ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা: অস্তিত্বের সংকটে সমতলীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ০৪:৩৬ পিএম
আপডেট: ২২ মে ২০২৪, ০৫:৩২ পিএম
শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা: অস্তিত্বের সংকটে সমতলীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়
বিপ্লব বড়ুয়া

মহামানব গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে আড়াই হাজারের বছর পূর্বে যে শান্তি ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এই বিশ্বজগতে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটছে, বিশ্বব্যাপী তা এখন অন্যতম গবেষণার বিষয়। তৎসময়ে ভগবান তথাগত গৌতম বুদ্ধ হিংসা, শত্রু, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, সহনশীলতা, বৈরিতা, সুখ, দুঃখ, ভোগ, বিলাস থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে নিজে জয় করে মানবমুক্তির উদ্দেশ্যে মৈত্রী, শান্তি, সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে মানুষের জীবনমানে এক আমুল পরিবর্ত ঘটিয়েছিলেন। আজ তার বাণী ও দর্শন বিশ্বের জ্ঞান-ভান্ডারকে আলোকিত করেছে। 

তিনি কোনো ধর্মপ্রচারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবিক দর্শনের পুরোধা প্রবক্তা। যেটি নিজে আত্মস্থের মধ্য দিয়ে মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত দুঃখ নিপীড়িত জর্জরিত জীবন থেকে মুক্তির পথে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রক্ত মাংসের শরীরে গড়া মায়ের গর্বে জন্ম নেওয়া একজন অদ্ধিতীয় দৃশ্যমান ব্যক্তি মানবতার জয়গান গেয়ে মানুষের মনের গহীনে ঠাই করে নিয়েছেন। 

তিনি অলোকিকতা বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন। শোনা কথায় কান দিতে নিষেধ করেছেন। যাচাই-বাচাই করে ভাল লাগলে গ্রহণের কথা বলেছেন, খারাপ লাগলে ত্যাগ করার কথা বলেগেছেন। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন বলে গ্রহণ করতে হবে তারও সর্তকবাণী দিয়েছেন। প্রাণী হত্যা, মিথ্যা কথা, চুরি, ব্যভিচার, লোভ, স্বার্থপরতা, অন্যের ক্ষতিসাধন থেকে মুক্ত থাকার কথা যেমন তিনি বলেছেন, তেমনি বলেছেন শত্রুকে মৈত্রী দিয়ে জয় করার কথা।

কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী এখন ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা। নিরস্ত্র মানুষের সবলের প্রাণ সংহার, ধর্মের নামে মিথ্যার বসবাস। উগ্রবাদীদের প্রবল উন্মাদনায় সময়ে সময়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতি হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত। অন্য ধর্মের মতবাদীদের দোষ দিই কেন! যেখানে এখন খোদ নিজ সম্প্রদায়েরর লাল কাপড় পরিহিতি গুটিকয়েক ছদ্মনামধারী ধর্মগুরুরা যখন ধর্মের নামে রাজনীতি-ব্যবসা খুলে সন্ত্রাসীদের সাথে উঠাবসা করে, ধর্মালয়ে সাধারণ গৃহীদের গায়ে হাত তুলে, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধ্বংযজ্ঞ, নারীর শাড়ি টেনে খুলে ফেলে নোংরা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা গুজব রটিয়ে পুরো দেশও সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি খুন্ন করে এই সব ধর্মগুরুরা কোন আদর্শ বাস্থবায়ন করার পথে নেমেছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ নর-নারীর বোধগম্য নয়! 

যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে দিয়ে দেশকে বিশ্বের সামনে উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত করছে সে মুহুর্তে বৌদ্ধ উগ্রবাদী ধর্মগুরুদের এমন আস্ফালন দেশ ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র!

মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের দেবদেহ নগরের সীমান্ত অঞ্চলের লুম্বিনী কাননের উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন কপিলাবস্তু নগরীর রাজা শুদ্ধোধন। মায়ের নাম রাণী মহামায়া। সিদ্ধার্থের জন্মের সাতদিন পর মা মহামায়া ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুর পর কুমার সিদ্ধার্থকে কোলেপিঠে লালন পালন করে আপন সন্তানের মায়ায় বড় করে তুলেন সৎমা মহাপ্রজাপতি গৌতমী।

গৌতমী এমন স্নেহ-আদরে মানুষ করেন এ কথা সন্তান সিদ্ধার্থকে কখনো বুঝার সুযোগ দেয়নি। সংসারের প্রতি ছিল উদাসীন কুমার সিদ্ধার্থকে সংসার অনুরাগী করার জন্য ১৬ বছর বয়সে যশোধরা নামের সুন্দরী এক রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়। সিদ্ধার্থ-যশোধরা দম্পতির কোল আলো করে একটি সন্তান পৃথিবীতে আসে। ছেলের নাম রাখলেন রাহুল। 

এদিকে সংসারচক্রে উদাসীন ছেলে সিদ্ধার্থকে খুশি রাখতে পিতা রাজা শুদ্ধোধন চার ঋতুর জন্য চারটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। যেখানে পুত্রের মনোজগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবরকম সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন তাঁর পিতা। একদিন কুমার সিদ্ধার্থ রথে চড়ে নগর পরিভ্রমণের জন্য বের হন। ছেলের এমন মনোযোগে পিতা রাজা শুদ্ধোধন সারা কপিলাবস্তু নগরীতে সাধারণ মানুষদেরকে উৎসব করার নির্দেষ প্রদান করেন। বেশ কয়েকদিন ভ্রমণে বের হয়ে কিছু প্রশ্ন তাঁকে পেয়ে বসে। যে বিষয়গুলো রাজ সন্তানের জন্য কাঙ্খিত ছিল না।

