![তালা-চাবিতেই জীবন](uploads/2024/05/11/-----1715413210.jpg)
বাড়ি-গাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, দোকানপাটসহ সবকিছুই নিরাপদ রাখার অন্যতম মাধ্যম তালা। তালা নষ্ট হলে কিংবা চাবি হারিয়ে গেলে মানুষকে পড়তে হয় চরম বিড়ম্বনায়। প্রয়োজন পড়ে তালা মেরামত কিংবা নতুন চাবি তৈরির। তালা মেরামত আর নতুন চাবি বানানোর কাজ শিখেই সংসার চালাতেন একশ্রেণির কারিগর। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নে হারিয়ে যাচ্ছে চাবি তৈরি ও তালা মেরামতের কাজ। তাই ভালো নেই তালা-চাবির কারিগররা। অনেকেই এ পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে ওমর ফারুক অন্যদের মতো হারিয়ে যাননি। প্রযুক্তির কল্যাণে নিজেকেও করেছেন পরিবর্তন। প্যাড তালা মেরামতের মাধ্যমে এ পেশায় এলেও বর্তমানে ওমর ফারুক বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবাসের তালা মেরামত করেন। সেখানে তিনি ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যারের মাধ্যমেই বেশির ভাগ কাজ করেন।
গ্রাম থেকে ১৯৯৮ সালে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় আসেন ওমর ফারুক। সংসার চালানোর জন্য পরিবারের অন্য সদস্যরা চাকরি বা কোনো কাজ করা শুরু করেন। ঢাকায় আসার পর দূরসম্পর্কের এক মামার সঙ্গে পরিচয় হয় ওমর ফারুকের। এরপর ২০০১ সালে তাদের তালা-চাবি মেরামতের দোকানে কাজে যুক্ত হন। কিশোর বয়সেই পড়াশোনার পাশাপাশি তালা-চাবি মেরামতের কাজ শিখতেন তিনি। এরপর কয়েক বছর কাজ শেখার পর তিনি গ্রামে ফিরে যান। মাঝখানে বিরতি দিয়ে ২০১২ সালের দিকে ঢাকায় ফিরে অন্যজনের দোকানে আবারও তালা-চাবি মেরামতের কাজে যুক্ত হন। সেই দোকানে কাজ শেখার অবস্থায় তিনি চিন্তা করেন, নিজের একটা দোকান হলে অনেক ভালো হতো।
সেই চিন্তা থেকে ২০১৪ সালের দিকে নিজেই একটা দোকান দেন। সেই সময়ে তিনি প্যাড তালা মেরামতের কাজ দিয়ে দোকান চালু করেন। তবে কয়েক বছর কাজ করার পর দেখেন, উন্নত প্রযুক্তির ডিজিটালসহ বিভিন্ন ধরনের তালা-চাবি বাজারে এসেছে। এগুলো বেশ টেকসই। ফলে পুরাতন তালা-চাবি মেরামত করতে তেমন কেউ আর আসেন না। এতে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। এসব দেখে ওমর হতাশ হলেও ভেঙে না পড়ে তিনিও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু করার চিন্তা করেন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালা-চাবি মেরামতের প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ শেখার বিদেশি অনলাইন কোর্সের খোঁজ পান তিনি। যেখানে তারা ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবাসের তালা-চাবি মেরামতের কাজ শেখান। তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব কাজ শিখে নেন। তবে এ কাজ শিখতে ওমরকে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয়েছে।
এরপর ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রো-মাইক্রোবাসের তালা-চাবি মেরামতের কাজ শুরু করেন ওমর। ধীরে ধীরে তার সেই কাজের সুফল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বাড়তে থাকে তার কাজ। বর্তমানে শুধু ওমর নিজের দোকানেই নয়, ঢাকার বিভিন্ন গাড়ির শোরুম ও গ্যারেজে গিয়ে কাজ করে থাকেন। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েও এসব কাজ করেন। এতে বর্তমানে এ কাজের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করেন ওমর। মা-বাবা, ভাইবোন ও স্ত্রী এবং দুই সন্তানসহ ১০ সদস্যের পরিবার তার। এ উপার্জন দিয়ে বর্তমানে সচ্ছলভাবে চলছে ওমরের সংসার।
অন্যদিকে, আরও একটি নতুন দোকান দিয়েছেন ওমর ফারুক। যেখানে দুজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সেই দোকানে তারা প্যাড তালা-চাবি মেরামতের কাজ করেন। একই সঙ্গে তাদেরকেও মাইক্রোবাসের তালা-চাবি মেরামতের কাজও শেখাচ্ছেন ওমর ফারুক।
হতাশা নিয়ে অনেকেই এ পেশা থেকে দিন দিন সরে যাচ্ছেন এবং এর মাঝে কীভাবে আপনি টিকে আছেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে ওমর ফারুক বলেন, বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে সব তালা-চাবির ধরন বদলেছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট, কি-কার্ডস, কোড সংমিশ্রণ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সব তালা-চাবি ব্যবহৃত হচ্ছে শহরের প্রতিটি বাড়িতে। তাই কদর কমেছে এসব এনালগ তালা-চাবির মিস্ত্রিদের। তার ওপর আবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হয় এ পেশার মানুষকে। তাই অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন।
এ পরিস্থিতি দেখে আমি একদম হতাশ হয়ে যাই। কিন্তু হেরে না গিয়ে এ পেশাতেই নতুন কিছু করার চিন্তা করি। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদেশি অনলাইন কোর্সের খোঁজ পাই। তারা ডিজিটাল মেশিন ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোবাসের তালা মেরামতের কাজ শেখায়। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব কাজ শিখি।
ওমর ফারুক বলেন, বর্তমানে প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ শিখে প্রতি মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা ইনকাম করছি। কাজ বেশি হলে ইনকামও বেশি হয়। আল্লাহর রহমতে পরিবার নিয়ে বর্তমানে ভালোভাবেই চলতে পারছি।