ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

সিদ্ধার্থ গৌতম ও যশোধারার দিনগুলো

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৪০ পিএম
আপডেট: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৪২ পিএম
সিদ্ধার্থ গৌতম ও যশোধারার দিনগুলো
সংঘানন্দ মহাথের

বহু দূরে উত্তর ভারতের প্রায় শেষান্তে ছিল কপিলাবস্তু- প্রাচীন রাজধানী নগরী। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, সেখানে নগর ও প্রাসাদ আনন্দে-উৎসবে মেতে উঠেছিল যখন রাজকুমার সিদ্ধার্থ জন্মগ্রহণ করেন। যারা রাজার নিকট সুসংবাদ নিয়ে এল, রাজা সেই খবরবাহকদের বহু দামি উপহার দিলেন, আরও যারা কাজ করেছিল তা যৎসামান্যই হোক, প্রত্যেকে বহু উপহার পেল। কারণ যে সন্তান জন্ম নিয়েছে তা রাজা এবং পুরো রাজ পরিবারের বহু প্রার্থনা ও সাধনার ফল ছিল। এ কারণেই যে, রাজা শুদ্ধোধন এবং রানি মহামায়া দুজনই দীর্ঘকাল নিঃসন্তান ছিলেন। এরপর রাজা বসলেন অন্দরের একটি কক্ষে, যেখানে একদল প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কাগজ, বই এবং অপরিচিত যন্ত্রপাতির ওপর ঝুঁকে কিছু কাজ করছেন।

আপনি কি জানতে চান তারা কী করছিলেন? খুব অদ্ভুত ব্যাপার। শিশু রাজকুমার সিদ্ধার্থের সময়ের তারা-নক্ষত্রের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং তার থেকে কুমারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছিলেন। অদ্ভুত শোনালেও এই ভারতবর্ষের অতি প্রাচীন রীতি যা আজও লোকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ দ্বারা এই ভবিষ্যদ্বাণী হলো একজন মানুষের ঠিকুজি কোষ্ঠী। আমি এমনও মানুষের কথা জানি, যার কাছে বেশ কয়েক পূর্বপুরুষের নাম ও কোষ্ঠী আছে। আমাদের দেশেও এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। কপিলাবস্তুর জ্ঞানী ব্যক্তিদের বহু সময় লেগেছিল রাজকুমারের কোষ্ঠী তৈরি করতে। কারণ তাতে যে ভবিষ্যৎ তারা দেখেছিলেন, তা এতই অসাধারণ ছিল যে, তারা ঘোষণা করার আগে সবার সহমত নিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন যে কাজটি নির্ভুল হয়েছে কি না। তবুও পাঁচজন পণ্ডিত মহাশয় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন এবং দুটো মতামত জানিয়েছিলেন মহারাজকে। অবশেষে তারা এসে রাজার সামনে দাঁড়ালেন। ‘বেশ এবার বলুন’ রাজা উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শিশুপুত্র আমার বাঁচবে তো?’ সবচেয়ে প্রবীণ জ্যোতিষী জবাব দিলেন, ‘বাঁচবে, মহারাজ।’

‘আহ’ বললেন মহারাজ, ‘বেশ বেশ।’ এ সংবাদ জানার পর এবার ধৈর্যসহকারে বাকিগুলো শোনা যেতে পারে। ‘সে বাঁচবে’ পুনরুক্তি করলেন বৃদ্ধ জ্যোতিষী এবং তারপর নিজের বক্তব্য জানালেন, ‘কিন্তু যদি এ কোষ্ঠী ঠিক হয়ে থাকে, তা হলে আজ থেকে সপ্তম দিনে, শিশুর মা, মহিষী মহামায়া মৃত্যুবরণ করবেন। এবং সেটাই ইঙ্গিত দেবে মহারাজ যে, আপনার পুত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম রাজা হবেন, না সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে বস্তু জগৎ পরিত্যাগ করে মহান ধার্মিক গুরু হবেন।’ এই বলে তিনি পিতাকে কাগজগুলো অর্পণ করে সঙ্গীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

মহামায়া মারা যাবেন- মহান রাজা অথবা ধার্মিক গুরু, কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল মহারাজের কানে। তিনি একা বসে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা ভাবতে লাগলেন। যে ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলেছে তা তার কাছে সেরকম সাংঘাতিক মনেই হলো না শেষ কথাগুলোর তুলনায়। ‘ধার্মিক গুরু’- ভিখারি- এই কথাগুলোর অর্থ একই? রাজা শিউরে ওঠেন। চিন্তার জগতে নিমগ্ন হতে থাকেন। কিন্তু দাঁড়াও! কথাগুলো ছিল ‘সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে, বস্তুজগৎ পরিত্যাগ’- ‘আমার পুত্র কোনোদিন সাধারণের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখবে না।’ পিতা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন, ভাবলেন এভাবেই পুত্রকে তিনি তার পছন্দের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবেন- এক পরাক্রমী মহারাজা।

সিদ্ধার্থ কুমারের জন্মের সাত দিনের মধ্যে মহারানি মহামায়া মৃত্যুবরণ করেন ঠিক যেমনটি সেই পণ্ডিতেররা বলেছিলেন। বিগত সাত দিনে তাকে প্রাণভরে সব রকমের যত্ন ও সেবা করা হলো। যত্নের কোনো ত্রটি ছিল না, বাঁচানোর সবরকম চেষ্টাই করলেন রাজা শুদ্ধোধন। কিন্তু লাভ হলো না। নির্ধারিত দিনে তিনি শিশুর মতো নিদ্রা গেলেন, আর উঠলেন না। রাজা শুদ্ধোধন এত শোকের মধ্যেও কিছুটা আশঙ্কিত, কারণ এখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে জ্যোতিষীরা সত্য কথা বলেছে। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, তার সন্তানকে তিনি ভিখারি হওয়ার ভবিতব্য থেকে বাঁচাবেনই। পরিবর্তে তাকে করে তুলবেন এই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও প্রতিপত্তিশালী রাজা; একে বৌদ্ধ সাহিত্য চক্রবর্তী রাজা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

শিশু যখন ধীরে ধীরে বালক হলো এবং বড় হতে লাগল, তার আশপাশের লোকেরা মনে করতেন তার সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। তিনি এত বুদ্ধিমান, প্রাণচঞ্চল, লেখাপড়া ও খেলায় এত চমৎকার ছিলেন এবং সব থেকে বড়ো কথা- এত প্রেমে পরিপূর্ণ যে তার একটি কথায় বা একবার দৃষ্টিপাতে যে কেউ তার অনুরাগী হয়ে পড়ে। তার কোনো শত্রু নেই। সবাই তার সম্বন্ধে সর্বদা বলে, তিনি ‘করুণায়’ পরিপূর্ণ’। তিনি ডানাভাঙা পাখিকে অশেষ যত্নে সেবা করতেন; কোনোদিন পশুপাখিদের তীরধনুক দিয়ে শিকার করেননি। যেমন কপিলাবস্তুর অনেক বন্ধু অভিজাত তরুণরা করত। তিনি বলতেন, নিরীহ ও অবলা জীবদের হত্যা করা পুরুষোচিত কাজ বলে তিনি মনে করেন না। তাহলে তিনি তীরের আঘাতের বেদনার কথা জানতেন। কিন্তু অন্য কোনোরকম দুঃখ-যন্ত্রণার কথা তিনি কখনো শোনেননি। তার গৃহ এক রাজপ্রাসাদ। তার চারদিকে মনোরম বাগান, বাগানের পর উত্তরে মাইলের পর মাইল উন্মুক্ত ক্ষেত্র রাজধানীর চারধারে বিস্তৃত। এগুলোর বাইরে তিনি কখনো বালক বয়সে যাননি। এখানে তিনি ঘোড়ায় চড়তে পারতেন, তীর চালনা করতে পারতেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে, দেখে, ভেবে, স্বপ্ন দেখতে পারতেন। এখানে কোনো দুঃখ ছিল না, দুঃখের কথা কেউ বলতও না। কারণ রাজা কর্তৃক দুঃখের কথা বলা নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই পরিবেষ্টিত জায়গাটি নিজেই এক রাজ্য ছিল। তিনি এর বাইরে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেনওনি। এবং তার বাবা সবাইকে বারণ করে দিয়েছিলেন তার সামনে যেন কোনো প্রকারের দুঃখ-যন্ত্রণার কথা না বলে। কারণ শুদ্ধোধনের সবসময় মনে হতো ‘সাধারণ মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে’ সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করবেন। এই যন্ত্রণার জ্ঞান থেকে তিনি পুত্রকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

