![১৫ মিনিট পানির নিচে ডুবে থাকেন বাজাউরা!](uploads/2024/06/15/bi-ro-h-1718435362.jpg)
প্রায় হাজার বছর আগের কথা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোহর রাজ্যের রাজার বিশাল নৌবহর চলেছিল সমুদ্র পথে। রাজকন্যা দায়াং আয়েশাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সুলু রাজ্যের রাজার সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য। রাজকন্যাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাজাউ নামে এক দুঃসাহসী উপজাতি। যারা এই এলাকার সমুদ্রকে নিজের হাতের তালুর মতোই চেনে।
ব্রুনেইয়ের তৎকালীন সুলতান চেয়েছিলেন আয়েশাকে বিয়ে করতে। কিন্তু জোহরের রাজা তার মেয়ের সঙ্গে ব্রুনেইয়ের সুলতানের বিয়ে দিতে রাজি হননি। এই অপমান ভুলতে পারেননি ব্রুনেইয়ের সুলতান। মেনে নিতে পারেননি সুলুর রাজার সঙ্গে রূপসী আয়েশার বিবাহের উদ্যোগ। তাই ব্রুনেইয়ের সুলতান অতর্কিত আক্রমণ করেছিলেন জোহর রাজ্যের নৌবহর। গভীর সমুদ্রের জল বাজাউদের রক্তে লাল করে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জোহরের রাজকন্যাকে।
দেশে ফিরে আয়েশাকে বিয়ে করেছিলেন ব্রুনেইয়ের সুলতান। বিপদে পড়েছিলেন ব্রুনেইয়ের সুলতানের ভয়ংকর আক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েকশ বাজাউ যোদ্ধা ও তাদের পরিবার। জোহর রাজ্যে ফিরলে জোহরের রাজার তলোয়ারের নিচে পড়তে হবে, সেই ভয়ে তারা আর দেশে ফিরতে পারেনি। সেই দিন থেকে, স্থলের সঙ্গে বাজাউদের চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। সমুদ্রই হয়ে গিয়েছিল তাদের ঘর।
বাজাউদের রয়েছে জলের নিচে শ্বাস ধরে রাখার বিরল এক দক্ষতা ও যোগ্যতা। সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল বাজাউদের পুরো জীবন কাটে সমুদ্রে। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে ঘিরে বেশ কয়েকটি উপসাগর রয়েছে। যাদের নাম সুলু, সেলেবিস, বান্দা, মালুকু, জাভা, ফ্লোরেস এবং সাভু। এই উপসাগরগুলোর বিস্তৃত নীল জলে ঘুরে বেড়ান বাজাউ জাতিরা। তারা বিশেষ আকৃতির নৌকা লেপা-লেপায় চড়ে। নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই তাদের। তাই এদের বলা হয় ‘সি জিপসি’
বা ‘সি নোম্যাড’।
সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় তীর থেকে আধা কিলোমিটার সমুদ্রের ভেতরে বাজাউরা তৈরি করেন তাদের অস্থায়ী গ্রাম। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা বাড়িগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুলে ফেলা যায়। বাড়িগুলোর নিচ দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ বয়ে চলে। ছোট ছোট ডিঙি মতো নৌকা করে চলে এ বাড়ি সে বাড়ি যাতায়াতও। তাদের তৈরি ঘরগুলো খুব মজবুত হয়ে থাকে। ২০০৪ সালে হওয়া সুনামিতে বাজাউদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
শুনতে অবাক লাগলেও এটা সত্যি, এই উপজাতির অনেক মানুষ আছে যারা মাটিতে কোনোদিন পা রাখেনি। বাজাউরা নিজেদের বয়স বলতে পারে না। এই যুগেও সময় কিংবা তারিখ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া তারা জানে না বিদ্যুৎ কী ও কেন লাগে। সামুদ্রিক মাছের তেলের মশাল আজও তাদের রাতের অন্ধকারে আলো দেয়। সমুদ্র তীরবর্তী কিছু গ্রামের মানুষ এদের জ্বালানি কাঠ, পানি এবং জামাকাপড় দেয়। বিনিময়ে বাজাউরা গ্রামবাসীদের সামুদ্রিক মাছ দেয়।
সমুদ্রের ২৩০ ফুট নিচে তারা শিকার করতে যায়। অবিশ্বাস্যভাবে তারা পানির নিচে প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট শ্বাস ধরে থাকতে পারে। তাদের প্রধান খাদ্য বিভিন্ন মাছ, স্টিং রে, স্কুইড এবং অক্টোপাস।
জীবজগতের ওপর করা গবেষণাপত্র প্রকাশ করে থাকে বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘সেল’। এই পত্রিকায় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক মেলিসা ইলার্ডো ও রাসমুস নিয়েলসেন বাজাউদের নিয়ে করা এক গবেষণাপত্রে দিয়েছেন বাজাউদের পানির নিচে শ্বাস ধরে রাখার রহস্যের উত্তর। গবেষকরা জানিয়েছেন, বাজাউদের জিনে থাকা কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যই তাদের প্রাকৃতিক ডুবুরি করে তুলেছে। বাজাউরা যখন শ্বাস চেপে জলে ডুব দেয় তখন তাদের দেহে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দেয়। হৃৎপিণ্ড তার কাজ কমিয়ে দেয়। অক্সিজেনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। পালস রেট নেমে দাঁড়ায় প্রতি মিনিটে মাত্র ৩০ বার। শরীরের বাইরের দিকের কলাকোষ থেকে রক্তপ্রবাহের অভিমুখ ঘুরে যায় শরীরের ভেতরের দিকে। রক্ত যায় মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসে।
তবে বাজাউ উপজাতিরা সবসময় সংশয়ে থাকে। কারণ বাজাউদের দেশ নেই। পরিচয়পত্র নেই। ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার তীর বরাবর সুলু সমুদ্রে যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। অসুস্থ হলেও তীর ছোঁয়ার উপায় নেই। নাগরিক না হওয়ায় ডাঙায় এলে হাসপাতালও চিকিৎসা করে না। বরং তাদের গ্রেপ্তারও হতে হয়। তাই জন্মের মতো বাজাউদের মৃত্যুও হয় সমুদ্রে। নৌকা করে দূর সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয় মরদেহ। সমুদ্রের পুত্র-কন্যারা সামুদ্রিক জীবের খাদ্য হতে হতে সমুদ্রগর্ভেই বিলীন হয়ে যান।
কলি