![ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর](uploads/2024/05/15/bujet-1715749955.jpg)
সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে বাজেটে রাজস্ব ছাড় দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিশেষভাবে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বিকাশে, গবাদি পশুখামার, পোলট্রি ও মাছ চাষে উৎসাহ দিতে বলেছেন।
রাজস্ব জালের আওতা বাড়াতে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করার কঠোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রতি অর্থবছরের শেষ সময়ে কেন লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করতে হচ্ছে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান। আগামীতে ঘাটতি থেকে এনবিআরকে বের হয়ে আসার পরামর্শও দেন তিনি। করদাতারা হয়রানির শিকার হন- মাঠপর্যায়ের রাজস্ব কর্মকর্তাদের এমন কোনো ক্ষমতা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। করদাতাদের সহযোগী হয়ে রাজস্ব আদায় করার পরামর্শ দিয়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের শহরের পাশাপাশি উপজেলায়ও যেতে বলেন তিনি। এনবিআরের কাজে ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে সম্পূর্ণ অটোমেশনে আসার নির্দেশ দেন।
একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের রাজস্ব বাজেট নিয়ে আলোচনার সময় এসব নির্দেশনা দেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী, অর্থসচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান, এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও কর শাখার বাজেট প্রস্তুতি কমিটির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এনবিআর চেয়ারম্যান রাজস্ব বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধারাবাহিকভাবে পাওয়ার পয়েন্ট আকারে উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী মনোযোগ দিয়ে এসব প্রস্তাব শোনেন। একাধিক প্রস্তাবের খুঁটিনাটি নিয়ে প্রশ্ন করেন। একই সঙ্গে নিজের মতামত তুলে ধরেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট প্রণয়নে গুরুত্ব দিয়েছেন। দাম কমাতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে জোর দিয়েছেন। বিশেষভাবে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে রাজস্ব ছাড় দিতে বলেছেন। যারা দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে বলেছেন। কালোবাজারিদের ধরতে জনগণকে সচেতন করতে বলেছেন। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে আরও জোর দিতে বলেছেন।’
মঙ্গলবারের বৈঠকে এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক কর্মকর্তা এমপিদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক আরোপের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, এর ফলে সরকারের প্রতি মেয়াদে গড়ে দুই শ থেকে আড়াই শ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় হচ্ছে। বৈঠকে উপস্থিত কেউ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো মতামত দেননি।
তবে প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে বলেন, যেকোনো প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করবেন। বাজেট ঘোষণার পর যেন কোনো বিতর্ক বা অসন্তোষ না হয়।
আলোচনার এক পর্যায়ে এনবিআর চেয়ারম্যান শিল্পের যেসব খাতে বা প্রতিষ্ঠানে বা ব্যক্তি পর্যায়ে রাজস্ব (কর, ভ্যাট ও শুল্ক) অব্যাহতি, কর অবকাশ সুবিধা বা রাজস্ব ছাড় রয়েছে তা প্রত্যাহারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে প্রস্তাবের বিবরণ দিয়ে পরামর্শ জানতে চান।
প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশের শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। অর্থনীতির গতিশীলতার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে শিল্প খাতেও সক্ষমতা তৈরির সুযোগ দিতে হবে। তবে কোনো ব্যক্তিকে খুশি করতে বা কারও অনুরোধ রাখতে রাজস্ব ছাড় সুবিধা দিয়ে তা যুগের পর যুগ বহাল রাখাও যাবে না। এনবিআর একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। কোনো ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
বৈঠকে জনস্বার্থে সিগারেট ও তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। বৈঠক সূত্র জানায়, এনবিআর শেয়ারবাজারে মুনাফা (গেইন কর) ৪০ লাখ টাকার বেশি হলে কর আরোপের প্রস্তাব করেছে। একইভাবে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। বর্তমানে মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর অন্যান্য করের সঙ্গে ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ আছে। প্রস্তাবি বাজেটে কথা বলার ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হতে পারে। একইভাবে প্রস্তাবিত বাজেটে ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার বিদ্যমানের চেয়ে ২.৫ শতাংশ কমানো হচ্ছে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২২.৫ শতাংশ। এটি কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। অপরদিকে বর্তমানে তালিকভুক্ত নয় (ননলিস্টেড) এমন কোম্পানির করহার ২৭.৫ শতাংশ। এ হার কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
বিত্তবানদের করহার বাড়ছে। যাদের বার্ষিক আয় ৫০ লাখ টাকার বেশি তাদের করহার বিদ্যমান ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে।
বৈঠকে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করণীয় কি, তা জানতে চাওয়া হয়। এনবিআর থেকে শিল্পের বিশেষ কিছু খাতে এবং পুঁজিবাজারে বিশেষ সুবিধায় কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। আলোচনায় উঠে আসে, ‘আবাসন খাতে এর আগেই বিশেষ ব্যবস্থায় কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের জন্য ফ্ল্যাট বা প্লট সরবরাহে কোনো ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারের কারণ দেখিয়ে ফ্ল্যাট ও প্লটের দাম বেড়েই চলেছে।’ বরং ঠিকঠাকমতো রাজস্ব পরিশোধ করে যেসব সৎ ব্যক্তি ব্যবসা করছেন তাদের প্রতি ন্যায় বিচার করা হয় না বলেও বৈঠকে উল্লেখ করা হয়। বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে এমন তথ্য জানিয়ে এনবিআর থেকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা করতে চাইলে তা থামিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী অর্থ পাচার রোধে কঠোর হতে বলেন। বর্তমান আইন ভালোভাবে বাস্তবায়নে নির্দেশ দেন। কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে অর্থ পাচার কমানোর পদক্ষেপ নিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি পুঁজিবাজারে মনোযোগী হতে বলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, এনবিআর বাজেটে বিশেষ সুবিধা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে। আইএমএফ এর বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রয়োজনে অর্থমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে এনবিআর থেকে আবারও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানোর চেষ্টা করা হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিকদের ওপর কর বাড়ানো এবং সারচার্জ (বেশি সম্পদ থাকার কারণে জরিমানা হিসেবে নিয়মিত করের বাইরে অতিরিক্ত কর) বাড়ানোর পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। বৈঠকে বেশি সম্পদের মালিকদের করহার বাড়ানোর প্রস্তাবের বিপক্ষে কেউ কথা বলেননি। তবে সারচার্জ সম্পর্কে বলা হয়, বেশি সম্পদ থাকা অপরাধ না। এর জন্য অতিরিক্ত কর সহনীয় রাখা উচিত।