![যশোরের অর্ধশতাধিক গণকবরের বেহাল দশা](uploads/2024/03/25/1711345397.jossor-111.jpg)
যশোরে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভ ও গণকবরগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। প্রায় অর্ধশত গণকবর সংরক্ষণের অভাবে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বেহাল রয়েছে বেশ কিছু বধ্যভূমি।
সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমির জায়গা-জমি। সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়ায় কোথাও কোথাও বধ্যভূমির জায়গায় বাড়িঘর ও দোকানপাট তৈরিরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবিলম্বে শহিদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের স্মৃতি জড়িত অন্তত অর্ধশতাধিক বধ্যভূমি রয়েছে যশোরে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ‘পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের বর্বরতার এসব স্মৃতিচিহ্ন।’
তিনি বলেন, ‘যশোর শহর ও শহরতলীতে ২০টির মতো বধ্যভূমি রয়েছে। জেলার ৭টি উপজেলায় রয়েছে আরও অসংখ্য বধ্যভূমি। এরমধ্যে ২০টির মতো বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে যশোরের সরকারি মুরগি ফার্ম বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, শহরতলীর চাঁচড়া বধ্যভূমি, রেলস্টেশন মাদ্রাসার শহিদদের গণকবর, ফার্টিলাইজার ফার্ম গণকবর, ক্যান্টনমেন্ট রোডের ক্লাবে রক্তঋণ সমাধি, শহিদ স্মৃতিফলক, শহিদ লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেনের চার সহযোদ্ধার স্মৃতিফলক, বারিনগর শহিদ লেফটেন্যান্ট আনোয়ারের সমাধি, খাজুরা এমএন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিফলক, বাহাদুরপুর গ্রামের শহিদদের স্মৃতিফলক, বকচর শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভ ও খুলনা বাসস্ট্যান্ড বিজয়স্তম্ভ।
আফজাল হোসেন দোদুল আরও বলেন, ‘তদারকির অভাবে বর্তমানে বেহাল আছে যশোর-খুলনা মহাসড়কের উত্তর পাশে রূপদিয়া নীলকুঠি বধ্যভূমি। এর বেশির ভাগ জায়গা দখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া ধোপাখোলায় রয়েছে ২৩ জন শহিদের স্মৃতিস্তম্ভ, নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে চারুবালা করের সমাধি, ফাতিমা হাসপাতালে শহিদ স্বপন বিশ্বাস ও তার সহযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভ, চৌগাছার ডাকবাংলো, মণিরামপুরে পাঁচ সূর্য সন্তানের কবরসহ অর্ধশতাধিক গণকবর অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশের দোসররা বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীসহ নিরীহ শত শত মানুষকে ধরে এনে এসব বধ্যভূমিতে হত্যা করেছে। শহরের অন্যতম বধ্যভূমি শংকরপুর রায়পাড়া এলাকায় হত্যা করা হয়েছিল অসংখ্য মানুষকে। যশোর জেনারেল হাসপাতাল, বকচর, কোতোয়ালি থানা ও রেলস্টেশন মাদ্রাসা সংরক্ষিত এলাকায় হত্যা করা হয়েছে কয়েক শ সাধারণ মুক্তিকামী মানুষকে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম গণকবরসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলোকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, ‘ইতোমধ্যে সরকার মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো বাঙালির সংগ্রামের চিহ্ন। আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে বধ্যভূমিগুলো। এগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব না হলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসজুড়েই গোটা জেলার ওপর পাকিস্তানি হানাদার ও দোসররা নির্মম তাণ্ডব চালিয়েছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীসহ নিরীহ শত শত মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছে বধ্যভূমিতে। শহরের অন্যতম বধ্যভূমি শংকরপুর রায়পাড়া এলাকায় হত্যা করা হয়েছিল অসংখ্য মানুষকে। দেশ স্বাধীনের পর এখান থেকে কয়েক ট্রাক মানুষের হাড় কঙ্কাল মিত্র বাহিনী ভারতে নিয়ে যায়। এই বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও বছরের অধিকাংশ সময় এটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘শহরতলী বকচর এলাকায়ও হত্যা করা হয়েছে অনেক দেশপ্রেমিক বাঙালিকে। বকচরের নটবর বাবুর বাঁশবাগানে বিহারিরা কয়েক শ বাঙালিকে হত্যা করে। ধোপাখোলায় দুজন রাজাকারকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা ২৩ বাঙালিকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বিরামপুরেও বেশ কয়েকটি গণহত্যা চালানো হয়। ৬ ডিসেম্বর যশোরমুক্ত হওয়ার পর বিরামপুরের একটি কুয়ার মধ্য থেকেই ১০টি মানুষের মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। আর ভৈরব নদের দড়াটানা ব্রিজের পাশেও ফেলা হয়েছে অনেক মুক্তিকামী মানুষের লাশ। যশোরের ঢাকা রোড বাবলাতলা ব্রিজসংলগ্ন ভৈরব নদের তীরে বেশকিছু কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। বিভিন্ন স্থানে হত্যার শিকার এই মানুষের লাশ সুইপাররা এখানে এনে ফেলত।’