আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাটা বড়ই পরিষ্কার। সরকারি দান-অনুদান ক্রমাগত বাড়ছে। সনদের স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে। সরকার বদল হয়, কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করার নীতিতে কোনো প্রকার ইতরবিশেষ ঘটে না। বরঞ্চ এ ব্যাপারে সরকারগুলো একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। এর পেছনে ভোট পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা তো রয়েছেই, আরও একটি গোপন অভিপ্রায়ও কাজ করে। সেটা হলো, গরিব মানুষকে গরিব করে রাখা।
তা ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মাদ্রাসা খোলা হয় এবং হচ্ছেও। স্কুল খোলার চেয়ে মাদ্রাসা খোলা সহজ এবং লাভজনক। মাদ্রাসা খুলতে খরচ পড়ে কম। সরকারি অনুদান পাওয়া যায়। না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, ধর্মপ্রাণ মানুষ দান-খয়রাত করবে। কাজটা লাভজনকও বৈকি। একদিকে নয়, দুই দিকে। প্রথমত, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতারা বড় মাপের ভালো মানুষ বলে খ্যাতি পায়। লোকটি আসলে হয়তো খাঁটি দুর্বৃত্ত, কিন্তু তার সেই পরিচয়টা চাপা পড়ে যায় ধর্মপরায়ণতার লেবাসের অন্তরালে। সামাজিকভাবে এটি একটি ভালো বিনিয়োগ। দ্বিতীয়, এতে পুণ্যলাভও ঘটে। সেটা আরেক ধরনের বিনিয়োগ। তাই দেখা যায়, বিত্তবানরা মাদ্রাসার জন্য টাকা দেয়, কিন্তু স্কুলের ব্যাপারে উৎসাহ দেখায় না। এমনকি অপেক্ষাকৃত কম টাকার মালিক যারা তারাও মনে মনে আশা রাখে, একটা মাদ্রাসা খুলবে।
মাদ্রাসা শিক্ষা যে কত ভয়ংকর হতে পারে, পাকিস্তানের শাসকরা এখন তা অস্থিমজ্জায় টের পাচ্ছে। এক সময় মার্কিন অর্থে তারা মহোৎসাহে মাদ্রাসা খুলেছে, সেখানে জঙ্গিরা তৈরি হয়েছে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হটাবে বলে। তালেবানরা ওইসব মাদ্রাসাতেই শিক্ষিত। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই। কিন্তু ওই যে জঙ্গিদের তৈরি করা হয়েছিল তারা তো আছে। আফগানিস্তানে তারা ছিল, এখনো আছে, অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছে। তারা এখন শত্রু খোঁজে, কমিউনিস্টদের না পেয়ে খোদ মার্কিনিদেরই শত্রু মনে করছে। কমিউনিস্টরা শয়তান ছিল, কেননা তারা ছিল ‘নাস্তিক’, এখন মার্কিনিরা শত্রু হয়েছে। কেননা, তারা হলো বিধর্মী। মার্কিনিদের নেতা সন্ত্রাসীশ্রেষ্ঠ জর্জ বুশ তাদের একদা মিত্র তালেবান, আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
প্রতিক্রিয়ায় ইসলামি জঙ্গিরা নিজেদের মুসলমান পরিচয়টিকে উচ্চে তুলে ধরে বলেছে, তারা জিহাদে লিপ্ত রয়েছে। উভয়পক্ষের অবস্থানই ধর্মীয় মৌলবাদী। বুশের পক্ষে আফগানিস্তান, ইরাক, পারলে ইরান দখল করে নেওয়ার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা অনেক বেশি কার্যকর ছিল। আমেরিকা বিপন্ন, আমাদের খ্রিষ্টান সভ্যতা হুমকির মুখে- এ ধরনের আওয়াজ অধিকতর উপযোগী অন্য দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন, আমাদের তাই যুদ্ধে যেতে হবে বলার তুলনায়। বুশ ছিলেন নব্য-হিটলার। হিটলার ব্যবহার করেছিলেন বর্ণবাদী বিদ্বেষকে, ইনি কাজে লাগিয়েছিলেন ধর্মীয় অহমিকাকে, আর পরিহাসের বিষয় এটাও, যে ইহুদিরা এক সময় হিটলারের বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হয়েছিল, এখন তারাই মার্কিনিদের সাহায্য নিয়ে প্যালেস্টাইনে আরবদের ওপর নির্মম গণহত্য চালাচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের মহানায়ক জর্জ বুশ নিজেকে বলছেন খ্রিষ্টান, তার আক্রমণে বিপন্নরা আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে নিজেদের বলছে মুসলমান। শোষক ও শোষিতের ঝগড়াটা তাই পরিণত হচ্ছে খ্রিষ্টান-মুসলমান কলহে। আত্মপরিচয়ের এই প্রশ্নটা আমাদের এ অঞ্চলেও জরুরি হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ আমলে কেউ ছিল হিন্দু, কেউ মুসলমান; পাকিস্তান শাসনামলে আমরা নিজেদের চিনলাম বাঙালি বলে। কিন্তু দেখা গেল, ক্রমে বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে সেই পরিত্যক্ত মুসলমান পরিচয়টিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। লক্ষণটা কিন্তু একেবারে শুরুতেই দেখা দিয়েছিল। বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে নতুন রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব যে বক্তৃতা দেন তাতে তিনি বলেছিলেন যে, আমরা হলাম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলমান রাষ্ট্র, সেই বলাটা কোনো আকস্মিক বিচ্যুতি ছিল না। তার নিজের ভেতরে এবং অনেকের ভেতরেই মুসলমান পরিচয়টি নিয়ে সুপ্ত একটা গর্ববোধ ছিল বৈকি। সুপ্তের ঘুমভাঙা কি আর অস্বাভাবিক ঘটনা?
