বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীই পড়াশোনা শেষে উন্নত এক জীবনের স্বপ্ন দেখেন। যে স্বপ্ন বাবা-মা ও নিজের ভবিষ্যৎকে ঘিরে আবর্তিত হয়। এজন্য সবারই ইচ্ছে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাট চুকিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, উন্নত জীবনযাপনের। সে লক্ষ্যে কেউ কেউ হয়তো বিদেশে পাড়ি জমান, কেউ হন উদ্যোক্তা আর একটি বড় অংশ যোগ দেন চাকরিতে। এর মধ্যে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষে চাকরির বাজারে ঢোকেন। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে সোনার হরিণ সরকারি চাকরি। প্রতি বছর বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত চাকরির আশায় নিজেদের প্রস্তুত করতে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ স্নাতক পড়ার সময়ই সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে আদা-জল খেয়ে নেমে পড়েন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। পাবলিক বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরকারি চাকরির যে আকাঙ্ক্ষাটা লক্ষ্য করা যায়, সেটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অনেক কম দেখা যায়।
এর কারণ হিসেবে বেশকিছু বিষয় বলা যেতে পারে।
এই অনীহার অন্যতম কারণ সরকারি চাকরিতে ধীরগতির নিয়োগ প্রক্রিয়া। অনেকের কাছে আবার এসব চাকরিতে নিয়োগের যে পরীক্ষা সেটাও গতানুগতিক বলে মনে হয়। তার ওপর নির্দিষ্ট সাবজেক্টে পড়া শেষে সরকারি চাকরি পাওয়াটাও বর্তমান বাজারে অনেক কঠিন। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগদানও তুলনামূলক সহজতর ও দ্রুততর। ফলে এখন পর্যন্ত দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কাছে এখনো সরকারি চাকরি খুব বেশি আগ্রহের জায়গা তৈরি করতে পারেনি। এর ওপর পদের তুলনায় অত্যধিক প্রতিযোগীর ভিড়ে চাকরিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তাও থাকে না। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষ করে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বেকার বসে থাকতেও চান না। ফলে করপোরেট সেক্টরের দিকেই তাদের মনোনিবেশ থাকে বেশি।
এ প্রসঙ্গে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সামিয়া রহমান অনি বলেন, ‘সরকারি চাকরিযুদ্ধে অনীহা রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এর কারণ, বরাবরের মতোই চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধীরগতি। তাছাড়া, সরকারিতে তাদের নির্দিষ্ট সাবজেক্টের মধ্যে কোনো চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্লেসমেন্টের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে দেখা হয় যে, প্রার্থী শহর বা ঢাকা অঞ্চলে থাকতে পারবেন কিনা কিংবা আপডেটেড প্রযুক্তি যেমন ‘এআই’ টুল-এর যথাযথ ব্যবহার রয়েছে কিনা। যেখানে, একজন স্টার্টআপ মার্কেটারও তার স্বল্পদিনের অভিজ্ঞতার জন্য বেসরকারি চাকরি বাছাই করবেন। এক কথায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারির তুলনায় দ্রুত যোগদান, সুগঠিত ক্যারিয়ার ও উন্নত কাজের পরিবেশ পাওয়া যায়, যা তরুণদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়।’
এই কম আগ্রহের আরেকটি কারণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থান। বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করে থাকে। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আসে উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে। ফলে তাদের কর্মজীবনে পা রেখেই আর্থিক অনটন বা স্থিতিশীল কোনো চাকরি না পাওয়ার শঙ্কা কাজ করে না। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান ভালো হওয়ায় এবং আর্থিক চাপ না থাকায় এসব শিক্ষার্থীর করপোরেট সেক্টর, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি বেশি ঝোঁক থাকে। এসব বেসরকারি সেক্টরের বেতনও সরকারি চাকরির থেকে বেশি হয়ে থাকে। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্তত দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে বেশি সুযোগ পান। ফলে প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি পেতে তাদের বেশি কাঠখড়ও পোড়াতে হয় না।
এ বিষয়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রকিবুল ইসলাম মনে করেন, ‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষতা বিকাশের প্রচুর সুযোগ থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্কিলে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই কাজের ভালো সুযোগ পান অর্থাৎ চাকরি পেতে সমস্যা হয় না।
এ ছাড়া অনেকেই মনে করেন, সরকারি চাকরির গ্রেড অনুযায়ী এখনো কর্মকর্তারা যে বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি পেয়ে থাকেন সেটা প্রযোজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাই অবস্থাসম্পন্ন অনেকেই উচ্চশিক্ষা বা আরও উন্নত জীবনযাত্রার আশায় বিদেশে পাড়ি জমান। এমনকি লাখ লাখ তরুণের স্বপ্নের চাকরি বিসিএস-এর মতো প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিও তাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধীরগতিরও যেমন কিছুটা দায় রয়েছে, তেমনি চাকরিপ্রত্যাশীদের তুলনায় পদের অপ্রতুলতাও ভীষণরকম দায়ী।
সে হিসেবে স্থায়িত্বের ঝুঁকি থাকলেও প্রাইভেট সেক্টর থেকে আরও বড় অঙ্কের বেতন পাওয়া যায়। সরকারি চাকরিতে নিজেদের অনীহার কারণ সম্পর্কে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. ইমরান নাজির বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে কম আগ্রহের পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত আধুনিক শিক্ষাক্রম, উন্নত প্রযুক্তিগত ও যোগাযোগ দক্ষতা এবং বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ওপর জোর দেয়; যা তাদের দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সেক্টরে চাকরির জন্য উপযুক্ত করে তোলে। সেখানে এরকম দক্ষতাসম্পন্ন প্রার্থীর চাহিদা বেশি থাকায় অল্প সময়ের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। উপরন্তু, সরকারি চাকরির গতানুগতিক নিয়োগ পরীক্ষা এবং দীর্ঘ নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায়ই তাদের এই সেক্টরে আগ্রহী হতে নিরুৎসাহিত করে।’
১৯৯৩ সালে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে মোট শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করলেও দেশের সরকারি চাকরির বাজারে তাদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। যদিও আগের চেয়ে কিছুটা হলেও চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। এখন বিসিএসের মতো সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রতিযোগিতায় নামছে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সরকারি নানা সেক্টরে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি নিয়োগপ্রাপ্তি অর্জন করেছে তার মধ্যে এই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়টি অন্যতম। এভাবে কম হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা সরকারি চাকরিতেও নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ছাপ রাখতে শুরু করেছে।
হাসান