![অন্য দরজা](uploads/2024/06/22/bire-k-1719041173.jpg)
ফজরের নামাজের সালাম শেষ করতে না করতেই, হঠাৎ করে ফোনের রিংটা বেজে উঠল।
মিসেস জামিল হকচকিয়ে গেলেন, এত সকালে ফোনের রিং শুনে। আজেবাজে স্বপ্নের কারণে এমনিতেই কাল সারা রাত অনেক অস্থিরতায় কেটেছে। এক ফোঁটা ঘুমাতে পারেননি। তারপরও শান্তভাবে ফোনটা তুললেন। ফোনের ওই পাশ থেকে অপরিচিত কণ্ঠ বলে উঠল- আসসলামু ওয়ালাইকুম ম্যাম, আমি ক্যাপ্টেন শাদিদ বলছিলাম কাশ্মীর সীমান্ত থেকে!
কাশ্মীর নামটা শুনে মিসেস জামিলের বুকের ভেতর ধক করে উঠল। তারপর ঠাণ্ডাভাবে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, আমি মিসেস জামিল বলছিলাম। অস্থিরতায় গলা-বুক সব শুকিয়ে গেল।
যে খবরটা উনি শুনতে চান না, সেটাই আবার শুনতে হবে না তো! তার এত চিন্তার মধ্যে ক্যাপ্টেন শাদিদ আস্তে করে বললেন, মোবারকবাদ ম্যাম! আপনার জন্য দুটো সংবাদ আছে, একটা ভালো সংবাদ, আরেকটি খারাপ সংবাদ। অবশ্য কথাটি বলতে গিয়ে ক্যাপ্টেন শাদিদের বারবার গলা ধরে আসছিল। মিসেস জামিল বুঝে ফেললেন, তাই খুব শান্তভাবে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, আমি খুশির খবরটা আগে জানতে চাচ্ছি।
ক্যাপ্টেন শাদিদ আবার বললেন- ম্যাডাম আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য মোবারকবাদ। আল্লাহ আপনাকে আখিরাত এবং দুনিয়াতে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। খারাপ খবর হচ্ছে ক্যাপ্টেন হুসাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি কিছুক্ষণ আগে শহিদ হয়েছেন। আপনি একজন শহিদের মায়ের মর্যাদায় আল্লাহর দরবারে ভূষিত হয়েছেন। ক্যাপ্টেন হুসাম সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন দেশকে হেফাজত করার জন্য। শহিদ হওয়ার আগ পর্যন্ত পিছ পা হননি, বীরের মতো লড়ে গেছেন। সুরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বোঝ না। ক্যাপ্টেন শাদিদ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একেবারে চুপ হয়ে গেলেন।
মিসেস জামিলের মাথায় তখন কোনো কাজ করছিল না, ক্ষতবিক্ষত মনটাকে জোর করে মানাতে চাইলেন। নিজেকে বুঝালেন- আল্লাহকে ভালোবেসে সব কিছু তাকে প্রশান্ত চিত্তে মেনে নিতে হবে। তারপর চুপ হয়ে আস্তে করে ফোনটা রেখে দিলেন।
তার পাঁচ মেয়ের পর হুসামের জন্ম, নামটি তার বড় মেয়ে খুব আদর করে রেখেছিল। নামের অর্থ ধারালো তরবারি। তার ছেলে ধারালো তরবারিব মতোই মেধাবী। ভদ্র, চুপচাপ হুসামকে কখনো কোনো কিছুর জন্য বলতে হয়নি। মেধাবীর পাশাপাশি দেখতে সুন্দর। মাঝে মাঝে তিনি নিজে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন তার ছেলের দিকে। এত সুন্দর কেন তার ছেলে? আবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ডেকে আদর করে বলতেন, আমার নজরই তো তোমার ওপর লেগে যাবে। তোমার জন্য আমি কোথা থেকে বউ আনব। ছেলে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রাখতেন। হুসাম তার বাবার পথে চলল। আব্দুল জামিল রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার, হুসামের স্বপ্ন দেশের সেবা করবে। মিসেস জামিল প্রথমে বাধা দিয়েছিলেন কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছিল। এত কিছু ভাবার সময় তো এখন না, তার ছেলের চলে যাওয়ার খবরটা তার মেয়েদের ও আব্দুল জামিলকে জানাতে হবে।
আচ্ছা ওরা কি আল্লাহর সিদ্ধান্তটাকে পরম চিত্তে মেনে নেবে। নাকি নাফরমানি করবে! তাদের ঘরের সবচেয়ে আদরের মানুষটা মাত্র ২৫ বছরেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। এই খবরটা কীভাবে দেবে সেই চিন্তাই করতে লাগলেন। তারপরও উঠে দাঁড়িয়ে মনকে শক্ত করে, নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কেন মানবে না? হুসাম শহিদ হয়েছে।
এর চেয়ে সৌভাগ্য আর তাদের জন্য কী হতে পারে! এটা মনে করতেই বাস্তবে ফিরে আসেন, আব্দুল জামিলকে ঘুমের মধ্যে খবরটি দেওয়া যাবে না, খুব ধীরে সুস্থে তাকে জানাতে হবে। তারপর শোবার রুমে গিয়ে আস্তে করে আব্দুল জামিলকে ঘুম ডেকে তোলেন। জামিল সাহেবও ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়তে চলে গেলেন, নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসলেন। ঠিক তখন মিসেস জামিল কানের কাছে এসে বললেন- মোবারকবাদ তোমাকে! তোমার জন্য সুসংবাদ আছে। জামিল সাহেব অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
মিসেস জামিল খুব শান্ত থেকে বললেন- তুমি একজন শহিদের বাবার মর্যাদায় ভূষিত হয়েছ।
জামিল সাহেব স্তব্ধ হয়ে গেলেন, কিছুক্ষণ বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন! মিসেস জামিল তাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জামিল সাহেব সান্ত্বনার শীতল স্রোতে অবশ হয়ে গেলেন। আর মিসেস জামিল সাহসী মা, অশ্রুহীন চোখে ছেলের জন্য দোয়ার হাত তুলে মুখে উচ্চারণ করলেন ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল, নিমাল মাওলা ওয়া নিমান নাসির’ (আল্লাহ তাআলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনিই হলেন উত্তম কর্মবিধায়ক; আল্লাহ তাআলাই হচ্ছে উত্তম অভিভাবক এবং উত্তম সাহায্যকারী)।
যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
কলি