প্রথম দিন পরিভ্রমণে বের হয়ে দেখেন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি জীর্নশীর্ন অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাফেরা করছেন। দ্বিতীয় দিন একজন অসুস্থ মানুষ রাস্তার ধারে কাঁতরাচ্ছেন। তৃতীয় দিন কিছু মানুষ এক মৃত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য তাঁর দৃষ্টি গোচরীভূত হয়। চতুর্থদিন একজন সন্ন্যাসীকে হেঁটে যেতে দেখে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা সারথীকে প্রশ্ন করেন- হে সারথি, এই চার দিন একে একে আমি রক্তমাংসে গড়া মানুষদেরকে যে অবস্থায় দেখলাম, তাদের জীবনটা এরকম হলো কেন? সারথি সিদ্ধার্থকে বললেন, ‘হে রাজপুত্র- জগত দুঃখময়’।

আরও বললেন, সংসারের মায়া-মমতা, রাজ্য, ধন-সম্পদ কোনো কিছুই চিরকাল স্থায়ী নয়। এই সুন্দর অবিনশ্বর পৃথিবী থেকে সবকিছু একদিন মুছে যাবে। আপনজন বলতে কোনো কিছুই থাকবে না। এইভাবে কুমার সিদ্ধার্থ দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে ২৯ বছর বয়সে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে পরিবারের সকলের অগোচরে গৃহ ত্যাগ করেন। পাহাড়-পর্বত, বনে-জঙ্গলে নীরব কোলোহল মুক্ত পরিবেশে দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনার পর ভারতের বিহার প্রদেশের বুদ্ধগয়া নামক স্থানে ৫৮৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ৩৫ বছর বয়সে বোধি বৃক্ষের নিচে বোধিজ্ঞান লাভ করে সম্যকসম্বুদ্ধ প্রাপ্ত হন। 

এরপর তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ ৪৫ বছর তাঁর অর্জিত জ্ঞান মানুষের কল্যাণে প্রচার করেছিলেন। তাঁর এই বাণী ও দর্শন পরবর্তীকালে নামানুসের একটি সার্বজনীন মনস্কতাপূর্ন ধর্মে পরিণত হয়। 

৫৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহামানব তথাগত বুদ্ধ আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশিনগর নামক স্থানে শালবৃক্ষের নীচে ৮০ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। 

পুরো পৃথিবীজুড়ে এই মহামানবের বাণী আজও সর্বজনীনভাবে সমাদৃত। 
 
আত্মশুদ্ধি, র্নিলোভ, নিরহংকর, ত্যাগময় জীবনের পথে উৎসর্গ করার সাধনাই হলো ধর্ম। কিন্তু বর্তমানে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি সম্পূর্ণ তার বিপরীত চিত্র। গত ৮ ও ৯ মার্চ ২০২৪ এবং এরপর ১১ মে ২০২৪ তারিখে একাধিকবার একশত আটত্রিশ বছরের প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে সংগঠিত অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দুটি বিবদমান গ্রুপের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং ঘটনা থেকে রটনার কীর্তিকলাপ, মারমার, কাটকাট অবস্থা যা দেখলাম তা রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। 

এর একটি পক্ষে হচ্ছে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি আর অপর পক্ষ হচ্ছে ব্যক্তি ভদন্ত ড. জিনবোধি ভিক্ষু। কেন এই তাণ্ডব ঘটানাে হলো এর উদ্দেশ্যই বা কি, সে বিষয়ে আমি ছোট্ট পরিপরে ঘটনার আলোকপাত করতে চাই। বিগত ১০/০৪/ ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের পুজনীয় শতবর্ষী অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত, বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু মহামান্য সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাথের, বিহার পরিচালনা কমিটির যৌথ সিদ্ধান্তক্রমে ড. জিনবোধি ভিক্ষুকে ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন ও  নিয়ম বহির্ভূত আচরণের জন্য বিহারের উপাধ্যক্ষ পদ থেকে অপসারণ করা হয়। জিনবোধি ভিক্ষু ১০/০৫/২০১২ সালে অপসারণ আদেশের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জজ আদালতে একটি মামলা করেন। 

দীর্ঘ দুই বছর দুই দিন পর অর্থাৎ ১২-০৫-২০১৪ তারিখ জিনবোধির করা মামলাটি আদালত তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করেন। কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ৯৯৫৭/২০১৬ সালে রিট আবেদন করলে ২৯/০৫/২০১৭ সালে আগের দেওয়া রায় বহাল রাখেন। ২৮/০২/ ২০২১ এবং  ১৭/০৭/২০২৩ সালে দুইবার আপিল আদালত তা খারিজ করে দেন। তারপর একের পর তিনি দীর্ঘ ১৩ বছরে অসংখ্য মামলা করেন বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। প্রথম ঘটনাটি  পুরো বৌদ্ধ সমাজকে ছাড়িয়ে সার্বজনীন সমাজে “ টপ অব দ্যা বড়ুয়া নিউজ”-এ পরিণত হয়। একইভাবে ঘটেছে শেষ ঘটনাটির ক্ষেত্রেও।

এ ঘটনায় কী এক পক্ষের দোষ? না উভয় পক্ষের দোষ? সমাজের নীতিনির্ধারণী মহলে এনিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। আমি কোনো পক্ষকে বড় করে দেখা বা দোষী সাব্যস্ত করা আমার লেখার প্রধান উপজীব্য নয়। এই চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার ব্যক্তি জিনবোধি কিংবা সংগঠন বৌদ্ধ সমিতি যেই পরিচালনা করুক সে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। আমার বিষয়বস্তু হচ্ছে অন্যখানে।

ড. জিনবোধি ভিক্ষু ও বৌদ্ধ সমিতি কেন তর্কে জড়ালো এবং তর্ক থেকে একজন মহিলার শাড়ি টানাটানি হলো, শাড়ি টানা রোধ করতে গিয়ে নারীর স্বামী ভিক্ষুকে স্ত্রীর হাতে থাকা পার্স দিয়ে প্রতিরোধ করে। জিনবোধি ভিক্ষু নিজের মুখে জুতা দিয়ে আঘাত করেছে বলে মিথ্যা প্রপাগান্ডা প্রচার করলে তাঁর কিছু ভিক্ষু অনুসারী পরবর্তীতে বৌদ্ধ বিহারকে পরিণত করে নরক কুন্ডুলিতে। 

