![ডেয়ারিতে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা](uploads/2024/05/21/Milk5-1716280525.jpg)
৩৮ বছর বয়সী রুপালি কর্মকার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। পূর্ণিমাগাঁতী গ্রামে রয়েছে তার একটি দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র। তিন সন্তানের মা রুপালির সংগ্রহ কেন্দ্রে ২৩৩ জন মহিলা দুগ্ধ খামারি রয়েছেন, যেখানে ৩০-৩৫ জন কৃষক দৈনিক দুধ সরবরাহ করেন।
তিনি তার সংগ্রহ কেন্দ্র থেকে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে মোবাইল ফোন, বিকাশ এবং নগদের মতো ডিজিটাল লেনদেন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন।
রুপালি কর্মকার খবরের কাগজকে বলেন, স্বচ্ছ ডিজিটাল ব্যবস্থা আমাকে কৃষকদের আস্থা অর্জন করতে সাহায্য করেছে। কর্মের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় মেয়েদের হাতে কৃষি ব্যবসা চলে আসছে। পুরুষরা তার এলাকায় কাপড় ও মাছের ব্যবসায় বেশি আগ্রহী। সরকারি ও বেসরকারি দুধ কোম্পানির কাছে দুধ বিক্রি করে রুপালির মাসিক আয় এখন প্রায় ৬০,০০০ টাকা। ‘চলতি বছরের মধ্যে আশপাশের গ্রাম মিলিয়ে ৫০০ জন নারী খামারি আমার সঙ্গে যুক্ত হবেন’ বলে জানান রুপালি।
রুপালির মতো যশোরের শার্শার পারভীন আকন্দ, পাবনার দিলারা বেগম দুগ্ধ খামার দিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পারভীন আকন্দ বলেন, ২টা ফ্রিজিয়ান গরু দিয়ে শুরু করেছিলেন ২০১২ সালে। এখন তার ফার্মে ১৮টি গাভী, ৫টা ষাঁড় এবং ৮টা বাছুর। এ বছর প্রায় ১৪ লাখ টাকা আয় করছেন পারভীন আকন্দ।
পারভীন জানান, সরকারের ডেইরি অ্যান্ড লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট হতে শতাধিক নারী সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন। এখানে প্রশিক্ষিণ পাচ্ছেন, যা তাদের কাজকে সঠিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব সেবাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ডে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। প্রান্তিক খামারিও এ প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে। খামারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে একদিকে যেমন সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় করছেন, অন্যদিকে বাড়ছে উৎপাদনও। এর ফলে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে দেশ। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র খামারিদের পণ্যের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) অনুসারে, দেশে প্রায় ১২ লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে। ৯৪ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে স্থানীয় দুগ্ধ খাতে আনুমানিক বিনিয়োগ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উচ্চ আয় এবং ক্রমবর্ধমান পুষ্টিসচেতনতার কারণে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গত ২০ বছরে দেশে দুধের উৎপাদন অন্তত পাঁচগুণ বেড়েছে। উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে।
যান্ত্রিকীকরণ ও ডিজিটাইজড করা প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, খামারিদের প্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় আনতে সরকার কাজ করছে। প্রযুক্তির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটাতে চাই। যারা প্রযুক্তির সেবা গ্রহণ করবেন তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। সেদিকে নজর রয়েছে সরকারের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের প্রধান চালিকাশক্তি এখন নারী। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের শ্রমে ভর করে এগোচ্ছে দেশের গবাদিপশু সম্প্রসারণ কার্যক্রম। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৮৮ দশমিক ২ এবং পুরুষের মাত্র ১১ দশমিক ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রাণিসম্পদ খাতে বর্তমানে শতকরা ২০ ভাগ প্রত্যক্ষ এবং ৫০ ভাগ পরোক্ষভাবে মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। যার অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, বর্তমানে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। কৃষিক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদের অবদান ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষকে প্রত্যক্ষ এবং ৫০ শতাংশ মানুষকে পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত করে। এসব কারণেই গবাদিপশুর খামার দ্রুত বর্ধনশীল ও সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ পরিবারেই গবাদিপশু লালন-পালন করা হয়। সাধারণত বাড়ির নারীরাই এগুলোর দেখাশোনা করেন। নারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে সামনের দিনগুলোয় এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ খাতেও উৎপাদন বাড়বে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ গোলাম হাফিজ কেনেডি খবরের কাগজকে বলেন, ‘নারীরা পরিবারের দেখাশোনার পাশাপাশি গবাদিপশু লালন-পালন করতে পারেন। এতে তারা পরিবারের আয়েও বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। এতে ঘরে বসে থেকেই তাদের আয় করার সুযোগ রয়েছে। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘নারীরা পারিবারিকভাবে গবাদিপশু দেখাশোনা করেন। বাড়ির কাজ যেমন অবৈতনিক, তেমনি পারিবারিক গবাদিপশু লালন-পালনও অবৈতনিক। এটা তাদের সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান নয়। বৃহত্তর পারিবারিক কাজের অংশ হিসেবেই তারা এটা করে থাকেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী খবরের কাগজকে বলেন, ‘সামাজিকভাবে আমাদের দেশে পরিবারগুলোর কর্তা পুরুষ। সে কারণে প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও পুরুষরাই বেশি মালিকানায় রয়েছেন। এক্ষেত্রে মালিকানার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশীদারত্ব বাড়ানো। সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তার জন্য বিভিন্ন স্থানে নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ পশুর খাদ্য তিন ধরনের- দানাদার, শুকনো খড় ও ঘাস। অনেক সময় যে পরিমাণ খাবার খাওয়ানো প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি খাওয়ানো হয়। আবার ওষুধও মাঝে মধ্যে বেশি ব্যবহার করা হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। আমরা উদ্যোক্তাদের কীভাবে কম খরচে উৎপাদন করা যায় তার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’