ঢাকা ২২ আষাঢ় ১৪৩১, শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা: অস্তিত্বের সংকটে সমতলীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৩৬ পিএম
আপডেট: ২২ মে ২০২৪, ০৫:৩২ পিএম
শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা: অস্তিত্বের সংকটে সমতলীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়
বিপ্লব বড়ুয়া

মহামানব গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে আড়াই হাজারের বছর পূর্বে যে শান্তি ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এই বিশ্বজগতে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটছে, বিশ্বব্যাপী তা এখন অন্যতম গবেষণার বিষয়। তৎসময়ে ভগবান তথাগত গৌতম বুদ্ধ হিংসা, শত্রু, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, সহনশীলতা, বৈরিতা, সুখ, দুঃখ, ভোগ, বিলাস থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নিজে জয় করে মানবমুক্তির উদ্দেশ্যে মৈত্রী, শান্তি, সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে মানুষের জীবনমানে এক আমুল পরিবর্ত ঘটিয়েছিলেন। আজ তার বাণী ও দর্শন বিশ্বের জ্ঞান-ভান্ডারকে আলোকিত করেছে। 

তিনি কোনো ধর্মপ্রচারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবিক দর্শনের পুরোধা প্রবক্তা। যেটি নিজে আত্মস্থের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত দুঃখ নিপীড়িত জর্জরিত জীবন থেকে মুক্তির পথে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রক্ত মাংসের শরীরে গড়া মায়ের গর্বে জন্ম নেওয়া একজন অদ্ধিতীয় দৃশ্যমান ব্যক্তি মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষের মনের গহীনে ঠাই করে নিয়েছেন। 

তিনি অলোকিকতা বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন। শোনা কথায় কান দিতে নিষেধ করেছেন। যাচাই-বাচাই করে ভাল লাগলে গ্রহণের কথা বলেছেন, খারাপ লাগলে ত্যাগ করার কথা বলেগেছেন। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন বলে গ্রহণ করতে হবে তারও সর্তকবাণী দিয়েছেন। প্রাণী হত্যা, মিথ্যা কথা, চুরি, ব্যভিচার, লোভ, স্বার্থপরতা, অন্যের ক্ষতিসাধন থেকে মুক্ত থাকার কথা যেমন তিনি বলেছেন, তেমনি বলেছেন শত্রুকে মৈত্রী দিয়ে জয় করার কথা।

কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী এখন ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা। নিরস্ত্র মানুষের সবলের প্রাণ সংহার, ধর্মের নামে মিথ্যার বসবাস। উগ্রবাদীদের প্রবল উন্মাদনায় সময়ে সময়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতি হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত। অন্য ধর্মের মতবাদীদের দোষ দিই কেন! যেখানে এখন খোদ নিজ সম্প্রদায়েরর লাল কাপড় পরিহিতি গুটিকয়েক ছদ্মনামধারী ধর্মগুরুরা যখন ধর্মের নামে রাজনীতি-ব্যবসা খুলে সন্ত্রাসীদের সাথে উঠাবসা করে, ধর্মালয়ে সাধারণ গৃহীদের গায়ে হাত তুলে, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধ্বংযজ্ঞ, নারীর শাড়ি টেনে খুলে ফেলে নোংরা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা গুজব রটিয়ে পুরো দেশও সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি খুন্ন করে এই সব ধর্মগুরুরা কোন আদর্শ বাস্থবায়ন করার পথে নেমেছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ নর-নারীর বোধগম্য নয়! 

যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে দিয়ে দেশকে বিশ্বের সামনে উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত করছে সে মুহুর্তে বৌদ্ধ উগ্রবাদী ধর্মগুরুদের এমন আস্ফালন দেশ ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র!

মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের দেবদেহ নগরের সীমান্ত অঞ্চলের লুম্বিনী কাননের উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন কপিলাবস্তু নগরীর রাজা শুদ্ধোধন। মায়ের নাম রাণী মহামায়া। সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পর মা মহামায়া ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর কুমার সিদ্ধার্থকে কোলেপিঠে লালন পালন করে আপন সন্তানের মায়ায় বড় করে তুলেন সৎমা মহাপ্রজাপতি গৌতমী।

গৌতমী এমন স্নেহ-আদরে মানুষ করেন এ কথা সন্তান সিদ্ধার্থকে কখনো বুঝার সুযোগ দেয়নি। সংসারের প্রতি ছিল উদাসীন কুমার সিদ্ধার্থকে সংসার অনুরাগী করার জন্য ১৬ বছর বয়সে যশোধরা নামের সুন্দরী এক রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধার্থ-যশোধরা দম্পতির কোল আলো করে একটি সন্তান পৃথিবীতে আসে। ছেলের নাম রাখলেন রাহুল। 

এদিকে সংসারচক্রে উদাসীন ছেলে সিদ্ধার্থকে খুশি রাখতে পিতা রাজা শুদ্ধোধন চার ঋতুর জন্য চারটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। যেখানে পুত্রের মনোজগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবরকম সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন তাঁর পিতা। একদিন কুমার সিদ্ধার্থ রথে চড়ে নগর পরিভ্রমণের জন্য বের হন। ছেলের এমন মনোযোগে পিতা রাজা শুদ্ধোধন সারা কপিলাবস্তু নগরীতে সাধারণ মানুষদেরকে উৎসব করার নির্দেষ প্রদান করেন। বেশ কয়েকদিন ভ্রমণে বের হয়ে কিছু প্রশ্ন তাঁকে পেয়ে বসে। যে বিষয়গুলো রাজ সন্তানের জন্য কাঙ্খিত ছিল না।

প্রথম দিন পরিভ্রমণে বের হয়ে দেখেন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি জীর্নশীর্ন অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাফেরা করছেন। দ্বিতীয় দিন একজন অসুস্থ মানুষ রাস্তার ধারে কাঁতরাচ্ছেন। তৃতীয় দিন কিছু মানুষ এক মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তাঁর দৃষ্টি গোচরীভূত হয়। চতুর্থদিন একজন সন্ন্যাসীকে হেঁটে যেতে দেখে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা সারথীকে প্রশ্ন করেন- হে সারথি, এই চার দিন একে একে আমি রক্তমাংসে গড়া মানুষদেরকে যে অবস্থায় দেখলাম, তাদের জীবনটা এরকম হলো কেন? সারথি সিদ্ধার্থকে বললেন, ‘হে রাজপুত্র- জগত দুঃখময়’।

আরও বললেন, সংসারের মায়া-মমতা, রাজ্য, ধন-সম্পদ কোনো কিছুই চিরকাল স্থায়ী নয়। এই সুন্দর অবিনশ্বর পৃথিবী থেকে সবকিছু একদিন মুছে যাবে। আপনজন বলতে কোনো কিছুই থাকবে না। এইভাবে কুমার সিদ্ধার্থ দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে ২৯ বছর বয়সে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে পরিবারের সকলের অগোচরে গৃহ ত্যাগ করেন। পাহাড়-পর্বত, বনে-জঙ্গলে নীরব কোলোহল মুক্ত পরিবেশে দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনার পর ভারতের বিহার প্রদেশের বুদ্ধগয়া নামক স্থানে ৫৮৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ৩৫ বছর বয়সে বোধি বৃক্ষের নিচে বোধিজ্ঞান লাভ করে সম্যকসম্বুদ্ধ প্রাপ্ত হন। 

এরপর তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ ৪৫ বছর তাঁর অর্জিত জ্ঞান মানুষের কল্যাণে প্রচার করেছিলেন। তাঁর এই বাণী ও দর্শন পরবর্তীকালে নামানুসের একটি সার্বজনীন মনস্কতাপূর্ন ধর্মে পরিণত হয়। 

