দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সিলেট নার্সিং কলেজের আবাসন সমস্যার কোনো সমাধান না করে উল্টো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা আটকে দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। রবিবার (২৬ মে) বিএসসি পুরাতন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের রিটেক পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার্থীরা কলেজে গেলে তাদের পরীক্ষা না নিয়ে সেখানে তাদের ক্লাস টিচার সুমা রানী দত্ত বলেন, ‘সিনিয়রদের চাপে অন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তারা কলেজের সব সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি আছে লিখে আবেদনপত্র দিতে হবে। যদি তারা এ ধরনের আবেদন না দেয় তাহলে তাদের রিটেইক পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না এবং ফেল করিয়ে দেওয়া হবে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনা বেগম।
এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক ও অমানবিক শর্ত না মানায় গতকাল শনিবার (২৫ মে) বিএসসি ইন নার্সিং চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল, দ্বিতীয় এবং প্রথম বর্ষের রিটেক ভাইবা পরীক্ষা নেওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়েছে।
শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বারবার পরীক্ষায় ফেল দেবেন বলে ভয় দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া কলেজ কর্তৃপক্ষ হোস্টেল ত্যাগের যে নোটিশ দিয়েছেন তা বাতিলের কথা বললেও ওই নোটিশ এখনো বাতিল করা হয়নি এবং শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায় হয়নি বলে এখনো হোস্টেলে অবস্থান করছেন বলে জানান।
পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন পাবলিক হেলথ, পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং, বিএসসি নার্সিং কোর্সের একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, “আজ কলেজ কর্তৃপক্ষ মিটিং করেছে। সেখানে আমাদের পক্ষ থেকে কয়েকজন ছাত্রী অংশ নেয়। সেই মিটিংয়ে আমাদের বলতে গেলে হেনস্থা করা হয়েছে। জোরপূর্বক তাদের দেওয়া বিভিন্ন শর্ত মানতে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। মিটিংয়ে হোস্টেলে থাকার সমস্যা সমাধানের কথা বললেই আমাদের ম্যাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে বলো, ডিজি মাকসুরা নূরকে গিয়ে বলো নতুন হোস্টেল চালু করে দিতে’।”
তারা বলেন, ‘গত ২৪ মে কলেজে লোকাল অথোরিটি এবং স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে শিক্ষকরা মিটিংয়ে বসেন। তখন আমরা হোস্টেলের সব শিক্ষার্থী এক সঙ্গে কলেজে যাই। কিন্তু কনফারেন্স রুমে মাত্র ৪ জনকে ঢুকতে দেওয়া হয়। ওখানে আবাসন সমস্যা নিয়ে কথা উঠে। বলা হয় যে কিছুদিনের মধ্যে জাইকা প্রজেক্টের দেওয়া হোস্টেল হ্যান্ডওভার নেওয়া হবে। তার আগ পর্যন্ত কলেজ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ওইভাবে শিক্ষার্থীদের থাকতে হবে। ভেতরে শিক্ষার্থী যারা ছিলেন তাদের দিয়ে ২৩ তারিখের আন্দোলনের জন্য ক্ষমা চাওয়ানো হয় এবং এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে তারা সেখানে বাধ্য হয়েই শিক্ষকদের কথা মেনে নেয়। ওই মিটিংয়ে বলা হয়, হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা কলেজ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে রাজি এই মর্মে এবং ২৩ তারিখ আমরা উনাদের কাজে বাধা দিয়েছি তার জন্য ক্ষমা চেয়ে আবেদন করতে হবে। আমাদের প্রতিনিধিরা এই সিদ্ধান্ত আমাদের জানানোর পর আমরা কেউ এই আবেদন দিতে রাজি হইনি। কিন্তু কলেজ থেকে বারবার ফোন কলের মাধ্যমে আবেদন জমা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।’
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘গতকাল আমরা তাদের কাছে সম্মানসূচক ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেছি এবং এই মর্মে দরখাস্ত দিয়েছি যে, ন্যায়সঙ্গত ও শিক্ষার্থীসুলভ সিদ্ধান্তে আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করব। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের দরখাস্ত গ্রহণ করেনি এবং বারবার ফোন কলের মাধ্যমে চাপ দেওয়া হয় যেন আমরা তাদের অযৌক্তিক দাবি মেনে নেই। আমরা তাদের এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নই, তাই আর কোনো আবেদন দেইনি। তারা তাদের সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে কিন্তু আমরা এতগুলো শিক্ষার্থী যে গাদাগাদি করে থাকছি এতে তাদের টনক নড়ছে না।’
তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিদিন হিট স্ট্রোকে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই গরমে রুমে ৪ জনের জায়গায় ৮ জন থাকলে আমরাও মারা যাব। এতে কলেজ কর্তৃপক্ষের হয়তো কিছু যাবে আসবে না। আমাদের অভিভাবক এই জায়গায় পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছেন। যেখানে আমাদের থাকার জায়গারই সংকট এই পরিবেশে আমরা পড়াশোনা করব কীভাবে? কলেজে কর্তৃপক্ষ নানাভাবে আমাদের চাপ দিচ্ছে। রিটেক ভাইবা পরীক্ষা স্থগিত করে দিয়েছেন। আমাদের পরীক্ষায় ফেল করানোর ও ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি দিচ্ছেন তারা।’
অন্যদিকে, ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি প্রথম বর্ষের আগামী ২৯ মে ফরম ফিলাপ করার কথা। কিন্তু হোস্টেলের সমস্যা সমাধান না হওয়ায় অনেকেই বাড়িতে চলে গেছেন। ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারির বেশ কয়েকজন ছাত্রী জানান, মিডওয়াইফারি প্রথম বর্ষের ৪৪ জন শিক্ষার্থী দ্বিতীয় তলার হলরুমে ২৫ জনের জায়গায় থাকছেন। এই গরমে তাদের অবস্থা খুব শোচনীয়। হোস্টেলে ওরা রুম পায়নি, আর কোনো রুমে উঠার মতো জায়গা নেই।
তারা বলেন, ‘আমরা আমাদের দাবি নিয়ে গেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা করে দেননি। তাই সবাই বাসায় চলে গেছি এবং জানিয়ে দিয়েছি হলরুমে থাকবে না। কলেজ কর্তৃপক্ষ যতদিন না এই সমস্যার সমাধান করবেন আমরা হোস্টেলে আসবে না।’
এ ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনা বেগম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কারও কোনো পরীক্ষা বন্ধ করা হয়নি। যাদের যে তারিখে পরীক্ষা সে তারিখেই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।’
আজ বিএসসি পুরাতন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের রিটেক পরীক্ষা কেন নেওয়া হয়নি এই প্রশ্নে কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই পরীক্ষা আগামীকাল নেওয়া হবে।’
শাহিনা বেগম বলেন, ‘সার্বিক বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছি। নতুন একটি বিল্ডিংয়ে ছাত্রীদের শিফট করতে হলে হেড অফিস থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে। প্রজেক্টের বিল্ডিং, তাই এটি হস্তান্তরে জন্য বেশ কিছু রিপ্রেজেন্টিভ লাগে। আগামীকাল একাডেমিক শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করব। তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে যা করার করবেন।’
প্রসঙ্গত, সিলেট নার্সিং কলেজ হোস্টেলে আছেন কলেজের পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন পাবলিক হেলথ, পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং, বিএসসি নার্সিং কোর্স ও ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রী। হোস্টেলের এই আবাসন সমস্যা চলছে প্রায় ৫-৬ বছর ধরে। দায়িত্বশীলরা দীর্ঘদিন ধরে নতুন বিল্ডিংয়ে ছাত্রীদের দেই দিচ্ছি বলে আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছেন না।
হোস্টেলের চার তলা ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় তিনটি হলরুম আছে। সেগুলোতে নার্সিংয়ের ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা থাকেন। মিডওয়াইফারি প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা দ্বিতীয় তলার হলরুমে থাকেন, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার হলরুমে থাকেন বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা। ভবনের প্রথম তলায় রান্নাঘর ও খাবার ঘরের পাশাপাশি কয়েকটি থাকার কক্ষও রয়েছে।
দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়ও থাকার কক্ষ আছে। এই কক্ষগুলোতে এই চার প্রোগ্রামের প্রথম বর্ষ (পুরাতন), দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্রীরা থাকেন। প্রতিটি কক্ষে চারজন করে থাকার ধারণক্ষমতা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এসব কক্ষে ছয়জন ছাত্রী গাদাগাদি করে থাকছেন। এই ছয়জনের মধ্যে চারজন সিনিয়র, একজন পুরাতন প্রথম বর্ষের ছাত্রী বেডে থাকছেন এবং হলরুমে জায়গা না হওয়ায় সব রুমে ফ্লোরে একজন জুনিয়রকে (নতুন প্রথম বর্ষ) থাকার জন্য দেওয়া হয়েছে। এখন কলেজ কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে, চারজনের ধারণক্ষমতার রুমে আটজন করে থাকতে। যা মানছেন না হোস্টেলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা।
সালমান/