![ইফতারে ঢাবি ক্যাম্পাসে সমবায় ব্যবস্থা](uploads/2024/04/05/1712294037.Du-Ifter.jpg)
সিয়াম সাধনার মাসে একটা সময় খাবার টেবিলে মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ইফতার করা হতো। কিন্তু সময়ের গোলকধাঁধায় সবকিছু পাল্টেছে। এখন কখনো ক্যাম্পাসের খোলা আকাশের নিচে, কখনো হলের চার দেয়ালের কক্ষেই ইফতার করতে হয়। যেখানে চেয়ার-টেবিল নেই, নেই ব্যক্তিগত প্লেট-চামচ-গ্লাস। এখন সম্মিলিতভাবে বড় গামলায় ভাগাভাগি করে ইফতার করতে হয় বন্ধুদের সঙ্গে। আমরা এই ভাগাভাগির আনন্দে পরিতৃপ্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খোলা চত্বরে ইফতার আয়োজনের ব্যাপারে জানতে গিয়ে এই অনুভূতির কথা জানা গেল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।
দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের চাইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) রমজানের আমেজ যেন বরাবরই বেশি থাকে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র হওয়াতেই ঢাবিতে সাবেক-বর্তমানসহ বহিরাগতদের এক মিলনমেলায় পরিণত হয় ইফতার পর্ব। সাবেক ও বহিরাগতদের কাছে না হলেও ক্যাম্পাসের ইফতার যেন বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছে পারিবারিক শূন্যতা ভুলে থাকার এক ভ্রাতৃত্বের ইফতার।
রোজার শুরুর দিকে ‘ক্যাম্পাসে ইফতার’ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে বিগত বছরগুলোর তুলনায় চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি ছিল না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রহমতের ১০ দিন পেরিয়ে মাগফিরাতের কয়েক দিন যেতে না যেতে সেই ধাক্কা কাটিয়ে চিরচেনা রূপে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঢাবির ইফতারের আয়োজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে টিএসসি, কার্জন হল, কলাভবন প্রাঙ্গণ, বটতলা, মল চত্বর, মিলন চত্বর, হাকিম চত্বর, সবুজ চত্বরসহ বিভিন্ন হলের মাঠসহ ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে ইফতারের আয়োজনে ব্যস্ত থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। ইফতারের ঘণ্টাখানেক বাকি থাকতেই আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। সবাই মিলে টাকা তুলে কোন কোন আইটেমের জোগান থাকবে, তা নিয়ে চলে বিশদ কর্মপরিকল্পনা। হলের ক্যানটিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের দোকান থেকে শুরু করে পলাশী কিংবা পুরান ঢাকার চকবাজারের বাহারি ইফতারি প্রায়ই স্থান পায় তাদের প্লেটে।
পদ হিসেবে থাকে ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, জিলাপি, বেগুনি, আলুর চপ, কাবাব, জিলাপি, হালিমসহ নানা মুখরোচক খাবার। এ ছাড়া থাকে তরমুজ, আনারস, পেয়ারা, কলা, খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল। গত বুধবার ঘড়িতে সময় তখন সাড়ে ৫টা পেরিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) বোতলে করে শরবত তৈরি করছিলেন সাদিক। এর মাঝেই কথা হয় ইংরেজি বিভাগের ছাত্র সাদিকের সঙ্গে।
তিনি খবরের কাগজকে বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার করতে ভালো লাগছে। গামলায় সব একসঙ্গে করে ইফতারের এই যে আয়োজন, এটি বেশি উপভোগ করা হয়। হালকা খুনসুটি আর খাবারের প্রতিযোগিতায় পরিবারের শূন্যতা অনেকাংশেই দূর হয়ে যায়। হয়তো টেবিলে বসে ভাই-বোন, মা-বাবাকে নিয়ে বসতাম, কিন্তু এখানে বসা হয় খোলা আকাশের নিচে। সব মিলিয়ে অল্প মন খারাপ হলেও বন্ধুদের সংস্পর্শে নিমেষেই সেই খারাপ লাগা দূর হয়ে যায়।
গোল হয়ে বসে থাকা পাঁচ বন্ধুর সেই গ্রুপে সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তারেক। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা ছিল যে আমরা টিএসসিতে ইফতার করব। আগেকার সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ ইফতার করা হচ্ছে।’
কয়েক কদম এগোতে চোখে পড়ল সাত-আটজনের আরেকটি গ্রুপ। তারাও গোল হয়ে বসে আছেন, ইফতারি রাখার জন্য বিছিয়েছেন পত্রিকা। মুড়ি-ছোলা-বুন্দিয়া-পেঁয়াজু-বেগুন-চপসহ বাহারি মুখরোচক খাবারসামগ্রী একসঙ্গে মাখছেন হৃদয়, তিনিও ঢাবির শিক্ষার্থী। একদিকে হৃদয় খাবারগুলো একত্রে করে মাখছেন, অন্যদিকে তার গ্রুপের বাকি বন্ধুরা অবশিষ্ট পেঁয়াজু-বেগুন-ডিম চপ-আলুর চপ-সবজি পাকৌড়া-চিকেন টিকিয়া একসঙ্গে টুকরো করে ছিঁড়ছেন এবং হৃদয়ের মাখানো খাবারে সেগুলো মিলিয়ে দিচ্ছেন। খাবার মাখতে মাখতে কথা হয় হৃদয়ের সঙ্গে।
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘সাধারণত এভাবেই হলে ইফতার করি। হলের কক্ষে প্রতিদিনই একসঙ্গে তিন-চারজন বসে এভাবে ইফতার করা হয়। এখানে আমরা আলাদা আলাদা প্লেট সাজিয়ে খেতেও পারতাম। কিন্তু এক প্লেটে-একসঙ্গে খাওয়ার যে আনন্দ, সেটি তো উপভোগ করতে পারতাম না। মনে হয় এভাবে ইফতারি করা হলে বন্ধুদের মাঝে সম্পর্ক সুদৃঢ় ও গাঢ় হয়। হয়তো কয়েক বছর পর সবাই যখন এই ক্যাম্পাস ছেড়ে অন্যত্র চলে যাব তখন স্মৃতিতে এসব দৃশ্য জাজ্বল্যমান হয়ে থাকবে। বিশেষত যখন রমজান আসবে, সেই স্মৃতি অনেকটা ফিনকি দিয়ে উঠবে।’
বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং সঙ্গে বহিরাগতরাও। পাঁচ-ছয় বছর আগে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করেছেন সুমন, বর্তমানে কর্মরত রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকে।
তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা যারা এসেছি সবাই আমার ব্যাচের হলেও বিভিন্ন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী রয়েছেন এই ইফতারে। পূর্বপরিকল্পনায় ছিল যে আমরা ক্যাম্পাসে ইফতারের আয়োজন করব। সেই থেকেই অফিস শেষে তাড়াহুড়ো করে টিএসসিতে এসে একসঙ্গে ইফতার করা।’
অতীতচারী হয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এখানে (টিএসসি) সহ ক্যাম্পাসের কত জায়গায় ইফতার করেছি। বেশ মনে পড়ে এখনো। পরিবার সেই সময় কাছে না থাকলেও সেসব দিন ছিল বেশ রোমাঞ্চকর।’