![গারো পাহাড়ে পল্লী বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ, হুমকিতে বন্য প্রাণী](uploads/2024/04/21/1713671200.Sherpur-Electricity-Special.jpg)
শেরপুরের গারো পাহাড়ে বসবাস করা অবৈধ দখলদাররা এখন পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ পাচ্ছেন। গহীন অরণ্যে তাদের ঘর আলোকিত হলেও বন্য প্রাণীর জন্য তা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের আবাসস্থল হারিয়ে প্রায়ই বন্য হাতি লোকালয়ে চলে আসছে। ঘটছে প্রাণহানির মতো ঘটনা। স্থানীয়রা বলছেন, একটি ভোটার আইডি কার্ড ও চার হাজার টাকা দিলেই বনের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে আসে। যদিও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশকর্মীরা। অন্য দিকে বনবিভাগ বলছে, তাদের অনুমতি না নিয়েই বিদ্যুৎ বিভাগ দখলদারদের বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছেন। এটা বন্ধ করা জরুরি। বনবিভাগের তথ্যমতে, জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে গারো পাহাড়। এই তিন উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার একর বনভূমির মধ্যে বেদখলে রয়েছে প্রায় ২৫০০ একর ভূমি। তিন রেঞ্জের মধ্যে বালিজুড়ি রেঞ্জে ৪৩৭ একর, রাংটিয়া রেঞ্জে ১৩৯৬ একর, মধুটিলা রেঞ্জে ৫৭৭ একর বেদখল।
জানা গেছে, একসময় পাহাড়জুড়ে দেখা যেত বহু টিলা। সে সময় বনের ভেতরে বিভিন্ন বন্য প্রাণী ছিল। তবে ধীরে ধীরে মানুষ টিলা কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করে, বন ধ্বংস করে চাষাবাদ শুরু করে। এর ফলে কমতে থাকে বনের ভূমি। এভাবেই কেউ ৩০ বছর কেউবা ৪০ বছর ধরে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। দখলকারীরা প্রথমে পাহাড়ি টিলা কেটে ও জঙ্গল পরিষ্কার করে ছোট পরিসরে ঘর তোলেন। পরে ধীরে ধীরে অবৈধ বসতির সম্প্রসারণ করতে থাকেন। তারা কোনো নিয়ম না মেনে অর্থের বিনিময়ে বনের ভেতরে অবৈধ ঘরবাড়িতে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ নিয়ে বসবাস করছেন। বনের ভেতরের অংশ আলোকিত থাকায় বন্য প্রাণীরা বিভিন্ন দিকে চলে যাচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে তাদের জীবন। একদিকে বন উজাড়, অন্য দিকে বিদ্যুতের আলো, বন্য প্রাণীরা দিশেহারা হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। তাদের তাণ্ডবে প্রায়ই মানুষ মারা যাচ্ছে। বনের মধ্যে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে এরই মধ্যে বন্য হাতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ে দখলদারদের মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাশাপাশি মুসলিম দখলদার রয়েছেন।
ঝিনাইগাতীর পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা অঞ্জন মারাক বলেন, ‘কারেন্ট (বিদ্যুৎ) নিতে আমগর (আমাদের) তেমন কোনো কাগজপাতি লাগে নাই। খালি আইডি (ন্যাশনাল আইডি) কার্ড ও ছবি লাগছে। চার হাজার টাকা ও এসব কাগজপাতি দেওনের (দেওয়ার) এক সপ্তাহ পর খুঁটি, তারসহ সব গাড়ি দিয়ে এসে পড়েছে।’
শ্রীবরদী বালিজুড়ি খ্রিষ্টানপাড়ার বাসিন্দা সুজিত রং বলেন, ‘বর্তমানে গাছগাছালি নেই, পাহাড়ে বড় টিলা নেই, পাখপাখালি কই থাকব, থাকার তো আর জায়গা নেই। তাই থাকে না। বনের মধ্যে তেমন খাবারও নেই, কি খাব। হাতি আসে, কিন্তু এক জায়গায় থাকে না, এদিক বা ওদিক যায়। জায়গা তো নেই, থাকব কই।’
খ্রিষ্টানপাড়ার বাসিন্দা কুপিন্দ্র বলেন, ‘আমরা খাস জমিতেই থাকি, জমির কাগজ কই থেকে দিব। ওরা (বিদ্যুৎ অফিসের লোকজন) প্রতি বাড়ি বাড়ি লিস্ট করছে আর প্রতি বাড়ি থেকেই চার হাজার টাকা করে নিয়েছে। পরে কারেন্ট এসেছে। কাগজপত্রও লাগে না, কিছুই লাগে না।’
নালিতাবাড়ীর পানিহাটা সীমান্তের বাসিন্দা পবিত্র মং বলেন, ‘আমাকে মিটার দেওয়া হয়েছে। আমার তেমন কোনো কাগজপত্র নেয়নি। ভোটার আইডি কার্ড ও চার হাজার টাকা লাগছে। আর কোনো টাকা-পয়সা লাগে নাই। এখন পাহাড়ের ভেতর আলোকিত হয়েছে। আগে তো অন্ধকার ছিল। এখন সব জায়গায় কারেন্ট আছে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই গারো পাহাড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হলে অবশ্যই বনবিভাগের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া কোনোভাবেই বনের ভেতরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, পল্লী বিদ্যুৎ ও অন্যান্য বিদ্যুৎ বিভাগ বনবিভাগের কোনো অনুমতি ছাড়াই সংযোগ দিচ্ছে। সেখানে অনেক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এসব জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া বন্ধ হোক। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে এখানে হাতি এবং প্রাণীর অভয়ারণ্য করা হোক।’
রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা করিম মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘বনবিভাগের জমিতে অবৈধভাবে যারা বসবাস করছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, বনের ভেতরে অবৈধ বসবাসকারীরা বিদ্যুতের লাইন নিয়েছে। তারা কীভাবে বিদ্যুতের লাইন পেল, সেটি আমরা জানি না। বিদ্যুতের লাইন নিতে হলে বসবাসকারীদের জমির কাগজসহ অনেক কাগজপত্র দিতে হয়। কিন্তু যারা পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন তারা তো জমির কাগজপত্র দিতে পারবে না, জমি তো সরকারি। কিন্তু কীভাবে বিদ্যুতের সংযোগ পেলেন সেটা আমাদের জানার বাইরে। বিদ্যুৎ বিভাগের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংযোগ দেয়নি। বনের ভেতরে বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার মো. আলী হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘হয়তো স্থানীয় দখলদারের কাছে কাগজপত্র রয়েছে, আর সেই কাগজপত্র দিয়েই শতভাগ বিদ্যুতায়নের স্বার্থে তাদের আমরা বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছি। যদি তারা অবৈধভাবে বসবাস করে থাকেন তাহলে তাদের উচ্ছেদে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালাতে হবে। প্রয়োজনে আমরাও পাশে থাকব। চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করব।'