দুইবারের ঘটনা পুলিশের সামনে সংঘঠিত হয়েছে। প্রথম দিনের অপ্রীতিকর ঘটনা কারো কাম্য ছিল না। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ সমাজের মান ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করি। আমরা যদি একটু সুক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখি ঘটনাটিকে সেদিন তাৎক্ষণিকভাবে কী মিটিয়ে ফেলা যেতো না? যদি প্রথমটি তাৎক্ষণিকভাবে মিটিয়ে ফেলা যেতো তাহলে পরের ঘটনাটি ঘটার কোনো সম্ভাবনা থাকতো না। দুটি ঘটনাই জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারী কিছু ধর্মান্ধ উগ্রবাদী উশৃঙ্খল ভিক্ষুদের কারণে সংঘঠিত হয়েছে বলে সাধারণ জনগণের ভাষ্য।

ভিক্ষুরা হবেন আত্মত্যাগী কিন্তু না ভিক্ষু সংঘের কাছ থেকে সামান্যতমও সংযম প্রদর্শন করতে দেখা যায়নি। রাগ-ক্রোধ মানুষকে যে কী রকম ভয়াবহ হিংস্ত্র করে তোলে তার জ্বলন্ত উদাহরণ পুরো বৌদ্ধ সমাজ এই তিন দিন স্বচক্ষে দেখেছে। যা বৌদ্ধ সমাজ একটি বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই ঘটনা উঠতি প্রজন্মের সন্তানদের বহু বছর ভোগাবে।

তথ্যসুত্রে জানতে পারি, ৮ মার্চ ২০২৪ তারিখ রাতে পুলিশ উভয়পক্ষকে ডেকে শান্তিশৃঙ্খলা বজার রাখার স্বার্থে পুলিশ দলগতভাবে বিহারে প্রবেশাধিকার নিষেধ করে। কিন্তু পরের দিন দুপুরে জিনবোধি ভিক্ষুর কিছু তরুণ ভিক্ষু ও গৃহী অতর্কিত বিহারে প্রবেশ করে যেভাবে আসবাবপত্র ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দিয়ে ধর্মীয় বই, বিহারের দলিল পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। 

এটা সত্য যে, এই বিষয়টিকে অনেকে ভাল চোখে গ্রহণ করেনি। কেন এরা এইরকম করল?  

প্রিয় পাঠক, আপনারা আমার মতের সাথে আপনাদের মতের মিল নাও হতে পারেন? পুলিশের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ড. জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারীরা বিনা বাধায় ৯ তারিখ যেভাবেই হোক বিহারে গেলেন তাতে কারো কোনো রকম আপত্তি নেই, কিন্তু ওইদিন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা যদি না ঘটাতো আপনাদের ওপর কারো আঙুল তোলার প্রশ্নই আসতো না। অতিউৎসাহীরা যে ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটালো তা সেদিন অন্যধর্মের হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।

ভিক্ষুরাই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালো ১১ মে ২০২৪ তারিখে। সেদিন বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দ প্রতিবছরের ন্যায় বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপন করার জন্য প্রস্তুতি সভার মিটিং আহ্বান করছিল। সেখানে বৌদ্ধ সমিতি ও বৌদ্ধ সমাজের অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবর্গরা যখন মিটিং করে এই ফাঁকে জিনবোধি ভিক্ষুর অনুসারী ভিক্ষুরা হামলা করে গৃহীদের রক্তাক্ত করে বৌদ্ধ বিহারকে রক্তে রঞ্জিত করে। 

ভিক্ষুরা যেখানে সাম্য মৈত্রী করুণার কথা বলবে সেখানে গৃহীদেরকে মেরে জখম করার এদৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। এনিয়ে মামলা হয়েছে। বৌদ্ধ সমিতির নেতৃবৃন্দরা তো আমাদের সমাজের মানুষ। কারো না কারো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রবীন ব্যক্তিত্ব। যাদের অর্থ-বিত্ত মেধায় বৌদ্ধ সমাজ এগিয়েছে সেইসব ব্যক্তিদের ওপর আঘাত! সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন ভিক্ষুদের মারমুখি চেহারাগুলো দেখছিলাম তখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেছে। 

তাহলে দেখুন, এই যে ফাটল দেখা দিলো তা দিয়ে কী লাভ হলো, কার লাভ হলো। জিনবোধি ভিক্ষুর, সমিতির না বৌদ্ধ সমাজের? ঘটনার পর তৃতীয় কোনো পক্ষকেও সংকট নিরসনে উদ্যেগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। উল্টো একের পর এক মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ছে। তাহলে বৌদ্ধ সমাজ কী এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে? 

বিবেকের কাছে একবার প্রশ্ন করুন, ঘটনাকে কেন্দ্র করে যারা যেভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তৎপরবর্তী যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছিল, মিছিল-মানবন্ধন করেছিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় অধিকাংশ ফেইক আইডি খুলে অশালীন ভাষায় গালাগাল ও সামাজিক ব্যক্তিত্বদের ছবিতে জুতার মালা, বিহার অঙ্গনে কুশপুত্তলিকা দাহ, টানানো, আগুন দেওয়া, ঝাড়ু ও লাথি মারা, ভিক্ষুরা গৃহী উপাসকদের মেরে রক্তাক্ত করে জখম এগুলো কি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাজ? 

যে ক্ষত সৃষ্টি হলো, সম্প্রদায়ের সম্মানে চুনকালি লাগল, এটির ক্ষত আগামী কত বছর পর্যন্ত বয়ে বেড়াবে কেউ চিন্তা করেছেন কি? এর দায়ভার কে নেবে? বৌদ্ধ সমাজ যে অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, করুণা মুদিতার কথা বলা হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ থেকে তার কোনো রকম অস্তিত্ব-নিশানা দেখতে পেলাম কী?

২০২৪ সালের বুদ্ধ পূর্ণিমার মহান দিন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন হবে তার গ্যারান্টি কোথায়? ঘোর এই অমানিশায় গ্রাস করা অস্তিত্বের সংকট থেকে সমতলীয় বৌদ্ধ সমাজকে বাঁচাবে কে? আর কতবার বৌদ্ধ বিহার অপবিত্র হবে। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে এই উগ্রবাদ ধর্মান্ধ রাহুর কবল থেকে রক্ষা করুন।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিষ্ট
[email protected]

দেশাত্মবোধ ও আন্দোলনের মৌলিকতা

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০১:৫৮ পিএম
দেশাত্মবোধ ও আন্দোলনের মৌলিকতা
এম আর লিটন

বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে দেশাত্মবোধ চেতনা একটি অপরিহার্য মৌলিক উপাদান। স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলন পর্যন্ত, দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধের ভূমিকা অতুলনীয়। তবে বর্তমান সময়ে কিছু আন্দোলন ও স্লোগান এমন দিকনির্দেশনার অভাবে সংকটে পড়েছে। যা আমাদের ঐতিহ্য ও দেশাত্মবোধের মূলগত বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

দেশাত্মবোধ চেতনা হলো একটি জাতির আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের স্লোগান ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ দেশপ্রেম ও মুক্তির অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। এ স্লোগান আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং জাতীয় গর্বের বহিঃপ্রকাশ ছিল। দেশে যেকোনো সংকট ও আন্দোলনের সময় ওই দেশাত্মবোধ চেতনা আমাদেরকে একত্রিত করে। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে।

আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে তার মৌলিক উদ্দেশ্য ও চেতনায়। একটি আন্দোলনের উদ্দেশ্য যতই যৌক্তিক হোক না কেন, যদি তা দেশাত্মবোধ চেতনায় সমৃদ্ধ না হয়, তাহলে সেই আন্দোলনের মৌলিক মূল্য কমে যায়। সাম্প্রতিক কোটাব্যবস্থা বাতিলের আন্দোলনে ‘রাজাকার’ স্লোগানের ব্যবহার উদ্বেগজনক ছিল। যদিও কিছু সময় পর আন্দোলনকারীরা ওই স্লোগান পরিবর্তন করেছিলেন। যাইহোক, রাজাকার শব্দটি স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবজ্ঞা করা হয়। এই ধরনের স্লোগান আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান অনেকেই অপরিপক্কভাবে বা প্ররোচনার প্রভাবে আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করেছেন। যদিও এটি আন্দোলনের গতি বা কর্মসূচির অংশ হয়, তবে এর মাধ্যমে জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অমর্যাদা প্রকাশ পায়। যারা আন্দোলন স্লোগান হিসেবে রাজাকার শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাদের উচিত ওই স্লোগানের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং জাতীয় চেতনাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে কাজ করা।

যেকোনো আন্দোলনের বিজয় তখনই স্থায়ী হবে, যখন তা দেশাত্মবোধ চেতনায় শাণিত হবে। দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতীয় পরিচয়কে সম্মানিত করার মাধ্যমে আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও মূল্য সংরক্ষিত থাকবে। তাই, আন্দোলনের সফলতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য আমাদের উচিত দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্মান জানানো। এসব চেতনাবিরোধী স্লোগানের বিরুদ্ধে সবার কঠোর অবস্থান নেওয়া উচিত। 
দেশাত্মবোধ চেতনা ও আন্দোলনের মৌলিকতা আমাদের জাতীয় সত্তার মূল ভিত্তি। কোনো আন্দোলন যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ না হয়, তাহলে বিজয় অর্জন করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আমাদের উচিত দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আন্দোলন পরিচালনা করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সম্মানকে প্রাধান্য দেওয়া। এইভাবে, আমাদের আন্দোলনগুলো সঠিক দিশা ও প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে এবং জাতির কল্যাণে অবদান রাখবে।

লেখক: সাংবাদিক

জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৪:২৭ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম
জাতীয় শিক্ষাক্রম ফ্রেমওয়ার্ক-২০২১ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত কতটা গুরুত্ব পেল?
মো. হাবিবুর রহমান

গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য একটি কার্যকরী শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রণয়ন অপরিহার্য। কারিকুলাম প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন জাতীয় কারিকুলাম প্রণয়নে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে? বা কীভাবে করা হয়েছে? প্রণীত জাতীয় কারিকুলাম এখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে, এ বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া কী বার্তা দেয়? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুবাদে স্নাতক পর্যায়ে দুটি ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি কারিকুলাম প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। টারসিয়ারি পর্যায়ে বর্তমানে ওবিই (OBE, Outcome Based Education) পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য ইউজিসি কর্তৃক নির্দেশনা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। মোটাদাগে এই স্টেইকহোল্ডাররা হলেন: বিষয় বিশেষজ্ঞ (Subject Experts); প্রাক্তন শিক্ষার্থী (Alumni); শিক্ষার্থীদের বা যাদের জন্য কারিকুলাম প্রণয়ন করা হচ্ছে তাদের প্রয়োজন  (Target Population's Needs); অভিভাবক  (Guardians); চাকরিদাতা (Employers); এডভাইজরি প্যানেল (বিভিন্ন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত) এবং সমাজের সদস্য (Community Members)। আমি ও আমার সহকর্মীরা কারিকুলাম প্রণয়নের সময় উল্লিখিত এই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাদা করে বসেছি, আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি এবং তাদের মতামতগুলো লিপিবদ্ধ করেছি। প্রণীত কারিকুলামেও এর যথাযথ প্রতিফলন ঘটেছে। 

জাতীয় শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) প্রনয়নের  ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। জাতীয় শিক্ষাক্রমের প্রভাব/ফলাফল জাতির জীবনে সুদূরপ্রসারী। সুতরাং শিক্ষাক্রম প্রণয়নের প্রক্রিয়াও যথাযথ ও সময়োপযোগী হওয়া বাঞ্চনীয়। কারিকুলাম প্রণয়নের ধাপসমুহ সঠিকভাবে অনুসরণ করলেই যে, প্রণীত কারিকুলাম ত্রুটিমুক্ত হবে একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারিকুলামের কার্যকারিতা ভালো বোঝা যাবে এর বাস্তবায়ন পর্যায়ে। তবে, কারিকুলামের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। কেন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না? বা দুর্বলতাগুলো কোথায়? তা চিহ্নিত করা জরুরি। কেননা এর মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিভাবকদের সাথে কথা বলেছি ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেছি। এই আলোকে অভিভাবকদের কাছ থেকে আমি অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। অভিভাবকদের মাধ্যমে এই নেতিবাচক মনোভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে এবং তাদের মানসপটেও নতুন কারিকুলামের প্রতি তথা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হতে পারে। যা আদতে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অশনিসংকেত। সুতরাং শুরুতেই এই অনাস্থা দূর করা জরুরী। মোটাদাগে যে বিষয়গুলো অভিভাবকগণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের সাথে আমার আলোচনায় উঠে এসেছে, সেগুলো হল: ক। নতুন কারিকুলাম প্রণীত সিলেবাস, বই-পুস্তক, শ্রেণী-শিখন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা; খ। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট ও চূড়ান্ত না হওয়া (অতিমাত্রায় পরীক্ষামূলক বা এক্সপেরিমেন্টাল); গ। নতুন কারিকুলাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের (দেশে ও বিদেশে) উচ্চ শিক্ষা পদ্ধতির বা কারিকুলামের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এবং এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণার অভাব; ঘ। সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। 

নতুন কারিকুলামের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত, প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিক সমালোচনাকে গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরি। কারিকুলাম প্রণয়নের প্রাইমারি স্টেইকহোল্ডারদের একদম বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না এবং কোনো ভালো ফলাফলও বয়ে নিয়ে আসবে না। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং একে ফলপ্রসূ করতে হলে স্টেইকহোল্ডারদের যৌক্তিক মতামত গ্রহণ ও তাদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য।  

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা
[email protected]

একেই বলে ছাগলধরা!

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৪, ১২:৪৪ পিএম
আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৪, ০৫:০৪ পিএম
একেই বলে ছাগলধরা!
ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া (মুন্না)

আগের দিনে ছাগল নিয়ে যত প্রবাদ ছিল তা বর্তমান সময়ের একটি ছাগল পরিবর্তন করে দিয়েছে। ছাগলে কিনা খায়, পাগলে কিনা বলে? হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে! এসব প্রবাদ এখন উল্টে গেছে। এখনকার ছাগলরা উচ্চবংশীয়! যা তা খায় না। তথাকথিত ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ইমরান হোসেনের প্রচেষ্টায় এবার বিরল কিছু গরু ও ছাগল কোরবানির বাজারে এসেছে। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে এসব বিরল গরু ও ছাগলের বিষয়ে জানার ও দেখার। সরাসরি নয়, ফেসবুকের কল্যাণে।

একটি গরুর দাম ১ কোটি আর একটি ছাগলের দাম ১৫ লাখ। শুনতে গল্প মনে হলেও এটাই বাস্তব। এগুলো সাধারণ কোনো গরু ও ছাগল নয় বরং এরা উচ্চবংশীয়, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির। এদের বিশেষ কেরামতি আছে। সত্যিই তাই। এরা এমন ভাইরাল গরু ও ছাগল যে এদের লালন-পালনকারী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই ইতোমধ্যে সুপার ভাইরাল হয়ে গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত আমরা শুধু একটি ছাগলের কেরামতি দেখছি, কোটি টাকার গরুর কেরামতি দেখার অপেক্ষায় আছি।

বাংলাদেশের সর্বত্র এখন এই ভাইরাল ছাগল নিয়ে বেশ তুলকালাম চলছে। মজার বিষয় হলো ছাগলটি আমাদের সমাজের তথাকথিত ওপর শ্রেণির কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। যে কাজ কোনো দিন কেউ করতে পারত কি না সন্দেহ রয়েছে, তা একটি ছাগল অনায়েসে করে দেখিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, এই ছাগলের ভয়ে এখন সবাই তটস্থ। রীতিমতো কারও কারও ঘুম হারাম করে দিয়েছে এই ছাগল। ছাগলকাণ্ডে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এর ক্রেতা ইফাত। আবার ছাগলকাণ্ডে ক্রেতা ইফাতকে অস্বীকার করেছে তার জন্মদাতা বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. মতিউর রহমান (সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত)। পর্দার আড়ালে চলে গেছে পুরো মতিউর পরিবার। কী নিদারুণ পরিস্থিতি? যে ছাগল কাঁঠাল পাতা খায়, সে এখন আমাদের মানুষ চেনাচ্ছে। এই ছাগলকাণ্ডে আমরা মতিউর রহমান নামক একজন অতি ক্ষমতাধর, বিশাল সম্পদশালী অসৎ সরকারি অফিসার সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তার ঠিকুজিকুষ্ঠি পুরোপুরি উদ্ধার হয়েছে। তার স্ত্রীরা, পুত্র ও কন্যারা কোথায় কী করছেন, কী কী অবৈধ সম্পদ ভোগদখল করছেন তা গোটা পৃথিবীর মানুষ জানতে পেরেছে।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, যে মতিউর রহমানকে ইতিপূর্বে কেউ থামাতে পারেনি একটি ছাগল তা করে দেখিয়েছে। এই ছাগলের কল্যাণেই জানতে পারলাম যে, এই মতিউর রহমান ছিলেন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সব ক্ষমতার ওপরে। বাংলাদেশের সব স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিল মতিউর রহমানের শক্ত নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশের যে কাউকে তিনি ম্যানেজ করার স্বক্ষমতা রাখতেন। তার দাপটে ভালো ও সৎ অফিসাররা ছিলেন অসহায়। মনে হচ্ছে মতিউর রহমান বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে খুব ছোট করে ফেলেছিলেন, যেখানে চাইলেই যা ইচ্ছে তা করা যায়। কীসের আইন, কীসের নিয়ম, কীসের শৃঙ্খলা। একটি দেশকে পিছিয়ে দিতে এরকম দু-একজন মতিউর রহমানই কি যথেষ্ট নয়? রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে মতিউর রহমানের মতো মানুষেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না, তা তো হতে পারে না। তাই তো একটি ছাগলের মাধ্যমে মতিউর রহমানকে বধ করা হয়েছে। এটা কি নিছক কাকতালীয়? নাকি দুর্ভ্যাগ্যবশত? নাকি অ্যাক্সিডেন্ট? সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা ধরা বড় দায়। 