পরে বাঙালিত্ব নিয়ে গর্বটা কমেছে, কেননা বাঙালির নতুন রাষ্ট্র মানুষকে মুক্তি দেয়নি, যেভাবে দেওয়ার কথা ছিল; আর সেই ফাঁকে মুসলমানত্বের অহমিকাটা নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। পরবর্তী শাসকরা ওই মুসলমান পরিচয়টাকেই বড় করে তুলেছেন। প্রমাণ? সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় করে দেওয়া। আর এরশাদের তো কথাই নেই। তিনি তো একজন ‘সাচ্চা’ মুসলমানই! রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ আরও এগিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ যখন বাড়ে তখন সেটার জন্য প্রকাশের পথ থাকে দুটো। একটি ডানের, অপরটি বামের। আমাদের শাসকরা বামপন্থাকেই সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করে। যে জন্য আমরা দেখেছি যে, একাত্তরের পরে শেখ মুজিব মনুষ্যসভ্যতার এবং বাঙালির নিকৃষ্টতম শত্রু আল-বদর, রাজাকারদের বিচার করে যেতে পারেননি, কিন্তু নকশাল দেখামাত্রই গুলি করা হবে বলে হুকুম জারি করেছেন। আর ক্ষমতায় এসে জিয়া দেখেছেন তার প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে আওয়ামী লীগ, যার জন্য আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান ভিত্তি যে ধর্মনিরপেক্ষতা তাকে নির্মূল করার পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু তিনিও জানতেন যে, তার প্রকৃত শত্রু যদি কেউ থাকে তবে তারা আওয়ামী লীগ নয়, বামপন্থিরাই। তাই বামপন্থি কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির মঞ্চে উঠতে হয়েছে এবং রাজাকাররা মন্ত্রী হতে পেরেছে। বামপন্থিদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আরও একটি কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, সেটা হলো নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের একাংশকে নিজের দলে টেনে নেওয়া। বামপন্থি ধারা শক্তিহীন হয়েছে, দক্ষিণপন্থিরা চাঙা হয়ে উঠেছে, বর্ষাকালের খালের মতো; তবে তারা খাল থাকেনি, পরিণত হয়েছে নদীতে। জিয়া যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সেটাও ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে যা দক্ষিণপন্থিদের সাহায্য করেছে। সেটা হলো তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন। এর ফলে বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থিরা উল্লসিত এবং বামপন্থিরা বিষণ্ন হয়েছে। তবে বাংলাদেশে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তেমনটা বিশ্বের অন্য কোথাও চোখে পড়েছে কি না জানি না। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল বামপন্থিদের সবচেয়ে পুরানো এবং সর্ববৃহৎ সংগঠন। তাদের একাংশ বলে বসল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, চেষ্টা করল নিজেদের বিলুপ্ত করে দিতে।
বামদিকের পথ অবরুদ্ধ দেখে মানুষের বিক্ষোভ ডানদিকে মোড় নিতে চাইল। তাতে সুবিধা হলো ডানের, এবং ডানের শেষ মাথায় যাদের অবস্থান সেই জামায়াতে ইসলামীর, তারা ক্ষমতালাভের আশায় নাড়াচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে।
বাস্তবতার চেহারাটা এ রকমেরই নির্মম। কিন্তু উপায় কী? প্রতিকার আসবে কোন পথে? গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতায় যারা আস্থা রাখেন না অথচ গণতন্ত্রের কথা বলেন, তারা হয় অজ্ঞ নয়তো ভণ্ড। আমরা আমাদের পরিচয় দিতে চাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে, মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে নয়। কিন্তু আমাদের শাসকশ্রেণি তা চায় না।
নিজেদের গণতন্ত্রের পথযাত্রী করতে হলে যা করতে হবে তা হলো রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনা এবং সেই সঙ্গে সমাজে মৌলিক অর্থাৎ বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো। এই দুটি অত্যাবশ্যকীয় কাজের কোনোটিই সম্ভব হবে না, যদি না শাসকশ্রেণিকে পরাভূত করা যায়। কিন্তু পরাভূত যে করব, সেটা কোন পথে? নির্বাচনের? নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে ওই কর্তব্যপালন সম্ভব নয়, সেটা তো অভিজ্ঞতাই আমাদের বলে দিচ্ছে। নির্বাচনের অর্থ হচ্ছে শাসকশ্রেণির কোন অংশের হাতে আমরা লাঞ্ছিত ও শোষিত হব সেটা ঠিক করা, তার বেশি নয়, কমও নয়। পথটা হলো আন্দোলনের। যে আন্দোলন আমরা অতীতে করেছি, এখন প্রয়োজন তাকে আরও সুসংহত করে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাওয়া। নইলে আমরা কেবল আক্ষেপই করব, মুক্তি পাব না। এমনকি সামনে এগোতেই পারব না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়