একজন ভারতীয় যুবকের অধ্যয়নকাল হওয়া উচিত তার ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর সে স্বাধীন। যখন তরুণ গৌতম সে বয়সের কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন তিনি নিজেই দেশ ছেড়ে অন্য দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিতে পারতেন। কেউ বারণ করতে পারত না তাকে, নিজের পিতাও না- কারণ তিনি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন। তাই এই সময়ে তারা তাকে বাঁধতে চাইলেন, ফুলডোরে। তাকে প্রস্তাব দিলেন বিয়ে করে সংসারী হতে। তাদের মনে হলো, এ এখন শুধু সময়ের প্রশ্ন। তার কাছাকাছি যদি এক সুন্দরী সহধর্মিণী এবং ফুটফুটে আদরের সন্তান থাকে তা হলে তিনি আনন্দ ও ভালোবাসার বন্ধনে এমন বাঁধা পড়ে যাবেন যে বাড়ি ত্যাগ করতে পারবেন না। তিনি তাদের জন্য আরও ধন-সম্পদ সংগ্রহ করতে প্রয়াসী হবেন এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ও ক্ষমতাশালী সম্রাট হয়ে উঠবেন। ঠিক যেমনটি তার জন্মের সময় জ্ঞানী পণ্ডিতরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু গৌতম একটা ব্যাপারে মনস্থির করেছিলেন। তিনি নিজে পাত্রী দেখবেন ও পছন্দ করবেন। তাই সমস্ত তরুণ সভাপদ যাদের বিবাহযোগ্য ভগিনী ছিল একসঙ্গে সাত দিনের জন্য সভায় নিমন্ত্রিত হলেন। প্রতিদিন সকালে নানারকম খেলাধুলা চলতে লাগল, হয় গদা খেলা, বা তলোয়াল খেলা বা অশ্বলায়ন। বিকেলে নানা ধরনের খেলার প্রদর্শনী যেমন লোফালুফির খেলা, সাপ খেলা ইত্যাদি এবং নাটকের আয়োজন হতো। এগুলো রাজপ্রাসাদের প্রদর্শনালাতেই হতো এবং সবাই একসঙ্গে বিনোদনের আনন্দ নিতেন।

রাজা নিজে, মন্ত্রীরা এমনকি সভাসদরাও সবাই একজন বিশেষ নারীর কথা ভাবছিলেন, যাকে গৌতম পছন্দ করবেন। তার সৌন্দর্য, গুণ ও কৌলীন্য অন্য সবার চেয়ে বিশিষ্ট ছিল। তার নাম যশোধারা। যেদিন শেষদিন এল, গৌতম দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে একে একে অতিথিদের কোনো না কোনো অসাধারণ বিদায় উপহার দিয়ে বিদায় জানালেন- কাউকে কল্কহার, কাউকে কঙ্কন, কাউকে বহুমূল্য রত্ন। যখন যশোধারার পালা এল তাকে দেওয়ার মতো একটি ফুল ছাড়া গৌতমের কাছে আর কিছু ছিল না। তিনি নিজের পোশাকের ভিতর থেকে একটি ফুল বের করে যশোধারার হাতে দিলেন। যারা দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, মনে করলেন যশোধরাকে বুঝি তার পছন্দ নয়, তাই এই অবহেলা। যশোধরা নিজে ছাড়া আর সবাই খুব দুঃখিত হলেন। তার কাছে ওই একটি ফুল অন্য বান্ধবীদের মূল্যবান উপহারের চেয়েও আরও মূল্যবান বলে মনে হলো। পরদিন কপিলাবস্তুর রাজা যখন নিজে তার বাবার কাছে এসে ছেলের জন্য তাকে চাইলেন, তিনি একেবারেই  আশ্চর্য হলেন না। তার শুধুই এটাই অবাক লাগল যে সবকিছু যেন কী স্বাভাবিক ও সরল। তিনি মনে মনে হয়তো আবছাভাবে সচেতন ছিলেন যে, পূর্বতন বহু জীবনের শৃঙ্খলে তিনিই তো তার স্ত্রীর ছিলেন। কিন্তু যশোধারা এমনই একজন যার নামে বহু পাণিপ্রার্থী আকৃষ্ট হতো। এবং মর্যাদার রীতি অনুসারে গৌতমকে তার শৌর্য প্রমাণ করেই তাকে জয় করতে হবে। রাজবংশের এমনই ধারা ছিল। এই রীতি অনুযায়ী রাজপুত্রের প্রস্তাব কন্যার পিতা গ্রহণ করলেন।

গৌতম তার প্রস্তাব গ্রহণে উৎফুল্ল হলেন এবং সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্ধারিত দিনে প্রতিযোগিতার আহ্বান জানালেন। তার আত্মীয়রা বললেন, হায়! তুমি কী করবে? তুমি কোনোদিন উড়ন্ত পাখিকে বা পলায়মান হরিণকে নিশানা করোনি, কখনো দৌড়রত শূকর হত্যা করনি? তুমি কী করে বিশাল ধনুকে প্রসিদ্ধ তিরন্দাজদের পরাস্ত করবে? তিনি হাসি ছাড়া উত্তরে কিছু বললেন না। ভয় তার কাছে অজানা আর নিজের অন্তরে তিনি এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করছেন। নির্দিষ্ট সময়ে দেখা গেল তার আত্মবিশ্বাস সঠিক ছিল, কারণ তিনি সবার থেকে এগিয়ে সব পুরস্কার নিয়ে বিজয়ী হলেন।

রাজকুমার গৌতমের সঙ্গে যশোধারার বিয়ে হয়ে গেল। তাদের ভাবী বাসভবনকে পুরোনোটির চেয়েও বেশি সুন্দর করা হলো। নতুন রাজপ্রাসাদ একটি জলাধারের ওপর। প্রাসাদের খিলান সব গোলাপরাঙা পাথরের আর ঘন বাদামি রঙের কাঠের, বাগানের একপ্রান্তে শ্বেত পাথর নির্মিত এক দ্বীপ ঘিরে উচ্ছল একটি ঝরনা। সেই দ্বীপে গ্রীষ্মবাস- শ্বেত, শীতল, মর্মরকক্ষ তৈরি হলো। সারা প্রাসাদ ঘিরে নদীর বুকে গোপন ফোয়ারারা যখন ইচ্ছে তখন জল দান করে। জানালাগুলোতে হয় কাঠের জাফরি, নয় ছিদ্র করা মর্মরের ঝরোখা। যার ফলে আব্রু থাকবে, আলো থাকবে, ছায়া থাকবে। এই জানালা দিয়ে দেখা যাবে প্রসারিত ফুল গাছশোভিত বাগান, পুষ্পলতার বিভাজিকা। প্রতিটা বড় রাজকীয় হলঘরের কোনে ছাদের বর্গা থেকে লম্বা শিকলে ঝুলছে দুজনে বসে দোল খাওয়ার মতো দোলনা- তার তিন দিক ঘেরা, ভিতরে গদি, বালিশ।  গ্রীষ্মের দিনে এতে বসে দোল খাওয়া যায় ও শীতল বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যায়, আবার মনে হলে অলসভাবে শুয়েও থাকা যায়। সেবিকারা ধীর লয়ে পাখা দুলিয়ে বাতাস করতে পারে। সিংহাসনে বসবেন যিনি সেই রাজকুমারকে ঘিরে যারা থাকবে, তাদের সযত্নে তাদের সুন্দর চেহারা বা প্রাণবন্ত দেখে নির্বাচন করলেন এক মন্ত্রী। রাজকুমারের কানে কোনো বিলাপ, কোনো অশ্রুমোচনের শব্দ যেন না পৌঁছায়। তিনি যেন কোনোভাবেই রোগ, জরা ক্ষয়ের সম্মুখীন না হন। তিনি যদি কখনো নগরীতে যেতে চান তাকে যেন তখনই নানা বিনোদন, আনন্দে অন্যমনস্ক করে দেওয়া হয়। এমনই ছিল রাজার কড়া হুকুম। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন কে খণ্ডাবে? রাজা এই সত্যের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি যে, তার সব প্রচেষ্টা নির্দিষ্ট সময়ে তার আশঙ্কাই আরও বাড়িয়ে দেবে। তিনি ছেলের জন্য যে জীবন সাজিয়েছেন, তা বাস্তব নয়- একটা স্বপ্ন, একটা নাটক। সত্য সর্বদাই মিথ্যার চেয়ে শ্রেয়, এবং কোনো না কোনো সময়ে কুমারের মনে সত্যের প্রতি আগ্রহ জাগবেই। ঠিক তাই হলো। একদিন গৌতম নিজের সারথীকে বললেন, প্রাসাদের পাঁচিলের বাইরে নিজের নগরী কপিলাবস্তুতে তাকে নিয়ে যেতে, তার ভবিষ্যৎ রাজ্যের রাজধানীতে। হতবাক সারথীর আদেশ পালন ছাড়া উপায় ছিল না। তার অমান্য করার কোনো সাধ্য নেই। কিন্তু রাজা জানতে পারলে কী হবে ভেবে রাজার ক্রোধকেও যেন ভয় পেল প্রচণ্ড।

