![জবানবন্দিতে এল দেলোয়ারের নাম, তিনি ‘পুলিশের লোক’](uploads/2024/07/02/sugar-1719894238.jpg)
সিলেটে ধরা পড়া আলোচিত ১৪ ট্রাক চোরাই চিনির মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামির জবানবন্দিতে ট্রাক ভাড়া করা ও চোরাই চিনি বহনকারী দুই ব্যক্তির নাম এসেছে।
এর মধ্যে একটি অচেনা, আরেকটি চেনা নাম। দেলোয়ার মোল্লা নামের লোকটি সীমান্তের লোকজনের কাছে ‘পুলিশের লোক’ হিসেবে পরিচিত। থানার ওসির সঙ্গে তার ছবিও দেখা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার উমাইরগাঁওয়ে গত ৬ জুন ১৪ ট্রাক ভারতীয় চোরাই চিনি জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন পুলিশের এসআই মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করলে চোরাকারবারি শনাক্ত করতে তদন্তে নামে পুলিশ। জব্দ করা একটি ট্রাকের চালক মুনসুর আলীকে (৩৮) গত ১১ জুন গ্রেপ্তার করা হয়।
মুনসুর সিলেট সদর উপজেলার রঙ্গিটিলা গ্রামের রুস্তম আলীর ছেলে। গ্রেপ্তারের পরদিনই তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় সিলেটের মহানগর হাকিম (তৃতীয় আদালত) উম্মে হাবিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারপর তাকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় গত শনিবার গ্রেপ্তার করা হয় আরেকজন ট্রাকচালককে। তার নাম সদরুল আমিন আকাশ। একই আদালতে গত রবিবার বিকেলে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন আকাশ। তিনি সিলেট সদর উপজেলার উমদারপাড়ের আফান আলীর ছেলে।
আদালতে দুজনের জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জালালাবাদ থানার ওসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
সোমবার (১ জুলাই) তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতরা ১৬৪ ধারা মোতাবেক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন। তারা দুজনই মামলাসংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন। জবানবন্দিতে দেওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাইসহ অপরাপর আসামিদের শনাক্তপূর্বক আমাদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে।’
‘দেলোয়ার মোল্লা পুলিশের দিকটা দেখব’
জবানবন্দিতে ১৪ ট্রাক চিনি ধরা পড়ার আগে আরও তিনটি ট্রাক পালিয়ে যাওয়ার তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। ট্রাক ভাড়া করেছিলেন নুরু ইসলাম নামের একজন। আর চোরাই চিনির বাহক হিসেবে পথনির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেন দেলোয়ার মোল্লা নামের একজন। তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের ধারণা, এই দেলোয়ার হচ্ছেন চোরাকারবারিদের একজন।
এক ট্রাকচালকের দেওয়া জবানবন্দি এ রকম:
‘৫ জুন সন্ধ্যার দিকে নুর ইসলাম আমাকে বলে একটা ট্রিপ আছে। হাদারপাড় (বিছনাকান্দি) ট্রাক নিয়ে যেতে বলে। রাত সাড়ে ১০টায় হাদারপাড় যাই। নুরু ইসলাম আমাকে বলে, এক ট্রিপ চিনি নিয়ে যাও। তোমাকে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দেব। আমি বলেছি, পুলিশ ধরব। তখন সে (নুরু) আমাকে বলে, পুলিশে ধরবে না। পুলিশকে ম্যানেজ করব। আমি তখন ১৫৫ বস্তা চিনি নৌকা থেকে ট্রাকে তুলি। তারপর আমাকে নুরু ইসলাম বলেছে, দেলোয়ার মোল্লা পুলিশের দিকটা দেখব। আমি ট্রাক চালাইয়া সালুটিকর আসি। সেখানে দেখি, আরও ১৬-১৭টি ট্রাক দাঁড়ানো। নুরু ইসলাম আমাকে ফোনে বলে যে, উমাইরগাঁও (এসএমপির জালালাবাদ থানা এলাকা) রোড ধরে যাওয়ার জন্য। কিছু ট্রাক এক রোডে, কিছু অন্য রোডে, আবার সবকিছুর নির্দেশনা ফোনে ফোনে হচ্ছিল। আমরা ট্রাক নিয়ে উমাইরগাঁও রোডে রওনা হতেই একটা সাদা রঙের প্রাইভেট কার ও একটি মোটরসাইকেল আমাদের ট্রাক ক্রস করে, আমাদের রাস্তা ক্লিয়ার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরা কারা, আমি ঠিক জানি না। দেলোয়ার মোল্লা জানতে পারে, এরা কারা। আমরা উমাইরগাঁও যাওয়ার পরই দেখি, ছয়-সাতটা ট্রাক ঘুরিয়ে ফেলছে। আমি দেখে ট্রাকটি ঘুরিয়ে ফেলি। সামনের ট্রাককে জিজ্ঞেস করতে বলে, দুই-তিন মিনিট দাঁড়াতে। এর মধ্যে বাইক ও প্রাইভেট কারের লোকজন পালাইছে। অন্য ট্রাকের ড্রাইভাররাও পালিয়ে যায়। ৪-৫ মিনিটের মধ্যে দেখি, পুলিশ এসে গেছে। তখন সুযোগ বুঝে আমিও পালিয়ে যাই।’
কে দেলোয়ার মোল্লা?
