![সাংস্কৃতিক সংগঠনে বিভাজন তুষের আগুনে পুড়ছে ভবিষ্যৎ](uploads/2024/05/23/Rezanur-Rahman-1716439449.jpg)
আমরা বোধকরি আসল ছেড়ে নকলের পেছনেই দৌড়াচ্ছি। ঐক্য গড়ার চেয়ে অনৈক্যের পালে হাওয়া দিচ্ছি। রাজনীতিতে ঐক্য নেই অনেক দিন। একই অবস্থা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও। দেশে ভিন্ন নামে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন। গণমানুষের পক্ষে কথা বলাই সবার লক্ষ্য। অথচ অনেক ক্ষেত্রে সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। একই সংগঠনে বিভক্তির রেখা স্পষ্ট। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, টিভি নাটকের পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতিসহ (বাচসাস) একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে দীর্ঘদিন ধরেই বিভক্তি জিইয়ে আছে। মশারির ভেতর মশারি টাঙিয়ে প্রকাশ্য বিরোধে লিপ্ত অনেক সংগঠন। কে আসল কে নকল- এই বাদানুবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে অনেক সংগঠনের ক্ষেত্রে। ফলে দেশে প্রকৃত অর্থে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ব্যাহত হচ্ছে।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র একটি দেশের আয়নাও বটে। ভালো চলচ্চিত্রের কথা উঠলে দেশ হিসেবে ইরানের নামটা সহজেই উঠে আসে। একদা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রও অহংকার করার মতো একটা জায়গা তৈরি করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রের অবস্থা বড়ই নাজুক। এ জন্য চলচ্চিত্রের মানুষই কমবেশি দায়ী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ঘিরে ছোট-বড় ২০টিরও বেশি সংগঠন আছে। সবাই চায় চলচ্চিত্রের উন্নয়ন। এ জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। অথচ দেশের চলচ্চিত্র পরিবারে অনৈক্যই প্রকাশ্যে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নাটক, সিনেমার অভিনয়শিল্পীরা একটি দেশের অলংকারও বটে। একা শাকিব খানই প্রিয় মাতৃভূমিকে বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরার ভূমিকা নিতে পারেন। অথচ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে শিল্পীদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। একই সংগঠনে নানা পক্ষ। কেউ কাউকে মানেন না। অশিক্ষিত মূর্খ বলে গালাগাল দেন। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি প্যানেল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। আনন্দমুখর পরিবেশে এফডিসিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পরাজিত সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী নিপুণ আক্তার বিজয়ী প্রার্থীদের বিশেষ করে নতুন সভাপতি মিশা সওদাগর এবং সাধারণ সম্পাদক ডিপজলের গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে অভিনন্দন জানান। নিপুণের এই উদারতায় গোটা চলচ্চিত্র পরিবারে একটা স্বস্তির হাওয়া বয়ে যায়।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নতুন নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে। কিন্তু হঠাৎ করে নিপুণ আক্তার নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেন। নির্বাচন বাতিল চেয়ে তিনি আদালতে রিট করেছেন। ফলে দেশের চলচ্চিত্র পরিবারে বিশেষ করে শিল্পীদের মধ্যে বিভাজনের রেখা আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচনের ফলাফল জানার পরই সবার আগে নিপুণ আক্তার বিজয়ী প্রার্থীদের অভিনন্দন জানান। অথচ নিপুণই হঠাৎ কেন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেন? নিপুণ এই মুহূর্তে দেশে নেই। বিদেশে অবস্থান করছেন। বিদেশ থেকেই প্রচারমাধ্যমে বলেছেন, আমি ভোটের ফলাফল পর্যন্ত ছিলাম। ওই সময় আমি যা করেছি তা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছে। তাই আমি বাধ্য হয়ে আদালতে রিট করেছি। রিটে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ও নতুন করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চিত্রনায়িকা নিপুণ ও খলনায়ক ডিপজলের মধ্যেই বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। ডিপজলকে অশিক্ষিত দাবি করে নিপুণ বলেছেন, সরি টু সে, আমাকে বলতে হচ্ছে, শিল্পী সমিতিতে এমন একজন সেক্রেটারি পদে এসেছেন, যার কোনো শিক্ষা নেই। আমরা ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে আছি। এটা অশিক্ষিতদের জায়গা না। আনকালচারডদের জায়গা না। এটা কাজ করে দেখিয়ে দেওয়া লোকদের জায়গা। শুধু কাজ করলেই হবে না। জ্ঞান থাকতে হবে। শিক্ষিত হতে হবে। আমি একজন গ্র্যাজুয়েট। আমার তিন প্রজন্ম গ্র্যাজুয়েট।
