ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ-এই দুই উৎসব ঘিরেই বড় ধরনের বাণিজ্য হয়। ব্যবসায়ীরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন এসব বাণিজ্যের জন্য। এবারের চিত্র ভিন্ন। ঈদুল ফিতরের দুই দিন পরেই পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা বর্ষবরণ উৎসব। এবার ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনা চললেও বৈশাখী বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘ন্যূনতম ২০-২৫ বছর আগে-পরে দুই উৎসব হলে সাধারণ ক্রেতারা বাজেট করে প্রস্তুতি নিয়ে কিনতে পারেন। বিগত সময়ে দুই উৎসব থেকে যে পরিমাণ মুনাফা ঘরে তুলছেন ব্যবসায়ীরা এবারে তার থেকে কম হবে।’
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতর এবং বৈশাখ বরণ দুটি ভিন্ন উৎসব। দুই উৎসব ঘিরেই ক্রেতা-বিক্রতাদের প্রস্তুতি থাকে। বেচাকেনাও ভালো হয়। এবারে দুই উৎসব প্রায় এক সঙ্গেই হচ্ছে, মাত্র দুই-তিন দিনের ব্যবধান। ধনীদের কথা বাদ দিতে হবে। সাধারণ মানুষই প্রধান ক্রেতা। তারা প্রতিদিনের খরচের চাপে কষ্টে আছেন। দুই উৎসবের জন্য মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে আলাদা কেনাকাটা করা তাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, ‘এবারে কেনাকাটার ধরন দেখে বলা যায়, সাধারণ আয়ের মানুষ খরচের চাপ কমাতে এক কেনাকাটায় দুই উৎসব পার করার চেষ্টা করছেন। ক্রেতারা ঈদকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বৈশাখকেন্দ্রিক কেনাকাটা কম। তাই বৈশাখী বাণিজ্য প্রতিবার যেমন হয় এবারে তা হচ্ছে না।’
ফেরিওয়ালার ঝুড়ি থেকে নামিদামি শপিংমল সব জায়গায় ঈদ ও বৈশাখী বেচাকেনা চলে। দুই উৎসব ঘিরে বাণিজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সূত্র জানায়, ঈদুল ফিতরে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ কোটি টাকার এবং পহেলা বৈশাখে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর। অন্যদিকে সব ধর্মবর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে বাংলা নববর্ষ এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। দুই ঈদের পরে সবচেয়ে বড় উৎসব এটি। এই দুই উৎসব ঘিরেও বড় ধরনের বেচাকেনা হয়। এবারে ঈদ উদযাপনে গুরুত্ব বেশি থাকবে। ফলে বৈশাখী বাণিজ্য কমবে। ঈদ ও বৈশাখ বরণ ঘিরে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পোশাক। বৈশাখী পোশাকে লাল সাদার দাপট থাকে। অন্যদিকে ঈদে সব রঙয়ের পোশাকই চলে। সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমল এবং বিপণিবিতান ঘুরে দেখা যায়, ঈদের পোশাক দোকানে সাজানো বেশি। বিক্রিও হচ্ছে বেশি। ঈদের পোশাকেও লাল-সাদার নকশা রয়েছে। এবারের ঈদে গরম থাকায় হালকা রংয়ের পোশাকের চাহিদা বেশি। ঈদে ব্র্যান্ড, নন ব্র্যান্ড, দেশি-বিদেশি সব ধরনের পোশাকের চাহিদাই রয়েছে।
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, দুই ঈদ ও দুর্গা পূজায় দেশি ফ্যাশন হাউসের পোশাক বিক্রি বেশি হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বৈশাখ বরণ উপলক্ষে। এ সময়ে গ্রাম বাংলার দৃশ্য, পাখি, ফুল, ফল, নদী, বাঙালি ললনার ছবি আঁকা, সুতা দিয়ে নকশা করা রং বেরং এর শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়ার চাহিদা বাড়ে। এবারে এসব ফ্যাশন হাউসগুলো বৈশাখের চেয়ে ঈদকেন্দ্রিক পোশাক, সাজসজ্জাসহ অন্যান্য পণ্য বেশি রেখেছেন।
দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোর সংগঠন ফ্যাশন অন্ট্রাপ্রেনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এবং সাদাকালো ফ্যাশন হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজহারুল হক আজাদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাধারণত বৈশাখের পোশাক ঈদে চলে না। তবে ঈদের পোশাক বৈশাখে চলে। ঈদের পরেই বৈশাখ বরণের উৎসব হওয়ায় অনেক ক্রেতা ঈদের পোশাক দিয়ে বৈশাখের অনুষ্ঠান পার করতে চাইছেন। বৈশাখের জন্য আলাদা পোশাক কিনছেন না। একজন সাধারণ আয়ের মানুষের পক্ষে পাশপাশি দুটো উৎসবের জন্য আলদাভাবে পোশাক কেনার মতো