![সীতাকুণ্ড সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কোটিপতি ঝাড়ুদার](uploads/2024/07/05/ctg-1720161332.jpg)
ঝাড়ু দেন না অফিসে, অথচ পদবিতে তিনি একজন অস্থায়ী ঝাড়ুদার। চায়ের দোকানের কর্মচারী থেকে এখন তিনি উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কোটিপতি ঝাড়ুদার। তার সঙ্গে বনিবনা না হলে কোনো রেজিস্ট্রি করান না সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিব।
এ বিষয়টি নিয়ে সীতাকুণ্ডের সার্ভেয়াররা লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অভিযোগও দিয়েছেন। তবুও দমেননি তিনি। পাত্তা দেন না অফিসের অন্যদেরও। এক হাতে গোটা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস শাসন করে বছরের ব্যবধানে এই ঝাড়ুদার বনে গেছেন কোটি টাকার গাড়ি-বাড়ির মালিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এয়াকুব আলী ঝাড়ুদারের কাজ করতেন দৈনিক ৭০ টাকা মজুরিতে। প্রতিদিন সকালে অফিসে ঝাড়ু দিতেন। ধীরে ধীরে তিনি সাব-রেজিস্ট্রারের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। যখন যে সাব-রেজিস্ট্রারই আসেন, তিনি তার ওপর আস্থা রাখেন। তার বৈধ-অবৈধ কাজ সম্পাদনের জন্য সাব-রেজিস্ট্রার ও অন্য কর্মচারীকে ম্যানেজ করে একপর্যায়ে গড়ে তোলেন বিশাল ঘুষ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। এরপর থেকে তিনি আর ঝাড়ু দেন না।
ঝাড়ুদার এয়াকুবের রয়েছেন আরও দুই সহযোগী। তাদের নাম জামশেদ আলম ও হারুন। এদিকে কমিশনে দলিল রেজিস্ট্রেশন করার ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ঘুষ আদায়ের অভিযোগ আছে সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিবের বিরুদ্ধে। এমনকি সরকারি স্টাফ না হওয়া সত্ত্বেও এয়াকুবকে কমিশনে পাঠান রায়হান হাবিব।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা পরিষদের সামনে একটি হোটেলে (ভাতের দোকানে) চাকরির সুবাদে এয়াকুব সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দুপুরে ভাত নিয়ে যেতেন। এরপর ২০০৬ সালে তিনি ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ শুরু করেন সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে। ঝাড়ুদার থেকে সাব-রেজিস্ট্রারদের অঘোষিত পিএস হয়ে উঠেন তিনি। সেই ক্ষমতাবলে সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয় জুড়ে চলে তার শাসন। এরপর শুরু করেন ঘুষ লেনদেনের কারবার। হোটেল মালিক শাহ আলমের দোকানে কর্মচারী থাকাকালীন তার মেয়ের সঙ্গে এয়াকুবের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অবশেষে অল্পদিনে কোটিপতি বনে যাওয়া এয়াকুবের সঙ্গেই তার মেয়ের বিয়ে দেন।
ঝাড়ুদার মো. এয়াকুব রাঙ্গুনিয়া থানার কোদালা গ্রামের মোহাম্মদ ইউছুফের ছেলে। রাঙ্গুনিয়ায় বাড়ি করেছেন। সেখানে তার বাবা-মা থাকেন বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে সীতাকুণ্ড সদরসহ উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় তার শ্বশুর-শাশুড়ি, শালী, নানিশাশুড়ির নামে নিয়েছেন জমি। পরে সেসব তার স্ত্রীর নামে হেবা করেন তিনি। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কাজ করেন তার চাচাতো শ্যালিকা নাসরিন। এয়াকুবের রয়েছে দু-দুটি প্রাইভেট কার। চলাফেরা করেন বড় কর্মকর্তাদের মতো। জায়গাজমি নিয়ে রেখেছেন নানিশাশুড়ি সকিনা বিবির নামেও।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সীতাকুণ্ড উপজেলার আমিরাবাদ মৌজায় ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৬ শতক জমি কিনেছেন এয়াকুব (যার দলিল নম্বর- ৭৪৯৭/২৩ ইং)। ওই জমিটি কিনেছেন প্রায় ৭০-৮০ লাখ টাকায়। দলিল রয়েছে সকিনা বিবি নামে নব্বই বছর বয়সী এক নারীর নামে। ওই মহিলা সম্পর্কে ঝাড়ুদার এয়াকুবের নানিশাশুড়ি হন। বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রতিবেদক সরেজমিন গেলে স্থানীয় লোকজন এর সত্যতা নিশ্চিত করেন।
সেবা নিতে আসা অনেকেই জানান, যাচাই-বাছাই শেষে সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে গেলে তিনি দলিলের নানা খুঁত ধরেন। এ সময় দেনদরবার করতে তিনি এয়াকুবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এয়াকুব এই সুযোগটি কাজে লাগান। সাব-রেজিস্ট্রার কত টাকা হলে দলিল রেজিস্ট্রি করবেন, তা ওই ঝাড়ুদার এয়াকুবই নির্ধারণ করে দেন। সাব-রেজিস্ট্রার তার নির্ধারিত পরিমাণ কম বা বেশি হলে জমি রেজিস্ট্রি করেন না। সেই ক্ষমতার দাপটে ঝাড়ুদার এয়াকুব আলী ঘুষের টাকায় কোটিপতি হয়েছেন।