৫৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহামানব তথাগত বুদ্ধ আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশিনগর নামক স্থানে শালবৃক্ষের নীচে ৮০ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। 

পুরো পৃথিবীজুড়ে এই মহামানবের বাণী আজও সর্বজনীনভাবে সমাদৃত। 
 
আত্মশুদ্ধি, র্নিলোভ, নিরহংকর, ত্যাগময় জীবনের পথে উৎসর্গ করার সাধনাই হলো ধর্ম। কিন্তু বর্তমানে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি সম্পূর্ণ তার বিপরীত চিত্র। গত ৮ ও ৯ মার্চ ২০২৪ এবং এরপর ১১ মে ২০২৪ তারিখে একাধিকবার একশত আটত্রিশ বছরের প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে সংগঠিত অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দুটি বিবদমান গ্রুপের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং ঘটনা থেকে রটনার কীর্তিকলাপ, মারমার, কাটকাট অবস্থা যা দেখলাম তা রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। 

এর একটি পক্ষে হচ্ছে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি আর অপর পক্ষ হচ্ছে ব্যক্তি ভদন্ত ড. জিনবোধি ভিক্ষু। কেন এই তাণ্ডব ঘটানাে হলো এর উদ্দেশ্যই বা কি, সে বিষয়ে আমি ছোট্ট পরিপরে ঘটনার আলোকপাত করতে চাই। বিগত ১০/০৪/ ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের পুজনীয় শতবর্ষী অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত, বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু মহামান্য সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের, বিহার পরিচালনা কমিটির যৌথ সিদ্ধান্তক্রমে ড. জিনবোধি ভিক্ষুকে ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন ও  নিয়ম বহির্ভূত আচরণের জন্য বিহারের উপাধ্যক্ষ পদ থেকে অপসারণ করা হয়। জিনবোধি ভিক্ষু ১০/০৫/২০১২ সালে অপসারণ আদেশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জজ আদালতে একটি মামলা করেন। 

দীর্ঘ দুই বছর দুই দিন পর অর্থাৎ ১২-০৫-২০১৪ তারিখ জিনবোধির করা মামলাটি আদালত তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করেন। কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ৯৯৫৭/২০১৬ সালে রিট আবেদন করলে ২৯/০৫/২০১৭ সালে আগের দেওয়া রায় বহাল রাখেন। ২৮/০২/ ২০২১ এবং  ১৭/০৭/২০২৩ সালে দুইবার আপিল আদালত তা খারিজ করে দেন। তারপর একের পর তিনি দীর্ঘ ১৩ বছরে অসংখ্য মামলা করেন বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। প্রথম ঘটনাটি  পুরো বৌদ্ধ সমাজকে ছাড়িয়ে সার্বজনীন সমাজে “ টপ অব দ্যা বড়ুয়া নিউজ”-এ পরিণত হয়। একইভাবে ঘটেছে শেষ ঘটনাটির ক্ষেত্রেও।

এ ঘটনায় কী এক পক্ষের দোষ? না উভয় পক্ষের দোষ? সমাজের নীতিনির্ধারণী মহলে এনিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। আমি কোনো পক্ষকে বড় করে দেখা বা দোষী সাব্যস্ত করা আমার লেখার প্রধান উপজীব্য নয়। এই চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার ব্যক্তি জিনবোধি কিংবা সংগঠন বৌদ্ধ সমিতি যেই পরিচালনা করুক সে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। আমার বিষয়বস্তু হচ্ছে অন্যখানে।

ড. জিনবোধি ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমিতি কেন তর্কে জড়ালো এবং তর্ক থেকে একজন মহিলার শাড়ি টানাটানি হলো, শাড়ি টানা রোধ করতে গিয়ে নারীর স্বামী ভিক্ষুকে স্ত্রীর হাতে থাকা পার্স দিয়ে প্রতিরোধ করে। জিনবোধি ভিক্ষু নিজের মুখে জুতা দিয়ে আঘাত করেছে বলে মিথ্যা প্রপাগান্ডা প্রচার করলে তাঁর কিছু ভিক্ষু অনুসারী পরবর্তীতে বৌদ্ধ বিহারকে পরিণত করে নরক কুন্ডুলিতে। 

দুইবারের ঘটনা পুলিশের সামনে সংঘঠিত হয়েছে। প্রথম দিনের অপ্রীতিকর ঘটনা কারো কাম্য ছিল না। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ সমাজের মান ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করি। আমরা যদি একটু সুক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখি ঘটনাটিকে সেদিন তাৎক্ষণিকভাবে কী মিটিয়ে ফেলা যেতো না? যদি প্রথমটি তাৎক্ষণিকভাবে মিটিয়ে ফেলা যেতো তাহলে পরের ঘটনাটি ঘটার কোনো সম্ভাবনা থাকতো না। দুটি ঘটনাই জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারী কিছু ধর্মান্ধ উগ্রবাদী উশৃঙ্খল ভিক্ষুদের কারণে সংঘঠিত হয়েছে বলে সাধারণ জনগণের ভাষ্য।

ভিক্ষুরা হবেন আত্মত্যাগী কিন্তু না ভিক্ষু সংঘের কাছ থেকে সামান্যতমও সংযম প্রদর্শন করতে দেখা যায়নি। রাগ-ক্রোধ মানুষকে যে কী রকম ভয়াবহ হিংস্ত্র করে তোলে তার জ্বলন্ত উদাহরণ পুরো বৌদ্ধ সমাজ এই তিন দিন স্বচক্ষে দেখেছে। যা বৌদ্ধ সমাজ একটি বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই ঘটনা উঠতি প্রজন্মের সন্তানদের বহু বছর ভোগাবে।

তথ্যসুত্রে জানতে পারি, ৮ মার্চ ২০২৪ তারিখ রাতে পুলিশ উভয়পক্ষকে ডেকে শান্তিশৃঙ্খলা বজার রাখার স্বার্থে পুলিশ দলগতভাবে বিহারে প্রবেশাধিকার নিষেধ করে। কিন্তু পরের দিন দুপুরে জিনবোধি ভিক্ষুর কিছু তরুণ ভিক্ষু ও গৃহী অতর্কিত বিহারে প্রবেশ করে যেভাবে আসবাবপত্র ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দিয়ে ধর্মীয় বই, বিহারের দলিল পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। 

এটা সত্য যে, এই বিষয়টিকে অনেকে ভাল চোখে গ্রহণ করেনি। কেন এরা এইরকম করল?  

প্রিয় পাঠক, আপনারা আমার মতের সাথে আপনাদের মতের মিল নাও হতে পারেন? পুলিশের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ড. জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারীরা বিনা বাধায় ৯ তারিখ যেভাবেই হোক বিহারে গেলেন তাতে কারো কোনো রকম আপত্তি নেই, কিন্তু ওইদিন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা যদি না ঘটাতো আপনাদের ওপর কারো আঙুল তোলার প্রশ্নই আসতো না। অতিউৎসাহীরা যে ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটালো তা সেদিন অন্যধর্মের হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।

ভিক্ষুরাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালো ১১ মে ২০২৪ তারিখে। সেদিন বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দ প্রতিবছরের ন্যায় বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপন করার জন্য প্রস্তুতি সভার মিটিং আহ্বান করছিল। সেখানে বৌদ্ধ সমিতি ও বৌদ্ধ সমাজের অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবর্গরা যখন মিটিং করে এই ফাঁকে জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারী ভিক্ষুরা হামলা করে গৃহীদের রক্তাক্ত করে বৌদ্ধ বিহারকে রক্তে রঞ্জিত করে। 

ভিক্ষুরা যেখানে সাম্য মৈত্রী করুণার কথা বলবে সেখানে গৃহীদেরকে মেরে জখম করার এদৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। এনিয়ে মামলা হয়েছে। বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দরা তো আমাদের সমাজের মানুষ। কারো না কারো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রবীন ব্যক্তিত্ব। যাদের অর্থ-বিত্ত মেধায় বৌদ্ধ সমাজ এগিয়েছে সেইসব ব্যক্তিদের ওপর আঘাত! সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন ভিক্ষুদের মারমুখি চেহারাগুলো দেখছিলাম তখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেছে। 

তাহলে দেখুন, এই যে ফাটল দেখা দিলো তা দিয়ে কী লাভ হলো, কার লাভ হলো। জিনবোধি ভিক্ষুর, সমিতির না বৌদ্ধ সমাজের? ঘটনার পর তৃতীয় কোনো পক্ষকেও সংকট নিরসনে উদ্যেগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। উল্টো একের পর এক মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ছে। তাহলে বৌদ্ধ সমাজ কী এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে? 

বিবেকের কাছে একবার প্রশ্ন করুন, ঘটনাকে কেন্দ্র করে যারা যেভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তৎপরবর্তী যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছিল, মিছিল-মানবন্ধন করেছিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় অধিকাংশ ফেইক আইডি খুলে অশালীন ভাষায় গালাগাল ও সামাজিক ব্যক্তিত্বদের ছবিতে জুতার মালা, বিহার অঙ্গনে কুশপুত্তলিকা দাহ, টানানো, আগুন দেওয়া, ঝাড়ু ও লাথি মারা, ভিক্ষুরা গৃহী উপাসকদের মেরে রক্তাক্ত করে জখম এগুলো কি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাজ? 

যে ক্ষত সৃষ্টি হলো, সম্প্রদায়ের সম্মানে চুনকালি লাগল, এটির ক্ষত আগামী কত বছর পর্যন্ত বয়ে বেড়াবে কেউ চিন্তা করেছেন কি? এর দায়ভার কে নেবে? বৌদ্ধ সমাজ যে অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, করুণা মুদিতার কথা বলা হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ থেকে তার কোনো রকম অস্তিত্ব-নিশানা দেখতে পেলাম কী?

২০২৪ সালের বুদ্ধ পূর্ণিমার মহান দিন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন হবে তার গ্যারান্টি কোথায়? ঘোর এই অমানিশায় গ্রাস করা অস্তিত্বের সংকট থেকে সমতলীয় বৌদ্ধ সমাজকে বাঁচাবে কে? আর কতবার বৌদ্ধ বিহার অপবিত্র হবে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে এই উগ্রবাদ ধর্মান্ধ রাহুর কবল থেকে রক্ষা করুন।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিষ্ট
[email protected]

মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল
মো. রেজাউল করিম

‘মহুয়া’ পালা মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যতম আলোচিত গীতিকাব্য। সাহিত্য সর্বদাই সমাজের ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজের উপরিস্থিত ও অন্তস্থ আন্তসম্পর্কের বর্ণনাচিত্র। মৈমনসিংহ গীতিকায় কবিরা সরল লোকজ ভাষায় মানবজীবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে নর-নারীর প্রেম অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় কাহিনিসমূহ অমরত্ব লাভ করেছে। মহুয়া পালা এমনই এক আখ্যানচিত্র যে পালা বা গাথায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র বিধৃত হলেও তা গোটা বাংলার, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র হিসেবেই গণ্য করা যায়। মহুয়া পালায় বর্ণীত আখ্যানের সমাজচিত্র পৌনে চার শ বছর পরও চলমান বঙ্গীয় সমাজে অনেকাংশেই বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকার প্রায় সব কাব্যই মানব-মানবীর প্রেমাখ্যানের মনোস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মহুয়া পালাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পালার প্রধান দুই চরিত্র- নদের ছাঁদ ও মহুয়া সামাজিক অবস্থানের দুই মেরুতে অবস্থানকারী দুই যুবক-যুবতী। শুধু যে সামাজিক অবস্থান পৃথক তা-ই নয়, তাদের ধর্মও পৃথক। অথচ তারা একে অপরের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। প্রেম, পরিবার ও সমাজসৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত, মানোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, প্রেমের প্রতি অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি ও ত্যাগ- ফলে পরিবার ও সমাজসৃষ্ট আরোপিত নিগ্রহ এবং আরোপতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে মনোস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথের আখ্যান এই পালার উপজীব্য। পরিশেষে যার সমাপ্তি ঘটে ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে। 

নদের চাঁদ ও মহুয়া পালার চিত্রায়ন শুরু হয় গারো পাহাড়ের ওপারে হিমানী পর্বতে, যা কিনা ছয় মাসের দূরত্ব।  হিমানী পর্বতের ওপারে ঘন জঙ্গল যেখানে চন্দ্র কিংবা সূর্যের আলো পৌঁছে না- এমন ঘন জঙ্গলে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা, তার বাহ্যিক পেশা সাপুড়ে তথা বেদে- ডাকাত সর্দার হুমরা ‘হুমরা বাইদ্যা’ নামেই পরিচিত। ষোলো বছর আগের ঘটনা- হুমরা বাইদ্যা কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ডাকাতি শেষে অপরূপ রূপ-মাধুর্যের অধিকারী ছয় মাসের এক কন্যাকে দেখে চুরি করে নিয়ে আসে। এই ঘটনা শুধু যে তৎকালীন সমাজচিত্র তা-ই নয়, পৌনে চার শ বছর পরও বর্তমান বেদে জনগোষ্ঠী কর্তৃক শিশু, বিশেষত শিশুকন্যা চুরির কথা শোনা যায়। 

চুরি করে আনা শিশুকন্য মহুয়া অন্তজ বেদে সমাজে বেড়ে উঠতে থাকে আরও দশটি মেয়ের মতো। সাপের খেলা, নাটকীয় সংলাপ, নদী থেকে জল আনা, এমনকি ঘোড়ায় চড়া- সব কাজেই সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ভাগ্য অন্বেষণে নদী, জলাশয়, পাহাড় অথবা গ্রামীণ লোকালয়ে মৌসুমভেদে ঘুরে বেড়ায় তারই পালক-পিতা বেদেসমাজের দলপতির সঙ্গে। যাযাবর শ্রেণির বেদেসমাজ দলপতির ‘বৈদেশেতে’ যেত- সেই পর্বের বর্ণনা পাওয়া যায় পালায় এভাবে: ‘ঘোড়া লইল গাধা লইল, কত কইবো আর- সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়- শিকারি কুকুর লইল শিয়াল হেজে ধরে- মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে।’ উপরিউক্ত স্তবক থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে সমাজের পরিভ্রমণের চিত্র জানা যায়, যা এখনো বিরাজমান। তবে বর্ণনায় আতিশয়োক্তি রয়েছে বলে মনে হয়। একই নৌকায় কুকুর আর শেয়াল বহনের ঘটনা বর্ণনার আতিশয়োক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়।

এই স্তবকে সনাতন বাঙালি সমাজের আতিথেয়তার প্রমাণও পুরিস্ফুট। জমিদারের নায়েব প্রথম দর্শনেই মহুয়ার প্রেমে পড়ে। মহুয়াও তার প্রতি সমভাবে আকৃষ্ট হয়। সে নিজেদের আলয়ে নদেরকে নিমন্ত্রণ জানায়, যা পালায় এভাবে বর্ণীত হয়েছে: ‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা- জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা- সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরি কলা- ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।’ পালার এই স্তবক এ দেশের সনাতন সমাজের লোকজ খাদ্য দিয়ে হাজার বছরের আতিথেয়তা প্রকাশ করে, যা আজও গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান।

তৎকালীন বেদে সমাজের নারীরা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিষ অথবা ধারালো অস্ত্র সঙ্গে রাখত। পালার বিভিন্ন পর্বে তার বিবরণ পাওয়ায়। এ ছাড়া বিষের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যা বেদে সমাজে সে-সময়ে ছিল, এখনো আছে এমন তথ্য প্রমাণিত। এই পালায় তক্ষকের বিষ অস্ত্র হিসেবে বিবৃত হয়েছে যখন মহুয়া তাকে অপহরণকারী সওদাগরের মাঝি-মাল্লাদের বানিয়ে দেওয়া পানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেয়। এখানে দুটি দৃশ্যকল্প অবলোকন করা যায়। প্রথমত, বেদেকন্যা নিজের কাছে গোপনে বিষ রাখত। দ্বিতীয়ত, তারা সেই যুগে, এমনকি বর্তমানেও কথার জাদুতে মানুষকে মোহাবিষ্ট করতে পারে। তাই তো দেখা যায়- যারা তাকে অপহরণ করেছে, তার নাটকীয় কথার মাধুর্যে মোহাবিষ্ট হয়ে তারই সাজিয়ে দেওয়া পান খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বেদে সমাজে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া মাত্রই বিশেষত নারীরা পান খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা এখনো বিদ্যমান। 

গোটা পালা নিবিড় অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, এই পালার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজচিত্র, যা পৌনে চার শ বছর পর আজও শুধু বেদে সমাজ নয়, বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান। রক্ষণশীল সমাজের বেদেকন্যা মহুয়া সুন্দরী ও জমিদারের দেওয়ান সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদের ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন ধর্ম এবং বিবাহ তথা সম্প্রদানের ব্যাপারে অভিভাবকের সিদ্ধান্তের প্রাধান্য। সে-যুগেও অভিভাবকের সিদ্ধান্তের বাইরে যুবক-যুবতী প্রণয়াসক্ত হতো, যা এই পালায় বিবৃত হয়েছে। তবে কোনো বাধাই দুজনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দুজনে আত্মাহুতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে ভালোবাসা শাশ্বত। এমন চিত্র বাংলার গ্রামীণ সমাজই শুধু নয়, শহুরে সমাজেও এখন কদাচিৎ হলেও জানা যায়।  

হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদের প্রতি তার আদরের পালিত কন্যা মহুয়ার আসক্তি টের পেয়ে যায়। এই পর্যায়ে দেখা যায়, হুমরা বাইদ্যা ভাবে- কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাড়ির জমিতে ফসল উঠবে; ফসল তোলার টান, বাড়ির পুকুরের মাছ ধরার মৌসুম, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মহুয়ার গোপন প্রণয়ের আশঙ্কা- তাকে কিছু একটা করতেই হবে। বেদে দলে মহুয়ার সখা পালঙ্ক হুমরা বাইদ্যার নিষ্ঠুরতার আশঙ্কায় মহুয়াকে পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহ বাইরে বের না হওয়ার জন্য। ঠাকুরবাড়িতে সে পৌঁছে দেবে মহুয়ার মৃত্যুর খবর। মহুয়া রাজি হয় না, উল্টো ঠাকুরবাড়ির পানে চেয়ে চন্দ্র-সূর্য আর পালঙ্ক সখাকে সাক্ষী মেনে নদের চাঁদকে স্বামী বলে ঘোষণা করে। পালঙ্ককে বলে সে নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, অন্যথায় বিষপানে আত্মহত্যা করবে। হুমরা বেদে মহুয়ার অজান্তে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করে দলের অন্যদের সঙ্গে। হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদকে তক্ষকের বিষ প্রয়োগে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করতে বললে মহুয়া নদের চাঁদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালায় যা বলা হয়েছে: ‘আরে করে ঝিলিমিলি নদীর কূলে দিয়া, দুজনে চলিল ভালা ঘোড়া সুয়ার হইয়া’। 

ধর্মীয় বিশ্বাস, বাদ-মতবাদ গীতিকা-রচয়িতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করেনি। জীবনবিরোধী সবকিছুই অস্বীকৃত হয়েছে এ কাব্যমালায়। মৈমনসিংহ গীতিকায় মূলত মুক্ত প্রেমের জয়গান বিবৃত হয়েছে। এ গীতিকার নারীরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে কখনো বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধেও জীবনসাথী বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিয়েছে, গৃহত্যাগ করেছে। এটা কোনোকালেই অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব ছিল না। যে কারণে বলা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকায় নারীর শক্তি, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান বিবৃত হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক
[email protected]

পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৩:১৫ পিএম
পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা
মো. সাখাওয়াত হোসেন

সম্প্রতি ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে এক পুলিশ সদস্য কর্তৃক অন্য এক পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশে সৃষ্ট অস্থিরতা ও সংকট নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যম না যতটুকু তার থেকে কয়েক কাঠি এগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে কনস্টেবল কর্তৃক কনস্টেবল হত্যায় অনেকেই সন্তুষ্টির ঢেঁকুড় তুলেছে। এই যে পুলিশকে নিজের করে না ভাবা, পুলিশের দুঃসময়ে পাশে না থাকা, পুলিশকে মানসিকভাবে সমর্থন না করা ইত্যাদি বিষয়ে এক ধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের মধ্যকার যেকোনো ধরনের নেতিবাচক সংবাদে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার একটি ব্যতিক্রমী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো পুলিশ সদস্যদেরও অজানা নয়। অথচ যখনই কোনো সংকটের মুখোমুখি হই কিংবা কোনোভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত বা আমাদের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে কেউ ক্রোক করে এবং অপরাধীদের দ্বারা কোনোরকম ভয়ভীতি প্রাপ্ত হলে আমরা তৎক্ষণাৎ পুলিশের দ্বারস্থ হই। তদুপরি পুলিশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচার ও সৃষ্টকরণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। 

খবরে জানা যায়; রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি পুলিশ কনস্টেবল কাওসার আহমেদের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। কাওসারের স্ত্রী নিলুফারের ভাষ্যে; কাওসারের দুই সন্তান আছে। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। সংসারে কোনো ঝামেলা বা কলহ ছিল না। তবে তিনি জানান, ‘কাওসারের মানসিক সমস্যা ছিল। রাঙামাটির বরকলে চাকরি করার সময় তিনি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত তিনবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল। নিয়মিত ওষুধও সেবন করতেন। কাওসারের কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে। সংসারে কোনো অভাব-অনটন ছিল না। তবে চাকরি নিয়ে খুবই টেনশন করেন তিনি। ছয় ঘণ্টার ডিউটি আট ঘণ্টা হতো।’

ইংল্যান্ডে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৩০ জন মানসিক সমস্যায় ভোগেন- গবেষণা জরিপে এমন তথ্যের আভাস পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষ যেহেতু তাদের সদস্যদের মানসিক সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেছে কিংবা উদ্যোগ নিয়েছে তাহলে সমস্যা-পরবর্তী সমাধানের আভাসও পাওয়া গেছে। ইংল্যান্ডের মতো দেশে; যে দেশে পুলিশ পাবলিকের একটি চমৎকার সম্পর্ক বিদ্যমান, সেই দেশে পুলিশ সদস্যদের একটি বড় অংশের মানসিক সমস্যার উদাহরণ একটি বড় প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে আমাদের। বাংলাদেশ পুলিশ কি আদৌ তাদের সদস্যদের মানসিক অবস্থানকে তুলে ধরার কিংবা যাচাই করার কোনোরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে? অন্যান্য দেশে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ে প্রত্যেক ইউনিটে আলাদা করে সেন্টার স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার বিষয়ে সেন্ট্রালি পুলিশ হাসপাতাল রয়েছে, যেটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল এবং ইউনিট কিংবা রেঞ্জভিত্তিক চিকিৎসা সেন্টার কিংবা ডাক্তারদের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার তেমন ব্যবস্থা নেই। 

বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের চাকরিতে নানা রকমের চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান চাপকে মোকাবিলা করেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তথাপি এ ধরনের পেশাগত চাপকে ব্যবহারিকভাবে প্রশমনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সঙ্গত কারণেই পেশাগত প্রতিকূলতার আকার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি অঘোষিত নেতিবাচকতাকে সব সময় পুলিশ সদস্যদের মোকাবিলা করতে হয়। বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের পেশাগত চাপকে মোকাবিলা করতে বিশেষ ধরনের সাপোর্ট সেন্টার নেই। সাধারণত পুলিশ সদস্যরা যে ধরনের চাপকে মোকাবিলা করে থাকেন তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

প্রথমত, পুলিশের চাকরিতে সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। সবসময়ই পুলিশকে সজাগ থাকতে হয়, কখন কোন নির্দেশনা চলে আসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে; এ ধরনের একটা তাড়না সবসময়ই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থাকে। আমরা সবাই জানি, জরুরি যেকোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের সব ধরনের ছুটিও বাতিল হয়ে যায়। পুলিশের মূল কাজই হচ্ছে জনসাধারণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং জনগণের সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া। জায়গা থেকে পুলিশে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সারা দেশে ঈদের ছুটিকে সামনে রেখে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং হলফ করে বলা যায়, এ ইউনিটের সদস্যদের অধিকাংশ ঈদের ছুটি থেকে দায়িত্বের কারণে বঞ্চিত হন। 

দ্বিতীয়ত, সিনিয়র, জুনিয়র ও ব্যাচমেটদের সঙ্গে নানা বিষয়ে সম্পর্কের ঘাটতি একজন পুলিশ সদস্যের মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে থাকে। বিসিএস অফিসারদের মধ্যে এমন দেখা যায়, কোনো এক ব্যাচের কর্মকর্তা ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন আবার ওই একই ব্যাচের কর্মকর্তা এখনো এসপি হতে পারেননি। এমন নজির ও উদাহরণ বাংলাদেশ পুলিশে রয়েছে। এ ব্যাপারগুলো একজন অফিসারকে মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে ফেলে রাখে, ফলে পুলিশিংসহ অন্যান্য কাজে তার একটি নমুনা পাওয়া যায়। পুলিশের অভ্যন্তরীণ পদোন্নতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়গুলোকে সামনে রেখে একই ব্যাচের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ ও মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায়, জুনিয়র বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বিশেষ করে ছুটি ও কর্মঘণ্টা ইত্যাদি বিষয়ে। উপরন্তু আলোচনার জায়গা থেকে ব্যাচভিত্তিক ও রেঞ্জভিত্তিক সুযোগ-সুবিধার রকমফেরের কারণে মানসিক ট্রমার মধ্যে থাকেন অনেকেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পুলিশের পারফরম্যান্স ও মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবান্বিত করে থাকে। 

তৃতীয়ত, একঘেয়েমি কাজ। নিয়মিত একই কাজে অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিরক্তিবোধ চলে আসে। সে কারণেই কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এমনও দেখা যায়, কেউ সরাসরি পেট্রোল নিয়ে ব্যস্ত আবার অনেক পুলিশ সদস্য অফিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ আছেন একই রেঞ্জ কিংবা একই ইউনিটে দীর্ঘদিন কাজ করায় তার কাজের মান ও কাজের ধরনে উন্নতি না হয়ে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে আসছে। এ বিষয়গুলোকে সমন্বয়ে করে পোস্টি ও পদায়ন করা জরুরি, তা না হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের কাজের মানে তেমন তারতম্য দেখা যাবে না। 

চতুর্থত, পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা। দীর্ঘদিন ধরে নেতিবাচক ধারণার ব্যাপারটি পুলিশের মনে ও মগজে গেঁথে আছে এবং এ ব্যাপারগুলো পুলিশ কর্তৃক ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশের হাজার ভালো কাজ থাকলেও নেতিবাচক কাজটিকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পুলিশ একটি মানসিক অশান্তি নিয়ে দিনাতিপাত করে। বিপদে-আপদে পুলিশের সাহায্যের দ্বারস্থ হই এবং পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাই কিন্তু মূল্যায়নের সময় পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার লক্ষ্য নিয়েই যেন আমরা মতামত দিয়ে থাকি। এ ব্যাপারগুলো পুলিশ সদস্যদের গোচরীভূত এবং দায়িত্ব পালনের সময় উল্লিখিত বিষয়গুলো তাদের ট্রমার মধ্যে রাখে, যা পারফরমেন্সে প্রভাব ফেলে।  

পঞ্চমত, পদোন্নতি, বদলি ও পদকপ্রাপ্তিতে বৈষম্য ইত্যাদি কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে। পদোন্নতি নিয়ে সংস্থাটির বাইরে সরাসরি কোনো সদস্য কথা না বললেও তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও অভিমান বিরাজ করে। কমিউনিটিতে পরিচয় ও প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে দেয় পদোন্নতি সংক্রান্ত ইস্যুগুলো, সে কারণেই পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এ ব্যাপারগুলো সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের পারিবারিক ও কর্মময় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। 

ষষ্ঠত, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণে স্বাধীনতা হরণ করা হয়, এ ধারণা রয়েছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের। এ দোদুল্যমান অবস্থা থেকে পুলিশের অনেকেই বের হয়ে আসতে চান। পুলিশকে সংস্কারের ব্যাপারে প্রায় সবাই মতামত দেন। তথাপি কেন, কীসের জন্য পুলিশের সংস্কার আটকে গেছে, সেটি খুঁজে বের করে দ্রুততর সময়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে পুলিশের পারফরম্যান্স আশাব্যঞ্জক হবে নিশ্চিতভাবেই। আমরা মনে করি ও বিশ্বাস রাখি, পুলিশকে যদি আমরা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারি তাহলে পুলিশের কাছ থেকে আরও ইতিবাচক ও প্রো-অ্যাকটিভ কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা করতে পারি। যেমনটি দেখেছিলাম করোনার সময়ে। সর্বোপরি পুলিশের সংকটগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করে সামনের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা অচিরেই সমাধান হয়ে আসবে।
    
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

নতুন শরণার্থী গ্রহণের চাপ রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর করবে

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৪, ০৪:২২ পিএম
আপডেট: ২৯ জুন ২০২৪, ০৪:২২ পিএম
নতুন শরণার্থী গ্রহণের চাপ রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর করবে
কামাল উদ্দিন মজুমদার

রাখাইনে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মি এর মধ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ আরও রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য তীব্র চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। আনুমানিক ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নাফ নদীর একটি এলাকায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের অধিকার অফিসের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেন। মায়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত থমাস অ্যান্ড্রুস বাংলাদেশ সরকারের কাছে "তার বন্ধ সীমান্ত নীতি প্রত্যাহার করতে" এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মানবিক সমর্থন আবারও প্রদর্শন করার জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়ভাবে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে যে, তারা ইতোমধ্যে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আতিথ্য করেছে এবং আর গ্রহণ করতে পারবে না।

ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক ঘটনাগুলোর ভিড়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে  বসবাস করা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুর্দশার দিক থেকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। মায়ানমার থেকে সমস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য তারা এখনও কোনও দৃঢ় পদক্ষেপে নিতে পারেনি। তারা শুধু মুখে মুখে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মায়ানমারে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকদের প্রত্যাবর্তনের বার বার আশ্বাস দিলেও গত প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও স্বদেশে ফেরাতে পারেনি। 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং অধিকার গোষ্ঠীগুলোকে বুঝতে হবে যে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পারে না বা নতুন কোনো অনুপ্রবেশের অনুমতি দিতে পারে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকার করে যে- রেশনের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সহিংসতা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা জোরপূর্বক নিয়োগ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন ও মঙ্গলকে হুমকির মুখে ফেলেছে। একইভাবে তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে নতুন শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করা রোহিঙ্গারাদের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলময় হবে না। 

পুরনো সমস্যা, নতুন চ্যালেঞ্জ  
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, আর কোনো রোহিঙ্গা বা মায়ানমারের নাগরিককে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। গত কয়েক দশক ধরে এখানে স্থানান্তরিত হওয়া দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বিশাল বোঝায় পরিণত হয়েছে। তাই মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের কোনো নতুন আগমনকে তা বাংলাদেশের জন্য হবে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। 

শরণার্থীদের স্থায়ী আবাসস্থল খুঁজে বের করার কোনো সমাধান না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ১৯৮০ এর দশক থেকে বয়ে বেড়ানো বোঝা আর বইতে রাজি নয়। দাতারা ২০২০ সালে প্রয়োজনীয় তহবিলের মাত্র ৬০ শতাংশ দিয়েছিল, যা ২০২২ সালে ৪৯ শতাংশ ও ২০২৩ সালে প্রায় ৫১.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

আন্তর্জাতিক সাহায্য হ্রাসের ফলে বাংলাদেশ প্রতি বছর রোহিঙ্গাদের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল আর্থিক বোঝা বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য ঋণ চাইতে বাধ্য করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশচ প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-এর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ঋণ চেয়েছিল - যার মধ্যে ৫৩৫ মিলিয়ন ঋণ এবং ৪৬৫ মিলিয়ন অনুদান রয়েছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কীভাবে আরও রোহিঙ্গাকে স্বাগত জানাবে! 

রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ শুধু আর্থিক সীমাবদ্ধতাই নয়, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ঝুকিতে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বিশেষ করে যুবকরা যারা সশস্ত্র সংগঠন এবং অপরাধচক্রে যোগদান করেছে, তারা অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, স্বর্ণ চোরাচালান এবং অন্যান্য অপরাধে জড়িত হওয়ায় শরণার্থী শিবিরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই আবার এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ জঙ্গি গোষ্ঠীর দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে এগুলোই জড়িয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫০০টিরও বেশি অপহরণ এবং ১৮৬টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা ও রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি বিশাল আর্থিক চাপ তৈরি করছে।

এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে স্থানীয়দের সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটছে। বাংলাদেশ এখন এমন একটি ফাঁদে আটকা পড়েছে যে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারে না, যেখানে তারা আরও রক্তপাতের সম্মুখীন হতে পারে। আবার তারা স্থানীয়দের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের জন্য উপযোগী পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারছে না। সুতরাং, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যেটি কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামান্য সহায়তায় কয়েক হাজার শরণার্থীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আবাসন দিয়ে আসছে, বার বার এটি করেই যাবে আর অন্যরা চুপচাপ দেখে যাবে তা আশা করা কপটতা ছাড়া আর কিছু নয়।  

চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে বাংলাদেশ বারবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে, তবুও প্রত্যাবাসনের আন্তর্জাতিক কোনো অর্থবহ ও আপাত প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। গত প্রায় আট বছরে, উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহায়তার পরিবর্তে শুধু ফাকা বুলি ও বিবৃতিই দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, উন্নত দেশ, যাদের বিশাল ভূমি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব কম, তারা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ কমানোর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারে। তাছাড়া, তারা মায়ানমার কর্তৃপক্ষ বা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর প্রদান করতে চাপ দিতে পারে যাতে তারা বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য না হয়। 

যেহেতু রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি গুরুতর এবং আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে পুনরায় সংঘর্ষের কারণে প্রত্যাবাসনের আপাত কোনো লক্ষন নেই, তাই বাংলাদেশে অবস্থান করা ১ দশমিক ৩ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার জীবন টিকিয়ে রাখা দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অভিবাসীদের গ্রহণ করতে বাংলাদেশকে বাধ্য করার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত দ্রুত আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি সংকটের দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হওয়া। 

লেখক: গবেষক
[email protected]

ভাষা আন্দোলনের মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব গাজীউল হক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৪, ১২:১৪ পিএম
আপডেট: ১৭ জুন ২০২৪, ১২:১৬ পিএম
ভাষা আন্দোলনের মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব গাজীউল হক
আ ন ম গাজীউল হক

ভাষা সৈনিক আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হক, যিনি আ ন ম গাজীউল হক নামে পরিচিত। আজ ১৭ জুন তার ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ১৪৪ ধারা অমান্যকারীদের অন্যতম ছিলেন আ ন ম গাজীউল হক।

আ ন ম গাজীউল হক ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, গীতিকার এবং ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন।

আজ ১৭ জুন। এই দিনটি আমার জন্য একটি কষ্টের দিন। এই দিনে ২০০৯ সালে হারিয়ে ফেলেছি, আমার অভিভাবককে। যিনি আমার পিতা। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক আমতলার জনসভায় সভাপতির আসনে থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যাঁর জীবনের অনেকটা বছর কেটেছে অন্ধকার কারাগারে। যিনি বাংলা ও বাংলা ভাষা নিয়ে তৃণমূল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে সরাসরি জড়িত থেকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় অধিষ্ঠিত করেন এবং সুপ্রিম কোর্টে বাংলা ও বাঙালির মায়ের ভাষা চালু জন্য লড়াই করেন। 

লড়াকু ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বগুড়ার হাইকমান্ড (সমর) নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৪৭, ১৯৪৮ ,১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও পরবর্তীতে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দলনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। 

৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের মধ্যে শুধু অন্যতমই নন বরং এই সিদ্ধান্ত আ ন ম গাজীউল হক ঘোষণা করেন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রায় ১২টার দিকে ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মাঝখানে যে পুকুর আছে তার পূর্ব ধারের সিঁড়িতে বিভিন্ন হলের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের নিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এবং ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসুচি স্থির করার জন্য যে ১১ জনের বৈঠক হয়, সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পরের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় যে সভা অনুষ্ঠিত হবে তার সভাপতিত্ব করবেন আ ন ম গাজীউল হক।

যে ১১ জন ছাত্রনেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন- আ ন ম গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমেন, এস এ বারী এটি, এম আর আক্তার মুকুল, কামরুদ্দিন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, আনোয়ার হোসেন ও মন্জুর আহমদ।

তার লেখা গান ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গেয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত প্রভাতফেরি করা হতো।

ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি (পহেলা ফাল্গুন) ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে। তার বাবা হযরত মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং একজন সুফী সাধক। মায়ের নাম নূরজাহান বেগম। পড়াশুনা শুরু করেন মক্তবে। পরে কাশিপুর স্কুলে ভর্তি হন।

সে সময় চলছিল খেলাফত আন্দলন। তখন তিনি তৎকালীন স্থানীয় থানার জোকোভিচ পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর জন্য অবশ্য তাকে চার ঘন্টা জেল খাটতে হয়েছিল।

