মোহাম্মদপুরের বাবর রোড, হুমায়ুন রোডসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের জন্য জেনেভা ক্যাম্প এখন একটি ‘বিষফোড়া’য় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় জনগণের মতে, মোহাম্মদপুরে যত অপরাধ সংঘটিত হয়, তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই জেনেভা ক্যাম্প। এখানকার টোল মার্কেট বিহারিদের দখলে চলে গেছে। মুরগিপট্টিতে জেঁকে বসেছে মাদক কারবার। এ ছাড়া প্রতিরাতেই শোনা যায় গুলির শব্দ। এ জন্য ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখেন স্থানীয়রা।
বাবর রোডের বাসিন্দারা বিভিন্ন সময়ে বিহারিদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে মোহাম্মদপুর থানা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, র্যাব-২, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর- এই চার সংস্থা বরাবর তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা লিখিতভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
স্থানীয়রা খবরের কাগজকে জানান, এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়াকে নিরুৎসাহিত করতে, সর্বোপরি তাদের শান্ত রাখা এবং মানবিক কারণেই এখানে বিহারিদের বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
রিকশার ব্যাটারি চার্জ চলছে অবৈধভাবে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েকটি সড়ক অত্যন্ত সরু। ফলে আগুন লাগলে তা সবার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এমন পরিস্থিতির মধ্যেই এই এলাকায় ক্যাম্পের বাসিন্দারা অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার করছেন। প্রতিদিনই এই এলাকা থেকে কয়েক শ রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য সন্ধ্যা থেকেই লোকজনকে লাইন ধরতে দেখা যায়। কিন্তু বিল দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু না থাকায় এখান থেকে সরকার কোনো আয় পাচ্ছে না। প্রতিটি রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়া বাবদ ২০০ টাকা করে নেওয়া হয়, যা চলে যায় বিহারিদের কয়েকজন সর্দার বা নেতার কাছে।
পরিবেশের কারণে অনেকেই বাসা ছাড়ছেন
সরেজমিনে দেখা যায়, বাবর রোডে পশু জবাই ছাড়াও এই সড়কের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা কয়েক শ মুরগির দোকান ও কাঁচাবাজারের জন্য এই এলাকার পরিবেশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। ফলে এখানে বসবাস করা বাসিন্দাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেকে নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠছেন।
১৯৭১ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৫ একর জায়গায় এখন ৬০ হাজারের মতো মানুষ বসবাস করছে এই জেনেভা ক্যাম্পে। এলাকার জনসংখ্যাও ক্রমেই বেড়ে চলছে। ক্যাম্পের উত্তরে বাবর রোডের অভিজাত আবাসিক এলাকা, দক্ষিণ পাশে মোহাম্মদপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় মোহাম্মদপুর হাইস্কুল ও আবাসিক এলাকা এবং পূর্ব পাশে হুমায়ুন রোডের আবাসিক এলাকা। মাঝখানে ১৫ একর জায়গাজুড়ে জেনেভা ক্যাম্প। এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সব সময়ই খারাপ ছিল। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবারও অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, অবস্থাটা এমন, মনে হচ্ছে সবাই যেন স্বাধীন হয়ে গেছে। কেউ কাউকে তোয়াক্কা করছে না।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর তিনটি ক্যাম্প ছাড়াও সার্বক্ষণিক টহলে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অস্ত্রের ঝনঝনানি, মাদক কারবার, বাজার-ফুটপাত দখল, হত্যা, ছিনতাই ও গুলিবিনিময় নৈমিত্তিক ঘটনা। গত দুই মাসে রীতিমতো আতঙ্কের জনপদ হয়ে উঠেছে এই এলাকা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
চার সংস্থাকে যেসব অভিযোগ দিয়েছিলেন স্থানীয়রা
২০২২ সালের এপ্রিলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে করা অভিযোগ থেকে জানা যায়, ফ্ল্যাট-বাড়ির সামনে রাস্তায় বিহারিদের হোটেল, মুরগির দোকান, কসাইখানাসহ বিভিন্ন দোকান রয়েছে। মুরগি, গরু, ছাগলের রক্ত, মলমূত্রে রাস্তা সব সময় নোংরা থাকে। বর্জ্যের কারণে স্যুয়ারেজ লাইন বন্ধ হয়ে নোংরা পানিতে রাস্তা ভেসে যায়। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার করেন না বলেও তারা লিখিত অভিযোগ করেন।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি অভিযোগে অসমাপ্ত রাস্তার কাজ শেষ করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করা ও সিটি করপোরেশনের টোল প্রদান না করা দোকান উচ্ছেদ করার আবেদন করা হয়। এ ছাড়া বাবর রোডের দক্ষিণ পাশের সড়ক দখল করে গড়ে ওঠা টোল মার্কেট উচ্ছেদ করার দাবিও জানানো হয়।
চলতি বছরের মার্চে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগে বাসিন্দারা জানান, ক্যাম্পের ভেতরে অপরিকল্পিতভাবে শত শত ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘরেই রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার, চোরাই গ্যাস লাইন, হিটার ও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ। এ ছাড়া বিয়ে, উরস ও জিয়াফতসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাঠ জ্বালিয়ে রান্নার কাজ করা হয়। এসব কারণে এই এলাকা অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে বাসিন্দারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
এ ছাড়া র্যাব-২ ও মোহাম্মদপুর থানায় আরও জানানো হয়, অতিরিক্ত শব্দ করে সারা রাত গানবাজনা হয়। এছাড়া রাস্তায় মাদক বিক্রি করা হয়।
বাবর রোডের একাধিক বাসিন্দা খবরের কাগজকে জানান, প্রতিদিন রাতে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। যে কারণে সব সময়ই তারা জানালা-দরজা বন্ধ রাখেন। এ ছাড়া বাসার সামনে মাদক কারবারিদের আনাগোনা সব সময়ই থাকে। বাসা থেকে বের হলেই মাদক কেনার জন্য চারপাশ থেকে কারবারিরা ঘিরে ধরেন। ফলে দিনের বেলায় বিশেষ প্রয়োজনে বের হলেও সন্ধ্যার পরে তারা বাসা থেকে বের হন না।
তারা আরও জানান, ক্যাম্পের বাসিন্দারা এখন তাদের জন্য বিষফোড়া। মুরগিপট্টির গোলাম কসাই, বাবু, আজগর, নাদিম, চট্টি, সোনিয়াসহ আরও বেশ কয়েকজন এই ব্যবসার আড়ালে আসলে মাদক ব্যবসা করেন। এ ছাড়া মাদক বিক্রি, রাস্তায় ময়লা ফেলা, পশু জবাই ও গাড়িতে হামলা করা প্রতিদিনের ঘটনা। এসবের প্রতিবাদ করলেই বাসিন্দাদের গায়ে হাত তোলা থেকে হত্যার হুমকিও দিয়ে থাকে দুর্বৃত্তরা।
এ ধরনের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা মোহাম্মদপুর থেকে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান এই রোডের বাসিন্দারা। তবে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হওয়ার পর এখন তারা স্বস্তিবোধ করছেন।
সম্প্রতি বাবর রোডের মুরগিপট্টির পাশে নিজ ফ্ল্যাট ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন নাজমুল ইসলাম। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিহারিরা কোনো শৃঙ্খলা মানতে চায় না। তারা সারা রাত জেগে গানবাজনা করে ও দিনের বেলায় ঘুমায়। বাসার সামনে নোংরা করে রাখে। আর মাদক বিক্রি তো সাধারণ ঘটনা। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনকে তাদের বিষয়ে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তো বসবাস করা যায় না। এখন ভাড়া বাসায় থাকছি।’
বাবর রোডের অবসরে যাওয়া আরেক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার আমাদের জন্য প্লটগুলো দিয়েছিল। এখানে বাড়ি বানিয়ে বিপদে পড়েছি। এই বিহারি ক্যাম্প এখান থেকে না সরালে কোনোভাবেই বসবাস সম্ভব নয়। সরকারের কাছে জোর দাবি, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।’
জেনেভা ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশের রাস্তা দখলে নিয়ে বিহারিরা গড়ে তুলেছে একটি টোল মার্কেট। এখানে মুদি দোকান দেওয়ার পাশাপাশি কাঁচাবাজারের ব্যবসা করছে তারা। এই টোল মার্কেটের দোকানগুলো তাদের আয়ের অন্যতম উৎস।
টোল মার্কেটে ৩৬৫টি দোকান রয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক মুদি দোকানদার। টোল মার্কেটের ভাই ভাই জেনারেল স্টোরের আবু তালেব খবরের কাগজকে বলেন, এই মার্কেটের দোকানগুলোর একাধিক মালিক ও তারা সবাই বিহারি। ৮ হাজার টাকা দোকান ভাড়া দেন। এ ছাড়া মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো আয় হয় বলে জানান এ প্রতিবেদককে।
এখানে তো প্রতিদিনই মাদক বিক্রি নিয়ে গোলাগুলি হয়, কীভাবে ব্যবসা করেন- উত্তরে আবু তালেব বলেন, ‘এইডা কোনো ব্যাপার না। এই হানে এইডা সাধারণ ঘটনা।’
বাবর রোডে প্রতিদিনই ভোর থেকে কয়েক শ গরু জবাই করা হয়। এই গরুর মাংস রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। গরু জবাইয়ের কাজটি করে থাকেন গোলাম কসাইসহ বেশ কয়েকজন। গোলাম কসাই খবরের কাগজকে বলেন, ‘এতটুকু জায়গার মধ্যে এত মানুষ থাকে। জায়গা না থাকায় রাস্তায় গরু জবাই করি।’ তবে কসাই পেশার আড়ালে মাদক বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায় বেশি জড়িত নারীরা। এই কাজে তারা কোলের শিশুদেরও ব্যবহার করেন। মুরগিপট্টিতে ইয়াবা কারবারি হিসেবে পরিচিত চট্টি ও তার বোন সোনিয়া। সম্প্রতি ইয়াবাসহ সোনিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সোনিয়ার বিষয়ে চট্টি খবরের কাগজকে বলেন, ‘হুদাই (শুধু শুধু) ধরছে, ধরলে টাকা পাওন যায়।’ মাদকসহ ধরছে বলতেই তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘কী মাদক, কিচ্ছু না, ভুয়া।’
সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর অভিযানে মোহাম্মদপুরসহ জেনেভা ক্যাম্পে শতাধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বুনিয়া সোহেল নামের একজন নেতা রয়েছেন।
মোহাম্মদপুর প্রধান সেনাক্যাম্পের একজন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, জেনেভা ক্যাম্প হচ্ছে অপরাধীদের আশ্রয়স্থল। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। তবে ক্যাম্পে প্রচুর অলিগলি থাকায় অপরাধীদের ধরতে বেগ পেতে হয়। অভিযানের পর এই এলাকায় অপরাধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুর এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। যোগদানের পর থেকে আমি অপরাধ দমনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। জেনেভা ক্যাম্পসহ পুরো মোহাম্মদপুরে পুলিশ প্রতিদিনই টহল দিচ্ছে। অপরাধ এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।’
তিনি বলেন, ‘মাদক বিক্রির টাকা নিয়ে গোলাগুলি তাদের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দমনে পুলিশ কাজ করছে। খবর পাওয়া মাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই থানাতে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ মামলা হতো। আমি আসার পর শক্ত হাতে অপরাধ দমনের চেষ্টা করছি। ফলে মামলার সংখ্যাও কমে এসেছে।’
বাবর রোডের বাসিন্দাদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা থানা থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। তবে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করা না গেলে এই এলাকার অপরাধ পুরোপুরি দমন করা সম্ভব হবে না।’