তারা কপিলাবস্তু গেলেন এবং সেদিন প্রথমবারের জন্য গৌতম বাস্তব জীবনকে কাছ থেকে দেখলেন। ঘিঞ্জি রাস্তায় বাচ্চাদের খেলতে দেখলেন। বাজারে খোলা দোকানে ব্যবসায়ীরা বসে খদ্দেরদের সঙ্গে দরদাম করছে, সামনে পসরা সাজানো। সূচিশিল্পী, কুমোর, পিতলের কামার- সবাই নিজের নিজের পসরা সাজিয়ে বসে কাজে ব্যস্ত। তার সাগরেদ পাশে বসে হাঁপর টানছে, আগুন জ্বলে উঠে ধাতুকে গরম করছে। কুমারের সাগরেদ তার জন্য চাক ঘুরিয়ে চলেছে। মালবাহকরা মাল নিয়ে নিয়ে ক্লান্ত মুখে যাওয়া-আসা করছে। ছাইমাখা এক সাধু লম্বা লাঠি নিয়ে হেঁটে চলেছে। অর্ধভুক্ত কুকুরগুলো একে অন্যকে দেখে খাবার নিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে গজরাচ্ছে, গ্রাম থেকে আসা ফল, শস্য, তুলাভরা গরুর গাড়ি দেখেও সরছে না। খুব কম মহিলা চোখে পড়ল, তাও অল্পবয়সি নয়, কারণ দুপুর হয়ে এসেছে। সকালের স্নানের সময় শেষ হয়ে  গেছে অনেকক্ষণ, তবু এক-আধজন যুবতীকে দেখা যাচ্ছে- ঘোমটা টানা, মাথায় বড় পিতলের কলসি। বাড়িতে জল নিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও রাস্তাঘাট রঙিন। কারণ পুবের মানুষদের পোশাকের অঙ্গ উজ্জ্বল রঙের রেশম বা পশমের শাল বা চাদর, বাঁ কাঁধের ওপর দিয়ে ফেলে ডান হাতের নিচ দিয়ে টানা। তাই শহরের ভিড়ে মেয়েদের পায়ের নুপুরের রুনুঝুনু ধ্বনি শোনা না গেলেও, প্রচুর ফিকে সবুজ, গোলাপি, বেগুনি, হলুদ, তুঁতে নীলের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। জনবহুল রাস্তা উজ্জ্বল ও রঙিন দেখতে লাগে। গৌতম সারথির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এখানে দেখছি শ্রম, দারিদ্র্য, ক্ষুধা- তাও কত সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দের মধ্যে মিশে আছে- সত্যি জীবন এতসব সত্ত্বেও কী মধুর!

তিনি নিজের মনেই এই কথাগুলো বললেন এবং ধীরে ধীরে সেই তিন অমোঘ শব্দের কাছাকাছি উপনীত হলেন- মানুষের তিনটি দুঃখ- ক্লান্তি, ব্যাধি ও মৃত্যু। গৌতমের জীবনে সেই মহাক্ষণটি এসে গেল। প্রথমে এল ক্লান্তি। এক বৃদ্ধ, অতি বৃদ্ধ মানুষ, তার মাথায় চুল নেই, মুখ দন্তহীন, হাত কাঁপছে- এই রূপ ধরে এল ক্লান্তি। ক্লান্তি তাকে জীবন্মৃত করে রেখেছে। লাঠিতে ভর দিয়ে সে তার শীর্ণ রোগগ্রস্ত হাত বাড়াল ভিক্ষার জন্য। রাজকুমার ঝুঁকে পড়ে ভিক্ষা দান করলেন আগ্রহভরে- বৃদ্ধ যা আশা করতে পারত তার চেয়ে অনেক বেশি। তার মনে হলো, তার নিজের আত্মাই বোধহয় ডুবে যাচ্ছে। ‘ও ছন্দক’ তিনি সারথিকে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী, এটা কী? এ কী? ওর কী হয়েছে?

ছন্দ সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘না, সেরকম কিছু না। মানুষটি শুধু হয়েছে।’ ‘বৃদ্ধ!’ গৌতম বললেন, আর কল্পনা করতে লাগলেন পিতার পাকা চুল এবং রাজ্যের বৃদ্ধ মন্ত্রীদের কথা। ‘কিন্তু সব বৃদ্ধ তো এরকম হয় না।’ সারথি বলল, হ্যাঁ হয়, যদি যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়। ‘আমার পিতা?’ কুমার বললেন, কিন্তু তার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল, ‘পিতা? যশোধারা? আমরা সবাই এরকম?’ সারথি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সবাই বৃদ্ধ হবেন, আর কেউ যদি অতি বৃদ্ধ হয়, তার এই দশাই হবে।’ গৌতম নীরব হয়ে গেলেন, ভয় এবং করুণা দুই-ই তাকে আচ্ছন্ন করল। কিন্তু মাত্র এক মুহূর্তের জন্য, কারণ ততক্ষণে রথের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এমন একজন ভয়ংকরদর্শন মানুষ যার শরীরের চামড়ায় গোলাপি ছোপ- এবং যে হাত সে মেলে ধরেছে, তার অনেক গাঁট নেই। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই দেখলে চোখ ঢেকে তাড়াতাড়ি সরে যেতাম। কিন্তু গৌতম সে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালেন না- মায়াভরা কণ্ঠে বললেন,  ‘আমার ভাই!’ এবং করুণায় উদ্বেলিত হয়ে শ্রদ্ধাভরে তাকে একটি মুদ্রা দান করলেন। ‘ও কুষ্ঠরোগী’ ছন্দক বলে উঠল, ‘ও কুষ্ঠরোগী, আমরা এগিয়ে যাই।’ ইতোমধ্যে লোকটি গৌতমের কণ্ঠস্বরের কোমলতায় চমকে উঠেছে। ‘এর মানে কী ছন্দক?’ গৌতম জিজ্ঞেস করলেন। ‘এর অর্থ রোগ ওকে গ্রাস করেছে, প্রভু।’ ‘রোগ! রোগ! সেটা কী?’ কুমার আবার প্রশ্ন করলেন। ‘প্রভু, এ এক যাতনা যা শরীরকে আক্রমণ করে। কেউ জানে না কেন বা কীভাবে। এ আরামকে নষ্ট করে দেয়। চরম গ্রীষ্মে অসুস্থ মানুষের শীত করে, পাহাড়ি বরফেও গরম অনুভব করে। এর প্রকোপে কেউ পাথরের মতো ঘুমায়, কেউ উত্তেজনায় পাগল হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শরীর গলে গলে পড়ে আবার কোনো ক্ষেত্রে শরীর আকৃতি ঠিক রাখে কিন্তু এমন শীর্ণ হতে থাকে যে হাড় গোনা যায়। আবার কখনো এমন ফুলে উঠে বীভৎস আকার ধারণ করে। রোগ এমনই হয়। কেউ জানে না কোথা থেকে হয়, কী থেকে হয় বা কখন আমাদের আক্রমণ করবে।

‘এই হলো জীবন- যে জীবনকে আমি মধুর ভাবতাম’, বললেন গৌতম। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চোখ তুলে চাইলেন, ‘মানুষ কীভাবে জীবন থেকে নিষ্কৃতি পায়?’ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষের কে এমন বন্ধু আছে যে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে?’

‘মৃত্যু’ বলল ছন্দক। ‘দেখুন, ওই আসছে শববাহীরা। নদীর ধারে নিয়ে যাবে শবদেহকে পোড়াতে।’

রাজকুমার তাকিয়ে দেখলেন চারজন বলশালী লোক, কাঁধে একটি নিচু চৌকি, তার ওপর শায়িত সাদা চাদরে ঢাকা একটি মনুষ্য আকৃতি। মানুষটি নড়ছে না, সে চাদরের তলায় স্থির এবং যদিও বাহকরা প্রত্যেক পদক্ষেপে বলে যাচ্ছে, ‘হরি বোল,’ যাকে তারা নিয়ে যাচ্ছে, সে এই প্রার্থনায় নিরুত্তর। সারথি বলল, ‘কিন্তু মানুষ মৃত্যু ভালোবাসে না। তাদের কাছে মৃত্যু বন্ধু নয়- বরং তারা আয়ু ও রোগের থেকেও মৃত্যুকে বড় শত্রু বলে মনে করে। মৃত্যু তাদের আচমকা হানা দেয় এবং তারা একে ঘৃণা করে ও প্রাণপণ এড়ানোর চেষ্টা করে।

গৌতম এবার শবযাত্রার মিছিলের দিকে ভালো করে তাকালেন। তার ভিতরে যেন অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল, তিনি বুঝতে পারলেন মানুষ কেন মৃত্যুকে ঘৃণা করে। মনে হলো যেন তার চোখের সামনে দিয়ে ছবির সারি চলমান। তিনি দেখতে পেলেন যে, মৃত ওই মানুষটির আগে বহুবার মৃত্যু হয়েছে এবং প্রতিবারই তার নবজন্ম হয়েছে। তিনিও এও দেখলেন যে, এই মৃত্যুর পরও ব্যক্তিটি নিশ্চিত এই পৃথিবীতে ফিরবেন। ‘যার জন্ম হয়, তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, যার মৃত্যু হয় তার জন্ম অবশ্যম্ভাবী।’ তিনি বললেন, ‘এই জীবনচক্রের ঘূর্ণিতে কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। ছন্দক, বাড়ি চলো।’

সারথি আদেশ পালন করল। রাজকুমার আর কোনো প্রশ্ন করলেন না, তিনি চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদে ফিরে- যা যা তার এতকাল মনোহর লাগত সব বিষময় মনে হতে লাগল। সবুজ মখমলি ঘাসের বাগিচা আর পুষ্পিত বৃক্ষ কীই-বা কাজের, এ সবই তো সত্য থেকে আড়াল করার খেলনা মাত্র। তিনি ও যশোধারা তো শিশুর মতো এসব খেলনা নিয়ে সেই বাগানে বসে খেলা করেন, যে বাগানের নিচে অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরি যে কোনো মুহূর্তে উদ্গিরণ করে তাদের ধ্বংস করবে। শুধু তারাই নন, অন্য সব মানুষই এই সত্য ভোলানো খেলা খেলে চলেছে, হয়তো-বা তাদের চেয়ে খেলা উপভোগ করার কিছু কম কারণ আছে তাদের। তার হৃদয় এক মহান উদ্বেলিত করুণার সাগরে পরিবর্তিত হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষের জন্য নয়, সব জীবের জন্য ভালোবাসার ক্ষমতা আছে ও কষ্ট সহ্য করারও ক্ষমতা আছে। ‘জীবন ও মৃত্যু এক দুঃস্বপ্ন।’ তিনি নিজের মনে মনে বলছিলেন, ‘আমরা কী করে একে চূর্ণ করে জেগে উঠব?’