ট্রাক ভাড়া করা নুরু ইসলামের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এই নামে এলাকায় একাধিক নাম থাকায় সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। তবে এলাকাবাসী দেলোয়ার মোল্লাকে এক নামে সবাই চেনেন। সবার বক্তব্য দেলোয়ার ‘পুলিশের লোক’!
খবরের কাগজের তাৎক্ষণিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই দেলোয়ার মোল্লার একটি ছবি গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিফুল ইসলাম শ্রাবণের সঙ্গে রয়েছে। দেলোয়ার মোল্লার ফেসবুক আইডিতে পাওয়া গেছে ওসি রফিকুলের সঙ্গে ছবিটি। ‘নতুন ওসির সাথে...’ ক্যাপশন লিখে দেলোয়ার মোল্লা তার নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিয়েছেন গত ডিসেম্বরে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেলোয়ার মোল্লার বাড়ি হাদারপাড় এলাকায়। হাদারপাড় সীমান্ত এলাকার পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দি যাওয়ার পথ। দেলোয়ার স্থানীয়দের কাছে ‘পুলিশের লোক’ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তিনি চলাচল করেন। তার পেশা কী- এ বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেননি। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকলেও তার চলাফেরা রাজকীয় বলে জানা গেছে। স্থানীয়দের মাধ্যমে দেলোয়ার মোল্লার দুটি ফোন নম্বর পাওয়া যায়। দুটি ফোনই বন্ধ পাওয়া গেছে।
‘আই মাস্ট অ্যারেস্ট হিম, এগেইনস্ট ক্রাইম’
দেলোয়ার মোল্লার ব্যাপারে জানতে চাইলে গোয়াইনঘাট থানার ওসি রকিফুল ইসলাম শ্রাবণ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি থানার ওসি। আমাদের কাছে অনেকেই আসে নানা রকম কাজ নিয়ে। কেউ কেউ ছবিও তোলে। কোন নামের কে অপরাধী ছবি তুলল, এ নিয়ে কিছু বলা সম্ভব না। অপরাধীর অপরাধ যদি আমাকে জানানো হয়, তাহলে আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। আই মাস্ট অ্যারেস্ট হিম, এগেইনস্ট ক্রাইম।’
যুবলীগ নেতার প্রতিবাদ
গত ৬ জুন ১৪ ট্রাক চিনি ধরা পড়ার পর প্রাইভেট কারের মালিকানার সূত্র ধরে ‘অচেনা এমপির লোক কারা’ শিরোনামে ৭ জুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। পরে ৯ জুন ‘চোরাই চিনির পথে সব সাক্ষীগোপাল’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ দুটি প্রতিবেদনের একটিতে সিলেট মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুপম আহমদের নাম ও আরেকটিতে থানায় তদবির করছেন ক্যাপশনে একটি ছবি প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনের একটি অংশ ও প্রকাশিত বিষয়ে রুপম দাবি করেন, তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। চোরাই চিনির সঙ্গে পাওয়া প্রাইভেট কারটি তিনি মাঝেমধ্যে চালাতেন। এ জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কেউ তার নামটি বলে থাকতে পারে। পুলিশের তদন্তে তার জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত মেলেনি। আর ছবি প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, এটি ঘটনার অন্তত দেড় মাস আগে আম্বরখানা পুলিশ ফাঁড়িতে অন্য একটি কাজে যাওয়ার। গাড়ি ছাড়ানোর তদবির তিনি করেননি বলে দাবি করেন।