
সমসাময়িক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর তালিকায় নজর দিলে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় তা হলো, প্রায় প্রতিটি দেশেরই সামরিক শক্তি অভাবনীয়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে অথবা কথিত সেই দুঃস্বপ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, বিশ্ব মোড়লরা কীভাবে তাদের সামরিক শক্তির ঝুলি দিন দিন আরও ভারী করছে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় অদৃশ্য এক কোণে বসে বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের দিকে কিছুটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি রাখার প্রচেষ্টাই ‘সামরিক শক্তির আদ্যোপান্ত’ সিরিজ। এই সিরিজে আজ থাকছে তুরস্কের সামরিক শক্তির বিস্তারিত-
ইউরেশিয়া অঞ্চলের দেশ তুরস্কের সামরিক শক্তি বেশ কিছু সংস্কার ও পরিমার্জনের পর বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিক পটভূমি ও কৌশলগত সুবিধা বাস্তবায়ন এই বিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইন্ডেক্সের (জিএফপিআই) তথ্য অনুয়ায়ী সামরিক শক্তিতে ১৪৫টি দেশের মধ্যে তুরস্কের অবস্থান অষ্টম। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমীহ আদায় করে নিয়েছে কয়েক শতাব্দীর পুরোনো এই শক্তি। তৎপর প্রতিরক্ষাখাত ও আধুনিক পররাষ্ট্রনীতির ওপর ভর করে নিজেদের অবস্থান ক্রমেই দৃঢ় করে তুলছে দেশটি।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
তুরস্কের সামরিক ইতিহাস জানতে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে যেতে হয়। বহুস্তরবিশিষ্ট সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ঐতিহাসিক এই পরাশক্তি কয়েক শতক ধরে বিশ্বে নিজেদের শক্তি বজায় রেখেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি সাম্রাজ্যের পতনের পর দেশটির সামরিক খাত উল্লেখযোগ্য রদবদলের সাক্ষী হয়।
১৯২৩ সালে প্রজাতন্ত্র গঠনের পর মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক সরকার ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকায়ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তুরস্কের রাষ্ট্রনীতিতে সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করে।
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৫২ সালে পশ্চিমা রাষ্ট্রজোট ন্যাটোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে যায় তুরস্ক।
১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সালে সংঘটিত কোরিয়ার যুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সামরিক সহাবস্থানে যায় তুরস্ক। ইউরেশিয়া অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব কমাতে এটা তুরস্কের কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল বলে মত বিশ্লেষকদের।
তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট ও সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে তুরস্কের জনগণের কাছে সামরিক বাহিনীর অবস্থান কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
দেশটির সাম্প্রতিক টানাপোড়েন মূলত কুর্দি বিদ্রোহীগোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ারকার্স পার্টি (পিকেকে) ঘিরে। এ ছাড়া আরব বসন্তের পর থেকে উদ্ভূত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধও তুরস্কের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কূটনৈতিক কৌশল আধুনিকায়নের চেষ্টা করছে বর্তমান এরদোগান সরকার।
সামরিক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি:
২০২৪ সালে এসে তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে (টিএএফ) প্রায় আট লাখ ৯০ হাজার সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে চার লাখ ২৫ হাজার সৈন্য সরাসরি কর্মরত। বাকিদের রাখা হয়েছে সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায়।
সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী - এই তিন শাখা নিয়ে তুরস্কের সামরিক বাহিনী গঠিত।
দেশের বার্ষিক জিডিপির প্রায় এক দশমিক পাঁচ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয় দেশটির সরকার। এই বরাদ্দের পরিমান অর্থের হিসাবে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া দেশের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বেশ কিছু সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তুরস্ক সরকার।
প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বৃদ্ধি:
প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশ নির্ভরতা কমাতে দেশেই অস্ত্র উৎপাদন শুরু করেছে আঙ্কারা। বেরাক্তার টিবি২-এর মতো অত্যাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে তারা। এ ছাড়া শক্তিশালী নৌঘাটি ও সাঁজোয়াযান তৈরির মাধ্যমে প্রতিরক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে তুরস্ক।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন:
তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গুরত্বারোপ করায় দেশেই আনম্যান্ড অ্যারিয়াল ভেহিকলসের (ইউএভি) মতো আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি সম্ভব হয়েছে। এদিকে প্রথমবারের মতো দেশের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কান ফাইটার উদ্ভাবনে প্রায় সফলতার দ্বারপ্রান্তে তুরস্ক।
