া শীর্ষ বৈঠকে বড় কোনো সিদ্ধান্ত সাধারণত হয় না। এমন কোনো দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়েনি। কিছুদিন আগে সংক্ষিপ্ত সফরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব যখন এসেছিলেন, তিনি দ্বিপক্ষীয় আলোচনা নয় বরং তিনি এসেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিমন্ত্রণপত্র হস্তান্তর করতে, দুই দেশের বিষয়ভিত্তিক কোনো আলোচনা করতে নয়।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে হয়তো দুই দেশের সরকারেরই নতুন মেয়াদে প্রবেশ উপলক্ষে একটি সৌজন্য সফর হলেও যদি কোনো পাস্পরিক সমস্যা সমাধানে প্রকৃত অগ্রগতি হয়, যেমন তিস্তা বা সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের মানুষ তাকে সানন্দে স্বাগত জানাবে। আমার মনে হয় বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এমন কোনো বড় প্রভাব পড়বে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মোদি এবং বিজেপির অবস্থান যেমন ছিল সেটা তারা ধরে রাখতে পারবে বলেই প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কথা যদি বলি, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ ভালো অবস্থায় আছে। আমাদের পক্ষ থেকে হয়তো কিছু চাওয়া-পাওয়ার আছে। সেটাও পাওয়ার ব্যাপারে আমার মনে হয় না দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। সম্পর্ক যেরকম আছে কমবেশি সেরকমই থাকবে বলেই আমি মনে করি।
লেখক: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব