![রাসেলস ভাইপারে আতঙ্ক নয়](uploads/2024/06/29/rasel viper-1719665892.jpg)
রাসেলস ভাইপার। বর্তমান সময়ে আলোচিত এক সাপের নাম। রাসেলস ভাইপারের দংশনে মানুষের মৃত্যু হবেই এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। মৃত্যু হয় অবহেলায়। সর্পদংশনের পর সঠিক চিকিৎসা করালে এটাকে পাত্তা দেওয়ার কিছুই নেই।
কিন্তু হঠাৎ করে এ সাপের উৎপাত কেন শুরু হলো? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার সবসময়ই কমবেশি ছিল। কিন্তু খাদ্যের অভাবে সেভাবে বংশবিস্তার করতে পারেনি। এখন জমিতে একাধিকবার ফসল হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ইঁদুর। এই ইঁদুর খেয়েই সাপ বংশবিস্তার করতে পারছে। আবার এখন মোবাইলে সাপের ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া যাচ্ছে। মানুষ সহজেই জানতে পারছে। এমন ব্যবস্থা আগে সেভাবে ছিল না বললেই চলে। ফলে রাসেলস ভাইপার থাকলেও মানুষ তা জানত না।
এই সাপের গায়ের রং এবং প্যাটার্নের সঙ্গে মিল থাকায় অনেকেই বিষহীন বালুবোড়া সাপের সঙ্গে বিষাক্ত রাসেলস ভাইপারকে গুলিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে চিনেনই না। ঝোপঝাড়, পরিত্যক্ত জমি কমে যাওয়ায় এই সাপ জমিতে, আইলে বসবাস করছে। আর এর নির্মমতার প্রথম শিকার হচ্ছে কৃষকরা। নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সাপ পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ থেকে আসতে পারে। এমনটাও বলেছেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলো, বন্যপ্রাণী ও সাপ বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ। বাংলাদেশের সাপ ও সর্পদংশন প্রতিরোধ ও চিকিৎসাবিষয়ক বইয়ের অন্যতম লেখক তিনি। রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মধুপুরের শালবন, চট্টগ্রামের পটিয়া, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের বিস্তৃতি ছিল। ২০০২ সালে সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুটি সাপ মারা হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের জাদুঘরে আছে। এরপর ২০০২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের খবর পাওয়া যায়নি। এমনকি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কোনো রাসেলস ভাইপার দংশিত রোগীর সন্ধানও পাওয়া যায়নি।
২০১৩ সালে রাজশাহীর আমনুরা উপজেলার ২২ বছরের এক ছাত্র বাড়ির পাশের জঙ্গলে অজগরের বাচ্চা ভেবে সাপ ধরতে গিয়ে হাতে দংশিত হয়। পরে সাপটি মেরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে গেলে সেই ছবি আমাদের কাছে পাঠালে সেটিকে চন্দ্রবোড়ার বাচ্চা বলে শনাক্ত করা হয়। সেটি ছিল বাংলাদেশের রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সর্পদংশিত রোগীর হাসপাতালে যাওয়ার প্রথম রেকর্ড। পাঁচ ডোজ অ্যান্টিভেনম দিলেও ১৪ দিন পরে ছেলেটি মারা যায়। তারপরই আমরা বন্যপ্রাণী গবেষক এবং চিকিৎসকরা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করি।
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপটি মূলত পদ্মা নদী এবং এর বিভিন্ন শাখা নদী দিয়ে বিভিন্ন জেলার চরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় রাসেলস ভাইপারের অবস্থান, দংশন, মৃত্যু ও হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
চন্দ্রবোড়া সাপ ডিম পাড়ে না, এটি সরাসরি বাচ্চা দেয়। সাধারণত ২০ থেকে ৪৫টি বাচ্চা দেয়, তবে সর্বোচ্চ ৭৫টি বাচ্চার রেকর্ড রয়েছে। বাচ্চাগুলো বাঁচার হার অনেক বেশি, সেজন্য এরা দ্রুত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া ভালো সাঁতার কাটতে পারে।
তবে এতদিন নদীর চরাঞ্চল এলাকায় রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি থাকলে এখন তা লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে যেসব রাসেলস ভাইপারের বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে তার সিংহভাগই স্ত্রী প্রজাতির। সাপ বিশেষজ্ঞ বোরহান বিশ্বাস রোমন বলেন, আমরা পদ্মাকেন্দ্রিক ৭-৮ বছরের ডেটা কালেক্ট করেছি। দেখা যাচ্ছে, রাসেলস ভাইপারের জুভেনাইল বেবিদের (দেশে জন্ম নেওয়া এবং বছরের বাচ্চা বা গত বছরের বাচ্চা) মধ্যে ৭৮ ভাগই স্ত্রী প্রজাতির।