কাশিপুর স্কুল থেকে তিনি উচ্চ প্রাইমারি বৃত্তি লাভ করেন। এই স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি শিক্ষক সুরেন বাবুর সান্নিধ্যে এসে দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন। ১৯৪১ সালে তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনিতে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে এই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপরই তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে আইএ ভর্তি হন।

কলেজের অধ্যক্ষ ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্যারের সংস্পর্শে এসে বাম রাজনীতিতে আসেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং ওই বছরই কুষ্টিয়ার নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কনফারেন্সে যোগ দেন।

তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, গীতিকার এবং মহান ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি বগুড়ার হাই কমান্ড (সমর) নিযুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত তিনি বগুড়াকে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত রাখেন। ভাষা আন্দোলনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে গাজীউল হক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন এই ভাষাযোদ্ধা বহুবার কারাবরণ করেছেন।

ভাষার জন্য দেশ যখন উত্তাল তখন ছাত্রাবস্থায় তিনি নেতৃত্ব দেন বগুড়ায়। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা পালন এবং ৪ মার্চের সভায় সভাপতিত্ব করে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন তিনি।

গাজীউল হক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় ঐতিহাসিক সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা করেন।

অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কণ্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্সের ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামে তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত, শফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকের সঙ্গে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন।

২৩ ফেব্রুয়ারি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাজীউল হক পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। বগুড়ায় এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার আলতাফুন্নেছা মাঠে তার গায়েবানা জানাজাও পড়ানো হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনার আগেই এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

পরবর্তীতে আন্দোলনের কারণে গাজীউল হকের বিরুদ্ধে জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হলে তিনি এম এ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। ১৯৫৩ সালে ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি চার বছরের জন্য বহিষ্কার হন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর এম এ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরবর্তীতে ছাত্র আন্দোলনে চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গাজীউল হকের এম এ ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

শুধু ভাষা আন্দোলনে এই মহান সেনানী অবদান রাখেননি, পরবর্তী সব অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় সংগ্রামে গাজীউল হক অংশ নিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে।

১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪’র সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯’র গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে সরাসরি অংশগ্রহন করেন।

তাঁকে পাওয়া গেছে ১৯৮০’র দশক জুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি অংশ নিয়ে বগুড়ার মুসলিম লীগকে শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করেন এবং কাগমারী সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে আওয়ামী লীগের সর্বাঙ্গীন প্রতিকূলতা প্রতিরোধে মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

তিনি এপ্রিল মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বগুড়াকে হানাদারমুক্ত রাখেন। হিলিতে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৭ সালে আইনজ্ঞ সৈয়দ নওয়াব আলীর অধীনে বগুড়া বারে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পূর্বপাকিস্তান ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসার সনদ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে যোগদান করেন। সর্বোচ্চ আদালতে একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন।

গাজীউল হক তাঁর সৃজনশীলতার অনেক স্বাক্ষর রেখেছেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯টি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম লেখা বই ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ‘আমার দেখা আমার লেখা’ এবং বাংলাদেশ আনচেইনড যা এখন মালয়েশিয়ার মোনাস ও লন্ডনে অক্সর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য গাজীউল হক ছিলেন আপোষহীন। ‘উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন’ বইটিতে তিনি সে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন।

২০০৯ সালের ১৭ জুন বিকালে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ করেন। পরে তাঁকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দিনটি আমার জন্য এতটাই কষ্টদায়ক যে আমি তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান হয়েও আমার পিতার স্মৃতি রক্ষায় কোনো কিছুই করতে পারিনি। আমার এবং আমাদের পরিবারের একটাই আশা তাঁকে শুধু তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া হোক। আমার বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন। তাঁর জন্য আমাদের চির শ্রদ্ধা।

অমিয়/

পাহাড়ের কান্না থামানো যাচ্ছে না

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৪, ০৪:৩৮ পিএম
আপডেট: ১৫ জুন ২০২৪, ০৪:৩৮ পিএম
পাহাড়ের কান্না থামানো যাচ্ছে না

প্রকৃতির নিয়তির কাছে পাহাড়ের মানুষগুলো বড় অসহায়। ফের পাহাড়ে একই পরিবারের তিনজন মাটিচাপা পড়ে মারা গেলেন। বড় ধরনের দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। চামেলীবাগে মাসাধিকাল ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাতের দরুন চামেলীবাগের টিলা ধসের অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। পাহাড় ধসের সময় ছিল না কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তারপরও পাহাড় ধসে একই পরিবারের তিনজন চাপা পড়ে অকালে চলে গেলেন। 

প্রতি বছরই এরকম ঘটনার অবতারণা ঘটছে। তাহলে তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? পাহাড়ের কোন অঞ্চল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ তা প্রশাসন চিহ্নিত করেছেন। তাহলে সেখানে বলিষ্ট এবং শক্ত ভূমিকা কেন নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ সরল প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়। 

একটি ঘটনা পর আমাদের টনক নড়ে। কিছুদিন তা বহাল থাকে। আবার সবকিছু আগের নিয়মে চলতে থাকে। এভাবে আমরা পাহাড়ের অনেক বোবা কান্নার সাক্ষী হয়েছি। সামনের দিনগুলো আমাদের প্রকৃতির ভয়াবহ তাণ্ডব মোকাবিলা করেই পাহাড়ে জীবনযাপন করতে হবে। তাহলেই কি আমরা এভাবেই পাহাড় চাপা পড়ে মরব? 

পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হলো পাহাড় কেটে আমরা নগ্ন করে ফেলেছি। ফলে সে এখন দাঁড়াতে পারছে না। পাহাড়ের অবকাঠামোগত আবরণ বিনষ্ট করায় প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে মাটি ধরে রাখা পাহাড়ের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। আমারা নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় উজাড় করে ফেলেছি। গাছের শিকড় মাটি শক্ত করে ধরে রাখার কাজটি করে যেত। গাছ কেটে ফতুর করায় পাহাড় তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। 

একেকটি পাহাড় ধরিত্রীর জন্য খিলান স্বরূপ। পাহাড়ের মাটি এবং গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাত এবং ভূমিকম্পে মাটি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় প্রবল ভূমি ধসে পাহাড়ের মাটি গলে নিচে দিকে নামতে থাকে। কিছু লোভী মানুষ পাহাড়ের পাদদেশের জায়গা দখল করে সেখানে নিম্নআয়ের মানুষের কাছে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকে। এভাবে একসময় খেটে খাওয়া মানুষগুলোর নীরব মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।

২০০-৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই ভূমি ধসের জন্য যথেষ্ট। সেখানে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে ২০০৭ সালে ৯৫০ মিলিমিটার পর্যস্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। চামেলীবাগের টিলা ধসে একই পরিবারের চারজন চাপা পড়েছিল। একজনকে তাৎক্ষণিক উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। 

টিলা ধসের পেছনে রয়েছে এক নির্মম ও ভয়ানক তথ্য। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি টিলা দখল করে তা সমতল ভূমি বানানোর জন্য টিলার গায়ে সরু নালা কেটে রেখেছেন যাতে বৃষ্টিপাত হলে উপরের মাটি ধীরে ধীরে গলে পাদদেশে পড়ে। টিলা সরকারি সম্পদ হওয়ায় তা দখল করা একটু কষ্টসাধ্য। তার দরুন টিলার শ্রেণিই তারা মুছে দিতে চান। এভাবেই সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় টিলার মাটি ব্যাপকভাবে ধসে পড়ে। এতেই হতাহতের ঘটনা ঘটে। 

