![কাজের ক্ষেত্রে মানসিকতা পাল্টাচ্ছে নতুন প্রজন্মের](uploads/2024/05/15/koffee-shop-1715755958.jpg)
গুলশানের একটি জমজমাট কফি শপে অফার চলছে। সদ্য সন্ধ্যা নেমেছে। ছিমছাম ক্যাফের হলুদ বাতিগুলো মিষ্টি আলো ছড়াচ্ছে ভেতরে। তাজা বিন থেকে ব্রিউ করা কফির গন্ধে ম-ম করছে চারদিক। সময় যত গড়াচ্ছে, ভিড় তত বাড়ছে ছোট দোকানটাতে। কিছুক্ষণ পরই হই-হুল্লোড় আর হাসি-আড্ডায় জমজমাট হয়ে ওঠে বহু মানুষের আড্ডার এই প্রাণকেন্দ্র।
গল্পের ফাঁকে কেউ অর্ডার করছেন এসপ্রেসো, কেউ মকা, কেউ লাটে, কেউবা ক্যাপেচিনো। কাস্টমারদের চাহিদামাফিক অর্ডার নিয়ে ছোটাছুটি করতে করতে ঘাম ছুটছে ক্যাফেতে কাজ করা তরুণ কর্মচারীদের। এদের মধ্যে একজন মাহীন। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার চটপটে যুবক। সদ্য স্নাতক পাস করেছেন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। একই বিষয় নিয়ে মাস্টার্সও করার ইচ্ছে আছে তার।
এত দূর পড়াশোনা করে কফি শপে কেন কাজ করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক দিন চাকরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু কোথাও সুযোগ হয়নি। অবশেষে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে এই কফি শপে কাজের সুযোগ পেলাম। এখানে জয়েন করার পর আসলে জায়গাটাকে উপভোগ করতে শুরু করেছি। সন্ধ্যার পর থেকে কত মানুষ এখানে আড্ডা দেন, এদের মধ্যে কত মুখ পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রথমে এত পড়াশোনা করে একটা কফি শপে ওয়েটারের কাজ করব ভেবে এক রকম হীনম্মন্যতা কাজ করত, এটা ঠিক। তবে এখন মনে হয়, কোনো কাজই ছোট নয়। তা ছাড়া এখানকার বেতন অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র অফিসারের কাছাকাছি।
দেশে মাত্র দুই দশক আগেও শিক্ষিত যুবসমাজের মধ্যে একধরনের সংবেদনশীলতা কাজ করত। সেটি হলো, জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজের ধরন-সম্পর্কিত হীনম্মন্যতা। শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী বড় কোনো পদে বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি না পেলে লোকলজ্জায় সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়ে তটস্থ থাকতেন তরুণরা। পশ্চিমা দেশগুলোতে বৈধ কোনো কাজকেই ছোট করে দেখা হয় না। তবে আমাদের দেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ‘ভদ্রলোকদের’ প্রতিষ্ঠিত কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে অনীহা কাজ করে। এমনকি বাবা-মা ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও এমন মনোভাব থাকে যে স্নাতক পাস করলেই তরুণরা বড় প্রতিষ্ঠানে বড় পদে চাকরি করবে।
তবে বেশ কিছু সময় ধরে দেশের এই চিত্রপটে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণীই কর্মস্থলের ব্যাপারে প্রচলিত ট্যাবু ভেঙে বিভিন্ন সুপার শপ, কফি শপ, চেইন শপ ও শোরুমগুলোতে কাজ শুরু করেছেন। সুপার শপ স্বপ্ন, আগোরা অথবা আড়ং-এর মতো চেইন শপগুলোতে বেশির ভাগ বিক্রয় কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকেন উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান এ বিষয়ে খবরের কাগজকে বলেন, ‘তরুণদের এ জাতীয় কাজে আগ্রহী হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হলো কর্মসংস্থানের অভাব। যে হারে উচ্চশিক্ষিত তরুণরা চাকরির বাজারে আসছে, ওই পরিমাণ কর্মসংস্থান বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না। দেশে সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও যে পদগুলো খালি হচ্ছে, তার বিপরীতে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। সুতরাং কোনো প্রতিষ্ঠিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে ভালো কোনো পদে কাজ করতে হলে তরুণদের যে সময় বিনিয়োগ করতে হয়, সে সময়টা পর্যন্ত তাদের টিকে থাকতে তো হবে! এই সময়টা তারা বেকার না থেকে বিভিন্ন সুপার শপ, শোরুম বা রেস্টুরেন্টগুলোতে খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত হয়।’
বসুন্ধরা শপিংমলে আড়ং’-এর আউটলেটে বিক্রয় কর্মী পূজা গোমেজ তার কাজের পরিবেশ বেশ উপভোগ করেন বলে খবরের কাগজকে জানান। সেখানে কাজ করার পাশাপাশি অনলাইনের একটা ব্যবসাও সামলান স্নাতকোত্তর পূজা। তিনি বলেন, ‘সব ধরনের বৈধ কাজকেই আমি সম্মানের চোখে দেখি।’ তার মতো আরও অনেক তরুণ-তরুণী কাজ করেন এই আউটলেটে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই স্নাতক পাস। সবাই তাদের কাজ উপভোগ করেন।
অনেক তরুণ-তরুণী পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে করছেন খণ্ডকালীন চাকরি। অনেকে এখন হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং ক্যাটারিং সেক্টরেও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের ডেপুটি ডিরেক্টর পারভেজ ববি খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং ক্যাটারিং সেক্টরে কাজ করার আগ্রহ বাড়ছে। আগে এই সেক্টরে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করা গড়পড়তা তরুণদের আগ্রহ বেশি ছিল। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা তরুণদেরও ক্যাটারিং এবং হোটেল ম্যানেজমেন্টের কাজ শেখার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেক তরুণ-তরুণীও আমাদের এখানে ক্যাটারিং কোর্সে ভর্তি হচ্ছেন।’
তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বড় একটি অংশ বিভিন্ন কফি শপে কাজ করছেন। গুলশানের বীনস অ্যান্ড বেরী’স-এর বারিস্তা ট্রেনার নাসরিন খবরের কাগজকে জানান, বারিস্তা ট্রেনিং নিতে আসা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষিত। অনেকে দেশের বাইরে যাওয়ার আগে বারিস্তা ট্রেনিং নিতে আসেন, আবার অনেকে দেশের ভেতরই বড় বড় হোটেল বা কফি শপগুলোতে কাজ করার আকাঙ্ক্ষায় বারিস্তা কোর্সে ভর্তি হন। অনেকে আবার প্যাশন থেকেই এই কোর্স করেন।