মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চরাঞ্চলে হঠাৎ করে রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে। গত তিন মাসে এই সাপের কামড়ে পাঁচজন মারা গেছেন। কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলের মানুষ সাপ আতঙ্কে ফসলের খেতে কাজ করছেন। অনেকে আবার সাপ দেখলেই পিটিয়ে মেরে ফেলছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কৃষকদের সতর্ক করার পাশাপাশি গামবুট সরবরাহ করা হচ্ছে। যদিও সাপে কাটা রোগীদের অ্যান্টিভেনম সীমিত থাকার কথা জানিয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে থাকা আজিমনগর, লেছড়াগঞ্জ ও সুতালড়ী ইউনিয়নের চরাঞ্চলে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের বসবাস। স্থানীয় কৃষকরা এখানকার জমিতে ভুট্টা, বাদাম, তিল, আমন ও আউশ ধানের চাষ করেন। এর মধ্যে ভুট্টা ও ধানখেতে সাপটির বিচরণ থাকে বেশি।
গত সোমবার দুপুরে আজিমনগর ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে খেতে ধান কাটছিলেন কৃষক শেখ শমসের আলীসহ বেশ কয়েকজন। সেখানে তারা সাপ দেখতে পান। পরে কৃষকরা লাঠি দিয়ে রাসেলস ভাইপার সাপটি মেরে ফেলেন। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার এক কৃষক সকালে জমিতে তিল কেটে রেখে দুপুরে তা বাড়ি আনতে গেলে তিলের বোঝায় রাসেলস ভাইপার সাপ দেখতে পান। একের পর এক এই সাপের দেখা মেলায় নদীতীরবর্তী চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে।
কৃষক শেখ শমসের আলী বলেন, ‘আমরা চরাঞ্চলের মানুষ। চাষাবাদ আর গরু-ছাগল পালন করে সংসার চালাই। এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম। গত সোমবার সকাল থেকে চারজন মিলে খেতের ধান কাটছিলাম। হঠাৎ একটি সাপ দেখতে পাই। দৌড়ে সেখান থেকে চলে এসে বাঁশ নিয়ে আসি। পরে চার পাঁচজন মিলে ওই সাপটিকে মেরে ফেলি। পরে জানতে পারি এটা বিষধর রাসেলস ভাইপার।’
স্থানীয় আব্দুল বাতেন বলেন, ‘কয়েকদিন আগে পশ্চিমচর গ্রামের এক কৃষক ওই সাপ দেখে দা দিয়ে কেটে দুই ভাগ করে ফেলেন। এ ছাড়া, শিকারপুরের সাইদুল মোল্লা তার জমির ধান গাড়িতে তোলার সময় আঁটির নিচে রাসেলস ভাইপার সাপ দেখতে পায়। পরে ওই সাপটিকে কয়েকজন মিলে মেরে ফেলেন।’
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে গত তিন মাসে অয়ন শীল, রুবেল ব্যাপারী ও শেখ লাল মিয়া নামে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া, ফরিদপুর জেলা-সংলগ্ন পদ্মার চর এলাকায় এই সাপের উপদ্রব রয়েছে। শুনেছি ওখানেও কয়েকজনকে এই সাপ কামড় দিয়েছে।’
আজিমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এ এলাকায় রাসেলস ভাইপারের আনাগোনা বেশি। এখন ধান কাটার মৌসুম হওয়ায় উদ্বেগটা বেশি। আমার ইউনিয়নেই দুজন মারা গেছেন। যেখানে ধান ও ভুট্টার আবাদ করা হয়েছে সেখানে এর ঝুঁকি বেশি। তাই সচেতনতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করেছি।’
পরিবেশ নিয়ে কাজ করে ‘হরিরামপুর শ্যামল নিসর্গ’ নামে একটি সংগঠন। ওই সংগঠনের উপদেষ্টা তৈয়বুল আজহার বলেন, ‘বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপার বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামে পরিচিত। এই সাপের কামড়ে হরিরামপুরের পাঁচজন মারা গেছেন। আমরা মানুষকে রক্ষার জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে গণসচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান খান জানান, হরিরামপুরের চরাঞ্চলের জমিগুলোতে কৃষকরা বছরে একাধিক ফসল আবাদ করেন। আর খেতে ফসল থাকায় ইঁদুরের সংখ্যাও বাড়ছে। পর্যাপ্ত খাদ্য ও বংশবিস্তারের যথাযথ পরিবেশ থাকায় সেখানে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বেড়েছে। আমরা সব সময়ই কৃষক ভাইদের সতর্কতার সঙ্গে খেতে কাজ করতে অনুরোধ করছি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মেহেরুবা পান্না বলেন, ‘এই সাপ খুবই বিষধর। যদি কাউকে কামড়ায় তাহলে ১০০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশনের কার্যকরী উপকার পাওয়া যাবে। তবে চাহিদা অনুযায়ী সাপে কাটা রোগীদের অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন খুবই সীমিত। জেলার সমন্বয় মিটিংয়ে চাহিদার কথা উপস্থাপন করা হয়েছে।’
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান জানান, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে আমরা কাজ শুরু করেছি। যেহেতু, এখন বোরো ধানের মৌসুম তাই উপজেলা পরিষদ থেকে প্রথম অবস্থায় চরাঞ্চলের কৃষকদের বিশেষ জুতার (গামবুট) ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, সাপ কামড়ালে গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ সরাসরি হাসপাতালে না এসে ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে যান। সময় নষ্ট করে পরে তারা হাসপাতালে আসেন। ততক্ষণে রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে যায়। যেহেতু সাপের উপদ্রব বেড়েছে তাই শিগগির উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এন্টিভেনম দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।