খরচ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমাদের এক উৎসবের বাণিজ্য হচ্ছে না বললেই চলে। অথচ শুধু দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোর পোশাক বণিজ্য হয় প্রায় আট হাজার কোটি টাকার। এবারে এ বাণিজ্য অনেক কম হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু পোশাকই না বৈশাখে মাটির, কাপড়ের, পুঁতি ও পাটের গহনা বেশি পরা হয়। পিতল, রুপার গহনাও চলে। অন্যদিকে ঈদে ইমিটেশনের গহনার বিক্রি বাড়ে। এবারে ঈদের পোশাকের সঙ্গে ঈদের গহনা পরবে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোর বৈশাখী বাণিজ্য অনেক কমেছে।’
এই দুই উৎসব ঘিরে সাজসজ্জার পণ্য, প্রসাধনী ও জুয়েলারিও ভালো বিক্রি হয়। এবারের ঈদে এসব পণ্যের কেনাকাটা দিয়ে বৈশাখ পার করবেন অনেকে।
রাজধানীর গাউসিয়া মার্কেটের কঙ্গন জুয়েলারির মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘মেয়েরা বৈশাখের সাজে দেশীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব বেশি দিয়ে থাকে। বর্ষা বরণে মাটি, কাপড়, পাট, সুতা, রুপার গহনা বেশি পরা হয়। ছোট-বড় প্রায় সব বয়সী নারীর হাতে থাকে লাল সাদা চুড়ি। ঈদে ইমিটেশনের, পুঁতির, গোল্ড প্লেটেড, রুপার গহনা বেশি বিক্রি হয়। ধনীরা সব সময় উৎসব উদযাপনে সোনার গহনা পরে। তাদের কথা আলাদা। এবারে বৈশাখের গহনার চাহিদা কম। সকলেই ঈদের জন্য কিনছেন।’
এসব উৎসবে ঘর-গৃহস্থালির জন্য এটা ওটা কিনে থাকে অনেকে। দুই উৎসব ঘিরে খাবারে ব্যাপক আয়োজন চলে। ঈদে পোলাও, মাংস, সেমাইসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার বেশি রান্না হয়। অন্যদিকে বৈশাখে ইলিশ, পান্তা ভাত, বাতাসা, মুড়ি, মুড়কি, ভর্তা-ভাজিসহ বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত খাবার খাওয়া হয়। এবারে ঈদের বাজারের সঙ্গে বৈশাখের খাবারও অনেকে কিনছে। সাধারণ মানুষের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের কেনাকাটার সঙ্গেই বৈশাখের জন্য বিশেষভাবে মশলা কিনে রাখছেন।
অন্যদিকে বৈশাখ ঘিরে উপজেলা, পাড়া, মহল্লা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত মেলা আয়োজন করা হয়। ঈদকেন্দ্রিক কিছু মেলা হলেও তা বৈশাখ বরণকেন্দ্রিক মেলার তুলনায় সংখ্যায় কম থাকে। এসব মেলাতে বেচাকেনাও ভালো হয়। এবারে রমজান থাকায় বৈশাখী মেলা আয়োজন করতে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে।
বৈশাখে বাহারি ডিজাইনের মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি বাড়ে। বিভিন্ন জেলা শহর থেকে রাজধানীতে মাটির পণ্য এনে গুদামজাত করে পাইকারি বিক্রেতা মো. শাহবুদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘পহেলা বৈশাখের এক মাস আগে থাকতে খুচরা বিক্রেতারা আমার কাছে মাটির মালের অর্ডার দিয়ে রাখেন। বৈশাখের ১৫ দিন আগে থাকতে তারা মাটির পণ্য নেওয়া শুরু করে। সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে মাটির মোমবাতি, থালা, বাসন, মগ, ফুলদানি, মুখোশ। এসব পণ্য মেলাতে বিক্রি হয়। এবারে অর্ডার অনেক কম। ঈদ নিয়েই সবাই ব্যস্ত।’
সাধারণত বৈশাখ ঘিরে ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া হলেও মানুষ ঈদের ছুটি কাটায় আপনজনদের সঙ্গে বাড়িতে। এবারে ঈদের ছুটির সঙ্গে বৈশাখের ছুটি পড়ে যাওয়ায় অনেকে পরিবারের সঙ্গেই বেশি সময় কাটানোর পরিকল্পনা করছেন।
চন্দ্রিমা রিসোর্ট মালিক খবীর উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এর আগে বৈশাখের ১৫/২০ দিন আগে থাকতেই আমাদের এই রিসোর্ট বুকিং হয়ে যেত। এতে ভালো আয় হয়েছে। ঈদের ছুটিতে সাধারণত সবাই পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটায়। এবারে ঈদের ছুটির সঙ্গে বৈশাখের ছুটি যোগ হওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। অনেক রিসোর্ট ফাঁকা পড়ে থাকবে।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সামদানী খন্দকার বলেন, ‘ঈদ ও বৈশাখে আলাদা ছুটি হওয়ায় অনেকে দুই উৎসব কেন্দ্র করে বেড়াতে যায়। বাড়িতে যায়। এবারে একসঙ্গে ছুটি হওয়ায় ভ্রমণ কমবে। তাই পরিবহন খাতে আয় কমেছে।’