মানুষের জীবনের তিনটি মহান দুঃখ তাকে বিদ্ধ করল ঠিক যেমনটি তার জন্মের সময় সেই জ্ঞানী ব্যক্তিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি খেতেও পারলেন না, বিশ্রাম নিতেও পারলেন না। প্রায় মাঝরাতে যখন পুরো রাজপ্রাসাদ ঘুমে মগ্ন, তিনি উঠে নিজের ঘরে পায়চারী করতে লাগলেন। একটি জানালা খুলে বাইরে ঘন অন্ধকার রাতের দিকে চেয়ে রইলেন। বাতাসের এক ঝটকা গাছের মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেল, মনে হলো মাটি যেন কেঁপে উঠল। এই বিশ্ব যেন তাকে বলল, ‘জাগো! তুমি যে জেগে উঠেছ, ওঠো, বিশ্বকে সাহায্য করো।’ কুমারের মন নিঃসন্দেহে এই অমোঘ ডাক শুনলেন এবং শব্দে উচ্চারিত না করেও এর মহাত্ম্য বুঝলেন। তিনি বাইরে রাতের তারার দিকে তাকিয়ে নিজের অন্তরে পথ খুঁজতে চাইলেন, কীভাবে এই জীবনের স্বপ্ন থেকে তিনি বেরিয়ে আসবেন ও তার নিয়তি নির্ধারিত স্থানে পৌঁছবেন। এভাবে ব্যাকুল মনে যখন তিনি দিশা হাতড়াচ্ছেন তখন তার হঠাৎ মনুষ্যজাতির প্রাচীন জ্ঞানী ঋষিদের কথা মনে এল। তিনি বলে উঠলেন, ‘এই খোঁজই তো সেই খোঁজ বা যুগে যুগে মানুষকে সংসার ত্যাগ করে গহন বনে, ভস্ম মেখে জীবনধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা নিশ্চয় কিছু জানতে পারেন। এই সেই উপায়। আমিও সেই রাস্তাতেই যাব। তারা তো অর্জিত জ্ঞান বিতরণ করার জন্য আর সংসারে ফেরেন না। তারা নিজেদের মধ্যেই সেই জ্ঞান সঞ্চিত রাখেন বা অন্য জ্ঞানীদের সঙ্গে বিনিময় করেন। আমি যখন এই গোপন রহস্যোদ্ধার করতে পারব, তখন আমি ফিরব, সব মানুষকে আমার জ্ঞানের কথা বলব। তখন নিম্ন থেকে নিম্নতম বর্গের যে সেও জানবে, উচ্চতম বর্গের যে সেও জানবে। মুক্তির উপায় গোটা বিশ্ব জানবে। এই কথা কয়টি নিজ মনে উচ্চারণ করে, জানালা বন্ধ করলেন এবং নিজের ঘুমন্ত পত্নীর শয্যাপাশে এলেন। ধীরে পর্দাগুলো সরিয়ে যশোধারার মুখপানে চাইলেন। এই সময়ই তার মনে প্রথম দ্বন্দ্ব শুরু হলো। তার কি যশোধারাকে পরিত্যাগ করার কোনো অধিকার আছে? তিনি আর কখনো নাও ফিরতে পারেন। একজন রমণীকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিধবা করা কি সাংঘাতিক ও নিষ্ঠুর কর্ম নয়? তার শিশু পুত্রকেও বড় হতে হবে পিতৃস্নেহ ছাড়া? জগতের জন্য আত্মত্যাগ ভালো কিন্তু অপরকে সেই ত্যাগে বাধ্য করা কি উচিত?

তিনি পর্দা আবার টানলেন এবং জানালার কাছে ফিরে গেলেন। তারপরই তার মধ্যে এক উপলব্ধি এল। মনে পড়ল যশোধারার মন সময়ে কত উচ্চ ও মহান মনে হয়েছে তার কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি যা করতে চলেছেন তার মধ্যে যশোধারারও অংশ থাকবে। তাকে হারানোর যে তীব্র বেদনা, তাতে গৌতমের ত্যাগের অর্ধেক যশোধারার হয়ে উঠবে, আবার তিনি যে জ্ঞান ও আলোকপ্রাপ্ত হবেন তারও অর্ধেক যশোধারার হবে। তিনি আর দ্বিধা করলেন না। আবার বিদায় জানাতে কাছে গেলেন। রেশমের পরদাগুলো সরিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। তাকে জাগাতে চাইলেন না, তাই সামনে ঝুঁকে তার পায়ের পাতায় চুম্বন করলেন। ঘুমের মধ্যে যশোধারা একটু আওয়াজ করে পা গুটিয়ে নিলেন। 

নিচে নেমে তিনি ঘুমন্ত ছন্দককে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগালেন এবং বললেন, রথের সঙ্গে এক্ষুনি নিঃশব্দে ঘোড়া বাঁধতে। তারপর তারা চুপচাপ সিংহদ্বার থেকে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পড়লেন এবং ঘোড়া দ্রুত ছুটতে লাগল। ধীরে ধীরে কুমার পিতৃগৃহ থেকে বহুদূর চলে গেলেন। ভোর হতে উনি থামলেন এবং রথ থেকে নামলেন। তারপর একের পর এক তার পোশাক ও আভরণ খুলতে লাগলেন। ছন্দকের হাত দিয়ে সব ফেরত পাঠালেন। সেগুলো প্রেমপূর্ণ উপহাররূপে একে-তাকে বার্তা দিয়ে পাঠালেন। তারপর নিজে ভিক্ষুকের পোশাক গোলাপি বস্ত্র পরলেন, গায়ে ভস্ম মাখলেন। হাতে নিলেন লাঠি আর ভিক্ষাপাত্র। ছন্দক অশ্রুপূর্ণ চোখে তার পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানালেন। গৌতম বললেন, ‘পিতাকে বলো, আমি ফিরে আসব।’ তারপর সংক্ষিপ্ত বিদায় জানিয়ে, জঙ্গলে মিলিয়ে গেলেন। ছন্দক সেই স্থানে রাজকুমার অদৃশ্য হওয়ার পরও অনকেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঝুঁকে শ্রদ্ধাবণত চিত্তে যেখানে কুমার দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানকার ধুলো তুলে মাথায় ঠেকালেন, তারপর রথ ঘুরিয়ে খবর দিতে গেলেন রাজাকে।

একটানা ছয় বছর রাজকুমার গৌতম তার সন্ধানে নিমগ্ন রইলেন। অবশেষে এক রাত্রে ধ্যানস্থ অবস্থায়, বোধিবৃক্ষের নিচে তিনি গভীর সত্য উপলব্ধি করলেন এবং সব জ্ঞানের উন্মেষ ঘটল। তখন থেকে তার আর সব নাম হারিয়ে গেল এবং তিনি পরিচিত হলেন ‘বুদ্ধ’ নামে। সেই আলোকপ্রাপ্তীর চরম মুহূর্তে তিনি উপলব্ধি করলেন যে জীবনের প্রতি তৃষ্ণাই সব দুঃখের কারণ। বাসনা থেকে মুক্ত হলে মানুষ সত্যেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। এবং তিনি এই মুক্তির নাম দিলেন, ‘নির্বাণ’ এবং নির্বাণের প্রতিকূলতা ভরা এই পথকে তিনি আ্যখ্যা দিলেন ‘শান্তির’ পথ।

