![শিল্প বিকাশে ছাড় চান ব্যবসায়ীরা](uploads/2024/06/11/industry-1718084034.jpg)
বাজেটে আইসিটিসহ কিছু খাতে ছাড়ের প্রস্তাব দেওয়া হলেও শিল্প খাতের প্রায় সব ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে রাজস্ব (শুল্ক, কর ও ভ্যাট) বাড়ানো হয়েছে। এতে শিল্পে ব্যবহৃত বেশির ভাগ কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির দাম বাড়বে। কারখানার নির্মাণ খরচ বাড়বে। উৎসে কর কমানো হয়নি, বরং আরও কিছু খাত এর আওতায় আনা হয়েছে। ডলারসংকট মোকাবিলায় কী করা হবে তা নিয়ে নেই স্পষ্ট নির্দেশনা। আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই খাতে গতি আনতেও নেই কোনো নির্দেশনা।
বাজেট ঘোষণার আগেই ঋণদানকারী সংস্থা আইএমএফকে খুশি রাখতে জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে উৎপাদন খাতসহ সব ধরনের পরিবহনের খরচ বাড়বে।
অন্যদিকে কমানো হয়নি সুদের হার। বেড়েছে বেসরকারিখাতে ব্যাংক ঋণ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন হয়নি। ব্যবসায়ীদের হয়রানিও কমেনি। দুর্নীতি বন্ধেও নেই কার্যকর পদক্ষেপ।
শিল্পোদ্যোক্তারা দাবি করেছেন, বিরাজমান সমস্যা তো আছেই, এর সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটে নেওয়া পদক্ষেপ যোগ হলে শিল্পের পুরোনো উদ্যোক্তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, সরকার অর্থসংকটে। বেসরকারি খাতের অবস্থাও ভালো না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে হলে শিল্প খাতে নতুন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু জাতীয় বাজেটেই যদি খরচ বাড়ানো হয় তবে বিনিয়োগ বাড়বে কীভাবে?
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে হলে শিল্পখাতের বিকাশে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। উৎসে করে ছাড় দিতে হবে। রাজস্ব ছাড়, প্রত্যাহার বা কমানো হলে রাজস্ব বেড়ে যাবে। ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। সব খাত থেকেই করপোরেট কর কমানো উচিত। খরচ কমানো হলেই কেবল শিল্প খাতে বিনিয়োগ আসবে। মনে রাখতে হবে, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারসংকটের কারণে দেশে শিল্প-ব্যবসাবাণিজ্য কঠিন সময় পার করছে। ডলারসংকট কাটানোর চেষ্টা করতে নীতি সহায়তাতো আমরা আশা করতে পারি। প্রস্তাবিত বাজেটে এই বিষয়ে তেমন কিছু নেই। ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে। রাজস্ব কমাতে হবে। এসব দূর না হলে মোটাদাগে বলা যায়, শিল্পখাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে।
বিরাজমান অনেক সমস্যা দূরও করা হল না, বরং এর সঙ্গে খরচ বাড়ানো হলে কিভাবে শিল্পখাতে বিনিয়োগ বাড়বে?’
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘করোনার পর থেকে দেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগ আসছে না বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে বাজেট ঘোষণার আগেই জ্বালানির দাম বাড়ানো হলো। কারখানার নির্মাণে খরচ বাড়ানো হলো। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কের শিল্পে খরচ বাড়ানো হয়েছে। শিল্প-বিনিয়োগ সংকটে আছে। এর মধ্যে জাতীয় বাজেটে শিল্পখাতে খরচ বাড়লে কীভাবে বিনিয়োগ বাড়বে?’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মো. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের চলমান অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, দেশে নতুন বিনিয়োগ তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২৩ সালের প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ, আর একই সময়ে নতুন বিনিয়োগ কমেছে ৩১ শতাংশ।
ডলারসংকটের কারণে অনেক বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে মুনাফা নিজ দেশে নিতে পারছে না। এর ফলে অনেকেই বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যবসা সংকুচিত করে ফেলছেন। নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারণও কমিয়ে ফেলেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ডলার সমস্যার সমাধান না হলে বিদেশি বিনিয়োগে সুবাতাস আসবে না। তাই বাজেটে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সমাধানে কিছু রাখা উচিত ছিল।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ৩০০ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। ২০২২ সালে এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৪৭ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।
অর্থনীতির বিশ্লেষক মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেট কিছুখাতে রাজস্ব ছাড় দিলেও বাড়ানো হয়েছে অনেক বেশি। বাজেট চূড়ান্তকালে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বার্থে মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ও উৎসে করে ছাড় দিতে হবে। একই সঙ্গে মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য রাজস্ব মুওকুফ, কম সুদে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ দিতে বাধ্য করতে হবে। না হলে দেশ থেকে অর্থপাচার বাড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের শিল্পখাত টিকিয়ে রাখতে হলে এবং নতুন বিনিয়োগ আনতে হলে আর্থিক, কারিগরি, বিপণন, প্রশিক্ষণ, রাজস্ব ছাড়সহ সব সুবিধা জাতীয় বাজেটে নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রস্তাবিত বাজেটে কাঁচামাল আমদানি সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘শুল্ককর অব্যাহতির সংস্কৃতির অবসানের উদ্দেশ্যে যেসব শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এতদিন কোনো শুল্ক ছিল না, সেখানে প্রস্তাবিত বাজেটে ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক নির্ধারণের সুপারিশ করছি। এ ছাড়া শিল্পের আরও কিছু কাঁচামালের শুল্ক অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, শিল্পে ব্যবহৃত মোট কাঁচামালের ৪৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। বাজেটে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ককর অব্যাহতি প্রত্যাহার ও কমানোয় মোট আমদানিকৃত কাঁচামালের অর্ধেকের বেশি এখন থেকে বেশি দামে কিনতে হবে।
শিল্পের কারখানা নির্মাণেও প্রস্তাবিত বাজেটে খরচ বাড়ানো হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কম্পোনেন্টের ওপর আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি।
একই সঙ্গে বাজেট প্রস্তাবে সিএনজি বা এলপিজি ফিলিং স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনার জন্য সিএনজি কনভার্সন কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।’
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কের বিভিন্ন খাতে শুল্ক কর বাড়ানোর প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানায় মূলধনি যন্ত্রাংশ ও নির্মাণসামগ্রী আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে ১ শতাংশ এবং হাইটেক পার্কের জন্য ৫ শতাংশ শুল্ককর আরোপ করছি। এসব এলাকা উন্নয়নের জন্য পণ্য আমদানিতেও ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এসব অঞ্চলের কারখানার যানবাহন আমদানিতে শুধু আমদানি শুল্ক অব্যাহতি প্রদান করে অন্যসব শুল্ক করাদি আরোপ করার সুপারিশ করছি।’