উদ্বেগের বিষয় হলো, ছাগলটা কিন্তু এখনো আছে। ইমরান হোসেনের খামারে, গলার কাঁটা হয়ে! এই ছাগল দিয়ে সে কী করবে? বিক্রি করবে, কে কিনবে? ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিজে জবাই করে খাবে, এই রকম ব্যবসায়ী তো সে নয়! তবে এই ছাগল নিয়ে সে যা করবে তাতেই কিন্তু নিউজ বের হবে। 

সাংবাদিকরা এই ছাগলের সংবাদ প্রকাশের জন্য রীতিমতো অপেক্ষা করছেন। তবে বাংলাদেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোরবানিতে ১ কোটি টাকার একটি গরু আর ১৫ লাখ টাকার একটি ছাগল বিক্রি করে যে ব্রেক-থ্রো ঘটিয়েছে উদ্যোক্তা ইমরান হোসেন, তার বিড়ম্বনা তো তাকে পেতেই হবে। কোরবানি তো আর লোক দেখানোর বিষয় নয়। উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল, এদের পূর্বপুরুষরা এলিট শ্রেণির সাধারণ মানুষের কাছে এসব বিষয়ের কি আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে? ইমরান হোসেন বিভিন্ন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে যতই সাফাই গাক না কেন সাধারণ মানুষ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তবে একটি কাজের জন্য ইমরান হোসেনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয় যে, তার অতিদামি এসব গরু ও ছাগল অবৈধ টাকার মালিকদের ধরতে একটা টোপ হিসেবে কাজ করেছে। যে টোপে ধরাশায়ী হয়েছেন মতিউর রহমানের মতো অতি কৌশলী ও প্রতাপশালী অসৎ অফিসার। কে জানে এরকম উচ্চবংশীয় গরু/ছাগল আবার কোনো এক নতুন মতিউরকে ধরার জন্য বসে আছে কিনা?

বাংলাদেশে সরকারি চাকরি করে বড় চেয়ারে বসার সুযোগে চতুরতার সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যারা অবৈধ টাকার পাহাড় বানিয়েছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা চুষেছেন বা চুষে যাচ্ছেন, তারা দয়া করে থামুন। সাবধান হোন। আপনাদের অবৈধ টাকা দিয়ে আপনারা সর্বোচ্চ কী করতে পারেন তা দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেন, বিদেশে বাড়ি কেনেন, দেশে অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে ফ্ল্যাট/বাড়ি ক্রয় করেন, কয়েক শ বিঘা জায়গার ওপর রিসোর্ট নির্মাণ করেন আর ছেলেমেয়েদেরে এসব অবৈধ টাকা অবাধে খরচ করতে দেন, এই তো? তাই সরকারি চাকুরে, যাদের কাছে এরকম হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে তাদের জন্য একটা পরামর্শ- টাকাগুলো বিদেশে প্রাচার না করে বরং তা দিয়ে বঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করুন, দেশের টাকা দেশেই রাখুন, বাংলাদেশের হাজার হাজার বেকার তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুন, অনুন্নত গ্রামের উন্নয়নে ও প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভালো কাজে ব্যবহার করেন। তা না হলে আপনিও একদিন নিশ্চিত এরকম ছাগলবধ হবেন। যাদের সহযোগিতায় অপকর্ম করেছেন, স্বার্থ বিনিময় করেছেন তারা কেউ কিন্তু আপনার দায় নেবে না। আপনাকে ছিছি করবে গোটা জাতি। আপনার অর্থই হবে অনর্থের মূল। এরকমই এক ছাগলকাণ্ডে উন্মোচিত হবে আপনার সব কুকর্ম, তাসের ঘরের মতো ধ্বংস হবে আপনার অবৈধ টাকার পাহাড়।

লেখক: অধ্যাপক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
প্রশ্নফাঁস: মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কোথায়?
তৌহিদ-উল বারী

পড়াশোনা মানে যেন লাভ-ক্ষতির ব্যবসা। এমনটাই পরিলক্ষিত হয়, যখন ক’টা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন মিলে যায়। তাহলে তো আর কথা নেই। ব্যাস! এখন শুধু খাতায় গিয়ে লিখে দেওয়াটা বাকি। কি বা দরকার এত লেখাপড়া করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। যেখানে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়া যায় আর পরে মিলে যায় লোভনীয় সার্টিফিকেট। এভাবেই যেন গেঁথে দেওয়া হয়েছে বর্তমান শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের মাথায়। একটি স্বল্প শিক্ষিত মানুষ নামের কুচক্রী মহল তাদের এই প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ের মধ্য দিয়েই পড়াশোনাকে বানিয়ে ফেলেছে একটি লাভ-ক্ষতির ব্যবসা।

প্রশ্নফাঁস একটি সভ্য জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনে নিঃসন্দেহে। যা আমরা শুনে এসেছি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ‘If you want to destroy a nation, first destroy it’s education’ যদি তুমি একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে প্রথমেই ওই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস কর।

এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, এ যেন শত্রুপক্ষ বাঙালি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার এক মহোৎসবে মেতে ওঠেছে। একটি স্বল্পশিক্ষিত মহল যেন শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করছে।

এসব স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মাথায় বিন্দুমাত্র কাজ করে না, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে জাতির কত বড় সর্বনাশ হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না বরং এরা তার থেকে বিমুখ হচ্ছে। যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা কোনোরকমে টেনেটুনে পাসের চিন্তা রাখে তাদের দলেই ধাবিত হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। কারণ একটাই, এসব শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে পাশ করার চেষ্টা। যার প্রেক্ষিতে মেধাবীরা আজ পড়াশোনার প্রতি, মেধাচর্চার প্রতি বিমুখ হচ্ছে। 