এই সবই ঘটেছিল সেই বনে, যার নাম আজ বুদ্ধগয়া, এবং আজও যেখানে সেই মহান বোধিবৃক্ষের পাশে একটি সুপ্রাচীন মন্দির আছে, যার প্রাচীনতা ঠিক বোধিবৃক্ষের পরই। বুদ্ধ সেখানে কিছুদিন থাকলেন, অনেক কথা ভাবলেন, তারপর সেই বন ছেড়ে বারাণসীতে এলেন এবং সেখানে মৃগবনে পাঁচজন সন্ন্যাসীর কাছে প্রথম বাণী প্রচার করলেন। এই সময় থেকেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল এবং বহু সংখ্যক মানুষ তার অনুগামী হলেন। দুই ব্যবসায়ী কপিলাবস্তু যাাচ্ছিলেন, তাদের মাধ্যমে তিনি পিতা ও যশোধারাকে খবর পাঠালেন যে তিনি নিশ্চয় বাড়ি যাবেন। অবশেষে বুদ্ধের খবর পেয়ে তাদের আর আনন্দের সীমা রইল না। বৃদ্ধ রাজা চাইছিলেন পুত্রের জন্য রাজকীয় অভ্যর্থনার আয়োজন করতে কিন্তু তিনি দেখলেন বহু লোকের ভিড় জমেছে, রাজদ্বারে সেনারা প্রস্তুত, অস্থির ঘোড়ারা হ্রেষারব তুলছে আর সেখানে আগত আপাদমস্তক হলুদ রঙে আবৃত এক ভিক্ষু, তিনি মানুষের ভিক্ষা গ্রহণ করছেন। মহারাজের তাঁবুর পাশ দিয়ে তিনি যখন যাচ্ছিলেন, রাজা দেখলেন এ তো তারই পুত্র। যিনি সাত বছর আগে গহিন রাতে রাজ্যে ত্যাগ করেছিলেন আর আজ বুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ভিক্ষু বুদ্ধ কোথাও না থেমে সোজা এগিয়ে গেলেন নিজের প্রাসাদের দিকে এবং নিজের ঘরে স্ত্রী-পুত্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন। যশোধারাও হলুদ বস্ত্র ধারণ করেছিলেন। যেদিন সকালে তিনি জেগে উঠে জেনেছিলেন তার স্বামী সংসার ত্যাগ করে বনে গেছেন, সেই দিন থেকে তিনি তার স্বামীর জীবনধারার অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি ফলমূল ছাড়া কিছু খাননি, ছাদ বা বারান্দার মেঝেতে ছাড়া আর কোথাও শয়ন করেননি। তিনি রাজকুমারীর সব আবরণ ও আভরণ দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি শ্রদ্ধাভরে গৌতমের পায়ের কাছে বসলেন ও তার পরিহিত বস্ত্রের প্রান্তের বাঁ-দিকে চুম্বন করলেন। তারা প্রায় কোনো কথাই বললেন না। বুদ্ধ তাকে আশীর্বাদ করলেন ও চলে গেলেন। তখন যশোধারার মনে হলো তিনি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেন। তাড়াতাড়ি পুত্রকে ডেকে বললেন, ‘যাও পিতার কাছে, গিয়ে চাও তোমার উত্তরাধিকার। ‘মা, আমার বাবা কে?’ বালকটি ভীতুস্বরে মুণ্ডিত মস্তক, হলুদ পরিহিত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু যশোধারা কোনো বর্ণনা দিলেন না, ‘তোমার পিতা’ তিনি বললেন, ‘ওই পুরুষসিংহ যিনি তোরণের দিকে যাচ্ছেন।’ বালকটি সোজা পিতার কাছে গিয়ে বলল, ‘পিতা, আমাকে পৈতৃক উত্তরাধিকার দিয়ে যান।’ সে কথা তিনবার বলার পর, বুদ্ধের প্রধান শিষ্য আনন্দ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি দিতে পারি?’ বুদ্ধ বললেন, ‘দাও’ এবং সেই হলুদ বস্ত্র বালকের গায়ে ফেলে দেওয়া হলো। তারা ফিরে দেখলেন, পেছনে মা আসছেন, তার মাথায় ঘোমটা টানা। তিনি নিশ্চিত স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাইছেন। কোমল হৃদয় আনন্দ আবার জিজ্ঞেস করল, ‘প্রভু, কোনো নারী কী আমাদের সংঘে আসতে পারেন না? তিনি কি আমাদের একজন হতে পারেন না?’ বুদ্ধ বললেন, ‘মানুষের জীবনের তিন যন্ত্রণা কি পুরুষদের মতো নারীদের জীবনেও ঘটে না? তা হলে শান্তির পত্রে তাদের চরণচিহ্ন পড়বে না কেন? আমার সত্য, আমার সংঘ সবার জন্য। তবু এই অনুরোধ তোমরই করা ভবিতব্য ছিল, আনন্দ।’ যশোধারাও সংঘে গৃহিত হলেন। তিনি বুদ্ধের কাছাকাছি একই কাননে বাস করতে লাগলেন ও সংঘের ধর্মপালন করতে শুরু করলেন। তার দীর্ঘ বৈধব্যের অবসান ঘটল এবং অবশেষে তিনিও শান্তির পথে পা বাড়ালেন।

জগতের সব প্রাণী সুখী হোক

লেখক: অধ্যক্ষ, সিলেট বৌদ্ধবিহার

জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৪:২৭ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম
জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?
মো. হাবিবুর রহমান

গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য একটি কার্যকরী শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রণয়ন অপরিহার্য। কারিকুলাম প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন জাতীয় কারিকুলাম প্রণয়নে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে? বা কীভাবে করা হয়েছে? প্রণীত জাতীয় কারিকুলাম এখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে, এ বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া কী বার্তা দেয়? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুবাদে স্নাতক পর্যায়ে দুটি ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। টারসিয়ারি পর্যায়ে বর্তমানে ওবিই (OBE, Outcome Based Education) পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ইউজিসি কর্তৃক নির্দেশনা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। মোটাদাগে এই স্টেইকহোল্ডাররা হলেন: বিষয় বিশেষজ্ঞ (Subject Experts); প্রাক্তন শিক্ষার্থী (Alumni); শিক্ষার্থীদের বা যাদের জন্য কারিকুলাম প্রণয়ন করা হচ্ছে তাদের প্রয়োজন  (Target Population's Needs); অভিভাবক  (Guardians); চাকরিদাতা (Employers); এডভাইজরি প্যানেল (বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত) এবং সমাজের সদস্য (Community Members)। আমি ও আমার সহকর্মীরা কারিকুলাম প্রণয়নের সময় উল্লিখিত এই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাদা করে বসেছি, আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি এবং তাদের মতামতগুলো লিপিবদ্ধ করেছি। প্রণীত কারিকুলামেও এর যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রনয়নের  ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। জাতীয় শিক্ষাক্রমের প্রভাব/ফলাফল জাতির জীবনে সুদূরপ্রসারী। সুতরাং শিক্ষাক্রম প্রণয়নের প্রক্রিয়াও যথাযথ ও সময়োপযোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। কারিকুলাম প্রণয়নের ধাপসমুহ সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই যে, প্রণীত কারিকুলাম ত্রুটিমুক্ত হবে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারিকুলামের কার্যকারিতা ভালো বোঝা যাবে এর বাস্তবায়ন পর্যায়ে। তবে, কারিকুলামের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কেন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না? বা দুর্বলতাগুলো কোথায়? তা চিহ্নিত করা জরুরি। কেননা এর মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছি ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছি। এই আলোকে অভিভাবকদের কাছ থেকে আমি অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। অভিভাবকদের মাধ্যমে এই নেতিবাচক মনোভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে এবং তাদের মানসপটেও নতুন কারিকুলামের প্রতি তথা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হতে পারে। যা আদতে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত। সুতরাং শুরুতেই এই অনাস্থা দূর করা জরুরী। মোটাদাগে যে বিষয়গুলো অভিভাবকগণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের সাথে আমার আলোচনায় উঠে এসেছে, সেগুলো হল: ক। নতুন কারিকুলাম প্রণীত সিলেবাস, বই-পুস্তক, শ্রেণী-শিখন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা; খ। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট ও চূড়ান্ত না হওয়া (অতিমাত্রায় পরীক্ষামূলক বা এক্সপেরিমেন্টাল); গ। নতুন কারিকুলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের (দেশে ও বিদেশে) উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির বা কারিকুলামের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এবং এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণার অভাব; ঘ। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। 

নতুন কারিকুলামের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত, প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিক সমালোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরি। কারিকুলাম প্রণয়নের প্রাইমারি স্টেইকহোল্ডারদের একদম বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না এবং কোনো ভালো ফলাফলও বয়ে নিয়ে আসবে না। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং একে ফলপ্রসূ করতে হলে স্টেইকহোল্ডারদের যৌক্তিক মতামত গ্রহণ ও তাদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য।  

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা
[email protected]

একেই বলে ছাগলধরা!

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৪ পিএম
একেই বলে ছাগলধরা!
ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া (মুন্না)

আগের দিনে ছাগল নিয়ে যত প্রবাদ ছিল তা বর্তমান সময়ের একটি ছাগল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ছাগলে কিনা খায়, পাগলে কিনা বলে? হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে! এসব প্রবাদ এখন উল্টে গেছে। এখনকার ছাগলরা উচ্চবংশীয়! যা তা খায় না। তথাকথিত ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ইমরান হোসেনের প্রচেষ্টায় এবার বিরল কিছু গরু ও ছাগল কোরবানির বাজারে এসেছে। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে এসব বিরল গরু ও ছাগলের বিষয়ে জানার ও দেখার। সরাসরি নয়, ফেসবুকের কল্যাণে।

একটি গরুর দাম ১ কোটি আর একটি ছাগলের দাম ১৫ লাখ। শুনতে গল্প মনে হলেও এটাই বাস্তব। এগুলো সাধারণ কোনো গরু ও ছাগল নয় বরং এরা উচ্চবংশীয়, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির। এদের বিশেষ কেরামতি আছে। সত্যিই তাই। এরা এমন ভাইরাল গরু ও ছাগল যে এদের লালন-পালনকারী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই ইতোমধ্যে সুপার ভাইরাল হয়ে গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত আমরা শুধু একটি ছাগলের কেরামতি দেখছি, কোটি টাকার গরুর কেরামতি দেখার অপেক্ষায় আছি।

