![হারানো বিজ্ঞপ্তি](uploads/2024/06/08/bi-ty-1717829484.jpg)
মা সবসময় বারণ করত বাবুকে। বলত, ‘কী দরকার বাপু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর। খেয়ে দেয়ে কাজ পাও না, বিপদ বাড়ানো।’ বাবা হাসত আর বলত, ‘ও তো ভালো কাজ করছে, যুবক ছেলে প্রতিবাদ না করলে কি চলে।’ আমিও মায়ের মতো ভীতু। বাবুকে বলতাম, ‘ভাই তোর দরকার নেই মানববন্ধনে যাওয়ার। আর তো কেউ আসে নাই, দেখ।’ ও হাসত আর বলত, ‘একজনকে তো আগাতেই হবে, নইলে কীভাবে হবে? শুনিস নাই, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে তৃণসম দহে।’ বলতে বলতে নাশতা না করেই ব্যাকপ্যাক নিয়ে বের হলো।
ওই যে গেল আর ফিরল না। ‘একে দেখেছেন, ছবিটা ভালো করে দেখেন, বাবু আমার ভাই, ভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, ভালো নাম আহানাফ চৌধুরী।’ রাস্তায়, অলিগলিতে এগুলো বলা আমার প্রতি মুহূর্তের কাজ হয়েছে। আমার ভাই ঘরে ফেরেনি। তার দোষ, সে প্রতিবাদ করেছিল।
আসিরন বুয়ার ৯ বছরের মেয়ে সুমাইয়াকে যখন ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছিল প্রভাবশালী নেতার কুপুত্র, তখন কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। আমার ভাই আর ওর বয়সী ছেলেরা প্রতিবাদ করে মিডিয়ার নজরে এনেছিল। ফলস্বরূপ, কেসটা কোর্টে উঠেছিল। লোকদেখানো আসামি গ্রেপ্তার ও কিছু লেখালেখি, আদালতে দৌড়াদৌড়ি।
কিছুদিন পরে আসামি জামিনে বের হয়ে সবাইকে প্রকাশ্যে হুমকি। বাদীকে কেস তুলে নেওয়ার জন্য চাপাচাপি। আসিরন বুয়াকে বলে, ‘দোষ তোর। এত পোলাপান পয়দা করে ছেড়ে দিছিস কেন? কিচ্ছু করতে পারবি না আমাদের, টাকা নিয়ে গ্রামে চলে যা, নাহলে তোকেও দেখে নেব।’
এসব দেখে সবাই চুপ হয়ে গেল। যারা প্রতিবাদ করেছিল, তারাও অজানা কারণে গুটিয়ে গেল। শুধু বাবু চুপ করল না। ও বাসা থেকে বের হলো আসিরন বুয়াকে সঙ্গে নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করবে বলে। আর ঘরে ফেরেনি আমার ভাইটা।
এরপর আমাদের দৌড়াদৌড়ি। থানা থেকেই শুরু হলো। থানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তারা কেউ সহযোগিতা তো করলই না, উল্টো ঠাট্টা-মশকরা করল। নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি, মানববন্ধন, প্রেস কনফারেন্স, ছোটাছুটি, মর্গ, হাসপাতাল, ফেসবুক, লেখালেখি কোনোকিছুই আমার ভাইকে ফিরিয়ে আনতে পারল না।
আসিরন বুয়াকে বাধ্য করা হলো মামলা প্রত্যাহার করতে। তিনি মামলা তুলে নিয়ে গ্রামে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,
‘আপা, বিচার বলতে কিছু নাই, মানুষ বলতেও কিছু নাই, শুধু চোখ-কান বুইজা ঘরে থাকবেন। বাবু ভাই ফিরব।’
মা আগেই স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী। বাবা রিটায়ার করে শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে।
একদিন হঠাৎ বাবা কোথা থেকে একটা হারিকেন জোগাড় করে আনল। ‘এই শহরে হারিকেন দিয়ে কী করবা?’ প্রশ্ন করতেই বাবা বলল, ‘মাঝে মাঝেই তো লোডশেডিং হয়, রাতে বাবু এসে যদি ভাবে বাসায় কেউ নেই, তাই গেটের সামনে জ্বালিয়ে, ঝুলিয়ে রাখব।’ বাবার কথা শুনে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
মাঝে মাঝে লোডশেডিং হয়। পুরো মহল্লা অন্ধকার হয়ে যায়, শুধু টিমটিম করে জ্বলে আমাদের বাড়িটা; অন্ধকার দূর করার দূত হয়ে নিকষ কালো অন্ধকারের ভেতর ছোট্ট আলোর বিন্দু হয়ে জ্বলে।
মহাম্মাদপুর, মাগুরা
কলি