![বিদ্যুতে থাকবে না ভর্তুকি, বাড়বে দাম](uploads/2024/05/15/electricity-1715746552.jpg)
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করাটাই এখন বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। দাম বাড়ানোকে মন্ত্রণালয় বলছে দাম সমন্বয়। এর সঙ্গে রয়েছে আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী আগামী তিন বছরে বিদ্যুতের ওপর থেকে সব রকম ভর্তুকি উঠিয়ে নেওয়ার বিষয়।
২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ওপর সরকারি ভর্তুকি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ ৮৪ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা এবং আগামী বছরের বাজেটেও প্রায় একই পরিমাণ বরাদ্দ হতে পারে বলে জানিয়েছে অর্থবিভাগ। আর চলতি অর্থবছরে বিদ্যুতের ওপর ভর্তুকি প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
গত বছরের জানুয়ারিতে আইএমএফের চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচিতে প্রবেশের পর সরকার তিন বার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরেক দফা বাড়ে বিদ্যুতের দাম। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরায় ১৪ দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরেও প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে সাত থেকে আট টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ প্রায় ১২ টাকা। আর আমরা গড়ে প্রতি ইউনিট বিক্রি করছি সাত টাকায়। ফলে সমন্বয়টা ওপরের দিকে বেশি করছি, নিচের দিকে কম করছি।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দাম বাড়ানোর রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। খুবই সামান্য করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে যাতে গ্রাহকরা বড় ধাক্কা না খায়। ধাপে ধাপে বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে সরকার। আগামী তিন বছরে এই প্রক্রিয়ায় মোট ১২ দফায় বিদ্যুতের দাম নিয়ে আসা হবে উৎপাদন খরচের সমান বা কাছাকাছি।
গত ৬-৭ মে ঢাকা সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলকেও এ কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গত সপ্তাহে এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইএমএফের বর্তমান দলটি ২৪ এপ্রিল থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে ৮ মে পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক করে।
ভোক্তা পর্যায়ে অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) ও সিপিডি এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেছে। পদ্ধতিগত ত্রুটি ও সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতি এবং নির্দিষ্ট গ্রাহকশ্রেণির জন্য ইউনিট প্রতি দাম কেমন হবে সেসব বিষয়ে সমন্বয়ের কথা বলছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা।
দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেছে ক্যাব। সংগঠনটির জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘খরচ কমিয়েও সরকার ভর্তুকি সমন্বয় করতে পারে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অপচয় রোধ করে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে সরকারের মনোযোগ নেই। চাহিদা না থাকলেও দরপত্র ছাড়া একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে এ খাতের খরচ আরও বাড়ানো হচ্ছে। সরকার অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করলে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজনই হতো না।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম ভর্তুকি সমন্বয় প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়বে সেটা যেমন সত্য আবার দাম বাড়া নির্ভর করে জ্বালানি তেল ও কয়লার আন্তর্জাতিক মূল্যের ওপর। যেমন গত বছর ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল জ্বালানি তেলের বাজারের অস্থিরতার কারণে। এ বছর চিত্র পাল্টেছে। যে কয়লা গত বছর আন্তর্জাতিক বাজারে ১৮০ ডলারে বিক্রি হয়েছে এবার তা ১২০ ডলারে নেমেছে। আবার কমেছে জ্বালানি তেলের দামও। ফলে দাম কেমনভাবে বাড়ানো হবে এটা প্রথম সমন্বয় করতে হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর ভালো বিকল্প হচ্ছে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ কমিয়ে ভর্তুকি কমানো।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে পুরোপুরিভাবে ভর্তুকি কমানো সম্ভব হবে না। গ্রাম পর্যায় এবং উৎপাদনমুখী শিল্পে বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতেই হবে। না হয় এর প্রভাব পড়বে চিনি, মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স ও ওষুধ শিল্পের মতো যেসব শিল্পের উৎপাদন দেশেই হয় তার ওপর।’