বাংলাদেশের সর্বত্র এখন এই ভাইরাল ছাগল নিয়ে বেশ তুলকালাম চলছে। মজার বিষয় হলো ছাগলটি আমাদের সমাজের তথাকথিত ওপর শ্রেণির কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। যে কাজ কোনো দিন কেউ করতে পারত কি না সন্দেহ রয়েছে, তা একটি ছাগল অনায়েসে করে দেখিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, এই ছাগলের ভয়ে এখন সবাই তটস্থ। রীতিমতো কারও কারও ঘুম হারাম করে দিয়েছে এই ছাগল। ছাগলকাণ্ডে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এর ক্রেতা ইফাত। আবার ছাগলকাণ্ডে ক্রেতা ইফাতকে অস্বীকার করেছে তার জন্মদাতা বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান (সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত)। পর্দার আড়ালে চলে গেছে পুরো মতিউর পরিবার। কী নিদারুণ পরিস্থিতি? যে ছাগল কাঁঠাল পাতা খায়, সে এখন আমাদের মানুষ চেনাচ্ছে। এই ছাগলকাণ্ডে আমরা মতিউর রহমান নামক একজন অতি ক্ষমতাধর, বিশাল সম্পদশালী অসৎ সরকারি অফিসার সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তার ঠিকুজিকুষ্ঠি পুরোপুরি উদ্ধার হয়েছে। তার স্ত্রীরা, পুত্র ও কন্যারা কোথায় কী করছেন, কী কী অবৈধ সম্পদ ভোগদখল করছেন তা গোটা পৃথিবীর মানুষ জানতে পেরেছে।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, যে মতিউর রহমানকে ইতিপূর্বে কেউ থামাতে পারেনি একটি ছাগল তা করে দেখিয়েছে। এই ছাগলের কল্যাণেই জানতে পারলাম যে, এই মতিউর রহমান ছিলেন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সব ক্ষমতার ওপরে। বাংলাদেশের সব স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল মতিউর রহমানের শক্ত নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশের যে কাউকে তিনি ম্যানেজ করার স্বক্ষমতা রাখতেন। তার দাপটে ভালো ও সৎ অফিসাররা ছিলেন অসহায়। মনে হচ্ছে মতিউর রহমান বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে খুব ছোট করে ফেলেছিলেন, যেখানে চাইলেই যা ইচ্ছে তা করা যায়। কীসের আইন, কীসের নিয়ম, কীসের শৃঙ্খলা। একটি দেশকে পিছিয়ে দিতে এরকম দু-একজন মতিউর রহমানই কি যথেষ্ট নয়? রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে মতিউর রহমানের মতো মানুষেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না, তা তো হতে পারে না। তাই তো একটি ছাগলের মাধ্যমে মতিউর রহমানকে বধ করা হয়েছে। এটা কি নিছক কাকতালীয়? নাকি দুর্ভ্যাগ্যবশত? নাকি অ্যাক্সিডেন্ট? সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা ধরা বড় দায়। 

উদ্বেগের বিষয় হলো, ছাগলটা কিন্তু এখনো আছে। ইমরান হোসেনের খামারে, গলার কাঁটা হয়ে! এই ছাগল দিয়ে সে কী করবে? বিক্রি করবে, কে কিনবে? ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিজে জবাই করে খাবে, এই রকম ব্যবসায়ী তো সে নয়! তবে এই ছাগল নিয়ে সে যা করবে তাতেই কিন্তু নিউজ বের হবে। 

সাংবাদিকরা এই ছাগলের সংবাদ প্রকাশের জন্য রীতিমতো অপেক্ষা করছেন। তবে বাংলাদেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোরবানিতে ১ কোটি টাকার একটি গরু আর ১৫ লাখ টাকার একটি ছাগল বিক্রি করে যে ব্রেক-থ্রো ঘটিয়েছে উদ্যোক্তা ইমরান হোসেন, তার বিড়ম্বনা তো তাকে পেতেই হবে। কোরবানি তো আর লোক দেখানোর বিষয় নয়। উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির সাধারণ মানুষের কাছে এসব বিষয়ের কি আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে? ইমরান হোসেন বিভিন্ন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে যতই সাফাই গাক না কেন সাধারণ মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তবে একটি কাজের জন্য ইমরান হোসেনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয় যে, তার অতিদামি এসব গরু ও ছাগল অবৈধ টাকার মালিকদের ধরতে একটা টোপ হিসেবে কাজ করেছে। যে টোপে ধরাশায়ী হয়েছেন মতিউর রহমানের মতো অতি কৌশলী ও প্রতাপশালী অসৎ অফিসার। কে জানে এরকম উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল আবার কোনো এক নতুন মতিউরকে ধরার জন্য বসে আছে কিনা?

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি করে বড় চেয়ারে বসার সুযোগে চতুরতার সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যারা অবৈধ টাকার পাহাড় বানিয়েছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা চুষেছেন বা চুষে যাচ্ছেন, তারা দয়া করে থামুন। সাবধান হোন। আপনাদের অবৈধ টাকা দিয়ে আপনারা সর্বোচ্চ কী করতে পারেন তা দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেন, বিদেশে বাড়ি কেনেন, দেশে অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে ফ্ল্যাট/বাড়ি ক্রয় করেন, কয়েক শ বিঘা জায়গার ওপর রিসোর্ট নির্মাণ করেন আর ছেলেমেয়েদেরে এসব অবৈধ টাকা অবাধে খরচ করতে দেন, এই তো? তাই সরকারি চাকুরে, যাদের কাছে এরকম হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে তাদের জন্য একটা পরামর্শ- টাকাগুলো বিদেশে প্রাচার না করে বরং তা দিয়ে বঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করুন, দেশের টাকা দেশেই রাখুন, বাংলাদেশের হাজার হাজার বেকার তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন, অনুন্নত গ্রামের উন্নয়নে ও প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভালো কাজে ব্যবহার করেন। তা না হলে আপনিও একদিন নিশ্চিত এরকম ছাগলবধ হবেন। যাদের সহযোগিতায় অপকর্ম করেছেন, স্বার্থ বিনিময় করেছেন তারা কেউ কিন্তু আপনার দায় নেবে না। আপনাকে ছিছি করবে গোটা জাতি। আপনার অর্থই হবে অনর্থের মূল। এরকমই এক ছাগলকাণ্ডে উন্মোচিত হবে আপনার সব কুকর্ম, তাসের ঘরের মতো ধ্বংস হবে আপনার অবৈধ টাকার পাহাড়।

লেখক: অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?
তৌহিদ-উল বারী

পড়াশোনা মানে যেন লাভ-ক্ষতির ব্যবসা। এমনটাই পরিলক্ষিত হয়, যখন ক’টা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন মিলে যায়। তাহলে তো আর কথা নেই। ব্যাস! এখন শুধু খাতায় গিয়ে লিখে দেওয়াটা বাকি। কি বা দরকার এত লেখাপড়া করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। যেখানে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়া যায় আর পরে মিলে যায় লোভনীয় সার্টিফিকেট। এভাবেই যেন গেঁথে দেওয়া হয়েছে বর্তমান শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের মাথায়। একটি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ নামের কুচক্রী মহল তাদের এই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ের মধ্য দিয়েই পড়াশোনাকে বানিয়ে ফেলেছে একটি লাভ-ক্ষতির ব্যবসা।

প্রশ্নফাঁস একটি সভ্য জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে নিঃসন্দেহে। যা আমরা শুনে এসেছি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ‘If you want to destroy a nation, first destroy it’s education’ যদি তুমি একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে প্রথমেই ওই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস কর।

এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, এ যেন শত্রুপক্ষ বাঙালি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার এক মহোৎসবে মেতে ওঠেছে। একটি স্বল্পশিক্ষিত মহল যেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করছে।

এসব স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মাথায় বিন্দুমাত্র কাজ করে না, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে জাতির কত বড় সর্বনাশ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না বরং এরা তার থেকে বিমুখ হচ্ছে। যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা কোনোরকমে টেনেটুনে পাসের চিন্তা রাখে তাদের দলেই ধাবিত হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কারণ একটাই, এসব শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে পাশ করার চেষ্টা। যার প্রেক্ষিতে মেধাবীরা আজ পড়াশোনার প্রতি, মেধাচর্চার প্রতি বিমুখ হচ্ছে। 

কেমন জানি, প্রশ্নফাঁস করে অবৈধ টাকা কামানোর নেশায় নেমেছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। ফলে গত ছয় বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এসব চক্রের প্রায় তিন শতাধিক সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পরিচালকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের একই অপরাধ করছে। বিচার কার্যক্রমের ধীরগতির সুবিধাও নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা।

তবে এত এত গ্রেপ্তারের পরও কেমন জানি এই প্রশ্নফাঁস ঠেকানোই যায় না। কোনো না কোনো ভাবে এসব প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যায়। কেন বারবার এমনটা হচ্ছে? এর পিছনে কারা দায়ী? কিসের ঘাটতি রয়েছে এই কুচক্রী মহলকে ঠেকানোর পেছনে? নাকি এভাবেই চলতে থাকবে ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো। প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, পরীক্ষা দেবে, অপরাধীও শনাক্ত হবে। কিন্তু বিচারের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকবে না। তাহলে এরকম হলে কেমন হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন? এটা নিয়ে কি আমরা মোটেও ভাবার বিষয় মনে করছি না! 

