
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের কৃষি ও ভূমিমন্ত্রী ছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। তিনি সম্পর্কে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফা। বরিশাল মহানগরীর কালীবাড়ি রোডে ও আগৈলঝাড়া উপজেলার সেরল গ্রামে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের দুটি পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে সেরলের বাড়িতে অবস্থান করতেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। আর মহানগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কালীবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবনে থাকতেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত এ দুই বাড়ি হতে বরিশাল মহানগর ও বরিশাল বিভাগ আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ হতো।
তবে সেরনিয়াবাত ভবনটি গত ৫ আগস্ট ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও বাড়ির মালামাল লুট করেন বিক্ষুব্ধরা। অগ্নিসংযোগের পর বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত।
অপরদিকে সেরলের বাড়িটির প্রধান ফটকে গত প্রায় ৮ মাস ধরে তালাবদ্ধ রয়েছে। শুধু বরিশালের সেরনিয়াবাত ভবনই নয়। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে অধিকাংশ নেতার বাড়ির প্রধান ফটক এখন তালাবদ্ধ। আবার কোনো কোনো নেতার পোড়াবাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ গত ১৬ বছর ‘ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে পরিচিত ছিল ওই বাড়িগুলো। ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, চাকরিতে নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়াঙ্গনসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো এসব বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো চলত এসব বাড়ি থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুসারে।
হাসানাতের বাড়ির প্রধান ফটকে তালা
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সেরল গ্রামের বাড়িটির কোনো নাম নেই। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে স্থানীয়দের কাছে বাড়িটি ‘দরবার শরীফ’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
স্থানীয়রা জানান, গত ১৬ বছর ধরে হাসানাতের বাড়িটি বরিশালের ‘ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, চাকরিতে নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্যনসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ হতো এই বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলো গঠন হতো তার নির্দেশে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ জেলা-উপজেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো চলতো এই বাড়ির নির্দেশনায়। এ ছাড়া সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বরিশালে বদলি হয়ে এসে হাজিরা দিতেন হাসানাতের বাড়িতে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত উপজেলা নির্বাচনের পর থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি হাসানাত আবদুল্লাহ এই বাড়ি ত্যাগ করেন। সে থেকে বাড়ির প্রধান ফটকে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
পোড়াবাড়ি হিসেবে পরিচিত সেরনিয়াবাত ভবন
কালী রোডের বাড়িতে থাকতেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বড় ছেলে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও পরিবারের সদস্যরা। গত বছরের ৫ আগস্ট বিকেলের দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা এ বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সেই থেকে বাড়িটি পোড়াবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
সেরনিয়াবাত ভবনের সমানের দোকানিরা জানান, ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এ বাসায় সাদিক আবদুল্লাহর পরিবারের সদস্যসহ শতাধিক নেতা অবস্থান করছিলেন। বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে যান। ওই সময় পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান সাবেক মেয়র সাদিক ও তার পরিবারের সদস্যরা। তবে ওই রাতে সেরনিয়াবাত ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গাজি নঈমুল ইসলাম লিটুসহ তিনজনের অগ্নিদগ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
স্থানীয়রা বলেন, এখান থেকে মহানগরসহ জেলার ১০ উপজেলার রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো। সে সময় সাধারণ মানুষ বাড়ির গেটেও ঢুকতে পারত না। অথচ এটি এখন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
ঝালকাঠিতে আমুর বাড়ির সামানে ব্যানার-পোস্টার
ঝালকাঠিতে শহরের প্রাণকেন্দ্র রোনালসে রোডে সাবেক এমপি ও ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর বাড়ি। গত ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ঘটনায় একাধিক মামলার আসামি আমির হোসেন আমুকে ৬ নভেম্বর ঢাকার ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখন কারাগারে।
আমুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ইটের অবকাঠামো ছাড়া তিনতলার বাড়িতে কিছু নেই। আগুন দেওয়ার কারণে দেয়ালের রং কালো হয়ে গেছে। প্রধান ফটক তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আর বাড়িটির প্রধান ফটকের সীমানা প্রাচীরে ঝালকাঠির বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানার-ফেস্টুনসহ বিভিন্ন প্রচারপত্র লাগানো রয়েছে।
পটুয়াখালীতে আফজালের বাড়ি
সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনের পটুয়াখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ি গত ৫ আগস্ট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বাসার নিচতলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে। এটি এখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
এ ছাড়া পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল, তার মেঝো ভাই সহসভাপতি পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক, সেজো ভাই সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুজিবর রহমান খালেক, তার স্ত্রী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সালমা রহমান হ্যাপী, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি শ ম রেজাউল করিম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আক্তারুজ্জামান ফুলু, ইন্দুরকানী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জিয়াউল আহসান গাজী, নাজিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ানরম্যান এস এম নুরে আলম সিদ্দিকী শাহিন, ভাণ্ডারিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম ও তার বড় ভাই পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক এমপি মহিউদ্দিন মহারাজ, বরগুনার সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোতালেব মৃধাসহ প্রায় শতাধিক নেতা-কর্মীর বাড়ি ৫ আগস্ট আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে আত্মগোপনে থাকায় বাড়িগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।