এদিকে ডিপজল বলেছেন, তিনি (নিপুণ) তো বাপকেই অস্বীকার করেন। রক্তের সমস্যা না হলে এমন বলতে পারেন না। কারণ ও (নিপুণ) যাকে দিয়ে চলচ্চিত্র চিনেছে তাকেই ভুলে গেছে। নিপুণকে উদ্দেশ করে ডিপজল আরও বলেছেন, কেস খেলার মন চায় খেল। যেটা খেলার মন চায় খেলবা আসো। আমরা চাই ভদ্রতা, নম্রতা। আমরা মামলা চাই না। এই মামলা করে সিনেমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আমরা সিনেমাশিল্পকে ধ্বংসের পথ থেকে এগিয়ে নিতে চাই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।
বাস্তবতা যা বলছে- নিপুণ এবং ডিপজলের দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি কার্যত আবারও দুই ভাগ হয়ে গেছে। নিপুণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল চেয়ে নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন। এদিকে নতুন নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক সভা করে নিপুণের দাবিকে ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে বলেছে, এ ব্যাপারে নিপুণের বক্তব্য চাওয়া হবে। নিপুণ যদি বক্তব্য না দেন অথবা বক্তব্য দিলেও তা যদি সন্তোষজনক অর্থাৎ যৌক্তিক না হয় তাহলে তাকে শিল্পী সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হবে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির এই দ্বন্দ্ব নতুন নয়। এর আগের মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে জায়েদ খানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন নিপুণ। সেবারও নির্বাচনে কারচুপি ও অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ তুলেছিলেন নিপুণ। এবারের অভিযোগও অনেকটা একই রকম। গতবার নিপুণ আইনি লড়াইয়ে জিতেছিলেন। এবার কী হবে তা এখনই বলা যাবে না। তবে একটা কথা বলাই যায়, শিল্পীদের মধ্যে এই বিভেদ চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। শিল্পীদের মধ্যে এই বিভেদ তুষের আগুনের মতো আমাদের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎকে পোড়াবে। যখন টের পাব তখন হয়তো করার কিছুই থাকবে না।
শুধু কি চলচ্চিত্রশিল্পীদের মধ্যেই এই বিভেদ? না, বিভেদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন দেশের মঞ্চ আন্দোলনের প্রেরণাশক্তি। অথচ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনেও অনৈক্য স্পষ্ট। অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগে ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ সংগঠন থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। কামাল বায়েজীদ মানতে নারাজ তিনি দুর্নীতি করেছেন। তাই তিনি ফেডারেশনের কর্মকাণ্ড ও আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে আদালতে রিট করায় ফেডারেশনের ঐক্যে ফাটল ধরেছে। কার্যত মঞ্চকর্মীরাও এখন বিভক্ত। এখানেও তুষের আগুন জ্বলছে।
টিভি নাটকের পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড। এই সংগঠনেও বিভেদ স্পষ্ট। দুটি পক্ষ বিবাদে জড়িয়ে ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটিকে নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বর্তমান সময়ে সংগঠনটির কার্যক্রম স্থবির। একটাই কারণ অনৈক্য। কেউ কারও কথা শুনতে নারাজ। নাট্যজন মামুনুর রশীদসহ টিভি নাটকের বর্ষীয়ান পরিচালকরা দুই পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির একাধিক উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, বাচসাস নামেই যার ব্যাপক পরিচিতি। বিনোদন সাংবাদিকদের এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটিও বিভেদের চোরাবালিতে নিমজ্জিত। দৃশ্যত যাদের পক্ষে সংগঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীরা আছেন, তারা প্রতিপক্ষের অহেতুক প্রতিবন্ধকের কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভালো কাজ করতে পারছে না। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
একটি গানের লাইন মনে পড়ছে। যেভাবেই তুমি সকাল দেখো সূর্য কিন্তু একটাই। যত ভাগে ভাগ করো না প্রেম হৃদয় কিন্তু একটাই। কাজেই আমরা যে যাই ভাবি না কেন, দেশ কিন্তু একটাই- প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। প্রতিটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্দেশ্য হলো দেশের জন্য ভালো কিছু করা। কিন্তু বিভাজন থাকলে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। বিভাজন হলো তুষের আগুন। দেখা যায় না। অথচ ভেতরে ভেতরে পুড়িয়ে ফেলে। যখন টের পাওয়া যায় তখন হা-হুতাশ ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। আসুন, সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যই শক্তি। ঐক্যেই মুক্তি। শুভকামনা সবার জন্য।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও
সম্পাদক, আনন্দ আলো