![সাপের বন্ধু রাজু](uploads/2024/06/08/Untitled-1-1717828722.jpg)
ছোটবেলায় সাপের খেলা দেখতে বসেছিলেন। সাপুড়ে দুটি সাপ তার হাতে দিলে তা তর তর করে গলা পেঁচিয়ে ধরে। কিন্তু ছোবল মারেনি। এরপর বড় হয়ে দেখলেন, অকারণে মানুষ নিষ্ঠুরভাবে সাপ হত্যা করছে। আর ছোটবেলায় সাপ গলা পেঁচিয়ে ধরলেও দংশন না করায় সাপের প্রতি তার এক ভালোলাগা, ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল। দিন দিন এই ভালোবাসায় যেন তিনি হয়ে উঠেছেন সাপের বন্ধু।
এ পর্যন্ত বিষধর, বিষহীন মিলিয়ে মোট ২৫০টিরও বেশি সাপ উদ্ধার করে বনে ছেড়ে দিয়েছেন। সেবাযত্ন দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন ২০টিরও বেশি অসুস্থ সাপ। সাপ ছাড়াও পাখি, বানর, প্যাঁচা, কচ্ছপসহ প্রায় ৫০টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেছেন তিনি। সাপপ্রেমী এই মানুষটির নাম মো. রাজু আহমেদ। বর্তমানে বাংলাদেশ স্নেক রেসকিউ টিমের সভাপতি তিনি। গ্রামের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুড়ার চরপারা গ্রামে। বাবা সাকোয়াত হোসেন এবং মা মোছাম্মদ রিনা খাতুনের তিন সন্তানের মধ্যে বড় তিনি। স্নেক রেসকিউ টিম সম্পূর্ণ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর বেশির ভাগ সদস্য ছাত্র। বর্তমানে এ টিমে মোট ৫০ জন সদস্য ও ২০০ জন তথ্যদাতা আছেন। সংগঠনটি এ পর্যন্ত ২ হাজার ২০০-এর বেশি সাপ উদ্ধার করে উপযুক্ত স্থানে অবমুক্ত করেছে বলে রাজু জানান।
রাজু ২০২০ সাল থেকে বিপদগ্রস্ত সাপ উদ্বার করে আসছেন। তবে প্রথম সাপ উদ্ধারকর্মের সূচনা হয় ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন। নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। তখন জালে জলঢোঁড়া সাপ উঠলে তা জাল থেকে বের করে বনে ছেড়ে দিয়েছেন। বসতবাড়ি, পুকুরে পাতা জালসহ বিভিন্নভাবে সাপ আটকা পড়লে মানুষ তাকে খবর দেয়। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে বাসাবাড়ি থেকে সেই সাপ উদ্ধার করে ছেড়ে দেন উপযুক্ত স্থানে।
বই পড়ে, ডিসকভারি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকসহ এ ধরনের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রোগ্রাম দেখে রাজু জানতে পারেন সাপ বিষয়ে নানা তথ্য। প্রথমদিকে বিষহীন সাপ উদ্ধার করতেন। পরে স্নেক রেসকিউ টিম থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর বিষধর সাপ ধরা শুরু করেন। তিনি এ পর্যন্ত যে সাপগুলো উদ্ধার করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাসেলস ভাইপার, রাজ গোখরা, খৈয়া গোখরা, শঙ্খিনী, গ্রিন পিট-ভাইপার ও নির্বিষ অজগর, কুকরি, বেত আঁচড়া, দুধরাজ, ফণীমনসা ইত্যাদি।
সাপ উদ্ধারে রাজুর অনেক সাফল্য থাকলেও শুরুটা তার একদম ভালো হয়নি। ‘বেদে, খেয়ে দেয়ে কাজ নাই সাপ ধরে’ এমন কটূক্তি তিনি শুনেছেন। এসব একদমই পাত্তা দেননি। তিনি বলেন, মানুষের কথায় আমি পাত্তা দিইনি। যারা আমাকে কটাক্ষ করেছে তাদের অনেকেই এখন আমার প্রশংসা করে।
তবে বিপদগ্রস্ত সাপ উদ্ধারে চ্যালেঞ্জও আছে কিছু। অনেকে ভাবে, সাপুড়েদের মতো বিন বাজিয়ে সাপ উদ্ধার করা হবে। উদ্ধারকারী লোকটি বয়স্ক হবে। এমন আরও কত কী। অনেকে আবার সাপ উদ্ধারের পর টাকা চেয়ে বসে। এদের বোঝানো মুশকিল হয় যে, বিপদগ্রস্ত সাপ উদ্ধার করা হয়েছে বনে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বিক্রির জন্য নয়। সাপ উদ্ধার করতে রাজু এ পর্যন্ত পাবনা, কুষ্টিয়া, নাটোর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছেন। সাপ উদ্ধারের পর উৎসাহী জনতাকে তিনি বুঝিয়ে বলেন, সাপ দেখলে
করণীয় কী। সাপে কাটলে কী করতে হবে, এমন আরও অনেক কিছু।
সাপের তো বনে থাকার কথা। কেন লোকালয়ে, বসতবাড়িতে বারবার আসছে। এমন প্রশ্ন অনেকেরই থাকতে পারে। এ প্রশ্নের জবাবটা রাজুর কাছ থেকেই জানা যাক। তিনি বলেন, নির্বিচারে বনভূমি ও লোকালয়ের আশপাশের বনজঙ্গল কেটে ফেলায় সাপসহ সব বন্যপ্রাণীর আবাস নষ্ট হচ্ছে। ফলে সাপ খাবারের খোঁজে বাড়িঘরের কাছে চলে আসছে। এতে সাপ-মানুষ সংঘাত বাড়ছে।
সাপ উদ্ধারে রাজুর দল আর বনবিভাগ একে অপরকে সহযোগিতা করে। রাজু জানান, বন বিভাগ প্রতিটি রেসকিউ সম্পর্কে অবগত থাকে। উদ্ধার করতে গিয়ে কোনো সমস্যায় পড়লে বন বিভাগের সহায়তা নেন। আবার বন বিভাগের যেসব এরিয়ায় সাপ উদ্ধার টিম আছে, সেসব এরিয়ায় উভয় মিলেই একসঙ্গে সাপ উদ্ধার করেন।
রাজুর সাপ উদ্ধার কার্যক্রম বিভিন্ন মহলের প্রশংসা কুড়াচ্ছে। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজু লোকালয়ে আসা বিপদগ্রস্ত সাপ উদ্ধার করে বনে ছেড়ে দিচ্ছে। এতে এক দিকে সাপগুলো বেঁচে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে সাপ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সাপের আবাসস্থল রক্ষা করতে হবে।
কলি