![চোখ রাঙাচ্ছে নিপাহ ভাইরাস](uploads/2024/01/31/1706786040.Manikganj-Nipah-virus.jpg)
মানিকগঞ্জ সদরের ঘোস্তা বাজারের প্রসাধনী ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে দোকানের কর্মচারী মোহাম্মদ তামিমকে দিয়ে এক লিটার কাঁচা খেজুরের রস কিনে আনেন। পরে তামিমসহ আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ওই রস পান করেন। শীতের শুরুতে খেজুরের রস খেতে পছন্দ করতেন তিনি। এই রস কারও কোনো সমস্যা না করলেও অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবুল। প্রথমে তাকে ভর্তি করা হয় সদর হাসপাতাল। অবস্থার অবনতি হলে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে দেওয়া হচ্ছিল চিকিৎসা। তখনই জানা গেল, তিনি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত। সেখান থেকে বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করার পরও বাঁচানো যায়নি বাবুলকে। চলতি বছর এটিই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু। দুই সন্তানের জনক বাবুলের বাড়ি সদর উপজেলার পুটাইল ইউনিয়নের মান্তা গ্রামে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানিকগঞ্জে যেহেতু প্রচুর খেজুর রস উৎপাদন হয়, তাই এই এলাকা নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। স্থানীয়দের কাঁচা খেজুরের রস না খেতে পরামর্শ দেওয়ার হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালে রাখা হয়েছে একটি ডেডিকেটেড কেবিন। কোনো রোগী এলে এখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হবে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৮৩ হাজার খেজুর গাছ আছে। আর এসব গাছের এক-তৃতীয়াংশই হরিরামপুর উপজেলায়। এখানেই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড়। শীত মৌসুমের প্রথম দিকে বিভিন্ন জেলা থেকে মৌসুমি গাছিরা এসে অযত্নে থাকা গাছগুলোকে ভাড়া নেন। আকারভেদে প্রতিটি গাছের জন্য গুনতে হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। প্রতিদিন বিকেলে গাছিরা দা, নলি নিয়ে খেজুর গাছের চাচ দেওয়া অংশ কেটে ছোটবড় হাঁড়ি বেঁধে রাখেন। পরদিন সকালে রস সংগ্রহ করেন। তবে, শীতের সকালে দল বেঁধে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া একটি প্রচলনে পরিণত হয়েছে। রসের মান ও ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই এখানে রস খেতে আসেন। তবে, মানিকগঞ্জের অধিকাংশ খেজুর গাছে শুধু হাঁড়ি বাঁধা থাকে। এর ওপরের অংশে থাকে না কোনো কাপড় বাঁধা।
বাবুল হোসেনের বাবা মো. মাইনুদ্দিন বলেন, ‘জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমার ছেলে, তার দোকানের কর্মচারী তামিমসহ মোট চারজন এক বোতল কাঁচা খেজুরের রস কিনে পান করে। দুই সপ্তাহ পরে ঠাণ্ডা-কাশি ও জ্বর নিয়ে ১৬ জানুয়ারি মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে বাবুলকে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ১৮ জানুয়ারি ভোরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। এ সময় লক্ষণ প্রকট থাকায় নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় আইইডিসিআরে। ২৪ জানুয়ারি বাবুলের নিপাহ ভাইরাস পজিটিভ আসে। অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় শনিবার রাত ৮টার দিকে ওই হাসপাতাল থেকে বাবুলকে মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েক ঘণ্টা পরেই বাবুল মারা যায়।’
হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার গাছি জয়নুদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘আমি তো গুড় তৈরির জন্য রস আনি। যারা আসেন তাদের বলি যে আমার হাঁড়িতে কোনো কাপড় দেওয়া ছিল না। তার পরও তারা আমার থেকে কিনে খান। খাওয়ার সময় বলেন, একটু খেলে কিছুই হবে না। আমি আর কী করব বলেন? এতো গাছের মধ্যে কাপড় বাঁধাও কষ্টকর।’
মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. কাজী এ কে এম রাসেল বলেন, ‘ঠাণ্ডা-কাশি ও জ্বর নিয়ে ১৬ জানুয়ারি মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে বাবুল হোসেন ভর্তি হন। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ১৮ জানুয়ারি ভোরে স্বজনরা ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের ভর্তি করেন। পরে জানা যায়, তিনি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শনিবার মারা গেছেন। যেহেতু মানিকগঞ্জে একজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাই আমরা সদর হাসপাতালে একটি কেবিন আলাদা করে রেখেছি। এমন কোনো রোগী এলে তাদের এই কেবিনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ সিভিল সার্জন মোয়াজ্জেম আলী খান বলেন, ‘নিপাহ ভাইরাস মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে বাদুড় রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত থাকলে এবং সেই রস মানুষ পান করলে তার মধ্যেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
মানিকগঞ্জ নিপাহ ভাইরাসে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জেলার একজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত শনিবার রাতে ঢাকায় মারা গেছেন। যেহেতু মানিকগঞ্জে খেজুরের রসের কেনাবেচা হয় সেক্ষেত্রে এর ঝুঁকিতো অবশ্যই আছে। আর আমরা শীত মৌসুমের প্রথম থেকেই কাঁচা খেজুরের রস না খাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছি।’
বাংলাদেশে মেহেরপুর জেলায় ২০০১ সালে প্রথম নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছর মোট আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে ৯ জনই প্রাণ হারান। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ৬৭ জন রোগী পাওয়া যায় ২০০৪ সালে, তাদের মধ্যে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ৩৩৯ জনের নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে ২২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ এই রোগে আক্রান্ত হলে ৭০ দশমিক ৭৯ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছেন।