![দুর্বল কোম্পানি জেড গ্রুপে স্থানান্তর করতে পারবে ডিএসই](uploads/2024/05/23/DSE-Z-1716444732.jpg)
পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানি ঘোষিত লভ্যাংশের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পরিশোধ বা বিতরণ করতে ব্যর্থ হলে ওই প্রতিষ্ঠানকে জেড গ্রুপে স্থানান্তর করতে পারবে স্টক এক্সচেঞ্জ, এমন বিধান করে এ বিষয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এখন থেকে এ নীতিমালার আলোকে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে ‘জেড’ গ্রুপে স্থানান্তর করবে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ। এ জন্য আলাদা করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কোনো অনুমোদন নিতে হবে না।
গত সোমবার (২০ মে) এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আগামী ২ জুলাই থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে। নতুন নিয়মানুযায়ী, পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ছাড়িয়ে গেলে ওই কোম্পানি জেড গ্রুপে যাবে।
বিএসইসির নির্দেশনায় বেশ কিছু শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার যে কোনো একটি শর্ত লঙ্ঘন করলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ওই কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করতে পারবে।
বিএসইসির নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানি শেষ লভ্যাংশ ঘোষণার তারিখ থেকে বা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির তারিখ থেকে পরপর দুই বছরের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হলে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হবে। পাশাপাশি আইন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করতে ব্যর্থ হলেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে কোনো রিট পিটিশন বা আদালতে বিচারাধীন কোনো আইনি প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ এজিএম অনুষ্ঠিত না হওয়ার ক্ষেত্রে, অর্থাৎ উপ-বিচারের বিষয় বা জোরপূর্বক ঘটনা ঘটলে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২ বছর সময় পর্যন্ত বিবেচনা করা যেতে পারে।
এতে বলা হয়েছে, যদি তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংস্কার বা বিএমআরই (ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন এবং সম্প্রসারণ) এর জন্য এই ধরনের কোনো সময় ব্যতীত ন্যূনতম ছয় মাস ধরে একটানা উৎপাদনে না থাকলে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হবে।
এ ছাড়াও পুঁঞ্জিভূত লোকসানের পরিমাণ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ছাড়িয়ে গেলে ওই কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা যাবে।
এ ছাড়া কোনো কোম্পানি ঘোষিত বা অনুমোদিত লভ্যাংশের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পরিশোধ বা বিতরণ করতে ব্যর্থ হলে সেটিকে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করতে পারবে স্টক এক্সচেঞ্জ।
ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান ছাড়া জেড ক্যাটাগরিভুক্ত অন্য কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা-শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালকদের শেয়ার লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। বিএসইসির অনুমতি ছাড়া তারা ওই কোম্পানির কোনো শেয়ার কিনতে, বেচতে বা হস্তান্তর করতে পারবেন না।
টি+৩ ভিত্তিতে জেড ক্যাটাগরির শেয়ারের লেনদেনের নিষ্পত্তি হবে।
নতুন এ আদেশের মাধ্যমে এর আগে ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি, ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর ও চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএসইসির জারি করা আদেশ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রদ কিংবা প্রাধান্য দেওয়া হবে।
এর আগে কিসের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেড গ্রুপে যাবে, সে বিষয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি। ওই নির্দেশনার শেষ পয়েন্টে বলা হয়, ইস্যুয়ার কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশসংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বর্তী লভ্যাংশসংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনায় এমন বলা হলেও চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তখন বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনায় বলা হয়েছে এক রকম, আর বাস্তবায়ন হয়েছে অন্যভাবে। বিএসইসির নির্দেশনায় যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে কোম্পানিগুলোর পরবর্তী লভ্যাংশসংক্রান্ত ঘোষণা আসার পর জেড গ্রুপে স্থানান্তরসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হওয়ার কথা।