আঞ্চলিক সামরিক অবস্থান:
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তুরস্কের সামরিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্ববহ। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও কাতারে দেশটির সামরিক সদস্যের কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। আঞ্চলিক কূটনীতিতে তুরস্কের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। সিরিয়ার সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পেছনে তুরস্ক সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) ভূমিকা এই বক্তব্যকেই প্রমাণ করে।
তুরস্কের সামরিক জোট:
ন্যাটোর সঙ্গে মিলে নিয়মিত সামরিক অভিযান পরিচালনা করে তুরস্ক। এ ছাড়া মুসলিম বিশ্বে কূটনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করতে পাকিস্তান ও আজারবাইজানের মতো ন্যাটো-বহির্ভূত দেশে সঙ্গেও ইতিবাচক সামরিক জোট গঠন করেছে দেশটি।
তুরস্কের পরমাণুনীতি।
বর্তমানে কোনো পারমাণবিক গবেষণা কার্যক্রম না থাকলেও এই খাতে উন্নতির প্রত্যাশা করছে তুরস্ক সরকার। মূলত জলবায়ুসহায়ক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যেই পরমাণু খাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি।
১৯৭৯ সালে পারমাণবিক অস্ত্র নিষ্ক্রিয়করণ চুক্তি (এনপিটি) স্বাক্ষরের মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা উৎপাদন বাতিল করেছে দেশটি। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তি কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী এই খাতের শান্তিপূর্ণ ও জনহিতকর ব্যবহার নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর তুরস্ক।
এ বিষয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাম্প্রতিক বক্তব্য বিশ্বমহলে কিছুটা অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। ‘তুরস্ক পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারলে বিরোধীতার এখতিয়ার নেই পশ্চিমা বিশ্বের’ - প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্যের পর সমালোচনা করছেন অনেকেই।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তিগত খামতি ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তুরস্ক চাইলেও সহসাই পারমাণবিক খাতে দুরূহ শক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারবে না।
এদিকে ন্যাটোর গোষ্ঠীগত প্রতিরক্ষা অনুবন্ধের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পারমাণবিক ঘাঁটি স্থাপনে সম্মত হয়েছে তুরস্ক। তবে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক বাণিজ্যে জড়িত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে আঙ্কারার কূটনৈতিক বিশ্বস্ততা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
আধুনিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ভবিষ্যতে তুরস্কের সামরিক খাতে বেশ কিছু সংস্কারের সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে তৎপরতা বৃদ্ধি:
সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান দ্বন্দ্বে তুরস্কের সক্রিয় অবস্থান থাকবে বলেই ধারণা করা যায়। ইরাক ও সিরিয়ায় কুর্দি বিদ্রোহ দমনে দেশটির সচেষ্ট ভূমিকা প্রত্যাশা করলে ভুল হবে না।
প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি:
কূটনৈতিক অবস্থান আরও শক্ত করতে প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত অস্ত্রের বহরে দেশে উৎপাদিত আধুনিক অস্ত্রই বেশি রাখতে চাইবে তুরস্ক। গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশটি প্রতিরক্ষা খাতে সমূহ উন্নতির পরিকল্পনা করছে।
পরমাণু খাতে আগ্রহ:
এনপিটি চুক্তির কারণে পারমাণবিক বোমা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র আকার ধারণ করলে আঙ্কারা এ বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি:
রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০’র মতো আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র কেনায় ন্যাটোর সঙ্গে কিছুটা বিরোধপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক। তবে ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রেখে ন্যাটো-বহির্ভূত দেশগুলোর সঙ্গে সহাবস্থান টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী এরদোয়ান সরকার।
তুরস্কের সামরিক অবস্থান এক বিশাল সাম্রাজ্যবাদ থেকে আধুনিক যুদ্ধশাস্ত্রের পাঠ দেয়। সিরিয়ার গোলান মালভূমি থেকে গাজার শরণার্থী শিবির - সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আঙ্কারার অবস্থারের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। সার্বিক বিবেচনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট নিরসনে দেশটি শান্তিপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেই প্রত্যাশা।
সূত্র: কার্নেগি এনডাওমেন্ট, ‘চেসিং দ্য রেড অ্যাপল: টার্কিশ কোয়েস্ট ফর স্ট্র্যাটেজিক অটোনিমি’, গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইন্ডেক্স (জিএফপিআই) , আইরিস- ‘এ লুক আপন টার্কিশ ফিউচার নিউক্লিয়ার ওয়েপনস পলিসি’
নাইমুর/অমিয়/