রাসেল ভাইপারের বিষ দাঁত অনেক বড় প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা এবং এরা প্রচণ্ড তীব্র গতিতে অর্থাৎ ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে দংশন করতে পারে। এরা সাধারণত স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে দংশন করে। সাপ যতটা লম্বা তার তিন ভাগের দুই ভাগ দূরত্বে গিয়ে দংশন করতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে অ্যান্টিভেনম দিয়ে সর্পদংশিত রোগীর চিকিৎসা করা হয় সেটি ভারত থেকে আমদানি করা। এটি পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম অর্থাৎ এটি দিয়ে বাংলাদেশের ২ প্রজাতির গোখরা (Cobra), ৫ প্রজাতির কেউটে (Krait) এবং রাসেলস ভাইপার (Russells viper) সাপের চিকিৎসা করা হয়। সময়মতো হাসপাতালে গেলে এবং চিকিৎসা হলে রাসেলস ভাইপার দংশন করা রোগী বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক।
রাসেলস ভাইপারকে চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়াও বলা হয়। ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের খেতে বাস করে। এরা ফোস ফোস শব্দ করে। দংশন করেও জায়গা ছেড়ে যেতে চায় না। রাসেলস ভাইপার দংশন করার পর দংশিত স্থানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হয় এবং ফুলে যায়। সেই সঙ্গে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এর আশপাশের কিছু জায়গাও ফুলে যায়। এ ছাড়া দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারী হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
রাসেলস ভাইপার সাপের বিষ তীব্র রক্ত ধ্বংসকারী বা হোমটক্সিন প্রকৃতির। এই বিষে শরীরের রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। ফলে ফুসফুস বা কিডনি বিকলের কারণে রোগী মারা যেতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসা না করালে দংশনের ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যেও রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এমনকি ২১ দিনের মাথায়ও মৃত্যুর নজির আছে। রাসেলস ভাইপারের বিষ শরীর থেকে মুক্ত হলেও চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। কারণ বিষ যতক্ষণ শরীরে থাকে ততক্ষণে লিভার, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) ২০২৩ সালের এক গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ৩ হাজার মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। সাপ দংশনের প্রথম ১০০ মিনিট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি এম এ ফয়েজ। সাপের দংশন ও এর ওপর চিকিৎসা নিয়ে বই লিখেছেন তিনি। তার মতে, গোখরা সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপ দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরি।
সর্পদংশনে করণীয়
সাপ দংশন করলে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। এর প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাক্তার আয়ান সিমপসং বলেছেন- Do it Right অর্থাৎ সঠিক কাজটি করতে হবে। R- Reassure, I- Immobilise, GH- Go to Hospital, T- Tell the Doctor.
সর্পদংশনের পর রোগীকে সাহস দিতে হবে। শান্ত রাখতে হবে। সর্পদংশিত অঙ্গের নড়াচড়া বন্ধ রাখা, যাতে বিষ শরীরে দ্রত ছড়িয়ে না পড়ে। অধিকাংশ সাপ হাতে বা পায়ে দংশন করে, দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া না করার ফলে শরীরে বিষ ছড়াতে সময় লাগে। পায়ে দংশন করলে লাঠি বেঁধে পা সোজা করে স্ট্রেচারে শুইয়ে দ্রত চিকিৎসাকেন্দ্রে নিতে হবে। চিকিৎসককে সব খুলে বলতে হবে। উল্লেখ্য, যেকোনো ধরনের বাঁধনে সাপের বিষ আটকাতে পারে না। এতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত-পা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে চন্দ্রবোড়া ও সবুজবোড়া সর্পদংশনে বাঁধন মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
রাসেলস ভাইপার থেকে বাঁচতে করণীয়
- জমিতে কাজের সময় অবশ্যই গামবুট পরতে হবে। সম্ভব হলে হাতে গ্লাভস থাকা উত্তম।
- রাতে লাইট নিয়ে চলাফেরা করতে হবে। রাতে জমিতে কাজ না করা ভালো। জমি এবং জমির আইলে হাঁটার সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
- জমির ধান, ভুট্টাসহ নানা ফসল কাটার জন্য যান্ত্রিক মেশিন ব্যবহার করতে পারলে ভালো হয়। জমির আইল দিয়ে হাঁটার সময় সচেতন থাকা দরকার।
- রাসেলস ভাইপার হিস হিস শব্দ করে। যা কানে বেশ জোড়েই শোনা যায়। এ কারণে হিস হিস শব্দ শুনলে সাবধান হতে হবে।
কাজ করার সময় মাটিতে শব্দ করা যেতে পারে। যাতে সামান্য হলেও কম্পন সৃষ্টি হয়। রাসেলস ভাইপার কম্পন বুঝতে পারে।
ভুল ধারণা
রাসেলস ভাইপার দ্রুত দংশন করতে পারে। কিন্তু এরা তেড়ে এসে দংশন করে না। এরা খুব অলস প্রকৃতির সাপ। কুণ্ডলি পাকিয়ে বসে থাকে। রাসেলস ভাইপারের দংশনের সঠিক চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে সঠিক চিকিৎসা আছে।
/আবরার জাহিন