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিদ্যুতের বর্ধিত ক্যাপাসিটি না কমিয়ে এ খাতের ভর্তুকির চাপ সম্পূর্ণ ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। ইউনিট প্রতি ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা পর্যন্ত বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। ৮ দশমিক ৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিয়ে ভোক্তার ওপর এক বছরের ব্যবধানে সাড়ে ১৭ শতাংশ বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। ভর্তুকি সমন্বয়ের নামে দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পকারখানার খরচের পাশাপাশি ভোক্তাদের খরচ বাড়বে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। দেশের নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারের খরচ বাড়বে ১০৬ থেকে ১১৮ টাকা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এইসব সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।’
ক্যাপাসিটি বলতে পাওয়ার সেল বলছে- ‘ক্যাপাসিটি চার্জটা পুরো বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে দুটি বড় ব্যয় রয়েছে- একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির মূল্য এবং আরেকটি হলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়। ক্যাপাসিটি চার্জটা উৎপাদন ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত।’
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আইন সংশোধন করে বিইআরসির পাশাপাশি দাম বাড়ানোর ক্ষমতা হাতে নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়িয়ে আসছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১০ সালে দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি আইন করা হয়েছিল যে আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতের ইউনিট প্রতি দাম ও খরচের মডেল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকবে। এই আইন জবাবদিহির জায়গা নষ্ট করেছে।
পিডিবি, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, ডেসকোসহ বিভিন্ন সংস্থা ২০১৩ সাল থেকে যে ৬৭টি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে তার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে পরিকল্পনা কমিশন। সেই প্রতিবেদনে কমিশন এসব প্রকল্পকে হতাশাজনক হিসেবে উল্লেখ করেছে।
বিদ্যুতের দামের বর্তমান চিত্র
সর্বশেষ গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিটপ্রতি সর্বনিম্ন ২৮ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা পঁয়ত্রিশ পয়সা পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে গড়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। এ বছর পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন এই দাম কার্যকর করা হয়।
বিভিন্ন সংগঠন ও গণমাধ্যমের হিসাব বলছে, বাসাবাড়িতে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী বা লাইফলাইন গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৮ পয়সা। আগে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য তাদের খরচ করতে হতো চার টাকা ৩৫ পয়সা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে চার টাকা ৬৩ পয়সা। অর্থাৎ দাম সাড়ে ছয় শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
এই শ্রেণির গ্রাহকরা সাধারণত বাসায় একটি ফ্যান ও দুটি বাতি চালান এবং মাসে সর্বোচ্চ ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। এর ফলে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী একজন লাইফলাইন গ্রাহকের আগে যেখানে মাসে নিট বিল আসত ২১৭ টাকা ৫০ পয়সা, এখন সেটি বেড়ে বিল আসবে ২৩১ টাকা ৫০ পয়সা। অন্তত ১৪ টাকা বেশি বিল দিতে হবে এই শ্রেণিকে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ।
যাদের বাসায় একাধিক বাতি, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ এবং একটি এসি রয়েছে, তারা সাধারণত ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে থাকে। তাদের জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ইউনিট প্রতি ৫৭ পয়সা। ফলে এখন থেকে মাসে তাদের প্রায় একশ টাকা বেশি বিল গুনতে হচ্ছে। আগে এই শ্রেণিতে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম ছিল ছয় টাকা ৬৩ পয়সা। এখন সেটি বাড়িয়ে প্রতি ইউনিটের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সাত টাকা ২০ পয়সা।
অন্যদিকে, আবাসিকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের। মূলত, বিত্তবানরাই এই শ্রেণির গ্রাহক। তাদের জন্য ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতে দাম সর্বোচ্চ ১ টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
আগে যেখানে প্রতি ইউনিটের জন্য তাদের মূল্য দিতে হতো ১৩ টাকা ২৬ পয়সা, এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১৪ টাকা ৬১ পয়সা। ফলে আগে ৬৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে যেখানে বিল আসত আট হাজার ৬১৯ টাকা, এখন সেখানে বিল দিতে হবে ৯ হাজার ৪৯৬ টাকার মতো। অর্থাৎ গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাদেরকে আটশ টাকার মতো বাড়তি বিল দিতে হবে।