এদিকে সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিব চলতি বছরের ২২ এপ্রিল সীতাকুণ্ড উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যোগদানের পর থেকে সীতাকুণ্ড দলিল লেখক সমিতি তার উপর ক্ষুব্ধ।
উপজেলা দলিল লেখক সমিতি এই সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মহাপরিদর্শক (নিবন্ধন অধিদপ্তর) বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছে।
ওই অভিযোগে সাব-রেজিস্ট্রারকে বদলিরও অনুরোধ করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়েও দেওয়া হয়েছে দরখাস্ত।
দলিল লেখকদের অভিযোগ, সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিব ঘুষ ছাড়া কোনো দলিল রেজিস্ট্রি করেন না। গত ২২ এপ্রিল তিনি এই অফিসে যোগদানের পর থেকেই চলছে ঘুষের অবাধ বাণিজ্য। জমি হস্তান্তর করতে আসা দলিল লেখক ও সাধারণ মানুষ অগ্রিম ঘুষ চুক্তি না করে রেজিস্ট্রি করতে এসে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। নথিতে কোনো সমস্যা না থাকলেও কিছু ত্রুটি বের করে দলিল ফেরত দিয়ে দিচ্ছেন সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিব। তিনি ক্রমাগত দলিল লেখকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। সাব-রেজিস্ট্রারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন ঝাড়ুদার এয়াকুব। সব কথা তার সঙ্গেই বলতে হয়। সাব-রেজিস্ট্রারের নির্দেশে দলিলের মূল্য অনুযায়ী ১৫ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ চান এয়াকুব। চুক্তি চূড়ান্ত হলে সাব-রেজিস্ট্রারকে সবুজ সংকেত দেন এয়াকুব। তারপর তিনি আর কোনো পরীক্ষা না করেই নথিটির কাজ সম্পাদন করেন।
তারা আরও জানান, একটি দলিলের জমির মূল্য ১ কোটি টাকা হলে অফিস ফি দিতে হবে ৫০-৬০ হাজার টাকা। এটি সরকারি ফি-এর বাইরে সম্পূর্ণ অতিরিক্ত অর্থ। এটা ওপেন সিক্রেট। আমরা আগে থেকেই দিয়ে আসছি। তাই এ নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ এটা একটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই নতুন সাব-রেজিস্ট্রার আসার পর যেকোনো অজুহাতে কাগজপত্র ফেরত দিচ্ছেন। ঘুষের চুক্তি ছাড়া রেজিস্ট্রি অফিসে নথি নিয়ে যাওয়া লোকদের সঙ্গে তিনি চরম দুর্ব্যবহার করেন। আমরা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে গত ৬ ও ৯ জুন দুবার বৈঠক করেছি। কোনো লাভ হয়নি।
দলিল লেখক সমিতির সভাপতি রফিকউদ্দিন আহাম্মদ খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, সাব-রেজিস্ট্রারের অস্বাভাবিক ঘুষের দাবি মেটাতে গিয়ে দলিল সম্পাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। সমস্যার সুরাহা করতে আমরা একাধিকবার সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিবের সঙ্গে বসেছি। কিন্তু তার দাবি, অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি সীতাকুণ্ডে বদলি হয়ে এসেছেন। এ টাকা তাকে তুলতে হবে।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সাব-রেজিস্ট্রারের ঘুষ-দুর্নীতির প্রসঙ্গ উল্লেখপূর্বক তাকে অপসারণের লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাব-রেজিস্ট্রারকে অপসারণ করা না হলে দলিল লেখকরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে যাবেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিব বলেন, আমার নামে এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমি আইনবহির্ভূত কোনো কাজ করি না বিধায় দলিল লেখকদের একটি সিন্ডিকেট আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
তিনি বলেন, ‘দলিল লেখকদের কাজ শুধুমাত্র দলিল লেখা। তারা দাতা-গ্রহীতাকে দলিল লিখে দিয়ে ফি নিয়ে রশিদ দেবেন। দলিল সাবমিট করা তাদের কাজ নয়। এ কাজ দাতা-গ্রহীতা যে কেউ করতে পারেন।
তিনি বলেন, আগে দলিল রেজিস্ট্রি বিভিন্ন নিয়মে করা হতো। এখন দলিল রেজিস্ট্রির জন্য এনবিআর আমাদের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম করে দিয়েছে। তাই হয়তো দলিল লেখকদের সঙ্গে আমাদের কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে। এ ছাড়া এসব অপপ্রচারকারীরা ঘুষ খেয়ে বা ঘুষ দিয়ে সীতাকুণ্ডে আসে। এক পক্ষ আমার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে এসব অপবাদ ছড়াচ্ছে।
এয়াকুব আলী বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমি এখনো তেমন কিছু করিনি। নানিশাশুড়ির নামে কেন জায়গা নেব? তবে সকিনা বিবি নামে যে নানিশাশুড়ি আছে, সেটা স্বীকার করেন তিনি (এয়াকুব)।