কেমন জানি, প্রশ্নফাঁস করে অবৈধ টাকা কামানোর নেশায় নেমেছে সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র। ফলে গত ছয় বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এসব চক্রের প্রায় তিন শতাধিক সদস্য। এর মধ্যে রয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র, বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পরিচালকসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে ফের একই অপরাধ করছে। বিচার কার্যক্রমের ধীরগতির সুবিধাও নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা।

তবে এত এত গ্রেপ্তারের পরও কেমন জানি এই প্রশ্নফাঁস ঠেকানোই যায় না। কোনো না কোনো ভাবে এসব প্রশ্ন ফাঁস হয়েই যায়। কেন বারবার এমনটা হচ্ছে? এর পিছনে কারা দায়ী? কিসের ঘাটতি রয়েছে এই কুচক্রী মহলকে ঠেকানোর পেছনে? নাকি এভাবেই চলতে থাকবে ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো। প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, পরীক্ষা দেবে, অপরাধীও শনাক্ত হবে। কিন্তু বিচারের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকবে না। তাহলে এরকম হলে কেমন হবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন? এটা নিয়ে কি আমরা মোটেও ভাবার বিষয় মনে করছি না! 

তবে আমরা এটা নিশ্চিত ভাবে জানি প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান আছে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশ আসামিদের অপরাধের শাস্তির রায় হয়নি। তাহলে কি এটাই হতে পারে একই ঘটনা পুনরাবৃত্তির কারণ? নাকি আরও কোনো অদৃশ্য কারণ রয়েছে এ প্রশ্নফাঁসের পেছনে। খতিয়ে দেখা হোক, চিরতরে বন্ধ হোক প্রশ্নফাঁসের এই দুর্নীতি-অনিয়ম। দিনশেষে মেধাবীরাই তাদের মেধার মেধার স্বাক্ষর রাখুক।

লেখক: শিক্ষার্থী ও কলামিস্ট 
[email protected]

মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
মহুয়া পালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র: সেকাল ও একাল
মো. রেজাউল করিম

‘মহুয়া’ পালা মৈমনসিংহ গীতিকার অন্যতম আলোচিত গীতিকাব্য। সাহিত্য সর্বদাই সমাজের ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজের উপরিস্থিত ও অন্তস্থ আন্তসম্পর্কের বর্ণনাচিত্র। মৈমনসিংহ গীতিকায় কবিরা সরল লোকজ ভাষায় মানবজীবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে নর-নারীর প্রেম অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় কাহিনিসমূহ অমরত্ব লাভ করেছে। মহুয়া পালা এমনই এক আখ্যানচিত্র যে পালা বা গাথায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র বিধৃত হলেও তা গোটা বাংলার, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজচিত্র হিসেবেই গণ্য করা যায়। মহুয়া পালায় বর্ণীত আখ্যানের সমাজচিত্র পৌনে চার শ বছর পরও চলমান বঙ্গীয় সমাজে অনেকাংশেই বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকার প্রায় সব কাব্যই মানব-মানবীর প্রেমাখ্যানের মনোস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মহুয়া পালাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পালার প্রধান দুই চরিত্র- নদের ছাঁদ ও মহুয়া সামাজিক অবস্থানের দুই মেরুতে অবস্থানকারী দুই যুবক-যুবতী। শুধু যে সামাজিক অবস্থান পৃথক তা-ই নয়, তাদের ধর্মও পৃথক। অথচ তারা একে অপরের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। প্রেম, পরিবার ও সমাজসৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত, মানোস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, প্রেমের প্রতি অকুণ্ঠ প্রতিশ্রুতি ও ত্যাগ- ফলে পরিবার ও সমাজসৃষ্ট আরোপিত নিগ্রহ এবং আরোপতি নিগ্রহের বিরুদ্ধে মনোস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথের আখ্যান এই পালার উপজীব্য। পরিশেষে যার সমাপ্তি ঘটে ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্য দিয়ে। 

নদের চাঁদ ও মহুয়া পালার চিত্রায়ন শুরু হয় গারো পাহাড়ের ওপারে হিমানী পর্বতে, যা কিনা ছয় মাসের দূরত্ব।  হিমানী পর্বতের ওপারে ঘন জঙ্গল যেখানে চন্দ্র কিংবা সূর্যের আলো পৌঁছে না- এমন ঘন জঙ্গলে বাস করে ডাকাত সর্দার হুমরা, তার বাহ্যিক পেশা সাপুড়ে তথা বেদে- ডাকাত সর্দার হুমরা ‘হুমরা বাইদ্যা’ নামেই পরিচিত। ষোলো বছর আগের ঘটনা- হুমরা বাইদ্যা কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে ডাকাতি শেষে অপরূপ রূপ-মাধুর্যের অধিকারী ছয় মাসের এক কন্যাকে দেখে চুরি করে নিয়ে আসে। এই ঘটনা শুধু যে তৎকালীন সমাজচিত্র তা-ই নয়, পৌনে চার শ বছর পরও বর্তমান বেদে জনগোষ্ঠী কর্তৃক শিশু, বিশেষত শিশুকন্যা চুরির কথা শোনা যায়। 

চুরি করে আনা শিশুকন্য মহুয়া অন্তজ বেদে সমাজে বেড়ে উঠতে থাকে আরও দশটি মেয়ের মতো। সাপের খেলা, নাটকীয় সংলাপ, নদী থেকে জল আনা, এমনকি ঘোড়ায় চড়া- সব কাজেই সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ভাগ্য অন্বেষণে নদী, জলাশয়, পাহাড় অথবা গ্রামীণ লোকালয়ে মৌসুমভেদে ঘুরে বেড়ায় তারই পালক-পিতা বেদেসমাজের দলপতির সঙ্গে। যাযাবর শ্রেণির বেদেসমাজ দলপতির ‘বৈদেশেতে’ যেত- সেই পর্বের বর্ণনা পাওয়া যায় পালায় এভাবে: ‘ঘোড়া লইল গাধা লইল, কত কইবো আর- সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়- শিকারি কুকুর লইল শিয়াল হেজে ধরে- মনের সুখেতে চলে বৈদেশ নগরে।’ উপরিউক্ত স্তবক থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে সমাজের পরিভ্রমণের চিত্র জানা যায়, যা এখনো বিরাজমান। তবে বর্ণনায় আতিশয়োক্তি রয়েছে বলে মনে হয়। একই নৌকায় কুকুর আর শেয়াল বহনের ঘটনা বর্ণনার আতিশয়োক্তি বলেই প্রতীয়মান হয়।

