![যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অসন্তুষ্ট’ করতে রাজি নয় বিএনপি](uploads/2024/05/15/BNP-1715752035.jpg)
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে হতাশা রয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মধ্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করতে রাজি নয় বিএনপি। এ কারণে ফিলিস্তিন ইস্যুতে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে দলটি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপরে নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ইসরায়েল। এই হামলায় এ পর্যন্ত নারী, শিশুসহ ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিধর রাষ্ট্র হয়েছে ইসরায়েল। এ কারণে সারা বিশ্ব ইসরায়েলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও সরকারি দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দেশের ইসলামপন্থি দলগুলো ফিলিস্তিন ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে।
যদিও এই ইস্যুতে বিএনপির ভেতরে ও বাইরে অনেকে দলটির বর্তমান অবস্থানকে কিছুটা ‘নমনীয়’ বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মুসলিম উম্মাহর প্রতি একাত্মতা পোষণকারী দল বিএনপির ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে যেভাবে দাঁড়ানোর বা সোচ্চার হওয়ার কথা, তাদের ভূমিকা ঠিক ততটা জোরালো নয়।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অসন্তুষ্ট হবে, এ কারণে ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিএনপি কথা না বলতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক চমৎকার। আবার ভারতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্কও চমৎকার। ফলে বিষয়টি কিছুটা ঘোলাটে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা ও মন্ত্রী অভিযোগ তুলে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতেই বিএনপি ফিলিস্তিন ইস্যুতে নীরব রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ সারা দেশে ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এ ছাড়া সরকারি দলের একাধিক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যও উঠে এসেছে। কিন্তু বিএনপির সভা-সমাবেশে ফিলিস্তিন ইস্যুতে এ ধরনের কোনো বক্তব্য শোনা যায়নি। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে থাকা দল ইসলামী আন্দোলন এ প্রশ্নে সবচেয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। দলটি গত ১০ মে রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে এক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আগামী ১৭ মে শুক্রবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে দলটি।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসলামপন্থি ও বিএনপির মিত্র বলে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী কিছুটা ভূমিকা পালন করলেও দলটি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি। গত ২২ মে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকে ফিলিস্তিনে অবিলম্বে হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। এর আগে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলার প্রতিবাদে গত ৯ মে ঢাকায় এক বিক্ষোভ সমাবেশ করে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। একই দিন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনে হামলার ঘটনায় নিন্দা জানান। দেশের বাম ও ইসলামপন্থি দলগুলোও ফিলিস্তিন ইস্যুতে কথা বলেছে।
সরাসরি ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিত না হলেও জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দল বিএনপিকেই ইসলামপন্থিদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে মনে করা হয়। আওয়ামী লীগসহ বাংলাদেশের বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবিদার দলগুলো সব সময়ই ইসলামি মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অভিযোগের আঙুল বিএনপির দিকেই তোলে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরিতে এই ইসলামপন্থি দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকায় বিএনপির পাশাপাশি ইসলামপন্থি কিছু দলও প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভের কিছুটা বহিঃপ্রকাশ বিএনপিতে ঘটলেও ইসরায়েলকে সমর্থনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে দলটি কৌশলী অবস্থান নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে এমন অবস্থানের কারণ জানতে চাইলে বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভারতের বিষয়ে যে কারণে আওয়ামী লীগ নীরব; ঠিক একই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে বিএনপি নীরব বা কৌশলী।’
বিএনপির ঘোষণাপত্রের ২৯(ঘ)-তে ‘মুসলিম দুনিয়ার ভ্রাতৃপ্রতিম সকল দেশের সঙ্গে গভীর ও স্থায়ী বন্ধুত্ব অটুট রাখা ও সম্প্রসারিত করা এবং (ঙ)-তে আরব ও ফিলিস্তিনি ভাইদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় পূর্ণ সমর্থন দান করা’র কথা উল্লেখ রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য নজরুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানে কোনো সমস্যা নেই। কারণ বিএনপি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে। তার মতে, ‘প্রয়াত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে জিয়াউর রহমান তথা বিএনপির যে সম্পর্ক ছিল, সেটা পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকে এবং বিএনপি এখনো ওই নীতি মেনে চলে।’
বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করতে রাজি নয়, সরকারের এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার তো কত অভিযোগই করে। সরকারের কাজই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা। কিন্তু আমাদের কথা পরিষ্কার। আমরা স্বাধীন ফিলিস্তিন এবং সে দেশের জনগণের পক্ষে। সেই জনগণের ওপরে যে নিপীড়ন ও অত্যাচার চলছে, আমরা তার বিরুদ্ধে।’
তবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিএনপির প্রতিবাদ বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপি কোনো মিছিল-সমাবেশ করেনি। হামলার দুই দিন পর গত ৯ অক্টোবর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সোশ্যাল হ্যান্ডেল এক্সে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন জানিয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন, যেখানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন, সেখানে আলাদা করে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
তবে সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আলোচনা উঠেছে। দলটির প্রবীণ একজন নেতা ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করে প্রতিবাদ করা উচিত বলে মতামত ব্যক্ত করেন। তার ওই প্রস্তাবে সমর্থন দেন উপস্থিত আরও দু-একজন নেতা। কিন্তু উপস্থিত অন্য নেতারা এ বিষয়ে একমত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দলটি কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেনি। তবে বিএনপির ভেতরে আলোচনা হলো, ফিলিস্তিন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা ঠিক হবে না। কারণ তাতে যুক্তরাষ্ট্রের রুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সর্বশেষ গত ৮ মে বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ‘কিছু করা উচিত’- এমন প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে উপস্থিত দুজন নেতা বলেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রতিবাদ কিছু না কিছু তো হচ্ছে। নতুন কিছু করার ব্যাপারে তারা নেতিবাচক মত দেন বলে জানা যায়।
খবরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘ফিলিস্তিন ইস্যুতে কথা কোথায় কম বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে তো। অন্যান্য দল কারা বেশি বলছে? সরকার এবং সরকারি দল বেশি বলছে। সরকারের দায়িত্ব বেশি বলে সরকার বলছে। তাদের বলতে হচ্ছে।’
স্থায়ী কমিটির অন্যতম আরেক সদস্য বেগম সেলিমা রহমান খবরের কাগজকে বলেন, সরকার তো সারাক্ষণ বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। যা নয় তাই বলে বেড়াচ্ছে। তারা নিজেদের কথাগুলো বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে। সরকারের কথায় বিএনপির কিছু আসে যায় না। মুসলিম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বিএনপির সহানভূতি ও সহমর্মিতা সবই আছে।
‘তবে এ কথা ঠিক যে, আন্তর্জাতিক বা বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে সমন্বয় করেই বিএনপিকে চলতে হয়। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের দিকে খেয়াল রাখাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া বিএনপি কিছু করতে গেলেই তো সরকারি দল লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে হাজির হয়।’ যোগ করেন বিএনপির এই প্রবীণ নেতা।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর একটি হোটেলে এক ইফতার পার্টিতে দেওয়া বক্তব্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফিলিস্তিনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দুই রাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ওই ইফতার অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক এবং যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হেলেন লাফাভসহ বাংলাদেশস্থ কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক ভার্চুয়াল সভায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইসরায়েল থেকে দুটি কার্গো বিমান অবতরণের খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি জানানো হয়। বলা হয়, গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহ আক্রমণ এবং ফিলিস্তিনে নির্বিচারে হত্যার ঘটনায় সারা বিশ্বে যখন নিন্দার ঝড় বইছে, সেই সময় ইসরায়েল থেকে ঢাকায় বিমান অবতরণ রহস্যের সৃষ্টি করছে।