অন্যদিকে বিএসইসির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সার্বিক বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে জেড গ্রুপ নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলোকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ। সুতরাং স্টক এক্সচেঞ্জ থেকেই এ বিষয়ে প্রকৃত ব্যাখা দিতে পারবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে বলা হয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনার আলোকেই ২২ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিএসইর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিআরও) এ বিষয়ে বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তার ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।
জেড গ্রুপ নিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জারি করা বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়, যেসব কোম্পানি পরপর দুই বছর লভ্যাংশ দেবে না এবং দুই বছর বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করবে না সেগুলো জেড গ্রুপভুক্ত হবে। এ ছাড়া ছয় মাস কোনো কোম্পানি উৎপাদনে না থাকলেও জেড গ্রুপভুক্ত হবে। এমনকি কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস পরিশোধিত মূলধনের থেকে বেশি হলেও, ওই কোম্পানির ঠিকানা হবে জেড গ্রুপে।
তবে নির্দেশনার শেষ পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ইস্যুয়ার কোম্পানির পরবর্তী লভ্যাংশসংক্রান্ত ঘোষণা অথবা বার্ষিক/অন্তর্বর্তী লভ্যাংশসংক্রান্ত ঘোষণার দিন থেকে এই নির্দেশনা কার্যকর হবে।
কিন্তু বিএসইসির নির্দেশনা জারির পর ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকেই হুট করে অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আরামিট সিমেন্টস, আজিজ পাইপস, ডেল্টা স্পিনিং, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, জিবিবি পাওয়ার, ইনটেক, ইন্টারন্যাশনল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, কেয়া কসমেটিকস, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ন্যাশনাল টি, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইনান্স, রিজেন্ট টেক্সটাইল, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, রিং শাইন টেক্সটাইল, সাফকো স্পিনিং, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক, ঢাকা ডাইং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইয়াকিন পলিমার এবং জাহিনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজকে জেড গ্রুপভুক্ত করেছে ডিএসই।
চলতি বছরের ৪ মার্চ আরও ৬টি জেড শ্রেণিভুক্ত হয়। তাতে ডিএসইতে জেড শ্রেণির কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫টিতে।
এ সময়ে যে ৬টি কোম্পানিকে জেড শ্রেণিভুক্ত করা হয় তার মধ্যে প্রাইম টেক্সটাইল, প্রাইম ফিন্যান্স, এএফসি অ্যাগ্রো ও অ্যাকটিভ ফাইন ‘বি’ শ্রেণি থেকে এবং নিউলাইন ক্লথিংস ও ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ‘এ’ শ্রেণি থেকে জেড শ্রেণিতে স্থানান্তর হচ্ছে।
জেড গ্রুপভুক্ত হওয়ায় এই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণসুবিধাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত আসায় ১৮ ফেব্রুয়ারি লেনদেনের শুরুতেই বড় ধরনের দরপতনের মধ্যে পড়ে কোম্পানিগুলো।
শহিদুল ইসলাম নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, দুই দফায় ২৮ কোম্পানিকে জেড গ্রুপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিন কোম্পানিতে আমার বিনিয়োগ রয়েছে। এতে আমি বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছি। জানি না আর কত লোকসান হবে।
রফিকুল ইসলাম নামের আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, ২৮ কোম্পানি জেড গ্রুপ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থবিরোধী হয়ে গেছে।
তখন ডিএসইর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. এটিএম তারিকুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন বিএসইসি যেভাবে বলেছে, সেভাবেই করা হয়েছে। আমাদের সিআরও বিএসইসি সংশ্লিষ্ট অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করে এটা ঠিক করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে দীর্ঘদিন বাজার এক প্রকার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর বাজারে যখন গতি ফিরছিল, তখন জেড গ্রুপ নিয়ে নির্দেশনা আবার নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বিএসইসির নির্দেশনায় ছিল একরকম। বাস্তবায়ন হয়েছে অন্যভাবে। এর ফলে বিএসইসি এবং ডিএসইর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।
তবে নতুন নির্দেশনার ফলে এ দ্বন্দ্ব কিছুটা নিরসন হবে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কোনগুলো জেড (জাঙ্ক) ক্যাটাগরিভুক্ত হবে, সে বিষয়ে বিএসইসি গত তিন বছরে ৫ বার আইন বদলেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের সাড়ে তিন মাস পর জেড ক্যাটাগরি নির্ধারণে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর একটি নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু তার কার্যকারিতা স্থগিত রাখে বিএসইসি। এ কারণে টানা দুই বছর নগদ লভ্যাংশ দেওয়ায় ব্যর্থ কোম্পানিকে জেড ক্যাটেগরিভুক্ত করার কথা বলা হলেও টানা চার বছর কোনো লভ্যাংশ না দিয়েও তারা ‘এ’ বা ‘বি’ ক্যাটেগরিতে ছিল।