বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমসের ৩৩তম আসরের পর্দা উঠেছে গতকাল। ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’খ্যাত এই আসরে রয়েছে বাংলাদেশেরও অংশগ্রহণ। তবে পক্ষকালজুড়ে ৩২টি ডিসিপ্লিনে ৩২৯ ইভেন্টের যে পদকের লড়াই হবে, তার কোনো একটিতে বাংলাদেশের কাউকে জয়ীর বেশে দেখাটা দূরকল্পনা। বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের জন্য অলিম্পিক মানেই যে কেবল অংশ গ্রহণের আনন্দ!
৯৮৪ সাল থেকেই নিয়মিত অলিম্পিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্যারিস অলিম্পিকের পাঁচজন দিয়ে বাংলাদেশের অলিম্পিয়ানের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৫৪ জনে। কিন্তু গত ৩০ বছরে এদের কেউই কোনো পদক জয়ের কাছাকাছিও যেতে পারেননি। এই দৃশ্যপট বদলাচ্ছে না কেন? দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম সফল তারকা শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকীর মতে, বাংলাদেশের খেলোয়াড়রাও সামর্থ্য রাখেন পদক জয়ের। তবে এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উন্নত প্রশিক্ষণ আর বেশি বেশি আন্তর্জাতিক গেমে অংশগ্রহণ জরুরি বলেও মনে করেন তিনি। অন্যদিকে সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শীলা বিশ্বাস করেন, অলিম্পিকে বাংলাদেশের চিত্রটা দিনে দিনে বদলাচ্ছে। তিন আসর ধরে একজন করে ক্রীড়াবিদ কোটা প্লেস অর্জন করে অলিম্পিকে খেলছেন। এই বিষয়টি উল্লেখ করে বাকীর মতো শীলাও বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বাংলাদেশও পারবে অলিম্পিকের পদক তালিকায় নিজেদের নাম তুলতে।
কমনওয়েলথ গেমসে দুটি রুপা ও একটি ব্রোঞ্জ জয়ী শুটার বাকী মনে করেন, অলিম্পিক পদক জয় বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব কিছু নয়। তার কথায়, ‘শুটিংটা অনেক ক্লোজ। এবার রবিউল ইসলাম অংশ নিচ্ছেন। ও প্র্যাকটিসে ৬৩০ প্লাস স্কোর করে। এই স্কোর করতে পারলে ও নিশ্চিতভাবেই ফাইনালে খেলবে। আর ফাইনালে খেলতে পারলে তো যেকোনো কিছুই হতে পারে। এখন জরুরি হচ্ছে কম্পিটিশনের দিনে ওই স্কোরটা করা।’ কিন্তু বাংলাদেশের শুটারদের সেটাই যে করা হয় না। দায়টা খেলোয়াড়দের দেওয়ার উপায় নেই। কারণ এ ধরনের বড় গেমসে নার্ভ ধরে রাখার উপায় একটিই- বড় বড় মঞ্চে নিয়মিত খেলা। কিন্তু বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যে সেই সুযোগটাই পায় না। বাকী যেমন একটা উদাহরণ দিলেন, ‘গলফ ও আর্চারি থেকে কোটা প্লেস অর্জন করে আমরা অলিম্পিকে খেলেছি। আমরা শুটাররাও কিন্তু কোটা প্লেস নিয়ে অলিম্পিকে যেতে পারি। কিন্তু কেন জানি ভাগ্যটা আমাদের পক্ষে থাকে না। যদি পাঁচটা কোটা প্রতিযোগিতা থাকে, তাহলে এগুলোর সবগুলোতে আমরা যেতে পারি না। কয়েকটি প্রতিযোগিতায় ২-৪ জন শুটার যায়, সেখানে হয়তো আরও ৮-১০ জন যাওয়া উচিত।’
এমনটা হলে হয়তো কোনো না কোনো শুটার ঠিকই কোটা প্লেস পেয়ে যেতেন। এবারই যেমন শুটার রবিউল ইসলাম কোটা প্লেস অর্জনের খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ হেল বাকী যোগ করে বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত কোটা প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নেওয়া উচিত। যদিও ফেডারেশন অনেক চেষ্টা করে। হয়তো অনেক ব্যয়বহুল এজন্য হয় না। সরকার, ক্রীড়া পরিষদ, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, স্পন্সর প্রতিষ্ঠান- সবাই মিলে যদি চেষ্টা করে, তাহলে হয়তো এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।’ সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে শুটিংয়ে হয়তো আসলেই পদকের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। কিন্তু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ও সুইমিংয়ে? অলিম্পিকে অ্যাথলেটিক এবং সাঁতার ঘিরেই সবার আগ্রহ থাকে বেশি। খেলাধুলার প্রাণই যে এই দুই ডিসিপ্লিন। এসএ গেমসে জোড়া স্বর্ণজয়ী সাঁতারু শীলার কথায়, ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড এবং সুইমিং ইভেন্টে ভালো করাটা অনেক কঠিন। এ জন্য অনেক ভালো প্ল্যানিং, দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিং দরকার। কারণ এখানে অনেক ভালো ভালো দেশ খেলে।’ তাই বলে অসম্ভবও মনে করেন না শীলা, ‘ভারত কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা করে ঠিকই অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমার কাছে মনে হয়, উন্নত সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে ট্রেনিং করতে পারলে উন্নতি সম্ভব। সরকার, ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এজন্য।’
বাংলাদেশে শুটিং, সাঁতার, অ্যাথলেটিকসের মতো খেলাগুলো বেঁচে আছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো কিছু সংস্থার জন্য। এই জায়গাটায় বিভিন্ন ক্লাবের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করেন বাকী ও শীলা দুজনই। ‘সাঁতারের কথা যদি বলি, আমাদের এখানে বাহিনী এবং বিকেএসপির বাইরে কজন সাঁতারু বড় বড় গেমে যাচ্ছেন? এটা তো ক্লাবভিত্তিক খেলা হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের এখানে সাঁতারে ক্লাবের অস্তিত্ব কোথায়?’- বলেন শীলা।
সাঁতার-অ্যাথলেটিকসে যারা বিশ্বসেরা, তাদের থেকে প্রাকৃতিকগতভাবেই বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে। তবে শীলা বিষয়টি মানতে নারাজ, ‘সেটা হলে আমরা তো সাফ গেমসে স্বর্ণ পেতাম না। ভারত তো ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা একই আবহাওয়ায় বসবাস করি। আমাদের উচ্চতা-ওজন ওদের সঙ্গে খুবই মিল। আমাদের ন্যাচারাল কাঠামো আসলে খারাপ না। আসলে শুধু পরিকল্পিত পরিকল্পনা দরকার আমাদের।’