![চমেকে অর্থাভাবে বন্ধ স্মৃতিস্তম্ভের কাজ](uploads/2024/03/25/1711346156.CTG-Gono-Kobor.jpg)
আজ নয়তো কাল, মাহবুব ফিরবেই। এটা ছিল মরিয়ম খাতুনের বিশ্বাস। ছেলের পথ চেয়ে দীর্ঘ ৩২ বছর প্রহর গোনেন তিনি। কিন্তু মাহবুব আর ফেরেননি। ২০০৪ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ছেলের কাছেই চলে যান মরিয়ম খাতুন। ৩৭ বছর পর পরিবার এবং স্বজনরা জানতে পারেন, চট্টগ্রামের প্রথম চার শহিদের একজন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তার লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনে গণকবরে মাটি চাপা দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী।
শুধু শহিদ মাহবুবুল আলম চৌধুরী নন, পাকিস্তানি নরপশুরা অন্তত ২৫ জন বাঙালিকে গণহত্যা করে সেখানে মাটি চাপা দিয়েছিল। ওই গণকবরে রয়েছেন চট্টগ্রামের প্রথম চার শহিদের একজন ওমর গণি এম ই এস কলেজের ছাত্রলীগ নেতা মাহবুবুল আলম চৌধুরী, একজন দরবেশ, দুজন ইপিআর সদস্য ও আরও অজ্ঞাত ২১ জন।
মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্টের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘২৬ মার্চের পর চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ি স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত নৌ ভবনে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৭ মার্চ ছাত্রলীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (প্রয়াত সাবেক সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি), মোছলেম উদ্দিন আহমদ (প্রয়াত এমপি ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি)সহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে নির্যাতন চালায়।’
এরপর ২৮ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি দল পুরোনো বিমান অফিসের পেছনের গলি দিয়ে মেথর পট্টি হয়ে এবং লাভ লেইন দিয়ে ডিসি হিলে উঠে অবস্থান নেয়। ২৮ মার্চ ছাত্রনেতা বশরুজ্জামানসহ চারজন এক গাড়ি নিয়ে নগরীর আন্দরকিল্লা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ নিয়ে যাচ্ছিলেন।
২৮ মার্চ বিকেল ৪টায় তাদের ১১ জনের একটি দল দুটি গাড়িতে করে আন্দরকিল্লা হয়ে চেরাগী পাহাড়ের মোড় দিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি নেভাল ফোর্স ডিসি হিল থেকে তাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি করে। তারাও প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু সুসজ্জিত হানাদার বাহিনীর সামনে স্বল্প শক্তির ১১ মুক্তিযোদ্ধা টিকতে পারেননি। এই যুদ্ধে বশরুজ্জামান চৌধুরী, দিলীপ বড়ুয়া, জাফরসহ চারজন শহিদ হন। পৌর চেয়ারম্যান ফজল করিমের কেয়ারটেকার আলী এবং প্রতিবেশী জহুর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাহবুবকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।
শহিদ মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ছোট ভাই রফিকুল আলম চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘তার বড় ভাই ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ২৮ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহিদ হন। চট্টগ্রাম শহরের চেরাগী পাহাড় মোড়ের এই প্রতিরোধ যুদ্ধে তিন সহযোদ্ধা শহিদ বশরুজ্জামান চৌধুরী, শহিদ জাফর আহমদ, শহিদ দীপক বডুয়াও বীরত্বের সঙ্গে শহিদ হন। তারা হলেন চট্টগ্রামের প্রথম শহিদ মুক্তিযোদ্ধা এবং চারজনই চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ও এম ই এস কলেজ ছাত্র সংসদের সিনিয়র নেতা।’
তবে তার ভাই যে যুদ্ধের একদম শুরুতেই শহিদ হয়েছিলেন তা তারা জানতে পারেননি। সেসময় যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো না থাকায় কেউ খবর দেয়নি। আবার ফটিকছড়ির গ্রাম থেকে কেউ খোঁজ নিতে আসারও সুযোগ পাননি। স্বাধীনতার পরও ছেলে ফিরে না আসায় ১৯৭৬ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি পুত্রশোকে মারা যান পিতাও। তারপরও আশায় বুক বেঁধে ছিলেন মা ও ছোট ভাইয়েরা।
রফিকুল আলম জানান, স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম ‘মেডিকেল কলেজে একাত্তরের শহিদদের গণকবরের সন্ধান’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে ভাইয়ের সন্ধান পান তারা।
মূলত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানেই মেডিকেলের পেছনে মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণার বধ্যভূমির তথ্যটি উঠে আসে। মেডিকেলের দশম ব্যাচের ছাত্র ডা. ওমর ফারুক তার স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্যে ঐতিহাসিক এই তথ্যটি প্রকাশ করেন। ডা. ফারুক স্বাধীনতার পরপরই কলেজে এসে নিজেই দেখেছেন মাটিচাপা দেয়া জায়গাটি। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল দিনগুলোতে কর্তব্যের খাতিরে কলেজে থাকতে বাধ্য হওয়া কর্মচারীদের কাছেও গণকবরের কথা তিনি শুনেছেন।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর গণকবরের স্থানটি সংরক্ষণ করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিশেষ উদ্যোগে কাজটি শুরু হয়। গণকবরের চারপাশ পাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছে। তবে শহিদ বেদী নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই কাজটি বন্ধ হয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম খবরের কাগজকে জানান, অর্থাভাবে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।