তবে আমরা এটা নিশ্চিত ভাবে জানি প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান আছে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশ আসামিদের অপরাধের শাস্তির রায় হয়নি। তাহলে কি এটাই হতে পারে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তির কারণ? নাকি আরও কোনো অদৃশ্য কারণ রয়েছে এ প্রশ্নফাঁসের পেছনে। খতিয়ে দেখা হোক, চিরতরে বন্ধ হোক প্রশ্নফাঁসের এই দুর্নীতি-অনিয়ম। দিনশেষে মেধাবীরাই তাদের মেধার মেধার স্বাক্ষর রাখুক।

লেখক: শিক্ষার্থী ও কলামিস্ট 
[email protected]

মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল
মো. রেজাউল করিম

‘মহুয়া’ পালা মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যতম আলোচিত গীতিকাব্য। সাহিত্য সর্বদাই সমাজের ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজের উপরিস্থিত ও অন্তস্থ আন্তসম্পর্কের বর্ণনাচিত্র। মৈমনসিংহ গীতিকায় কবিরা সরল লোকজ ভাষায় মানবজীবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে নর-নারীর প্রেম অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় কাহিনিসমূহ অমরত্ব লাভ করেছে। মহুয়া পালা এমনই এক আখ্যানচিত্র যে পালা বা গাথায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র বিধৃত হলেও তা গোটা বাংলার, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র হিসেবেই গণ্য করা যায়। মহুয়া পালায় বর্ণীত আখ্যানের সমাজচিত্র পৌনে চার শ বছর পরও চলমান বঙ্গীয় সমাজে অনেকাংশেই বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকার প্রায় সব কাব্যই মানব-মানবীর প্রেমাখ্যানের মনোস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মহুয়া পালাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পালার প্রধান দুই চরিত্র- নদের ছাঁদ ও মহুয়া সামাজিক অবস্থানের দুই মেরুতে অবস্থানকারী দুই যুবক-যুবতী। শুধু যে সামাজিক অবস্থান পৃথক তা-ই নয়, তাদের ধর্মও পৃথক। অথচ তারা একে অপরের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। প্রেম, পরিবার ও সমাজসৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত, মানোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, প্রেমের প্রতি অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি ও ত্যাগ- ফলে পরিবার ও সমাজসৃষ্ট আরোপিত নিগ্রহ এবং আরোপতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে মনোস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথের আখ্যান এই পালার উপজীব্য। পরিশেষে যার সমাপ্তি ঘটে ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে। 

নদের চাঁদ ও মহুয়া পালার চিত্রায়ন শুরু হয় গারো পাহাড়ের ওপারে হিমানী পর্বতে, যা কিনা ছয় মাসের দূরত্ব।  হিমানী পর্বতের ওপারে ঘন জঙ্গল যেখানে চন্দ্র কিংবা সূর্যের আলো পৌঁছে না- এমন ঘন জঙ্গলে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা, তার বাহ্যিক পেশা সাপুড়ে তথা বেদে- ডাকাত সর্দার হুমরা ‘হুমরা বাইদ্যা’ নামেই পরিচিত। ষোলো বছর আগের ঘটনা- হুমরা বাইদ্যা কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ডাকাতি শেষে অপরূপ রূপ-মাধুর্যের অধিকারী ছয় মাসের এক কন্যাকে দেখে চুরি করে নিয়ে আসে। এই ঘটনা শুধু যে তৎকালীন সমাজচিত্র তা-ই নয়, পৌনে চার শ বছর পরও বর্তমান বেদে জনগোষ্ঠী কর্তৃক শিশু, বিশেষত শিশুকন্যা চুরির কথা শোনা যায়। 

চুরি করে আনা শিশুকন্য মহুয়া অন্তজ বেদে সমাজে বেড়ে উঠতে থাকে আরও দশটি মেয়ের মতো। সাপের খেলা, নাটকীয় সংলাপ, নদী থেকে জল আনা, এমনকি ঘোড়ায় চড়া- সব কাজেই সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ভাগ্য অন্বেষণে নদী, জলাশয়, পাহাড় অথবা গ্রামীণ লোকালয়ে মৌসুমভেদে ঘুরে বেড়ায় তারই পালক-পিতা বেদেসমাজের দলপতির সঙ্গে। যাযাবর শ্রেণির বেদেসমাজ দলপতির ‘বৈদেশেতে’ যেত- সেই পর্বের বর্ণনা পাওয়া যায় পালায় এভাবে: ‘ঘোড়া লইল গাধা লইল, কত কইবো আর- সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়- শিকারি কুকুর লইল শিয়াল হেজে ধরে- মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে।’ উপরিউক্ত স্তবক থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে সমাজের পরিভ্রমণের চিত্র জানা যায়, যা এখনো বিরাজমান। তবে বর্ণনায় আতিশয়োক্তি রয়েছে বলে মনে হয়। একই নৌকায় কুকুর আর শেয়াল বহনের ঘটনা বর্ণনার আতিশয়োক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়।

এই স্তবকে সনাতন বাঙালি সমাজের আতিথেয়তার প্রমাণও পুরিস্ফুট। জমিদারের নায়েব প্রথম দর্শনেই মহুয়ার প্রেমে পড়ে। মহুয়াও তার প্রতি সমভাবে আকৃষ্ট হয়। সে নিজেদের আলয়ে নদেরকে নিমন্ত্রণ জানায়, যা পালায় এভাবে বর্ণীত হয়েছে: ‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা- জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা- সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরি কলা- ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।’ পালার এই স্তবক এ দেশের সনাতন সমাজের লোকজ খাদ্য দিয়ে হাজার বছরের আতিথেয়তা প্রকাশ করে, যা আজও গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান।

তৎকালীন বেদে সমাজের নারীরা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিষ অথবা ধারালো অস্ত্র সঙ্গে রাখত। পালার বিভিন্ন পর্বে তার বিবরণ পাওয়ায়। এ ছাড়া বিষের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যা বেদে সমাজে সে-সময়ে ছিল, এখনো আছে এমন তথ্য প্রমাণিত। এই পালায় তক্ষকের বিষ অস্ত্র হিসেবে বিবৃত হয়েছে যখন মহুয়া তাকে অপহরণকারী সওদাগরের মাঝি-মাল্লাদের বানিয়ে দেওয়া পানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেয়। এখানে দুটি দৃশ্যকল্প অবলোকন করা যায়। প্রথমত, বেদেকন্যা নিজের কাছে গোপনে বিষ রাখত। দ্বিতীয়ত, তারা সেই যুগে, এমনকি বর্তমানেও কথার জাদুতে মানুষকে মোহাবিষ্ট করতে পারে। তাই তো দেখা যায়- যারা তাকে অপহরণ করেছে, তার নাটকীয় কথার মাধুর্যে মোহাবিষ্ট হয়ে তারই সাজিয়ে দেওয়া পান খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বেদে সমাজে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া মাত্রই বিশেষত নারীরা পান খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা এখনো বিদ্যমান। 

গোটা পালা নিবিড় অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, এই পালার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজচিত্র, যা পৌনে চার শ বছর পর আজও শুধু বেদে সমাজ নয়, বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান। রক্ষণশীল সমাজের বেদেকন্যা মহুয়া সুন্দরী ও জমিদারের দেওয়ান সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদের ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন ধর্ম এবং বিবাহ তথা সম্প্রদানের ব্যাপারে অভিভাবকের সিদ্ধান্তের প্রাধান্য। সে-যুগেও অভিভাবকের সিদ্ধান্তের বাইরে যুবক-যুবতী প্রণয়াসক্ত হতো, যা এই পালায় বিবৃত হয়েছে। তবে কোনো বাধাই দুজনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দুজনে আত্মাহুতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে ভালোবাসা শাশ্বত। এমন চিত্র বাংলার গ্রামীণ সমাজই শুধু নয়, শহুরে সমাজেও এখন কদাচিৎ হলেও জানা যায়।  

হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদের প্রতি তার আদরের পালিত কন্যা মহুয়ার আসক্তি টের পেয়ে যায়। এই পর্যায়ে দেখা যায়, হুমরা বাইদ্যা ভাবে- কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাড়ির জমিতে ফসল উঠবে; ফসল তোলার টান, বাড়ির পুকুরের মাছ ধরার মৌসুম, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মহুয়ার গোপন প্রণয়ের আশঙ্কা- তাকে কিছু একটা করতেই হবে। বেদে দলে মহুয়ার সখা পালঙ্ক হুমরা বাইদ্যার নিষ্ঠুরতার আশঙ্কায় মহুয়াকে পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহ বাইরে বের না হওয়ার জন্য। ঠাকুরবাড়িতে সে পৌঁছে দেবে মহুয়ার মৃত্যুর খবর। মহুয়া রাজি হয় না, উল্টো ঠাকুরবাড়ির পানে চেয়ে চন্দ্র-সূর্য আর পালঙ্ক সখাকে সাক্ষী মেনে নদের চাঁদকে স্বামী বলে ঘোষণা করে। পালঙ্ককে বলে সে নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, অন্যথায় বিষপানে আত্মহত্যা করবে। হুমরা বেদে মহুয়ার অজান্তে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করে দলের অন্যদের সঙ্গে। হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদকে তক্ষকের বিষ প্রয়োগে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করতে বললে মহুয়া নদের চাঁদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালায় যা বলা হয়েছে: ‘আরে করে ঝিলিমিলি নদীর কূলে দিয়া, দুজনে চলিল ভালা ঘোড়া সুয়ার হইয়া’। 

ধর্মীয় বিশ্বাস, বাদ-মতবাদ গীতিকা-রচয়িতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করেনি। জীবনবিরোধী সবকিছুই অস্বীকৃত হয়েছে এ কাব্যমালায়। মৈমনসিংহ গীতিকায় মূলত মুক্ত প্রেমের জয়গান বিবৃত হয়েছে। এ গীতিকার নারীরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে কখনো বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধেও জীবনসাথী বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিয়েছে, গৃহত্যাগ করেছে। এটা কোনোকালেই অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব ছিল না। যে কারণে বলা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকায় নারীর শক্তি, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান বিবৃত হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক
[email protected]

পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা
মো. সাখাওয়াত হোসেন

সম্প্রতি ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক অন্য এক পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা ও সংকট নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যম না যতটুকু তার থেকে কয়েক কাঠি এগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে কনস্টেবল কর্তৃক কনস্টেবল হত্যায় অনেকেই সন্তুষ্টির ঢেঁকুড় তুলেছে। এই যে পুলিশকে নিজের করে না ভাবা, পুলিশের দুঃসময়ে পাশে না থাকা, পুলিশকে মানসিকভাবে সমর্থন না করা ইত্যাদি বিষয়ে এক ধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের মধ্যকার যেকোনো ধরনের নেতিবাচক সংবাদে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার একটি ব্যতিক্রমী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো পুলিশ সদস্যদেরও অজানা নয়। অথচ যখনই কোনো সংকটের মুখোমুখি হই কিংবা কোনোভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা আমাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে কেউ ক্রোক করে এবং অপরাধীদের দ্বারা কোনোরকম ভয়ভীতি প্রাপ্ত হলে আমরা তৎক্ষণাৎ পুলিশের দ্বারস্থ হই। তদুপরি পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচার ও সৃষ্টকরণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। 

খবরে জানা যায়; রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি পুলিশ কনস্টেবল কাওসার আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। কাওসারের স্ত্রী নিলুফারের ভাষ্যে; কাওসারের দুই সন্তান আছে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। সংসারে কোনো ঝামেলা বা কলহ ছিল না। তবে তিনি জানান, ‘কাওসারের মানসিক সমস্যা ছিল। রাঙামাটির বরকলে চাকরি করার সময় তিনি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত তিনবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল। নিয়মিত ওষুধও সেবন করতেন। কাওসারের কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে। সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। তবে চাকরি নিয়ে খুবই টেনশন করেন তিনি। ছয় ঘণ্টার ডিউটি আট ঘণ্টা হতো।’

ইংল্যান্ডে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন মানসিক সমস্যায় ভোগেন- গবেষণা জরিপে এমন তথ্যের আভাস পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ যেহেতু তাদের সদস্যদের মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেছে কিংবা উদ্যোগ নিয়েছে তাহলে সমস্যা-পরবর্তী সমাধানের আভাসও পাওয়া গেছে। ইংল্যান্ডের মতো দেশে; যে দেশে পুলিশ পাবলিকের একটি চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান, সেই দেশে পুলিশ সদস্যদের একটি বড় অংশের মানসিক সমস্যার উদাহরণ একটি বড় প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে আমাদের। বাংলাদেশ পুলিশ কি আদৌ তাদের সদস্যদের মানসিক অবস্থানকে তুলে ধরার কিংবা যাচাই করার কোনোরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে? অন্যান্য দেশে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে প্রত্যেক ইউনিটে আলাদা করে সেন্টার স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার বিষয়ে সেন্ট্রালি পুলিশ হাসপাতাল রয়েছে, যেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং ইউনিট কিংবা রেঞ্জভিত্তিক চিকিৎসা সেন্টার কিংবা ডাক্তারদের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার তেমন ব্যবস্থা নেই। 

বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের চাকরিতে নানা রকমের চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তথাপি এ ধরনের পেশাগত চাপকে ব্যবহারিকভাবে প্রশমনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সঙ্গত কারণেই পেশাগত প্রতিকূলতার আকার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি অঘোষিত নেতিবাচকতাকে সব সময় পুলিশ সদস্যদের মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের পেশাগত চাপকে মোকাবিলা করতে বিশেষ ধরনের সাপোর্ট সেন্টার নেই। সাধারণত পুলিশ সদস্যরা যে ধরনের চাপকে মোকাবিলা করে থাকেন তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

প্রথমত, পুলিশের চাকরিতে সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। সবসময়ই পুলিশকে সজাগ থাকতে হয়, কখন কোন নির্দেশনা চলে আসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে; এ ধরনের একটা তাড়না সবসময়ই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থাকে। আমরা সবাই জানি, জরুরি যেকোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের সব ধরনের ছুটিও বাতিল হয়ে যায়। পুলিশের মূল কাজই হচ্ছে জনসাধারণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং জনগণের সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া। জায়গা থেকে পুলিশে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সারা দেশে ঈদের ছুটিকে সামনে রেখে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং হলফ করে বলা যায়, এ ইউনিটের সদস্যদের অধিকাংশ ঈদের ছুটি থেকে দায়িত্বের কারণে বঞ্চিত হন। 

দ্বিতীয়ত, সিনিয়র, জুনিয়র ও ব্যাচমেটদের সঙ্গে নানা বিষয়ে সম্পর্কের ঘাটতি একজন পুলিশ সদস্যের মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে থাকে। বিসিএস অফিসারদের মধ্যে এমন দেখা যায়, কোনো এক ব্যাচের কর্মকর্তা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন আবার ওই একই ব্যাচের কর্মকর্তা এখনো এসপি হতে পারেননি। এমন নজির ও উদাহরণ বাংলাদেশ পুলিশে রয়েছে। এ ব্যাপারগুলো একজন অফিসারকে মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে ফেলে রাখে, ফলে পুলিশিংসহ অন্যান্য কাজে তার একটি নমুনা পাওয়া যায়। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পদোন্নতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়গুলোকে সামনে রেখে একই ব্যাচের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, জুনিয়র বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বিশেষ করে ছুটি ও কর্মঘণ্টা ইত্যাদি বিষয়ে। উপরন্তু আলোচনার জায়গা থেকে ব্যাচভিত্তিক ও রেঞ্জভিত্তিক সুযোগ-সুবিধার রকমফেরের কারণে মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পুলিশের পারফরম্যান্স ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবান্বিত করে থাকে। 

তৃতীয়ত, একঘেয়েমি কাজ। নিয়মিত একই কাজে অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিরক্তিবোধ চলে আসে। সে কারণেই কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এমনও দেখা যায়, কেউ সরাসরি পেট্রোল নিয়ে ব্যস্ত আবার অনেক পুলিশ সদস্য অফিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ আছেন একই রেঞ্জ কিংবা একই ইউনিটে দীর্ঘদিন কাজ করায় তার কাজের মান ও কাজের ধরনে উন্নতি না হয়ে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে আসছে। এ বিষয়গুলোকে সমন্বয়ে করে পোস্টি ও পদায়ন করা জরুরি, তা না হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের কাজের মানে তেমন তারতম্য দেখা যাবে না। 

চতুর্থত, পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা। দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক ধারণার ব্যাপারটি পুলিশের মনে ও মগজে গেঁথে আছে এবং এ ব্যাপারগুলো পুলিশ কর্তৃক ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের হাজার ভালো কাজ থাকলেও নেতিবাচক কাজটিকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুলিশ একটি মানসিক অশান্তি নিয়ে দিনাতিপাত করে। বিপদে-আপদে পুলিশের সাহায্যের দ্বারস্থ হই এবং পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাই কিন্তু মূল্যায়নের সময় পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নিয়েই যেন আমরা মতামত দিয়ে থাকি। এ ব্যাপারগুলো পুলিশ সদস্যদের গোচরীভূত এবং দায়িত্ব পালনের সময় উল্লিখিত বিষয়গুলো তাদের ট্রমার মধ্যে রাখে, যা পারফরমেন্সে প্রভাব ফেলে।  

পঞ্চমত, পদোন্নতি, বদলি ও পদকপ্রাপ্তিতে বৈষম্য ইত্যাদি কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। পদোন্নতি নিয়ে সংস্থাটির বাইরে সরাসরি কোনো সদস্য কথা না বললেও তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অভিমান বিরাজ করে। কমিউনিটিতে পরিচয় ও প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে দেয় পদোন্নতি সংক্রান্ত ইস্যুগুলো, সে কারণেই পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এ ব্যাপারগুলো সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পারিবারিক ও কর্মময় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। 

ষষ্ঠত, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে স্বাধীনতা হরণ করা হয়, এ ধারণা রয়েছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের। এ দোদুল্যমান অবস্থা থেকে পুলিশের অনেকেই বের হয়ে আসতে চান। পুলিশকে সংস্কারের ব্যাপারে প্রায় সবাই মতামত দেন। তথাপি কেন, কীসের জন্য পুলিশের সংস্কার আটকে গেছে, সেটি খুঁজে বের করে দ্রুততর সময়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে পুলিশের পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক হবে নিশ্চিতভাবেই। আমরা মনে করি ও বিশ্বাস রাখি, পুলিশকে যদি আমরা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারি তাহলে পুলিশের কাছ থেকে আরও ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করতে পারি। যেমনটি দেখেছিলাম করোনার সময়ে। সর্বোপরি পুলিশের সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করে সামনের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা অচিরেই সমাধান হয়ে আসবে।
    
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]