এই স্তবকে সনাতন বাঙালি সমাজের আতিথেয়তার প্রমাণও পুরিস্ফুট। জমিদারের নায়েব প্রথম দর্শনেই মহুয়ার প্রেমে পড়ে। মহুয়াও তার প্রতি সমভাবে আকৃষ্ট হয়। সে নিজেদের আলয়ে নদেরকে নিমন্ত্রণ জানায়, যা পালায় এভাবে বর্ণীত হয়েছে: ‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা- জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা- সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরি কলা- ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।’ পালার এই স্তবক এ দেশের সনাতন সমাজের লোকজ খাদ্য দিয়ে হাজার বছরের আতিথেয়তা প্রকাশ করে, যা আজও গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান।

তৎকালীন বেদে সমাজের নারীরা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিষ অথবা ধারালো অস্ত্র সঙ্গে রাখত। পালার বিভিন্ন পর্বে তার বিবরণ পাওয়ায়। এ ছাড়া বিষের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, যা বেদে সমাজে সে-সময়ে ছিল, এখনো আছে এমন তথ্য প্রমাণিত। এই পালায় তক্ষকের বিষ অস্ত্র হিসেবে বিবৃত হয়েছে যখন মহুয়া তাকে অপহরণকারী সওদাগরের মাঝি-মাল্লাদের বানিয়ে দেওয়া পানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেয়। এখানে দুটি দৃশ্যকল্প অবলোকন করা যায়। প্রথমত, বেদেকন্যা নিজের কাছে গোপনে বিষ রাখত। দ্বিতীয়ত, তারা সেই যুগে, এমনকি বর্তমানেও কথার জাদুতে মানুষকে মোহাবিষ্ট করতে পারে। তাই তো দেখা যায়- যারা তাকে অপহরণ করেছে, তার নাটকীয় কথার মাধুর্যে মোহাবিষ্ট হয়ে তারই সাজিয়ে দেওয়া পান খেয়ে সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, বেদে সমাজে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া মাত্রই বিশেষত নারীরা পান খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, যা এখনো বিদ্যমান। 

গোটা পালা নিবিড় অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে, এই পালার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজচিত্র, যা পৌনে চার শ বছর পর আজও শুধু বেদে সমাজ নয়, বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান। রক্ষণশীল সমাজের বেদেকন্যা মহুয়া সুন্দরী ও জমিদারের দেওয়ান সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদের ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন ধর্ম এবং বিবাহ তথা সম্প্রদানের ব্যাপারে অভিভাবকের সিদ্ধান্তের প্রাধান্য। সে-যুগেও অভিভাবকের সিদ্ধান্তের বাইরে যুবক-যুবতী প্রণয়াসক্ত হতো, যা এই পালায় বিবৃত হয়েছে। তবে কোনো বাধাই দুজনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দুজনে আত্মাহুতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে ভালোবাসা শাশ্বত। এমন চিত্র বাংলার গ্রামীণ সমাজই শুধু নয়, শহুরে সমাজেও এখন কদাচিৎ হলেও জানা যায়।  

হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদের প্রতি তার আদরের পালিত কন্যা মহুয়ার আসক্তি টের পেয়ে যায়। এই পর্যায়ে দেখা যায়, হুমরা বাইদ্যা ভাবে- কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাড়ির জমিতে ফসল উঠবে; ফসল তোলার টান, বাড়ির পুকুরের মাছ ধরার মৌসুম, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে মহুয়ার গোপন প্রণয়ের আশঙ্কা- তাকে কিছু একটা করতেই হবে। বেদে দলে মহুয়ার সখা পালঙ্ক হুমরা বাইদ্যার নিষ্ঠুরতার আশঙ্কায় মহুয়াকে পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহ বাইরে বের না হওয়ার জন্য। ঠাকুরবাড়িতে সে পৌঁছে দেবে মহুয়ার মৃত্যুর খবর। মহুয়া রাজি হয় না, উল্টো ঠাকুরবাড়ির পানে চেয়ে চন্দ্র-সূর্য আর পালঙ্ক সখাকে সাক্ষী মেনে নদের চাঁদকে স্বামী বলে ঘোষণা করে। পালঙ্ককে বলে সে নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, অন্যথায় বিষপানে আত্মহত্যা করবে। হুমরা বেদে মহুয়ার অজান্তে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করে দলের অন্যদের সঙ্গে। হুমরা বাইদ্যা নদের চাঁদকে তক্ষকের বিষ প্রয়োগে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে হত্যা করতে বললে মহুয়া নদের চাঁদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালায় যা বলা হয়েছে: ‘আরে করে ঝিলিমিলি নদীর কূলে দিয়া, দুজনে চলিল ভালা ঘোড়া সুয়ার হইয়া’। 

ধর্মীয় বিশ্বাস, বাদ-মতবাদ গীতিকা-রচয়িতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আচ্ছন্ন করেনি। জীবনবিরোধী সবকিছুই অস্বীকৃত হয়েছে এ কাব্যমালায়। মৈমনসিংহ গীতিকায় মূলত মুক্ত প্রেমের জয়গান বিবৃত হয়েছে। এ গীতিকার নারীরা ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে কখনো বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধেও জীবনসাথী বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকি নিয়েছে, গৃহত্যাগ করেছে। এটা কোনোকালেই অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব ছিল না। যে কারণে বলা যায়, মৈমনসিংহ গীতিকায় নারীর শক্তি, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান বিবৃত হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক
[email protected]