চাপা পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ছয় ঘণ্টা লেগেছে। মানুষ এভাবে আরও ১১টি পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানানোর সব আয়োজন করে রেখেছেন। নগরীর ব্রাহ্মশাসন, দুসকি, হাওলাদারপাড়া, মেজরটিলা, খাদিমতলা, মালানীছড়া, বালুরচর, চন্দ্রসটিলাসহ অন্তত ৩০টি স্থানে টিলার পাদদেশে হাজার হাজার মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। তাছাড়া বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার টিলায়ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক স্থানে সতর্কবার্তা হিসেবে লাল নিশানা টাঙিয়ে রাখার পরও তাদের সচেতন করা সম্ভব হচ্ছে না। 

বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সিলেট এলাকা এবং দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি কক্সবাজারে পাহাড় রয়েছে। তবে বৃহত্তম চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮০৯ বর্গমাইল বিস্তৃত এলাকাই মূলত পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে ঘনবসতি এবং মানুষের বিচরণ বেশি সেসব পাহাড় টিলাতেই দুর্যোগ-দুর্বিপাক বেশি ঘটছে। এ এলাকার বান্দরবান ও আলীকদম উপজেলায় দুর্যোগপূর্ণ বেশি। এর মধ্যে লামা উপজেলার হরিণমারা, চিউসিমারা, ফাইতং, তেলুনিয়া, জামালিয়া, কামিয়াখালী ও রূপসী এলাকা। লামা পৌর এলাকার হাসপাতালপাড়া, লুনারবিল, কুড়ালিয়ার টেক, টিএনটি পাহাড় এবং আলী কদম উপজেলার ক্রপ পাতা, পোয়ামহরী, আমতলী ও বাবুপাড়া সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। 

তাছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৩টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম জেলার মহানগরীতেও ১৩টি পাহাড়কে ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, জালালাবাদ পাহাড়, নবীনগর পাহাড়, হামজারবাগ, দেব পাহাড়, কুমবাগ পাহাড়, গোল পাহাড়, কৈবল্য পাহাড়, খুলশী পাহাড়, বার্মা কলোনী পাহাড়, হিলভিউ পাহাড়, জামতলা পাহাড়, এনায়েত বাজার পাহাড় ও বাটালী হিল পাহাড় অন্যতম। 

তাছাড়া কক্সবাজার শহরে পাহাড় কেটে কতগুলো অবৈধ বাড়ি তৈরি করা হয়েছে সরকারি দপ্তরে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। পরিবেশবাদী সংগঠন এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের হিসাবে, জেলার ১১ কিলোমিটার আয়তনের ছোট-বড় ৫১টি সরকারি পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে ৬৬ হাজারের বেশি বাড়ি। কয়েকতলা বিশিষ্ট রয়েছে ৫ হাজারের বেশি। আধা পাকা রয়েছে ৮ হাজার এবং বাকিগুলো সব বাঁশের বেড়া, ত্রিপল দিয়ে তৈরি বাড়ি। এসব বাড়িতে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে । 

এসব এলাকায় গত ১৫ বছরে শতাধিক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। উচ্চ আদালতে নিষেধাজ্ঞা থাকার পর ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস থেকে মানুষকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না। তার কারণ, খেটে খাওয়া গরিব মানুষ শহরের ভাড়া দিয়ে কুলাতে পারে না। অল্প আয়ের মানুষই মূলত পাহাড়ের পাদদেশের ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছেন। 

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগে মেরং রেঞ্জের ৫ হাজার ৮৯৯ দশমিক ৬২ একর, হাজাছড়া রেঞ্জের ১২ হাজার ৩৫০ একর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের নাড়াইছড়ি রেঞ্জের ৫৪ হাজার ১১২ একর বনাঞ্চলে গাছ নেই বললেই চলে। ১৯৮৬ সালে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বনাঞ্চল থেকে রেঞ্জ কার্যালয় গুটিয়ে নেওয়ায় এসব বনের অধিকাংশ গাছ দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায়।

বাংলাদেশের পাহাড় ধসের সবেচেয় বড় কারণ বোধ করি পাহাড় কর্তন। গত তিন দশকে কেবল চট্টগ্রামে তিন শতাধিক পাহাড় কাটা পড়েছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে পার্বত্য চটগ্রাম ও কক্সবাজারে। শুধু দুটি কারণে পাহাড় কাটা হচ্ছে। প্রথম মাটি কেটে ইটভাটায় ব্যবহার। দ্বিতীয় প্লট তৈরি করে বসত নির্মাণ। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বড় বড় ডেভেলপার কোম্পানি জড়িত। আর এই প্লট ও ফ্ল্যাট ব্যবসায় নির্বিচারে অনুমোদন দিয়ে কর্তৃপক্ষ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। 

চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার এ মহোৎসব চলছে মূলত খুলশী লাল খান বাজার, পাচলইশ, বায়েজীদ বোস্তামী, ফয়সলেক, পাহাড়তলী, কাটলী ও ভাটিয়ারীকে ঘিরে থাকা পাহাড়ে। অপরিকল্পিতভাবে এসব পাহাড়ের পাদদেশ কেটে ফেলার কারণে তা দুর্বল হয়ে যায়। বর্ষার পানি উপরে আটকে যায়। এ সময় শো শো শব্দে প্রবলবেগে তাতে ধস নামে। ২০০৭ সালে পাহাড়ে মহাবিপর্যয়ের পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ২৮টি কারণ এবং ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই। সেটি কার্যকর করা হলে পাহাড় ধসের পরিমাণ অনেক কমে যেত। 

পাহাড় ধসের ২৮টি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো- ভারী বর্ষণ, বালুর আধিক্য, পাহাড়ের উপরি ভাগে গাছ না থাকা। গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকির্পূণ বসবাস, বৃষ্টিপাতের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করা অপরদিকে ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে ছিল জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন করা, গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ও শক্ত করে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা, পাহাড়ের পানি ও বালু অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বসতি স্থাপন টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালু উত্তোলন না করা, পাহাড় এলাকার ১০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প করতে না দেওয়া, মতিঝর্না এবং বাটালী হিলের পাদদেশে বসতি স্থাপন উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, পাহাড় কাটার জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি এ ক্ষেত্রে। আর তাতেই মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। গত কয়েক দশকে হাজারের মতো মানুষের প্রাণ গেছে পাহাড় ধসের ঘটনায়। এ মধ্যে ১৯৯৬ সাণে ৭ জন, ১৯৯৭ সালে ৭ জন, ১৯৯৯ সালে ৩ জন, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ৫ জন, ২০০৫ সালে ৩ জন, ২০০৬ সালে ২ জন, ২০০৭ সালে ১২৭ জন, ২০০৮ সালে ১৩ জন, ২০০৯ এবং সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ৫৬ জন, ২০১১ সালে ১৩ জন, ২০১২ সালে ৯০ জন, ২০১৫ সালে ১৯ জন, ২০১৭ সালে ১৮০ জন, ২০২৩ সালে মারা গেছে ৪ জন। 

এ পরিসংখ্যান বলছে পাহাড় ধস হবে আর তাতে মৃত্যুর মিছিল বাড়বে। প্রশাসনিক কোনো দায় ও দায়িত্ব যেন এখান যেন অচল। ক্ষমতাবানরা পাহাড় কেটে বাড়ি তৈরি করবে। তাতে নিম্ন শ্রেণির মানুষ বসবাস করবে। আর প্রকৃতিক ধসে তাদের সমাধি ঘটবে। 

অলিউর রহমান ফিরোজ: সাংবাদিক
[email protected]